পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এই হত্যা পাহাড়ের মতো ভারী হবে

  • 20 November, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 417 view(s)
  • লিখেছেন : দেবজিৎ ভট্টাচার্য
রাষ্ট্র কখনও নিরস্ত্র বিপ্লবীদের ছেড়েছে? নিরস্ত্র হিডমা সহ আরও অনেককে আদালতে তোলবার সাহস দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছে। হত্যা করে যখন তাঁর দেহের দখল নিয়েছে তখন তাঁর পাশে জীবনসঙ্গিনী, রাজ্জাকা শুয়ে। অনেক তথাকথিত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আবার তা নিয়ে আনন্দ করলেন। রাষ্ট্র হয়তো আজকে দৃশ্যত সাময়িকভাবে জিতে গেল, কিন্তু হিডমাদের মৃত্যু হয়না।

ব্যক্তিকে পার্টির থেকে বড় করে দেখানোর কারসাজি আজকের দিনে 'লো ইনটেনসিটি কনফ্লিক্টে'র অংশ, তার সমাপ্তি ঘটলো সেই ব্যক্তিকে হত্যা করবার মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিকে পার্টির উর্ধ্বে দেখানোর কাজ শুরু করেছিল এ রাষ্ট্র। সেই ব্যক্তিটি হলেন মাডভি হিডমা। ফ্যাসিবাদ, উদারবাদ ও সংশোধনবাদ তথা রাষ্ট্রের কাছে এই নামটাই ছিল আতঙ্ক, অ্যানার্কিস্টদের কাছে ছিল রোমাঞ্চ আর বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কাছে ছিল ভরসার জায়গা, মহান দায়িত্ববান এক বিপ্লবী, কমরেড, যুদ্ধের সঙ্গী প্রভৃতি। 

হিডমা এক হত দরিদ্র আদিবাসী পরিবারের সন্তান। অভাব অনটনের অসহায়তার কবলে জন্ম থেকে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। প্রথমে এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিদ্রোহের মাধ্যমে, পরর্বতীকালে তাঁর মধ্যকার সেই বিদ্রোহের আগুন তাঁকে মাওবাদ দর্শনের প্রতি আকর্ষিত করে। কী এই দর্শন? যে দর্শন তাঁকে চিনিয়েছে নিজেকে এবং নিজের পায়ের তলার মাটিকে। সেই মাটি কেমন তা হিডমাকে বুঝিয়েছিল গভীরতার সাথে। তিনি এই সময় খালি বস্তুবাদী ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী, দেশের মাটিকে চিনেছিলেন উপর থেকে নয় বরং, ভেতর থেকে গভীরে ঢুকে। বুঝেছিলেন, প্রত্যেক আদিবাসীর পায়ের তলার মাটির নীচে বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদ গচ্ছিত আছে। সেই দিকে নজর রয়েছে রাষ্ট্রের। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাষ্ট্র তাঁদেরকে বন্দি করে রেখেছে বন্দুকের নলের ডগায়, যেই নল দিয়ে বেরোনো একটা লোহা জীবন কেড়ে নিচ্ছে তাঁরই আত্নীয়-পরিজন, সম্পূর্ণ গ্রামের নিরীহ আদিবাসীদের। এইগুলো তাঁর ভেতরে সংকট ও প্রয়োজনীয়তার মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আরও তীব্রতর করে তোলে, পেটের টানের থেকে বড় করে তোলে মুক্তির প্রয়োজনীয়তাকে। তিনি কিন্তু পারতেন অন্যায়, অনাচার, শোষণ সহ্য করে চুপ থাকতে, অন্যের জমিতে চাষ করে দু'বেলার পেট চালাতে, পারতেন মজুরি-দাস হয়ে এক বন্দিত্বের জীবন কাটাতে। কিন্তু, প্রধানত, তাঁর ভেতরকার বিদ্রোহী সত্ত্বা ও তাঁর ভেতরকার মানবিক বোধ এবং রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলোর মধ্যে চলতে থাকা প্রতিদিনের সংঘর্ষ সম্ভবত কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত করেছিল তাঁরই কাছে - এভাবে কতদিন বাঁচা সম্ভব হবে? ব্যক্তি(হিডমা) বেঁচে গেলেও পরিবার, আত্মীয়-পরিজনের কী হবে? তা বেঁচে গেলে গ্রাম, জেলা, রাজ্য, দেশ, পৃথিবী - সমগ্র জনগণ বাঁচবে কীভাবে? সমাজের অস্তিত্বের কী হবে? ঠিক যেমনভাবে আজ বস্তারের উনিশ বছরের এক সংগ্রামী আদিবাসী মেয়ে হাজতে বন্দি থাকাকালীন অবস্থায় প্রশ্ন ছুঁড়ে ঘাবড়ে দেন বড় বড় তদন্তকারী অফিসার ও পুলিশ কর্তাদের- 'কিছু জনের হাতে এতো জমি আর সংখ্যাধিক্যের হাতে জমি নেই কেন?' এমনভাবে হিডমা-ও সম্ভবত নিজের ভেতরের মননকে প্রশ্ন করেছিলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভেবেছিলেন জীবনটাকে নিয়ে। শুধু নিজের নয়, সকলের জন্যে দেশের স্বার্থে। প্রকৃতঅর্থে সে বুঝেছেন যে, মানুষ কেন সমাজবদ্ধ জীব, সমাজ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব নেই, আদপে সেই হলেন প্রকৃত শিক্ষিত এ সমাজের। যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি এদেশের নামী-দামী ডিগ্রিধারী নেতা-মন্ত্রী, আমলা, বিচারপতি ও আরও অনেকে। এঁরা প্রশ্ন করেন, মাওবাদ ও মাওবাদীরা এদেশকে কী দিয়েছে, এর উদাহরণ এসবেও রয়েছে। জনগণের মানবিক বোধ, গণতান্ত্রিক বোধ, উন্নতমানের নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ধারণা কেমন হতে পারে, তা-ই বাস্তবে করে দেখিয়েছে, এত বছরে যা পারেনি রাষ্ট্র দিতে তা দিয়েছে মাওবাদ ও মাওবাদীরা। এদেশের আট দশকের তথাকথিত স্বাধীন, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা তা মাত্র চার দশকের চলা সংগ্রামী বিকল্প ব্যবস্থার শিক্ষার কাছে হেরে গেছে। রাষ্ট্রের হারকে ও জনগণের জয়কে উদযাপন করতে শেখবার মধ্য দিয়ে হিডমারা জন্ম নিয়েছে। এখনও নিচ্ছে। ভবিষ্যতেও নেবে।

