পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আরএসএস/বিজেপির হিন্দুত্বের আগ্রাসন থেকে হিন্দুধর্মকে বাঁচানোই হিন্দুদের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 204 view(s)
  • লিখেছেন : শংকর
শুভেন্দু অধিকারীরা আওয়াজ তুলেছেন, হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই! সারা রাজ্যে পোস্টার পড়েছে, হিন্দুদের ভোট যেন তৃণমূল কংগ্রেসে না যায়! ভোট আসলেই হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দুদের কথা মনে পড়ে। এদিকে সারা দেশে হিন্দু জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশের অবস্থা কী? ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোটা দেশে দলিতদের ওপর সবর্ণদের অত্যাচার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দলিত নির্যাতন, দলিত মহিলাদের ধর্ষণ, খুন চরমে উঠেছে। আর এ ব্যাপারে এগিয়ে আছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি।

শুভেন্দু অধিকারীরা বলছেন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে তারা হিন্দুদের বাঁচাবেন। মুসলমানদের মেরে দেশ থেকে বের করে দেবেন। সারা দেশে বিজেপির নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কে কত বেশি হিন্দুদের রক্ষাকর্তা তা নিয়ে বাগাড়ম্বর, আস্ফালন চলছে। মানে, নির্বাচনে জেতার একটা সহজ সমীকরণ পাওয়া গেছে। যতই কুকীর্তি কর, দেশ বিক্রি কর, শিল্পপতিদের স্বার্থের সেবা কর, কৃষিক্ষেত্রকে বড় বড় কোম্পানীর হাতে ছেড়ে দাও, ওষুধ শিল্পের মালিকদের কাছ থেকে বন্ডে টাকা নিয়ে যথেচ্ছ ওষুধের দাম বাড়াও, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা তুলে দাও, শ্রমিকদের জীবন নরক করে তোল, মানে যা ইচ্ছে কর কিন্তু হিন্দু মুসলমান মেরুকরণটা বাড়িয়ে তোলো, দাঙ্গা লাগাও, নিজেদের হিন্দুবীর বলে প্রচার করো, ব্যাস তাহলেই কেল্লাফতে। একের পর এক নির্বাচনে জেতার গ্যারান্টি পেয়ে যাবে। তা, শুভেন্দুই বা এমন সহজ পথ ছাড়বেন কেন? তিনিও এই মসৃন রাজপথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন।

 

কিন্তু বিজেপি এবং আরএসএসের নেতারা যতই উন্মত্ত হিন্দুত্বের রাস্তাকে মসৃণ ভাবুন না কেন আসলে তা কিন্তু ঠিক তেমন নয়। বিজেপির হিন্দুত্ব জিনিসটায় আসলে তো হিন্দুধর্মের কোনো সারবত্তাই নেই। বিজেপির হিন্দুত্ব আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদ, যেখানে দশ পনের শতাংশ ব্রাহ্মণ, ঠাকুর আর বানিয়াদের রাজত্ব চলে। সংখ্যাগুরু হিন্দু সাধারণ মানুষ সেখানে ছোট জাতের লোক ছাড়া আর কিছু নয়। আম্বেদকর যেমন বলেছিলেন যে, এই যে বেদভিত্তিক ধর্ম সারাক্ষণ ব্রহ্ম ব্রহ্ম করে তা সে ব্রহ্ম তো তাদের মতে সবার মধ্যেই আছেন। তাহলে তথাকথিত ছোট জাতের মানুষদের তারা অস্পৃশ্য বানিয়ে রেখেছে কেন? বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য।

হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ নাকি বেদ! বেদের অন্তিম অংশ হল বেদান্ত। বেদান্তে বলা হয় সকল জীবাত্মা আসলে পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ দেখি কেন? অমুক রাম, অমুক শ্যাম, অমুক যদু, অমুক হিন্দু, অমুক মুসলমান এমনধারা ভিন্নতা আমাদের চোখে ধরা পড়ে কেন? কারণ আমরা মূর্খ তাই। মানুষ অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন। তাই আমরা ভিন্নতা দেখি। আমরা যদি ব্রহ্মজ্ঞান পেতাম, আমাদের যদি ব্রহ্মলাভ হত, সঠিক জ্ঞান যদি আমাদের থাকত তাহলে আমরা বুঝতাম যে, এই ভিন্নতা আসলে আমাদের মোহ, মিথ্যা! তাহলে আমরা বুঝতাম সবই আসলে ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তুমি কে? উপনিষদ প্রশ্ন করেছে। এই তুমি যে কেউ ‘তুমি’। যে কোনো মানুষ। তার আচার বিচার ধর্ম সংস্কৃতি যাই হোক না কেন! তুমি কে? অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন মানুষ বলবে আমি দেবদত্ত, আমি ধনঞ্জয়, আমি ব্রাহ্মণ, আমি শুদ্র, আমার গোত্র অমুক কি তমুক, আমি হিন্দু, কী আমি মুসলমান, ইত্যাদি। কিন্তু সঠিক ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলে তুমি দেখবে আসলে তুমি হলে সে। তুমি-ই সে! তৎ ত্বম অসি! তুমি-ই ব্রহ্ম।

এই তো বেদ। বেদের নির্যাস। এই যদি হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থের প্রধান বার্তা হয় তাহলে হিন্দুই বা কে আর মুসলমানই বা কে? সবই তো ব্রহ্ম! তাহলে, শুভেন্দু অধিকারী কিংবা যোগী আদিত্যনাথদের কী হবে? প্রশ্ন উঠতেই পারে, এরা আসলে কারা? এরা তো হিন্দুই নয়। হিন্দুধর্মকেই এরা অস্বীকার করে, নাকচ করে। এদের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে বাঁচানোই তো প্রথম দরকার।

ব্রহ্মবিদ্যাই যদি হিন্দুধর্মের সার হয় তাহলে যে শাস্ত্র এই বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছে, চর্চা করেছে তার কলেবর বিপুল। তার মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ সাহিত্য আছে, উপনিষদ আছে, ব্রহ্মসূত্র আছে, তেমনই ন্যায়শাস্ত্র আছে। মহর্ষি গৌতম ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রের প্রণেতা। গৌতমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আছে। কবিতাটির নাম ‘ব্রাহ্মণ’। কবিতাটি প্রণিধানযোগ্য। এটি হিন্দুধর্মকে বুঝতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। গৌতম তাঁর শিষ্যদের নিয়ে একদিন ব্রহ্মচর্চায় বসেছেন। এমন সময়ে এক বালক এসে হাজির। সে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা করতে চায় গৌতমের কাছে।

 

“হেনকালে অর্ঘ্য বহি

করপুট ভরি’ পশিলা প্রাঙ্গনতলে

তরুন বালক; বন্দি ফুলফলদলে

ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে

কহিলা কোকিল কন্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,

‘ভগবন্ ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী

আসিয়াছি দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী,

সত্যকাম নাম মোর’।”

গৌতম বৈদিক আচার্য। তিনি জানেন ব্রহ্মবিদ্যা এমন জিনিস যা যে কেউ দিতে পারে না, এবং যে কেউ নিতে পারে না।

“শুনি স্মিতহাসে

ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,

‘কুশল হউক সৌম্য। গোত্র কী তোমার?

বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার

ব্রহ্মবিদ্যালাভে’।”

 

এই শুনে সেই বালক জানাল তার গোত্র কী তা সে জানে না। পরের দিন মার কাছ থেকে শুনে এসে সে জানাবে কী গোত্র তার এমন বলে সে চলে গেল। পরের দিন বালকটি এসে কী জানাল? সে বলল,

“ভগবন নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম জননীরে, কহিলেন তিনি, ‘সত্যকাম্,

বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে

জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে –---

গোত্র তব নাহি জানি’।”

এই কথা শুনে গৌতমের শিষ্যদের মধ্যে হাসাহাসি পড়ে গেল। বিষ্ময়, ঘৃণা, ক্রোধ, অবজ্ঞা সবই বর্ষিত হল সেই বালকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু, গৌতম কী বললেন? শুনুন,

