ধর্ম যাঁর যাঁর উৎসব সবার। বাংলাদেশের মাটিতে বহুল চর্চিত ভাবনা। এই নিয়ে বিতর্ক আছে। পাল্টা শোনা যায়, ধর্ম যার যার, উৎসব তার তার। তবুও ‘উৎসব সবার’ করে তোলার ভীড়ে মানুষের কমতি নেই। ওপারের সীমানা ছাড়িয়ে এপার বাংলাতেও ডানা মেলেছে ভাবনাটা। আজও মানুষের মনে এই আবেগ শুকিয়ে যায়নি, মানুষের প্রতিবাদের ভাষায় এই বিশ্বাসটা ধরা আছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা তো প্রতিবাদে আছেনই; আছেন ধর্ম নির্বিশেষে মানুষে মানুষে সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী মুসলিমরা। এমনকি বহু জায়গায় শান্তিকামী ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও হামলার নিন্দায় পথে নেমেছেন। বহু টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে গড়ে ওঠা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা-বিশ্বাসটুকু ফিরিয়ে আনতে এই সময়ে সরকারের দায়-দায়িত্ব ছাপিয়ে মানুষের ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের এখনকার জরুরি কাজ সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি দাঁড়ানো। এতে জটিলতা আছে, খামতির পূর্ব নজির কিছু আছে। তার সমাধান বাংলাদেশকেই করতে হবে।
বিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত, কাছে অথবা দূরে যেখানেই সংখ্যালঘু মানুষের উপর অত্যাচার হোক, মানুষ প্রতিবাদ জানায়। ঘরের কাছে হলে একটু বেশিই আলোড়িত হয়। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনায় এপার বাংলায় বেশি করেই প্রতিবাদ হচ্ছে।
এপার বাংলায় প্রতিবাদ, তারও আবার রকমফের আছে। এটা আগে দেখা যায়নি। এমন অনেক মানুষ যারা আজ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসায় আগ্রাসী মেজাজে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসা তাদের কাছে ছিল নিছক দাঙ্গা এবং তার দায় মুসলিমদের। এই ক’দিন আগের ঘটনা, অসমে একচেটিয়া মুসলমান উচ্ছেদ, তিনজন মুসলিম হত্যা ও মৃতদেহ নিয়ে বর্বরোচিত ঘটনার থেকেও মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। তাদের কাছে সেদিনেরটা ছিল সংখ্যালঘু হয়ে সংখ্যাগুরুর মাথায় চেপে বসার ঔদ্ধত্য আর এদিনেরটা ‘উইপোকা’র উপদ্রব। প্রতিবাদ যারা করেছিলেন, তাদের মধ্যে কারো কারো ভাষা এখনকার মতো জীবন্ত ছিল না। এই ভীড় ঠেলে উঠে আসা সহমর্মিতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিবাদের যতটুকু বাংলাদেশের মাটিতে জেগে উঠবে, সেইটাই আশ্বস্ততা।
সংখ্যালঘু প্রশ্নটা দেশ-দশ নির্বিশেষে একই আবর্তে ঘুরে মরে। ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হলে তা তো ফালা ফালা হয়ে যায়। এখানে যে রহিম সেখ, ওখানে সে-ই রামা কৈবর্ত। সেই জায়গায় রাষ্ট্র হাত লাগালে রহিম-রামাদের দুর্দশা ঘোচায় কে?