আঠারো নভেম্বর ভোরের দিকে হিডমার দেহের দখল নিলো রাষ্ট্র, এর আগে নিয়েছিল তাঁর গ্রামের দখল। সেই গ্রামে থাকেন মাত্র কয়েক'শ জন আদিবাসী। তাঁদের মধ্যে প্রায় একশো জন হিডমা পথ অনুসরণ করে মাওবাদের রাস্তা ধরেছে। যে রাস্তা অস্ত্র বোঝাই ট্রাক যাওয়ার জন্য তৈরি নয়, যে রাস্তা দেশি-বিদেশি পুঁজির সংস্থাগুলোর চলাচলের স্বার্থে বানানো হয়নি, যে রাস্তা অসাম্যতার পাহাড়ে ঘেরা নেই। বরং, যে রাস্তা কেবল তৈরি হয়েছে জনগণের নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে জনগণের রাজত্ব কায়েম করতে প্রয়োজনকেন্দ্রিক উন্নয়নকে সামনে রেখে, সাম্যতার ইমারত বানানোর লক্ষ্যে। সেই রাস্তার পথিক ছিলেন হিডমা, সঙ্গী ছিল বন্দুক। যাঁর নল সব সময় জন-হিংস্রতার বিরুদ্ধে উঁচিয়ে থাকতো, হিংস্র নলের দিকে তাক করে। তাই ২০২১ সালে এক নিরস্ত্র সি.আর.পি.এফ সেনা হিডমাদের হাতে যুদ্ধ-বন্দি হয়েও কিছু দিন বাদে ছাড়া পান তাঁদেরই বিকল্প ব্যবস্থার দৌলতে, জনতানা সরকারের আদালতে, জনগণের রায়ের মধ্য দিয়ে। হিডমাদের এই উন্নতমানের প্রকৃত অহিংস্রতার চেতনার দখল নিতে পারবে রাষ্ট্র?

রাষ্ট্র কখনও নিরস্ত্র বিপ্লবীদের ছেড়েছে? নিরস্ত্র হিডমা সহ আরও অনেককে আদালতে তোলবার সাহস দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছে। হত্যা করে যখন তাঁর দেহের দখল নিয়েছে তখন তাঁর পাশে জীবনসঙ্গিনী, রাজ্জাকা শুয়ে। অনেক তথাকথিত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আবার তা নিয়ে আনন্দ করলেন। তবে তাঁদের হিডমাদের মত গভীরভাবে একটাবার ভেবে দেখা উচিৎ ছিল, যে, ভালোবাসা প্রাণের চেয়েও অনেকখানি দামী হতে পারে, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের লক্ষ্যে মতাদর্শগত দৃঢ়তার সাথে জড়িয়ে পড়লে। এই বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মসমর্পণের বাজারি ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনে এই বিপ্লবী দম্পতিও পারতেন সেই পথ বেছে নিতে। অথবা, একে অপরকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু, প্রকৃত মুক্তির স্বাদ যে ভালোবাসার সম্পর্ক নিতে শিখেছে তাঁর কী আর বন্দিত্ব ভোগ করবার জায়গা থাকে? উল্টে, বিপ্লবী মৃত্যুই তাঁদেরকে, সেই মহান ভালোবাসার সম্পর্ককে বারেবারে নতুন জন্ম দিয়েছে। 

