সাচার কমিটির সুপারিশ আজ সতেরো বছর পার করে আমরা ভুলেই গেছি। কেন্দ্র তো বটেই রাজ্য সরকারও সাচার সুপারিশ কার্যকর করার কথা ভুলেছে, কারণ ভুলে যাওয়ারই কথা। ভারতের মুসলমনদের অনগ্রসরতা দূরীকরণের পদক্ষেপ তো পরের কথা, মুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা এবং অর্জিত অধিকারগুলোও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারণ সরকার চাইছে না। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পরে রাজ্যের তৎকালীন শাসক বামফ্রন্ট খুবই অসুবিধের মধ্যে পড়ে। বামফ্রন্ট দাবি করেছিল, তারা মুসলমানদের যা করেছে তা এন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক ভাল। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে এই রিপোর্টের তথ্য ঘিরে মুসলিমদের মধ্যে বিতৃষ্ণা তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে। সেই বিতৃষ্ণা সুদূর প্রসারী হয়েছিল। তার ফল আমরা দেখেছিলান ২০১১-য়। কেন্দ্রের সরকার পালটেছে, রাজ্যেও বামফ্রন্ট সরকার নেই। যাঁরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে হইচই করেছিলেন, তাঁরা চুপ করে গিয়েছেন। কোনও রাজনৈতির দলই আর সাচার কমিটির রিপোর্টের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না, বরং এড়িয়ে চলে। সাচার রিপোর্টে রাজ্যের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যা তথ্য আমরা জানতে পারি, ১৭ বছরে তার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কলকাতার হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশন ‘সাচার কমিটি এবং ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম প্রসঙ্গ’ বিষয়ে দু’দিনের একটি জাতীয় পর্যায়ের সেমিনার করেছে সম্প্রতি। আশুতোষ মেমোরিয়াল হলে সেমিনারের উদ্বোধন করেন রাজ্যসভার প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে রহমান খান। সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা উপপ্রধান ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরুদ্দিন শাহ, বিহারের প্রাক্তন মন্ত্রী শাকিল উজ্জামান আনসারি উদ্বোধনী পর্বে সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে সেমিনার সংগঠিত করার হিম্মৎ দেখানোর জন্য অভিনন্দন জানান উদ্যোক্তাদের।
প্রথম ইউপিএ সরকারের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সাচার কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তা নিয়ে তখন অনেক কথা হয়েছিল। অথচ এখন সাচার রিপোর্ট নিয়ে চর্চাই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ দেশ এবং রাজ্যের রাজমৈতির পরিবেশ ও পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। যে কোনও সমাজে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য নিশ্চিত করতে হয় তাদের পরিচিতি, নিরাপত্তা এবং সমতাকে। আজকের দিনে এর সবকটাই আক্রান্ত। তাই উন্নয়ন চাইলে সবার আগে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হবে।
রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ আসা মাত্র সবার আগে ওবিসি ক্যাটেগরিতে ১৫ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু প্রকৃত চিত্রটি হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রাপকদের ১৭৩ জনের তালিকায় মাত্র এক জন মুসলমান। মুসলিম ছাত্রীদের জন্য রায়গঞ্জে যে হস্টেল তৈরি করা হয়েছিল, তার ভবনেই এখন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। বামফ্রন্টের আমলে রাজ্য সরকার যে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছিল, এখন সেটা ধংস করে পার্ক সার্কাসের দামী জমি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। খাদ্য, পোশাক, ভাষায় অভিন্নতাকে শেষ করে দিতে কেন্দ্র সরকার তৎপর।
জামিরুদ্দিন শাহ বলেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নকে যাঁরা সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণ বলেন, তাঁরা আসলে ভোটের হিসাব কষেন। কই সংখ্যাগুরুদের বেলায় তো এমন শব্দ ভাবা হয় না! তিনি মুসলিমদের অনগ্রসরতা দূর করার জন্য মুসলিম সমাজকেও এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে জাকাত এবং ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি বলেন, সাচার কমিটি রোগ নির্ধারণ করেছে। রোগ সারাতে সরকারি তরফে যে উদ্যোগ দরকার, সেটা ইউপিএ সরকার নিয়েছিল। কিন্তু এখন কেন্দ্রের সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো বিভিন্ন রাজ্যের সরকার সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সময় হয়েছে।
দু’দিনের ওই সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সমাজকর্মী শায়রা শাহ হালিম। স্বাগত ভাষণে হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ডা. ফুয়াদ হালিম বলেন, সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যে চর্চার প্রয়োজন, তা এই সেমিনারের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২০ জন স্কলার এই সেমিনারে যোগ দেন।
