সুমন কলকাতায় কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রতীক আমারও কলকাতায় কাজ করতে ভালোই লাগছে। গত পাঁচ বছর ধরে আমরা যে রাজ্যে কাজটা করছি, তার তুলনায় কলকাতা তো একেবারেই অন্যরকম। এখানে যে কোনও খাবার জায়গা বলুন, শপিং মল বলুন, দৃশ্যগতভাবে একসঙ্গে তাও হিন্দু মুসলমান মানুষদের দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু গুজরাটে তো এই দৃশ্য ভাবাই যায় না। এটা শুধু ২০২২ সালে নয়, বেশ অনেক বছর ধরেই এই ছবি আমরা গুজরাটে দেখি না। সুতরাং কলকাতা আমার একটা অন্যরকম ভালো লাগার শহর।
অমিত কেন মনে হলো, কলকাতায় কাজ করা উচিৎ? কেন মনে হচ্ছে এই কাজটা পড়াশুনার সঙ্গে যুক্ত করা উচিৎ? সিলেবাসে এই ধরনের কিছু অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ?
প্রতীক আমরা যদিও পাঁচ বছর ধরে এই ভুয়ো খবর চিহ্নিত করার কাজ করছি। কিন্তু কোথাও আমাদের মনে হচ্ছিল যে আমরা আটকে যাচ্ছি। আমাদের হয়তো আজকে অনেকেই চেনেন আমাদের নাম দিয়ে, কিন্তু সামাজিক ভাবে আমাদের প্রভাব খুবই সীমিত। সাংবাদিক মহলে কিংবা রাজনৈতিক মহলে হয়তো আমাদের পরিচিতি আছে, কিন্তু তার বাইরে আমরা কোথায়? তাই আমাদের মনে হয়েছে, এই জায়গা থেকে বেরোনোর উপায় কি? বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার সঙ্গে যদি এই ভুয়ো খবর চিহ্নিত করার কাজটা যুক্ত না করা যায়, তাহলে লাভ হবে না। আমরা জানি শিক্ষা জগতে অনেক আমলাতন্ত্র আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কঠিন কাজটা যদি আজকে না শুরু করা যায়, তাহলে গতানুগতিক ভুয়ো খবর চিহ্নিত করার কাজটা আমরা হয়তো করেই যাব, কিন্তু খুব বেশী দূর এগোতে পারবো না। বেশ কিছু দেশে বিদ্যালয় স্তরেই ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাসের মধ্যে এই ভুয়ো খবর চিহ্নিত করা, বা তার কি প্রভাব সমাজে পড়ছে, তা নিয়ে আলোচনা করার কাজ ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দেখা গেছে ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশে, যেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে এই নতুন ধরনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা আমেরিকার শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, শিক্ষা জগতে এ নিয়ে একটা সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হয়েছেযে, আসলে যে-কোনও ভুল তথ্য বা খবর পরিবেশনের একটা উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো মানসিক উত্তেজনা তৈরি করা, হয় একজন মানুষ সেই মানসিক উত্তেজনাকে নিজের মধ্যে আত্মীকরন করে নেবেন অথবা সেই উত্তেজনাকে আরও নানান মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন, যাতে সেই মানুষেরাও সেই উত্তাপ পান। এমনিতেই আমাদের সমাজ অত্যন্ত বিভাজিত হয়ে আছে, তার মধ্যে একজন মানুষের রাগ, ক্ষোভ বা দুঃখ যদি এই ধরনের ভুয়ো খবর বা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে বাড়তে থাকে তখন সমস্যা বাড়ে। এমনিতেই আমাদের দেশে সাধারণত যেকোনো এই ধরনের মিথ্যে খবর খুব দ্রুত ছড়ায়, এবং তা সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধেই করা হয়, তাই আমাদের কাজটাও আরও বড় মাপে করা জরুরি। যদি অন্তত একটি রাজ্যে আমাদের এই কাজটা ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলেই অনেক দূর অবধি এগোনো যাবে। আমাদের মনে হয়েছে, বাংলায় এই মূহুর্তে এমন একটি সরকার চলে, যাঁরা আমাদের সাহায্য না করলেও আমাদের বাধা দেবেন না, তাই এখানে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা কেবল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাজ করবো এমনটা নয়, আমরা সামাজের নানা স্তরে কাজ করতে চাই, আপনাদের ‘সহমন’ যেহেতু এই কাজটা করে, সুতরাং আমরা নিশ্চিত একসঙ্গে কাজ করতে পারবো।
সুমন অনেক সময়ে দেখা গেছে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, নাগরিকত্ব নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা বেশীরভাগই মুসলমান এবং তাঁদের পোষাক পরিচ্ছদ দেখেই চেনা যায়, কিংবা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা উইপোকার মতো দেশটাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে, আপনার মনে হয় এই ধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করা সম্ভব?