 

“শুনি সে বারতা

ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা

মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল

পতঙ্গের মতো –--- সবে বিষ্ময়বিকল,

কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার

লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহঙ্কার।

উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন,

বাহু মেলি বালকেরে করি আলিঙ্গন

কহিলেন, ‘'অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।

তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত’।”

 

তাহলে দেখুন, গৌতমের কাছে কার কোথায় জন্ম সেটা শেষ বিচারে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুরুতে তিনি সত্যকামের কাছে তার গোত্র জানতে চেয়েছিলেন বটে কিন্তু সেটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি আসলে জানতে চান বালকটি ‘ব্রাহ্মণ’ কি না। সত্যকাম জানে না তার গোত্র কী। এর আগে কেউ তাকে এমন প্রশ্ন খুব সম্ভবত করেও নি। সে তার মা-কে জিজ্ঞাসা করে তার কী গোত্র। জবালাও তা জানেন না। তাঁর কথা থেকে অনুমিত হয় ‘যৌবনে দারিদ্রদুখে’ তিনি পতিতা ছিলেন। সে সময়ে উচ্চবর্ণের নারীরা সাধারণত এই পেশায় আসতেন না। অনুমিত হয় তিনি তাঁর সন্তানকে নিয়ে গ্রাম থেকে দূরে বাস করেন। হয়ত অরণ্যে। ‘'কুশক্ষেত্রবাসী” কথাটিতে তার ইঙ্গিত আছে। সত্যকাম মা-র কাছ থেকে জেনে এসে সবার সামনেই সত্য কথাটি গুরু গৌতমের কাছে প্রকাশ করে। সে কিন্তু জানত এতে করে সে অবজ্ঞা, ঘৃণা, ধিক্কারের পাত্র হতে পারে। অন্ততপক্ষে তার ব্রহ্মবিদ্যা লাভের সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে তাতে কোনো সন্দেহই ছিল না, কারণ গৌতম তাকে আগের দিনই বলে দিয়েছিলেন যে একমাত্র ব্রাহ্মণেরই এই অধিকার আছে। সে অনায়াসে মিথ্যা বলতে পারত। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও সে সত্য কথাই বলল। গৌতম এতেই অভিভূত হন। তাই সত্যকামকে আলিঙ্গন করে তিনি বলেন যে, সে অব্রাহ্মণ নয়, সে দ্বিজদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ, দ্বিজোত্তম। তার ‘সত্য’ কুলে জন্ম, সে ‘সত্যকুলজাত’।

যদি তাই হয়, যদি জন্মের থেকেও বড় হয় কর্ম, গুণাবলী, তাহলে কে হিন্দুর ঘরে জন্মেছে, আর কে মুসলমানের ঘরে জন্মেছে তার আর কোনো গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য বৈদিক মতে থাকতে পারে না। হিন্দুর ঘরে জন্ম হয়েও আপনি হতে পারেন লুচ্চা, লুম্পেন, দেশবিরোধী, মানুষ বিরোধী, অপরাধী। এর হাজারো প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে দেখছি। আবার মুসলমান হয়েও একজন বৈদিকের চোখে আপনি হতে পারেন “দ্বিজোত্তম”, “সত্যকুলজাত”। এ তো ন্যায়াচার্য গৌতমের শিক্ষা। আমরা জানি যে, এটি শুধু গৌতমেরই অভিমত ছিল না। বৈদিক আচার্যদের বৃহৎ অংশেরই এমন অভিমত ছিল। যাকে বলা হয় গুণভিত্তিক বর্ণবিভাজন। আজ এই মতামতের থেকে অনেক বেশি সমর্থনযোগ্য মতামত আছে, কিন্তু সে প্রশ্ন আলাদা। আমাদের প্রশ্ন হল, এই যদি বৈদিক পরম্পরা হয়, আর বেদ যদি হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হয়, তাহলে বিজেপি/আরএসএসের যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট উন্মাদরা “আব্দুল্লার খাটে তোর জন্ম” বলে যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, হিন্দু পরিবার থেকে আসা প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে, কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে, এই উন্মাদ নরাধমরা কারা? তারা কোন হিন্দু?

