এবছর বাংলাদেশে শারদোৎসব চলাকালীন কুমিল্লার একটি পুজো মণ্ডপে হনুমানের কোলে কুরআন শরীফ রাখার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুর্গাপুজো মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর এবং তার পরবর্তী হিংসার ঘটনা বাংলার এপার ওপার সবার জন্যই এক অপার বিষাদময় শারদ স্মৃতি হয়ে রইলো। ধর্মীয় মৌলবাদী বা অধর্মের কারবারিদের ক্ষমার অযোগ্য এই বর্বরতা এবং সহিংসতায় স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালি সভ্য সমাজ ব্যথিত, বিরক্ত এবং বীতশ্রদ্ধ। এইসব ঘৃণ্য ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা শুধু বাংলাদেশকে নয়, বৃহৎ বাংলার আপামর বাঙালিকেই কলঙ্কিত করেছে, ঠিক যেভাবে নেলীর জন্য কলঙ্কিত হয়েছিল অসমীয়া সমাজ, আর একইভাবে দাদরির জন্য কলঙ্কিত হয় হিন্দি বলয় ।
এই তিনটি সংস্কৃতির সঙ্গেই আমার একটা আত্মিক যোগ রয়েছে – তার কারণ আমি একটি বাঙালি পরিবারের ছেলে, চিন্তায়-চেতনায় একজন বাঙালি; আমার জন্ম আসামে এবং বেড়ে ওঠা বাঙালি-অসমীয়া সংস্কৃতির সমন্বয়ের একটা পরিবেশে; আর কর্মসূত্রে হিন্দিবলয়ে কয়েকটি বছর কেটেছে, যে অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অজস্র সুখ-দুঃখের স্মৃতি। তাছাড়া আমি একজন অসমীয়া ভাষার বাঙালি শিক্ষক এবং হিন্দি ভাষার বাঙালি শিক্ষিকার সন্তান। বাঙালি হিসেবে আমি যতই গর্ব করিনা কেন, এই তিনটি সংস্কৃতির প্রতিটিই আমার অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই তিনটের একটাকেও বাদ দিয়ে আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। সবক্ষেত্রেই সকল সমাজের মানুষের সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে মেলামেশা রয়েছে আমার। যেখানেই থেকেছি, সেখানেই অগণন মানবিক মনের মানুষ এসে সামিল হয়েছেন আমার বন্ধুবৃত্তে। স্বাভাবিক ভাবেই উপরোক্ত সবকটা অমানবিক ঘটনাই আমাকে ব্যথিত করেছে। বিশেষ করে আশির দশকের নেলী, যা আমাকে আশৈশব তাড়া করেছে। আর একইভাবে সাম্প্রতিক কুমিল্লার ঘটনা এবং তার পরবর্তী সব নারকীয় কাণ্ড আমাকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়াবে।
নেলীর হত্যাকাণ্ড আমার মনে একটা গভীর রেখাপাত করেছিলো, আমি তখন স্কুলে পড়ি, আমার দিদার বাড়িতে থাকতাম। দুয়েকদিন পরপরই দেখতাম কিছু অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত (আগে এক বা একাধিকবার দেখেছি এমন) লোকজন আসছেন ঐ বাড়িতে। আস্তে আস্তে জানতে পারতাম এঁরা আমাদের নিকটাত্মীয় বা দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা এই পরিবারের পূর্বপরিচিত। তাঁদের বাড়িঘর নওগাঁ জেলার বিভিন্ন জায়গায়। বড়মাপের কিছু একটা বিপদ ঘটেছে, তাই এক কাপড়ে বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। হাইলাকান্দিতে নিকটাত্মীয়, দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা অন্যান্য পরিচিতজনের বাড়িতে যে যেভাবে পেরেছেন আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ এক বছরেরও বেশি সময় এভাবেই ছিলেন। কীভাবে পালিয়ে এলেন, কীভাবে সেই গণহত্যা চলছিলো সেইসব তাঁদের মুখে শুনতাম। আমার দাদুরই এক ভাই নাকি প্রাণ বাঁচাতে একটি পুরনো কবরের গর্তে লুকিয়ে সারারাত কাটিয়েছিলেন, বহু বছর পর আমার মায়ের সেই কাকুর সঙ্গে আমার দেখা হয় আমাদের বাড়িতে। জানতে পারি তাঁরই সমবয়সী পরিচিত আরেকজনকে মসজিদে যাওয়ার পথে আটকে দেয় খুনিরা, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে অনুরোধ করেন মেরে ফেলার আগে যেন তাঁকে নামাজটা আদায় করতে দেওয়া হয়, কিন্তু যারা হিংসা, ঘৃণা এবং নরসংহারের উৎসবে মাতোয়ারা ছিলো, তাদের কাছে এই আকুতির কানাকড়িও মুল্য থাকার কথা নয়, তাদের যা করার তারা তাই করেছিলো।
