দেখা যাক, পাঁচ বছরে অতিরিক্ত ৩১৮ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে সরকার কী কী করতে পারে?
সর্বজনীন পুষ্টি
দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হয় রেশনে। খরচ হয় বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। যদি খাদ্যশস্যের সঙ্গে পরিমাণ মতো দানাশস্যও দেওয়া হতো, তাহলে ধরা যাক আরো ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হত। এর সঙ্গে যদি ভোজ্য তেলও বিনামূল্যে দেওয়া হতো তাহলে ধরা যাক মোটের ওপর আরও ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হতো। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে মোট ২০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হত ষাট শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, দানাশস্য এবং ভোজ্য তেল দিতে। ধরা যাক, এর আওতায় ৯০ শতাংশ মানুষকে আনা হল। তাহলে খরচা হত দেড় গুণ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা।
সর্বজনীন পাকা বাড়ি
হিসেব বলে, আমাদের দেশে ৬০ শতাংশ পরিবারের আলাদা রান্নাঘর, বাথরুম, পায়খানা, ও নিকাশি বিশিষ্ট পাকা ঘর আছে। কিন্তু ৪০ শতাংশ পরিবারের তা নেই। আমাদের দেশে গড়ে সওয়া চারজনে একটা পরিবার ধরলে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে পরিবারের সংখ্যা ৩০ কোটির একটু বেশি। তার চল্লিশ শতাংশ মানে ১২.২ কোটির মতো। তাদের রান্নাঘর, বাথরুম, পায়খানা ও নিকাশি বিশিষ্ট পাকা ঘর তৈরি করে দিতে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টাকা করে যদি খরচ হয়, তাহলে মোট খরচ ৬১ লক্ষ কোটি টাকা।
সর্বজনীন স্কুল শিক্ষা
আমাদের দেশে সরকারি স্কুল শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে দিল্লি। দিল্লির সরকারের এই কারণে খরচ হয় বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। দিল্লির জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লক্ষ। অর্থাৎ স্কুল শিক্ষায় জনপিছু (সাবধান! ছাত্রপিছু নয়) দিল্লি সরকারের বছরে খরচ ৫১৫১. ৫১ টাকা। দিল্লিতে মোট স্কুল পড়ুয়ার ৪০ শতাংশ মতো সরকারি স্কুলে পড়ে। যদি ধরে নেওয়া হয়, পরিকাঠামো পর্যাপ্ত হলে এবং শিক্ষার মান পর্যাপ্ত হলে ৯০ শতাংশ পড়ুয়া সরকারি স্কুলেই পড়বে, তাহলে দিল্লিতে সরকারের জনপিছু স্কুল শিক্ষায় খরচ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১১, ৫৯০ টাকা বছরে। সারা ভারতে যদি এই পরিমাণ খরচকেই স্কুল শিক্ষায় মান্য সরকারি খরচ ধরা হয়, তাহলে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার জন্য বছরে খরচ দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে তা হবে ৭৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা
আমাদের দেশে সরকারি জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও দিল্লি সরকার সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের খরচ হয় বছরে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো। দিল্লিতে প্রায় ৪৭ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাই নেয়। যদি এটা বেড়ে নব্বই শতাংশ হয়, তাহলে খরচ দাঁড়ায় ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, তিন কোটি তিরিশ লক্ষ জনংখ্যার দিল্লিতে জনপিছু বছরে ৫১৫১. ৫১ টাকা খরচ করলে ৯০ শতাংশ মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনা সম্ভব। সারা ভারতের ক্ষেত্রে এটা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে দাঁড়ায় ৩৩ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সর্বজনীন বিদ্যুৎ