মাও সেতুং বলেছেন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে মুক্তির পথ দেখায়, আর পার্টিকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায় গণমুক্তি ফৌজ। সেই ফৌজের নেতৃত্বের দায়িত্বে একদা দাঁড়িয়ে ছিলেন হিডমা, এমনটাই প্রমাণ করতে চায় রাষ্ট্র। তারা ভুলে যায় যে, বিপ্লবী হিডমার পার্টি নিপীড়িত জনগণের কোলে তিনটি সন্তান সঁপে দিয়েছে; এক, রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, দুই; বিপ্লবী তত্ত্ব-অভিজ্ঞতা; তিন, হিডমাদের গণমুক্তির ফৌজকে। এর প্রমাণ রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর হিডমার গ্রাম দখলের পরেও মিলেছে। গত বছরে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল তাতেও কেউ অংশগ্রহণ করেননি সেইখানে। ব্যক্তি কখনও কখনও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানের ভূমিকা পালন করে, এক্ষেত্রে বোধয় তাই ঘটেছে। সেই কারণে, হিডমাকে বন্দি করে রেখে ছত্তিশগড়ের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় শর্মা ছুটেছিলেন হিডমা মায়ের কাছে, ভণিতা করতে। হয়তো, বৃদ্ধা মায়ের চোখের জল দেখিয়ে তাঁর মনকে আবেগঘনিষ্ট করে তাঁকে আত্মসমর্পণ করাতেন, আরও অনেকের মনোবলে বুলডোজার চালাতে। আসলে হিডমার মতাদর্শের জোরের কাছে রাষ্ট্র অনেক আগেই হেরে গেছে। যেমনটা হেরেছিল ব্রিটিশ, এ রাষ্ট্র শুরুর সময়কাল থেকে - শহীদ ভগৎ সিং থেকে চারু মজুমদার ইত্যাদি আরও অনেক বিপ্লবী কমিউনিস্টদের মতাদর্শের জোরের কাছে। এমন এক-একজন দেশপ্রেমী, বিপ্লবীকে হত্যা করে বাকিদের বিপ্লবী উদ্যমতা ভাঙতে, মনোবল গুড়িয়ে দিতে - নানা প্রোপাগান্ডাময় প্রচার, রাষ্ট্রের মর্ডান ওয়ারফেয়ারের 'লো ইন্টেনসিটি কনফ্লিক্ট'-এর নানা কারসাজি ভেস্তে যাওয়ার সিংহ ভাগ সুযোগ রয়েছে এইবারে, বিপ্লবী হিডমার ক্ষেত্রে। 

নিরীহ জনগণ থেকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট, সম্পাদক বাসবরাজুর হত্যার পর, যারা নয়া সংশোধনবাদের পথে অনেকের আত্মসমর্পণ দেখছে, সেগুলোকে প্রথম থেকে গভীরতার সাথে উপলব্ধি করছে এবং এখন হিডমার ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা দেখলো, স্বাভাবিকভাবে তারা আরও ধৈর্য্যশীল, সহ্য-ক্ষমতাবান হবে, তাদের ভেতরটা পাহাড়ের মত শক্তপোক্ত হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকে মতাদর্শ ও সংগঠনের প্রতি আরও ভালোবাসা, সুশৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা বাড়াবে, আর নিজেদের বাইরেটাকে মজবুত ও বিস্তৃত আকারে মেলে ধরবে নিপীড়িত জনগণের কাছে। তারাই ভবিষ্যত, তারাই ছড়িয়ে দেবে বিপ্লবী সংগ্রামকে জনগণের মাঝে। যে শিক্ষা মার্কসবাদের সর্বোচ্চ রূপ মাওবাদ দেয়। ভারতে নকশালবাড়ির ধারাবাহিকতার বৈপ্লবিক ইতিহাস প্রত্যেক নিপীড়িত, কোণঠাসা হওয়া, অত্যাচারিতদের বিপ্লবী শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব দিলো - দৃঢ় প্রত্যয়ী, আদর্শবান হিডমার মতন মহান বিপ্লবী কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে।

0 Comments

Post Comment