এই গণহত্যায় যারা ঘটিয়েছিলো তারা ঠিক কারা, কেন হয়েছিল এইসব হত্যাকাণ্ড তার গভীরে গিয়ে ভাবার মতো চিন্তাশক্তি আমার স্কুলজীবনে আমার মধ্যে তৈরি হয়নি। বিষয়টি আস্তে আস্তে বুঝতে চেষ্টা করি যখন কলেজে পড়ি। তৎকালীন দুয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও খানিকটা ভাবায়। এরকম দাঙ্গার সাথে প্রথম পরিচিতি ঘটে নব্বইয়ের দশকের একেবারে শুরুতে। আমি তখন শিলচরের গুরুচরণ কলেজের ছাত্র, আমার দাদা পড়ত হাইলাকান্দির শ্রীকিষণ সারদা কলেজে। বাবরি নিয়ে যখন দেশজুড়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে, বাড়ি থেকে তখন আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাইলাকান্দি ফিরতে বলা হয়। বরাক উপত্যকায় হাইলাকান্দিতেই প্রথম দাঙ্গা হয়, যেদিন বিকেলে আমি বাড়ি ফিরি সেদিনই। দাদার কাছে জানতে পারি সবকিছুই নাকি একেবারে অতর্কিতভাবে হয়। একটি পিরিয়ডের ক্লাস শেষ হওয়ার পর দাদার এক সহপাঠী নাকি ওর কাছে ওর খাতাটা চায়, কিছু একটা নোট করা ওর বাকি ছিলো তাই। এর কিছুক্ষণ পর বাইরে চেঁচামেচি শুনে তারা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে দুই সম্প্রদায়ের ছাত্ররা পরস্পরের দিকে তেড়ে আসছে। দাদার সেই সহপাঠীই নাকি অন্যপ্রান্তে গিয়ে একটা আদলা ইট ছুড়ে দাদাকে আঘাত করে। এরপর দিন দুয়েক উত্তাল ছিলো হাইলাকান্দি শহর। বর্বরোচিত লুটপাট, ভাঙচুর আর মারামারি। দুটি সম্প্রদায় পরস্পরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে পাশবিক উম্মত্ততায়। তখন অনুমান করি এরকম ভাবেই হয়তো শুরু হয়েছিলো নেলীতে, তারপরই হয়তো সেটা গণহত্যার রূপ নেয়।
তখন আমি নৃতত্বের ছাত্র, তাই প্রতিটি বিষয়ের আপেক্ষিক গুরুত্বটা মনে জায়গা পেতে শুরু করে। কোনো কিছুকেই ভালো বা খারাপ বলে গ্রহণ বা খারিজ করার প্রবণতাটা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এতে গুরুচরণ কলেজের পরিবেশের অনেকটা কৃতিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে নৃতত্ব বিভাগে শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এঁদের অধিকাংশই আবার চরম দক্ষিনপন্থী, যা আমার একেকবার অদ্ভুত লাগতো। যাঁদের মতাদর্শের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই তাঁরাই আমার ভালোবাসার মানুষ, আর তাঁদের কাছেই আমি পরম প্রিয়জন। এইসব ভেবেই আরও কিছুটা বিশ্লেষণমুখী হওয়ার চেষ্টা করতাম সবকিছুতেই।
ততদিনে নেলীর ঘটনাটার প্রেক্ষিতটাও আরও কিছুটা পরিস্কার হয়। গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে অসমীয়া সমাজের সঙ্গে একাত্মতা তৈরি হয়, ক্রমে ক্রমে অসমীয়া সমাজেও একটি বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়। একসময় উপলব্ধি হয়, যাঁদেরকে মারা হয়েছিল বা যাঁরা এই হত্যালীলা চালিয়েছিলো তাঁরা সবাই আমার আপনজন। সেই ধারণা আজও পাল্টায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক অভিসন্ধিগুলো ও পরিস্কার হয় আস্তে আস্তে। আজ মনেহয় তার পুরোটাই পরিস্কার, পুরোটার পেছনেই কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। সেই গণহত্যার কিন্তু কেউ বিচার পায়নি, আজ তার সম্ভাবনাও নেই বললে চলে।
আমার বোধোদয়ের পর থেকেই যতসব সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং তারসঙ্গে জড়িয়ে অনেকগুলো হিংসার ঘটনার সাক্ষী হয়েছি, সেগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারস্পরিক যোগাযোগ রয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আসামে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাবলীর সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতির একটা যোগসুত্র আমি পাই, কিন্তু আমার অসমীয়া বন্ধুবৃত্তের অনেকেই তা এককথায় নস্যাৎ করে দেন। তাঁরা এখনো আসামের বৃহত্তর সমাজের একাংশকে অবলীলায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী বলে থাকেন। নেলীতে যাঁদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিলো তাঁরা সেই সমাজেরই লোকজন। তখন বিদেশী তাড়ানোর হুজুগ তুলে এসব নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। অথচ এঁদের পূর্বপুরুষরা দেশভাগের অনেক আগে থেকেই এই মাটিতেই রয়েছেন।