শুভেন্দু অধিকারীরা আওয়াজ তুলেছেন, হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই! সারা রাজ্যে পোস্টার পড়েছে, হিন্দুদের ভোট যেন তৃণমূল কংগ্রেসে না যায়! ভোট আসলেই হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দুদের কথা মনে পড়ে। এদিকে সারা দেশে হিন্দু জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশের অবস্থা কী? ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোটা দেশে দলিতদের ওপর সবর্ণদের অত্যাচার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দলিত নির্যাতন, দলিত মহিলাদের ধর্ষণ, খুন চরমে উঠেছে। আর এ ব্যাপারে এগিয়ে আছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি। এই তথ্য খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের। সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশে দলিতদের ওপর খুন, ধর্ষন, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল ৫২,৮৬৬টি। এর মধ্যে অধিকাংশ, ৯৭.৭%, ঘটনা ঘটেছে মাত্র ১৩-টি রাজ্যে। তার মধ্যে সব থেকে এগিয়ে উত্তর প্রদেশ। প্রায় চার ভাগের এক ভাগ (১২,২৮৭টি) ঘটনাই ঘটেছে সেখানে। এর পরই আছে রাজস্থান। তারপর মধ্যপ্রদেশ। এগুলি সবই বিজেপি শাসিত রাজ্য। আমরা দেখেছি বিজেপি কীভাবে দলিতদের ওপর অত্যাচারের বিভিন্ন ঘটনায় যারা অভিযুক্ত তাদের নিয়ে মিছিল করেছে, তারা জেল থেকে ফেরত আসার পর তাদের মালা দিয়ে বরণ করেছে। হাতরসের ঘটনায় তারা প্রকাশ্যেই “এস সি, এস টি মুর্দাবাদ” স্লোগানও দিয়েছিল। প্রকাশ্যেই তারা সবর্ণ অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়। বিজেপির প্রশ্রয়েই আজকে এই অপরাধীদের বাড়বাড়ন্ত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এই সমস্ত তথাকথিত হিন্দুবীররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের পদাতিক সৈন্য হিসাবে দলিতদের ব্যবহার করে, আর ভোটের সময় হিন্দু ভোট অটুট রাখার স্লোগান দেয়। এ ছাড়া হিন্দুরা বিজেপি আরএসএসের কাছে বেশি কিছু গুরুত্ব পায় না। 

 

জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তকরণ আয়োগ (NCRB)- এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সারা দেশে দলিতদের ওপর নির্যাতনের সংখ্যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের রিপোর্টের থেকে সামান্য বেশি, ৫৭,৫৮২ টি। এই সংখ্যা তার আগের বছর, ২০২১-র (৫০,৯০০) থেকে ১৩.১% বেশি। বছরে বছরে লাফ দিয়ে এই সংখ্যা বাড়ছে। একদিকে যতই বাড়ছে হিন্দুদের সব মিলে এক হয়ে বিজেপির পাশে দাঁড়ানোর ডাক, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যতই গর্জন বাড়ছে, ততই দেখা যাচ্ছে হিন্দু দলিতদের ওপর বিজেপিপুষ্ট সবর্ণদের অত্যাচার বাড়ছে। NCRB এর রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি এগিয়ে। সবার প্রথম হল উত্তর প্রদেশ (১৫,৩৬৮), তারপর রাজস্থান (৮,৭৫২), তারপর মধ্যপ্রদেশ (৭,৭৩৩)।

 