হিসেব বলে, আমাদের দেশে যদি নব্বই শতাংশ গৃহস্থ বাড়ির বিদ্যুতের বিল নিঃশুল্ক করতে হয়, তাহলে বছরে খরচ হয় বাজেটের চার শতাংশের মতো। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে কুড়ি শতাংশের মতো। দেশের বার্ষিক বাজেট ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো, অর্থাৎ সর্বজনীন বিদ্যুৎ খাতে পাঁচ বছরে খরচ মোট ৯ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
সর্বজনীন গণপরিবহন
আমাদের দেশে গণপরিবহন বলতে ট্রেন বাস স্টিমার ইত্যাদি। এখন ট্রেন আর ক্ষতিতে চলে না, প্রায় একশ শতাংশ অপারেটিং রেশিওতে চলে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, টিকিটে কোনও ভর্তুকি দেওয়া হয় না। ট্রেনে অসংরক্ষিত টিকিট বেচে রেলের আয় হয় বছরে ১৪.৬ হাজার কোটি টাকার মতো (২০২২-২৩ অর্থনৈতিক বর্ষের হিসেব)। যদি ট্রেনের অসংরক্ষিত ভাড়া মুকুব করে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ পয়সা খরচ এবং টিকিট কাটার হ্যাপা থেকে বাঁচে। সংরক্ষিত টিকিট বেচে রেলের বছরে আয় হয় আরো ৪৮.৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে শুধু স্লিপার এবং এসি থ্রি টায়ার টিকিট বেচে আয় যদি ধরে নিই এর অর্ধেক, অর্থাৎ ২৪.৪ হাজার কোটি টাকার মতো; তাহলে ২৪.৪ ১৪.৬=৩৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে ট্রেনের এসি থ্রি টায়ার অবদি ভাড়া মুকুব করা যেতে পারে। পাঁচ বছরে তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ধরা যাক, একই পরিমাণ খরচ হবে বাসের ক্ষেত্রেও। তাহলে পাঁচ বছরে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করলে এসি থ্রি টায়ার অবদি ট্রেন যাত্রা এবং সমস্ত ধরনের বাসযাত্রা নিঃশুল্ক করে দেওয়া সম্ভব।
সর্বজনীন টেলিযোগাযোগ
আমাদের দেশে যতখুশি ফোন, এসএমএস, এবং দৈনিক ২ জিবি ইন্টারনেট ডাটার বাৎসরিক খরচ খুব বেশি হলে ৩০০০ টাকার মতো। যদি দেশের ৯২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সবারই স্মার্ট ফোন থাকে, তাহলে তাদের মোট এই বাবদ বাৎসরিক শুল্ক ২ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরে ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এটাও নিঃশুল্ক করে দেওয়া সম্ভব।
অর্থাৎ পুষ্টি, পাকা বাসা, স্কুল শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিদ্যুৎ, গণপরিবহন, এবং টেলিযোগাযোগ— এগুলি যদি সর্বজনীন হয়; অর্থাৎ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের জন্য নিঃশুল্ক হয় তাহলে পাঁচ বছরে মোট খরচ হয় ৩০ ৬১ ৭৫ ৩৩.৫ ৯ ৪ ১৩.৮=২২৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
অর্থাৎ, এগুলো নিশ্চিত করার পরও সরকারের হাতে পাঁচ বছরে ৯২ লক্ষ কোটি টাকা পড়ে থাকে।
সেই টাকায় প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের ৯০ শতাংশকে (৪০ কোটির মতো) বছরে কুড়ি হাজার টাকা করে দেওয়া সম্ভব। তাতে খরচ পাঁচ বছরে ৪০ লক্ষ কোটি টাকা।
বেকার ও প্রায়-বেকার (৮ কোটি) এবং ৯০ শতাংশ ষাটোর্ধ মানুষকে (১২ কোটি: আমাদের দেশে জনসংখ্যার দশ শতাংশ ষাটোর্ধ) বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেওয়া সম্ভব। তাতে পাঁচ বছরে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ।
না, সম্পত্তি পুনর্বন্টনের জন্য সচ্ছল মধ্যবিত্ত তো নয়ই, এমনকি ধনীদের (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ১% ব্যক্তি, কিন্তু যারা অতিধনী বা ভীষণ-ধনী বা বেশ-ধনী নয়) সম্পত্তিতেও হাত দেওয়ার দরকারই নেই। শুধু অতিধনী, ভীষণ-ধনী ও বেশ-ধনীদের সম্পত্তির যথাক্রমে অর্ধেক, সিকিভাগ ও দশমাংশ আদায় করলেই এগুলো সম্ভব।
আগের কিস্তিটি পড়ুন।