সাচার রিপোর্ট থেকেই প্রথম জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উচ্চপদে মুসলমানদের অংশগ্রহণ মাত্র ৪.৭ শতাংশ, এবং মোট সরকারি চাকরিতে মাত্র ২.১ শতাংশ। তার নয় বছর পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিকস' যে 'স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট: ২০১৪-১৫' প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অংশিদারিত্বের হার ৫.৭৩ শতাংশ। এই অগ্রগতি দেখলে মুসলমানের প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট হয়। সাচার কমিটির কতটা কার্যকর হয়েছে তা দেখার জন্য অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডুর নেতৃত্বে একটা কমিটি গড়ে দেন তদানীন্তর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ২০১৪ সালে সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, গোটা দেশেই মুসলমানের চোখে পড়ার মতো কোনও উন্নতি হয়নি। মনে রাখতে হবে, সাচার বা অমিতাভ কুণ্ডু— দুটি রিপোর্টই তৈরি হয়েছিল সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
তার দশ বছর পরে অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড, প্রতীচী ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ২০১৬ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ৬৪.৭ শতাংশ মুসলমান পরিবার দারিদ্রসীমার নীচে বাস করছে। গ্রামীণ বাংলার ৪৭ শতাংশ মুসলমান মানুষ হয় খেতমজুর, বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। ভাল চাকরির অভাব, কাজের অভাব, ঠিকা শ্রমিক হয়ে দিন গুজরান করার ফলে মুসলমান সমাজে দারিদ্রের এত প্রাবল্য। এই মানুষগুলি যেখানে দিনরাত দারিদ্রের সঙ্গে লড়ছেন, তখন তাঁদের তোষণ করা হচ্ছে বলে যাঁরা দাবি করছেন, তাঁরা কোন রাজনীতি করতে চাইছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে নজর ঘোরালে দেখা যাবে যে, ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৬৮.৭ শতাংশ, যেখানে রাজ্যের গড় সাক্ষরতার হার ৭৬.৩ শতাংশ। স্ন্যাপের পূর্ব-উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে স্নাতক ছিলেন মাত্র ২.৭ শতাংশ। যে কোনও সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চশিক্ষা সমীক্ষার ২০১৮-১৯ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোট মুসলমান শিক্ষকের অনুপাত মাত্র ৬.৯ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১২-১৩ সালে এই অনুপাত ছিল আরও কম, ৩.৯ শতাংশ।
২০১৮-১৯ সালে রাজ্যের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যেমন যাদবপুর, কলকাতা এবং প্রেসিডেন্সিতে মুসলমান শিক্ষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৮, ১৯ এবং ১৭। রাজ্যের কলেজগুলিতে ২০১৮-১৯ সালে শিক্ষকদের ৭.৮ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ, ২০১২-১৩ সালে যা ছিল ৩.১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের ১৪ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের, কলেজের ক্ষেত্রে যা ১২.৫ শতাংশ। আবারও কিছু বিখ্যাত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা নগণ্য। মনে রাখতে হবে, রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে ২৭ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম। যতটুকু প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে, তা ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া অংশকে সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য হয়েছে বলে মনে হয়। উপরের তথ্য প্রমাণ করছে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের মানুষেরা পিছিয়ে রয়েছেন। সত্যিই মুসলমান তোষণ হলে কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হত?
স্ন্যাপ-গিল্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে সমস্ত ব্লকে মুসলমান জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের কম, সেখানে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের জন্য ২.৩ হাসপাতাল রয়েছে। অথচ, যে-সমস্ত ব্লকে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি মুসলমান মানুষের বাস সেখানে প্রতি লক্ষ মানুষের জন্য হাসপাতাল রয়েছে মাত্র ১.৪। হাসপাতাল বেডের সংখ্যাও মুসলমান মানুষের জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্লকে কমছে। স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে মুসলমান এলাকায়, এই তথ্যই উক্ত প্রতিবেদন থেকে উঠে আসছে।
গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থায় পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষের উন্নয়ন করা সরকারের দায়িত্ব। সে কাজটা হচ্ছে কি?