এদিকে দলিতদের হাতে চাকরী নেই, জমি নেই, উচ্চশিক্ষা নেই। জাতভিত্তিক জনগণনার যে দাবি উঠেছে তাকে সর্বতোভাবে বিজেপি আটকাতে চাইছে। তারা খুব ভালো করে জানে যে, জাতভিত্তিক জনগণনা হলেই এই সত্য ধরা পড়ে যাবে যে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, সুযোগ সুবিধে সবেরই মালিক হল হাতে গোনা কিছু ব্রাহ্মণ, বানিয়া আর ঠাকুররা। আর মুখে হিন্দুপ্রেম! গরীব হিন্দুরা শুধু দাঙ্গার সৈন্য আর ভোট জোগানোর পুতুল। ক্ষীর খাচ্ছেন মহন্তরা।

 

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতির কল্যানে প্রতি ৩৫ মিনিটে এই মহান দেশে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন। তাঁরা হিন্দু নন? ৯৭ শতাংশ শ্রমিকের কাজ স্থায়ী নয়। তাঁরা ন্যূনতম বেতনও পান না। তাঁরা হিন্দু নন? বিপুল সংখ্যক যুবক বেকার, অর্ধবেকার, কর্মহীন, শিক্ষকদের বিপুল অংশ আজকে চুক্তিভত্তিক কাজ করেন। শিক্ষিত অর্ধবেকারের সংখ্যা ভয়াবহ। প্রতি বছর শিক্ষাজীবন শেষ করে বেরচ্ছে যে লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী তাঁদের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত। তাঁরা হিন্দু নন? কর্পোরেটের আগ্রাসনের সামনে কয়েক কোটি ছোট ব্যবসায়ী আজ মৃতপ্রায়। তাঁরা হিন্দু নন? কর্পোরেট-প্রিয় হিন্দুত্ববাদী সরকারের হাত থেকে তাঁদের কে বাঁচাবে?

 

পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী নিয়ে মাতামাতি কখনই ছিল না। বঙ্গে চিরকাল, অতি প্রাচীন সময় থেকে এটা বাসন্তী পুজোর সময়, অন্নপূর্ণা পুজোর সময়। বঙ্গের কৃষিকাজ ভিতিক উৎসব এবং ধর্মীয় আচার হল এগুলি। এখানকার হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চিরকালই কৃষিভিত্তিক। ‘এগ্রিকালচার’ থেকেই এখানকার ‘কালচার’। এই সংস্কৃতিতে পরধর্মের বিরুদ্ধে আগ্রাসন নেই। সহাবস্থান আছে। হিন্দুদের লোকায়ত ফসল উৎসববেদীতে, অন্নপূর্ণার দরবারে হিন্দু মুসলমান সবারই অবারিত দ্বার। বর্তমানে কতিপয় হিন্দুত্ববাদী উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিকে ‘রামনবমী’র নামে এখানে চালাতে চাইছে, যা মুসলমানদের লক্ষ্য করে এক আগ্রাসনের গল্প ফাঁদতে চাইছে সংকীর্ণ ভোটবাজির স্বার্থে। এর ফলে মুসলমানরা বিপদাপন্ন তো হচ্ছেনই, তার সঙ্গে এখানকার চিরাচরিত হিন্দুধর্ম লাটে উঠেছে। বাসন্তী পুজো, অন্নপূর্ণা পুজো বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। তারস্বরে রামনবমীর গান বাজছে হিন্দিতে। বাংলা ভাষায় তো রামনবমীর গান তৈরিই হয় নি কোনোদিন। বাংলার হিন্দুদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম বর্তমানে উত্তর ভারতীয় আগ্রাসী বিকৃত পৌরুষ কেন্দ্রীক বর্বর হিন্দুত্বের আগ্রাসনে আজ বিপদের মুখে। এই অবস্থা শুধু বঙ্গে চলছে তা নয়, গোটা দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতে চলছে। রাজ্যে রাজ্যে হিন্দুদের মুখের ভাষা, চিরায়ত সংস্কৃতি, চিরায়ত হিন্দুধর্ম লাটে উঠতে বসেছে বিজেপির ধান্দাবাজী উত্তর-ভারতীয় হিন্দিভাষী হিন্দুত্বের দাপটে।

 

এই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের হাত থেকে হিন্দুদের বাঁচানোই হিন্দুদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment