মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, ভারতকে তাদের দেশে ওষুধ রপ্তানি করতেই হবে, নইলে তিনি 'দেখে নেবেন’। ট্রাম্প গুণ্ডার হুমকির মুখে ভারত সরকার ২৪টি ওষুধ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তড়িঘড়িয়ে তুলে নিয়েছে। এই আবহে, একটু জেনে নেওয়া যাক ভারতে ওষুধ শিল্পের অবস্থাটা ঠিক কীরকম? বিশেষত ওষুধ তৈরির অন্যতম কাঁচামাল অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (API) উৎপাদনে ভারত ঠিক কতটা স্বনির্ভর? আর বর্তমান সরকারের সব সরকারি সংস্থা বেচে দেওয়ার যে নীতি তা-ই বা কীভাবে এই API-উৎপাদন শিল্পকে প্রভাবিত করছে?
ভারত মোটামুটিভাবে যত অ্যাক্টিভ ফার্ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (API) আমদানি করে বিদেশ থেকে, তার ৭০% আমদানি করে চীন থেকে। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ১) API কী? API হলো একটি টার্ম, যা ওষুধের মধ্যে বায়োলজিক্যালি আক্টিভ (জৈবিকভাবে সক্রিয়) উপাদানকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। খুবই সাধারণ ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল উৎপাদন করতেও API-এর ওপর নির্ভর করতে হয়।
বিদেশ বা মূলত চীন থেকে API আমদানির ওপর অতি-নির্ভরশীলতা কমানোর উপায় খুঁজতে ২০১৫ সালে ভারত সরকার কাটোচ-কমিটি গঠন করে। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ২) কাটোচ কমিটি দেশে API উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহ দিতে নানা পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুনির্দিষ্ট একটি প্রস্তাব ছিল: সরকারি সংস্থার, যাকে আমরা পাবলিক সেক্টর আণ্ডারটেকিং বা PSU বলে থাকি, তার পুনরুজ্জীবন। যাতে করে এই সরকারি সংস্থাগুলি API উৎপাদন করতে পারে। বেশিরভাগ সরকারি সংস্থারই প্রচুর খালি জমি আছে, যেগুলিকে ড্রাগ পার্ক বানানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ষোড়শ লোকসভার (২০১৪-২০১৯) রাসায়নিক ও সার-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি তাদের ৩২তম প্রতিবেদনে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল: সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির খালি জমিতে 'বাল্ক ড্রাগ পার্ক' বানানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে পারে। সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির পরিকাঠামো ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এবং সংস্থাগুলির সম্পদকে ব্যবহার করে একাজ করা যেতে পারে। এভাবে ভারতের বাল্ক ড্রাগ শিল্পের, বিশ্বের এক নম্বর বাল্ক ড্রাগ শিল্পে পরিণত হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা আছে, এই আশাও ব্যক্ত করা হয় ওই প্রতিবেদনে। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ৩)
এবার দেখা যাক, ভারত সরকার কী করলো?
এ বিষয়ে ভারত সরকারের মনোভাব ঠিক কী, তা স্পষ্ট হয়ে যায় সরকারের 'অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট' থেকেই। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপরোক্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই এই 'অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট' বানানো হয়েছিল। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ৪) এই রিপোর্টে সরকারের সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থানটি ছিল এই যে, নীতি আয়োগের সংশ্লিষ্ট কমিটি ভারতের সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলিকে 'প্রায়োরিটি সেক্টর’ বলে চিহ্নিত করেনি। আর সেকারণেই ভারত সরকার মনে করে, ওই সরকারি ফার্মা সংস্থাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বেচে দেওয়া হবে অথবা কৌশলগতভাবে সরকারের অংশীদারিত্ব কমিয়ে ফেলা হবে।
যেমন কথা তেমন কাজ। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিন্ধান্ত গৃহীত হয়, সরকারি সংস্থা – ইন্ডিয়ান ড্রাগস অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড (IDPL), রাজস্থান ড্রাগস অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড (RDPL) পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া হিন্দুস্থান অ্যাণ্টিবায়োটিক্স লিমিটেড (HAL) ও বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড (BCPL)-এর কৌশলী বিক্রির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। এই দুটি সংস্থার হাতে থাকা অতিরিক্ত জমি সরকারি সংস্থাকে বেচে দিয়ে, সেই অর্থে পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধ করে সংস্থাদুটিকে বিক্রি করে দেওয়া হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ৫)
বেঙ্গল কেমিক্যালকে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়। ভারত সরকারের তরফে কোর্টকে জানানো হয়, যেহেতু বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রায়োরিটি সেকটরের অন্তর্গত বলে চিহ্নিত নয়, তাই সরকার সংস্থাটির কৌশলী বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও, কলকাতা হাইকোর্ট বেঙ্গল কেমিক্যালের কৌশলি বিক্রির সরকারি সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেয়। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ৫)
ভারত সরকারের তরফে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ ৭)
বর্তমানের এই সংকট-মুহূর্তে, আর ট্রাম্পের মতো এক গুণ্ডার ধমকির মধ্যেও, বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো একটি 'নন-প্রায়োটিরিটি সেক্টরের’ সরকারি সংস্থাও ১০ লাখ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে। (তথ্যসূত্র – লিংকঃ 8)
আমরা থালি বাজাই আর বাতি জ্বালাতে থাকি!
তথ্যসূত্রঃ
[১] https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)30459-1/fulltext?fbclid=IwAR2YlnPZ2EU6jVV5AhmDGRoXXrtJu3NvSOVRWH8ndeilKyb2veGseMh651Y
[২] https://pharmaceuticals.gov.in/sites/default/files/Katoch Committe Report_0.pdf?fbclid=IwAR3Y-qk9axidPkXThYvlWCqJHEk39abtM8aKhREJH-wwkpIjrns_vRxAt5I
[৩] https://eparlib.nic.in/bitstream/123456789/65100/1/16_Chemicals_And_Fertilizers_32.pdf?fbclid=IwAR2j4oJytua7_CSg8xaTWFFtzKFNL-7Gx3Bd1KO8b69oSxVZRIJeWwa4gz4#search=pharma
[৪] https://eparlib.nic.in/bitstream/123456789/65105/1/16_Chemicals_And_Fertilizers_37.pdf?fbclid=IwAR02msVx_o98N70JyXEvRdR6yV4PM3uQYT5wmayZOaR410i6soYjpsmh4Kc#search=pharma
[৫] https://pib.gov.in/Pressreleaseshare.aspx?PRID=1592574&fbclid=IwAR1WCdp3baLLmBGEqApm0wJCm0zO4EOuZEjXsKRmcgicSoTkEAJa9Qf1hDw
[৬] https://indiankanoon.org/doc/187588268/?fbclid=IwAR0j-aUMg1_eLPiR7lwQ-ZzliI63Vq8d86ZJxmaSYBL5Ds7ElwaYsrJ76f8
[৭] https://www.livemint.com/Companies/N9IqOcYTVqgAxK1CFrVuOP/Govt-moves-Calcutta-HC-over-sale-of-Bengal-Chemicals.html
[৮] https://indiankanoon.org/doc/187588268/?fbclid=IwAR0j-aUMg1_eLPiR7lwQ-ZzliI63Vq8d86ZJxmaSYBL5Ds7ElwaYsrJ76f8
(অর্ক মাইতি কলকাতা হাইকোর্টের তরুণ আইনজীবী। মূল ইংরেজি লেখাটির বাংলা তর্জমা করেছেন অগ্নিবেশ রায়।)