বাংলাদেশে কোরান অবমাননার নামে সাম্প্রদায়িক হিংসার রেশ অকুস্থল ছাড়িয়ে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দেখিয়ে দেয়, দেশে মুসলিম মৌলবাদের ডালপালা বহুদূর ছড়ানো। ২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ছোট-বড় বহু সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন রাষ্ট্রীয় মদতের অভিযোগ ছিল। ২০০৯ সাল থেকে এখন অবধি একটানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে আছে। ২০১৮-য় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসে। মহাজোটের শাসনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপদের মধ্যে নেই। কিন্তু বিষয়টা এই পর্যন্ত নয় যে, সাম্প্রদায়িক হিংসা সময়ে সময়ে ঘটবে আর সরকার লাঠি-বন্দুক নিয়ে পিছন পিছন দৌড়বে।
বাংলাদেশে ২০১৮-র গণরায় পিছনের সাম্প্রদায়গত খারাপ দিনগুলোর বিপরীতে মানুষের আকাঙ্খার স্পষ্ট প্রতিফলন। সেখানে সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির ভাবনার সপক্ষে স্পষ্ট রাজনৈতিক অভিপ্রায় চাই। বর্তমান সরকার মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারছে কিনা, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির এখন প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা শুধু নয়, সাম্প্রদায়িকতার শিকড়ে আঘাত করা। সেই নিয়ে প্রশ্ন কিছু থেকে যায়।
পূর্ব পাকিস্তান ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুবরণের মূল্যে, সোয়া চার লক্ষ নারীর অমানুষিক লাঞ্ছনা-নির্যাতন সয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পূর্বাপর চেতনার দমে এমন এক সংবিধান দেশ হাতে পেয়েছিল, যা দেশভাগের গ্লানি মুছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভ্রান্তিকে সরিয়ে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চার মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সংবিধান দ্ব্যর্থহীনভাবে সমস্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। দেশের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫-এ পাকিস্তানপন্থীদের সামরিক অভিযানে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবরে পাঠানো হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সংবিধানের শুরুতে আনা হয় ইসলামীয় শব্দবন্ধ ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম)। ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদের আমলে সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ উল্লেখ করা হয়। এর বিরুদ্ধে তখনই আইনী লড়াইয়ে নামেন কবি সুফিয়া কামাল, ড. কামাল উদ্দিন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ পনেরজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই শক্তি সঞ্চয় করে। সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রারম্ভিক অবস্থান অর্থাৎ মূলনীতি ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে আসার পর সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অভিধা পুনরায় যুক্ত করে। কিন্তু জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে আনা ইসলামীয় অভিধা থেকেই যায়।
সংবিধান থেকে ইসলামীয় অভিধাগুলো সরিয়ে দিলেই সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেওয়া যাবে, তা নিশ্চয় নয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতায় প্রাতিষ্ঠানিকতা হারাবে। এটা হবে রাজক্ষমতার অভিমুখে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে একটা বড় বাধা। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক অবয়ব পাবে।
সংবিধানের মূলনীতির প্রারম্ভিক ভিত্তিতে ফিরে যাওয়ার পূর্ণ সযোগ সরকারের সামনে আছে। ২০০৯ থেকে একটানা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার চলছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সপক্ষে দেশে বিশাল জনমত রয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ)’এ বিচার আছে। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতি চলে গেছে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ তো আছেই। তবুও সরকার এখনও সাংবিধানিক জটিলতার পূর্ণ সমাধানের পথে এগোতে পারেনি। এই অপারগতা একটা মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি লগ্ন হয়ে আছে, কিন্তু তাঁর অবদানের ঠাঁই নেই।
কোরান-কাণ্ডে দেখা গেল, মূল পূজা মণ্ডপ সংলগ্ন আলাদা মণ্ডপে বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপূজার রীতির বাইরে গিয়ে রাম-সীতা-হনুমানের মূর্তি রাখা হয়েছিল। গত ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে হিন্দুদের এক বড়সড় প্রতিবাদ মিছিলে স্লোগান শোনা গেল, জয় শ্রী রাম, হর হর মহাদেব, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশে হিন্দু-মেরুকরণের চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশের হিন্দুদের লাভ কিছু নেই; লাভ মুসলিম মৌলবাদী শক্তির। এপার বাংলায় জয় শ্রীরাম থেকে হনুমান চালিশার রাজনীতিটা আমরা জানি। ওপার বাংলায় তার ছায়াপাতের রহস্যভেদ হওয়া দরকার। ট্র্যাজেডি এই যে, সেখানকার হিন্দু সমাজে সামাজিক ন্যায়ের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার গ্লানি আজ এইভাবে মুছে ফেলার প্রবণতা দানা বাঁধছে। পুরো ব্যাপারটায় একটা দায়-ভার আওয়ামী লীগ সরকারেও বর্তায়।
যে কথা দিয়ে এ লেখার শুরু, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানুষেরা এই বিশ্বাস নিয়ে মহাজোট সরকারের প্রতি চেয়ে আছে যে, এটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। ২০০৯ সাল থেকে একটানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস-ভরসায় মিলে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সেদিনের লড়াইয়ের চেতনা। সরকার যদি তার মর্যাদদানে দ্বিধান্বিত হয়, মানুষ কী করবে? সময় বিপদসঙ্কুল। আশা করা যায়, মানুষ সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দেবে না। এপার বাংলায় আমরা যারা অটুট মানব-সম্প্রীতির বাংলাদেশ দেখতে চাই, বাংলাদেশের সেই লড়াইয়ের দিনগুলো দেখে যাব, সংহতি জানাব নিশ্চয়। আর আমাদের এই বাংলায়ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতির জন্য লড়াই আছে, লড়াই চলবে। অনড় কাঁটাতার। এপার বাংলা-ওপার বাংলা সুখে না হোক, এভাবে দুঃখেই মিলিত হোক।
তথ্যসূত্র:
১) ‘বাংলাদেশে পুজো বেড়েছে ৪৮৩টি’, আনন্দবাজার ০৫ অক্টোবর ২০১৯
২) শাহরিয়ার কবির, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দ্বৈরথ’, বিজনেস বাংলাদেশ ডট কম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১