অসমীয়া সমাজে এঁরা সবাই যে বাংলাদেশী এমন একটা ধারণা নির্মাণ করা হয়েছে বহুকাল ধরে। অথচ এই বাংলাভাষীরা তাঁদের অস্তিত্বের মৌলিক উপাদানটি বিসর্জন দিয়ে অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন, আর এঁদের জন্যই অসমীয়া আজ আসামে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। দুর্গোৎসবের কিছুদিন আগে এরকম একজন কল্পিত বাংলাদেশী পুলিশের হাতে প্রাণ হারান। তাঁর মৃতদেহের উপর একজন সরকারি ফটোগ্রাফার ক্রমাগত চরম উল্লাসে লাফাতে থাকেন। যাঁদেরকে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করে নিগ্রহ করা হয়, তাঁদের কথাগুলো তো প্রতিবেশি বাংলাদেশেও পৌঁছে যাচ্ছে নিমেষে, যেখানে কিনা সেই সম্প্রদায়েরই কিছু কট্টর মৌলবাদী সংগঠন বার বার মাথা চাড়া দেবে বলে মুখিয়ে থাকে। এবার তারা সাম্প্রদায়িক হিংসার একটা কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগিয়েছে।
তবে এই ঘটনাগুলির পারস্পরিক যোগসাজশ যাই থাকুক বা না থাকুক, এইমাসে বাংলাদেশে দুর্গোৎসবকে ঘিরে যে অমার্জনীয় নারকীয় ঘটনাবলী ঘটানো হয়েছে, তা আমাদের সভ্যতাকে সহস্র যোজন পিছিয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা। কেউ কেউ আবার পাল্টা সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে নেমেছেন, যা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক মহলেও কাউকে তেমন কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম নয়, দুর্ভাগ্যক্রমে হয়তো শেষ ও নয়। এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে যাঁরা প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হিংসার ক্ষেত্রেই একইভাবে লজ্জিত হয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন, বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন এবং অপরাধীর শাস্তির জন্য জোরালো দাবী তুলেছেন। এরকম কুকর্মের বিরুদ্ধে যাঁরাই প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই যিনি বা যাঁরা অপরাধী অথবা ঘটনার শিকার, তাঁর বা তাঁদের পরিচিতি দেখে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধেমতো পরিসর আগে বেছে নিয়েছেন, তারপর প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। অথচ গণপ্রতিবাদ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল সময়ের দাবি, সভ্যতার দাবি।
আমাদের অনেকেই এরকম পরিস্থিতিতে নীরব থাকা পছন্দ করি বা নিরাপদ মনে করি। যখন চুপচাপ থাকি তখন হয়তো ভাবি –
মরেছে মরুক মোল্লা-কাফির,
আমার কী বা যায় আসে তাতে?
আমি তো রয়েছি দিব্যি বেঁচেবর্তে,
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে”।
তবুও কিছু মানুষ এগিয়ে আসেন, সবরকম মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা বা সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু যাঁরাই জাতপাত সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবাদমুখর হয়ে থাকেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজে তাঁরা বরাবরই নিজ নিজ সম্প্রদায়ে অপ্রিয় হয়ে যান, আর বৃহত্তর সমাজে সংখ্যালঘু হয়ে যান। সেই ভয়েও হয়তো অনেকেই চুপ থাকেন। ইতিহাস সাক্ষী - এভাবে নীরব থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়।
যাইহোক বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ এই সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। এই বাংলায়ও অনেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। কিন্তু কিছু কিছু প্রতিবাদের ধরণ-ধারন এখনও ভাবাচ্ছে। সেই গতে বাঁধা আমরা-ওরা চলছে। এইভাবে বেছে বেছে প্রতিবাদী হওয়াটাও কম বড় অপরাধ নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তার পরবর্তী হতাশা, আক্রোশ এবং প্রতিবাদ যার যার তার তার হয়ে গেলে সেটা পরবর্তী দাঙ্গার ইন্ধন যোগানো ছাড়া আর অন্য কোনো কাজেই আসেনা। আমার মনে হয় এর দায় আমরা কেউ এড়িয়ে যেতে পারিনা, কেউই না! শুভ বোধের উদয় হোক এই কামনাই করি অন্তহীন আন্তরিকতায়। সবরকমের সহিংসতার বিরুদ্ধে সকলকেই সমান সক্রিয়তায় এগোতে হয়। প্রতিবাদ আর প্রতিহিংসার মাঝখানে সুতোটা খুবই সুক্ষ্ণ, এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করলে আবার সেই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এবং একইরকম সহিংসতার প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।