প্রতীক খেয়াল করুন,পাঁচ-সাত বছর আগেও হয়তো ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আসতো, কিন্তু আজ এটা রোজ বাড়ছে। কিছুদিন আগেই হরিদ্বারে যে ধর্ম সংসদ হল, সেখানে যেভাবে গণহত্যার কথা বলা হয়েছে, তা কিছুদিন আগে অবধি ভাবা যেত না, কিংবা আগে যদি এই ধরনের কোনও মন্তব্য সমাজে কেউ করতেন, তখন সমাজের মধ্যে থেকেই তার বিরোধিতাও উঠে আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধরনের বক্তব্যও আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে।এমনকি গণহত্যার হুমকি দিলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা এই মূহুর্তে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এই কথাগুলো হয়তো বোঝাতে পারবো না, কিন্তু আমরা যদি সামাজিক স্তরে ছোট ছোট উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি, তখন অনেকেই আকর্ষণ বোধ করবে। যে রাজনীতি ধর্মকে বা জাতিকে হাতিয়ার করে ঘৃণা ছড়ায়, তা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে, এবং বাচ্চাদের বিশেষ করে ক্ষতি হয় এর মধ্যে দিয়ে, তাই সবার আগে বাচ্চাদের চেনা উচিৎ কোনটা প্রচার, কোনটা ভুল বা মিথ্যে খবর, কারণ তারাই কিছুদিন পরে বড় হবে, কলেজে যাবে, সমাজে মিশবে, সুতরাং তাদের যদি আজকে এই তথ্য সংক্রান্ত স্বাক্ষর না করা যায়, তাহলে সমস্যা বাড়বে। আজকে আমাদের অনেকেই হয়তো, চিনতে পারি কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল, আমরা জানি বিজেপি এই কাজটা হয়তো বেশী করে থাকে, কিন্তু যদি ক্ষমতার বদলও ঘটে যায় একদিন, যে ক্ষতিটা এখন হচ্ছে, তা কি করে ফেরত আসবে? বাচ্চারা আজ যদি ভুল-ঠিক তফাৎ না করতে শেখে, ভবিষ্যতটা কি খুব সুন্দর হবে?
অমিত আপনারা সমাজের কোন অংশের মধ্যে মূলত কাজ করতে চাইছেন? এ সময়ে তো বেশীরভাগ মানুষই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, তাঁদের কাছেও কি যাওয়ার কথা ভাবছেন?
প্রতীকপ্রাথমিকভাবে আমরা হয়তো শহরে কাজ করতে চাইবো, কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা গ্রামগঞ্জেও যেতে চাই, কারণ সেখানেও স্মার্ট ফোন এবং সেখান থেকে ছড়ানো প্রচার বাড়ছে। গ্রাম এবং শহরে হয়তো ভিন্ন ধরনের ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হয়, কোথাও হয়তো ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত মিথ্যে বার্তা আসে, কোথাও হয়তো অন্য রকমের কিছু আসে, তাই দু জায়গায় কাজ করতে হবে দু’ভাবে। প্রাথমিকভাবে শিক্ষা জগতের কোনওমানুষ ভুয়ো তথ্য চেনা এবং তা মোকাবিলা করার উপায় সংক্রান্ত কিছু পাঠ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করানোর কাজ শুরু করতে পারেন।আমরা সর্বতোভাবে সে কাজে সাহায্য করবো। এবং সেখান থেকে কিছু ফলাফল আমরা দেখাতে পারি।সেটা হলে সরকারের তরফ থেকে হয়তো আমাদের কাজের একটা স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব। সিলেবাসের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের প্ররিপ্রেক্ষিতেই তা ভাবতে হবে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের স্বাক্ষরতার হার ৯৯ শতাংশ, কিন্তু আমাদের দেশে তো তা নয়, তাই সিলেবাস তৈরির ক্ষেত্রেও সেই পার্থক্য রাখতে হবে। যেহেতু আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই, তাই আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের থেকেই সুবিধা চাই না। আমরা জানি কিছু অর্থনৈতিক সমস্যা হবে, কিন্তু কেউ যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে আমাদেরও এগোতে সুবিধা হবে।
সুমন এমন কোনও পদ্ধতি কি আপনারা আনতে চাইছেনযে, কোনও নম্বরে ফোন করলেই সমাধান হবে?
প্রতীক সেরকম কোনও পদ্ধতি আনলে খুব বেশী সুবিধা হবে না। অনেকে বলতে পারেন, যাঁরা ভুয়ো তথ্য পাঠান, তাঁদের জেলে ভরে দেওয়া উচিৎ, কিন্তু তা করলে হবে না, কথা বলার অধিকার বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, তথ্য থেকেই আসে ভুয়ো তথ্য। আমাদের ভাবতে হবে, কারা কিভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে, শেষবিচারে তাঁরাই নির্বাচনে ভুমিকা রাখেন, সুতরাং তাঁদের কাছেও পৌঁছতে হবে। হয়তো তাঁরা রাজনৈতিকভাবে একটি ধারণা তৈরি করে রেখেছেন, কিন্তু তাঁদের কাছে পৌঁছতে হবে অন্যভাবে। ভুয়ো তথ্য নিয়ে একটু বড় ভাবে কিছু ধারণা যদি সমাজে তৈরি করা যায় তাহলে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। আমার এক বন্ধু আছেন গুজরাটে, যিনি সাধারণ মানুষকে অনলাইন সার্ভিস ব্যবহার করার প্রশ্ক্ষণ দেন। সেই রকম কোনও উদ্যোগের মধ্যে দিয়েও এই কাজটা করা যায়।
সুমন/ অমিত ‘সহমন’ নানান সময়ে হিন্দু মুসলমানদের একসঙ্গে বসিয়ে কথোপকথনের আয়োজন করে থাকে, ‘অল্ট নিউজ’ সেই রকম কিছু উদ্যোগের সঙ্গে কি থাকতে চাইবে? কোনও কর্মশালা যদি সংগঠিত করা যায়, তাহলে কি একসঙ্গে এগোনো যাবে?
প্রতীক নিশ্চয় থাকবে, আশা করা যায় আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারবো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
অল্ট নিউজের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে
নীচের সূত্রে ক্লিক করুন
https://pages.razorpay.com/altnews