অবশেষে প্রায় দুই বছর পর এবার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সুসম্পন্ন ভাবে শেষ হয়েছে। খুব ভালো কথা এবং অত্যন্ত খুশির খবর। গত বছর করোনার তীব্রতা এবং তার প্ররিপ্রেক্ষিতে লকডাউনের প্রভাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা করা যায়নি। যার প্রভাব একটা গোটা প্রজন্মকে মানসিক ভাবে জর্জরিত করেছে। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও এই যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে।
সাধারণত মাধ্যমিক পরীক্ষা হল ছাত্রজীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। যা জীবনের গতিপথ নির্ধারণের প্রথম পদক্ষেপ। সেই পরীক্ষার আগের থেকেই ভালো ছাত্রছাত্রী এবং তথাকথিত মধ্যমেধার ছাত্রছাত্রীদের দিন রাত এক করা পরিশ্রম অভিভাবকদেরও একপ্রকার পরীক্ষাই বটে। আজ অনেক দিন পর তাদের সকলের নিশ্চিন্ত বিশ্রাম। এক কথায় 'মাধ্যমিক শেষ হলো, ছেলে ঘুমালো, এবং পাড়া জুড়ালো..!'
বছরের শুরুতেও ওমিক্রনের প্রভাবে মাধ্যমিক শুরু হবে কি না, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু এ বিষয়ে সমগ্র শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত ছিলেন যে, গতবারের মত এই বছর পরীক্ষা না হলে আবার গোটা একটা প্রজন্ম পরীক্ষাহীন রেজাল্ট নিয়ে তাদের পরবর্তী শ্রেণীতে উঠবে। একই সাথে সঠিক বিচার তাদের প্রতি করা হবে না। কারণ অনলাইনে এই দুই বছর প্রমাণ হয়ে গেছে গ্রামীণ প্রান্তিক এলাকায় কোনোমতেই সঠিক শিক্ষা দান সম্ভব নয়। অনলাইন পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের মনে খুব একটা ভালো প্রভাব বিস্তার করছে না ফলে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ খারাপ হতে পারে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত অফলাইনে লিখিত পরীক্ষা সুসম্পন্ন হলো। এটা ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই আনন্দের কথা।
পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রাকমুহূর্তে ছাত্রছাত্রীরা কিছুটা দ্বিধার মধ্যেই ছিল। গত বছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যালয়গুলি যখন খুলে যায়, তারপর দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই সময় থেকেই একটা জিনিস শিক্ষক এবং শিক্ষিকারা লক্ষ্য করেছিলেন যে, দীর্ঘদিন শ্রেণীকক্ষের বাইরে অনলাইন এবং প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত পড়াশোনার কারণে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতায় লিখতে অনেক রকম সমস্যা হচ্ছে। অনেক অবান্তর উত্তর এবং প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে চলে আসার মানসিকতা তৈরি হয় হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। যেহেতু এসব অঞ্চলে অনলাইন ক্লাস সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র অ্যাক্টিভিটি টাস্কের মাধ্যমে যেটুকু পড়াশোনা বিদ্যালয়ের কাছ থেকে পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু সময় বেশি ছিল না। আবার ওমিক্রনের তীব্রতার কারণে জানুয়ারি মাসে কিছু দিন বিদ্যালয়গুলি বন্ধ ছিল। আবার যখন বিদ্যালয় খুললো তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা অফলাইনে হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে এবং পরীক্ষা দ্বারপ্রান্তে।
যেহেতু আমি নিজে একটি গ্রামীণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই লক্ষ্য করলাম এবং পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার বোঝা গেল, টেস্ট পরীক্ষার কথা মাথায় রেখেও বলা যায় এবারের পরীক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণীতে নিয়মিত ভাবে শেষ লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত জড়তা রয়েছে। সারি সারি পরীক্ষার্থীরা কেমন এক যেন ভাবলেসহীন ভাবে বসে আছে। যেন যন্ত্রের মতন তারা পরীক্ষা দিচ্ছে। বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়ে ভাবুক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে নয়তো খোলা জানলার দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশ্ন কেমন সেটা জিজ্ঞেস করলেও তার সেরকম কোনো উত্তর নেই। একদম নিশ্চুপ।
প্রতিবার মাধ্যমিকের সময় মধ্যমেধা বা নিম্নমেধার ছেলে মেয়েরা যেরকম হালকা বা জোরে কথা বলার চেষ্টা করে, এবার সেরকম ও বিশেষ কিছু করছে না। হালকা ধমকেই একদম চুপ। কেমন যেন যান্ত্রিক প্রজন্ম! বয়সকালের নিম্ন মেধার নকল করার যে প্রবণতা সেটা পর্যন্ত সেরকম বিশেষ কিছু দেখা গেলো না, টুকটাক ছাড়া। কেউ কেউ আস্তে করে বলছে, "পড়াশোনাই হয়নি দু’বছর। কি আর লিখব!" মাঝে মাঝে দয়াও হয় ওদের দেখে। মনে হয় দুই একটা প্রশ্নের উত্তর বলে দিই। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব ও কৃত্রিম গাম্ভীর্য দিয়ে তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখি। খুবই খারাপ লাগে। সারা পরীক্ষায় হয়তো দুই থেকে তিনজন ছাত্রছাত্রী মেরে কেটে একটা দুটো অতিরিক্ত পাতা নিল। যা আগে ভাবাই যেতো না! কাগজে পড়লাম এবং অন্যান্য বিদ্যালয় থেকেও শুনলাম অনেকে এবার পরীক্ষাই দেয়নি। ছেড়ে দিয়েছে পড়াশোনা। এবং পরীক্ষা হলের অভিজ্ঞতাও অনেকাংশে এক। অবিশ্বাস্য ভাবে অনেকে প্রথম দিন নিজের নাম পর্যন্ত ঠিক করে লিখতে পারছিল না পরীক্ষার খাতায়। জানি না, কি দুঃসহ ভবিষৎ আসছে পরবর্তী সময়ে!
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছাত্রীদের কি অবস্থা? নিজের স্কুলে প্রথম বার বড় পরীক্ষা দেওয়ার উচ্ছাসও তাদের মধ্যে দেখা গেল না। তবুও হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল তারা। যদিও শিক্ষক শিক্ষিকারা খাতা দেখার সময় বুঝেছেন, কিছু স্কুলে তারা প্রাণ ভরে হালকা গার্ড দেওয়ার সুবিধা পেয়েছে পাতার পর পাতা ভরিয়েছে। আবার অনেক স্কুলে আইনমাফিক গার্ড দেওয়ার কারণে তাদের খাতায় খুব একটা আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া যায়নি।
করোনা কাল বড়ই অসহায় করে দিয়েছে এই কিশোর বেলাকে।
তবুও নানাবিধ অসুবিধার কারণে এটুকু বলা যায় এবার অফলাইনে পরীক্ষা দিয়ে অন্তত জীবনের আসল পথে যাত্রা শুরুর প্রাথমিক পথ তারা পেরোলো। এখন দেখা যাক ভবিষ্যৎ কি দাঁড়ায়।
জীবনানন্দের ভাষায়:
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,’ তবুও আশা রাখি দ্রুত এই আঁধার ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে কেটে যাবে। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর প্রকৃত শিক্ষার কোনও আশা দেখতে পাবে না। এক দুঃসহ অবস্থায় পরে থাকবে তারা।