প্রায় সাথে কাতার বিশ্বকাপে অস্তমিত হল এশিয়ার আশা-আকাঙ্খা। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এশিয়ার মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপের মূলপর্বের মঞ্চ থেকে বিদায় নিল বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় নিজেদের জায়গা করে নেওয়া এশিয়ার দুই শেষ প্রতিনিধি দেশ- জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। তবে দুই দলের বিদায় নেওয়ার ভঙ্গিতে বিস্তর পার্থক্য ছিল। সূর্যোদয়ের দেশ জাপান যেখানে বিদায় নিল বিগত রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্সদের সঙ্গে তুল্যমূল্য লড়াই করে ফুটবল বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে সেখানে ব্রাজিলের ফুটবল আগুনের দাবানলে ঝলসিয়ে গেল জাপানেরই পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া।
জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া ইউরোপীয় তথা বিশ্বফুটবলের মহাশক্তিধর দুই দেশ যথাক্রমে স্পেন ও পর্তুগালকে হারিয়ে বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় জায়গা করে নিয়ে আশা জাগিয়েছিল এশিয় ফুটবলের অগ্রগতি সম্বন্ধে। ২০০২ সালে দেশের মাটিতে দক্ষিণ কোরিয়া বিতর্ককে সঙ্গে করে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌছেছিল কিন্তু তার আগে পড়ে কোনও এশিয় দেশই বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি। গ্রুপ পর্বে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল সেই আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু কয়েকঘন্টার ব্যবধানে এই আশা হতাশায় পরিণত হল।
জাপান তবে লড়াকু ফুটবল খেলে নিজেদের প্রতি সম্ভ্রম বাড়িয়ে নিল। বিগত বিশ্বকাপের বিদায়ী ম্যাচে জাপান একসময় বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষপর্যন্ত ২-৩ গোলে পরাজিত হয়। রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে জাপান সমানে সমানে লড়াই করল। প্রথমার্ধের ৪৩ মিনিটে সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে জাপানের দেইজেন মায়েদা জাপানকে এগিয়ে দেন। যদিও জাপানের এই অগ্রগমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণের চাপ বাড়ায় ক্রোয়েশিয়া। খেলার ৫৫ মিনিটে ফ্রিক থেকে গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরান আইভান পেরিসিচ। ক্রোয়েশিয়া দলের সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় পেরিসিচ যেভাবে এখনও প্রতিম্যাচে নিজের ইউটিলিটি প্রমাণ করে চলেছেন তাতে তার ফুটবল সাধনা আর অধ্যবসায়কে কুর্নিশ জানাতেই হয়। নির্ধারিত সময়ের বাকি সময় খেলা চলল আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে ভর করে। তবে অতিরিক্ত আধঘন্টার খেলায় দুই হাফেই চাপ বাড়ালো ক্রোয়েশিয়া কিন্তু জাপানের সশক্ত রক্ষণভাগ ক্রোটদের কাঙ্খিত গোল পেতে দেয়নি। সেইসময় জাপানি ডিফেন্স চাপের মুখে অনড় ছিল। কিন্তু টাইব্রেকার পেনাল্টিতে গিয়ে জাপানিরা নার্ভ ফেল করল। জাপানের নেওয়া চারটের মধ্যে তারা মাত্র একটি পেনাল্টিকেই গোলে পরিণত করতে পারল। গোল করলেন আসানো। লিভাকোভিচ জাপানের তিনটি পেনাল্টি আটকে টাইব্রেকারে পেনাল্টি আটকানোর হ্যাটট্রিক করলেও তার কৃতিত্বকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেও বলতে হচ্ছে জাপানি খেলোয়াড়রা তিনটি পেনাল্টিই মেরেছিলেন অত্যন্ত জঘন্য। সবকটি মাটি ঘেঁষা শটই ছিল দুর্বল এবং দীর্ঘদেহী ক্রোট গোলরক্ষক লিভাকোভিচের নাগালের মধ্যে। দুর্দান্ত লড়াই করেও এবারের বিশ্বকাপে শেষ ষোলোতে এসেই অভিযান শেষ করতে হল জাপানকে। কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার ছাড়পত্র পেতে অবশ্য ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ ইগর স্টামাকের দেশের খেলোয়াড়দের টাইব্রেকার পর্যন্ত লড়ে যেতে হল।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্রাজিলের বিরুদ্ধে শুরুটাই হল দুঃস্বপ্নের মত। ম্যাচ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্রাজিল ঝড় আছড়ে পড়ল কোরীয়দের ওপর। মাত্র সাত মিনিটেই ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের শিকারি বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়া আক্রমণ থেকে প্রথম গোল করে গেলেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। পাঁচ মিনিট পরেই ব্রাজিল পেনাল্টি আদায় করে। যদিও পেনাল্টিটা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত, রিচার্লিসন কিছুটা প্লে-একটিং করে সেটা আদায় করেন। পেনাল্টি থেকে নিজস্ব ভঙ্গিতে গোল করে ব্যবধান বাড়ান নেইমার। ঘানার বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে পড়েও দুর্দান্তভাবে দুটি গোলই শোধ করে একসময় খেলায় ফিরে এসেছিল দক্ষিণ কোরিয়ে। কিন্তু ব্রাজিল ঘানা নয়, ব্রাজিলের জোগো বোনিতোর সৌন্দর্য কে বিপক্ষের পক্ষে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল দক্ষিণ কোরিয়া। নেইমারকে ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে তারা দুরমুশ করা শুরু করল কাতার বিশ্বকাপের শেষ এশিয় প্রতিনিধিদের। ২৯ মিনিটে করা রিচার্লিসনের গোলটি এই ম্যাচে তো বটেই নিঃসন্দেহে কাতার বিশ্বকাপের এখনও পর্যন্ত সেরা গোল। গোল নয় যেন এক লোকসঙ্গীতের ছন্দ। সাম্বার ছন্দে জোগো বোনিতোর ছটায় ছন্দবদ্ধ আক্রমণে কোরীয় রক্ষণভাগকে তছনছ করে দিয়ে গোল করলেন রিচার্লিসন, না রিচার্লিসন একা নন, বলা ভালো পুরো ব্রাজিল দলটাই যেন এই গোলটা করল। তারপরে ব্রাজিলের আক্রমণের ঝাঁঝ আরও বাড়ল আর ৩৬ মিনিটে পাকুয়েতা ব্রাজিলের চতুর্থ গোলটি করে ফেললেন। বিরতির আগেই ব্রাজিলের হাফ-ডজন গোলে এগিয়ে যাওয়ার কথা, আর যে গোলসংখ্যা বাড়ল না তার কারণ কোরীয় গোলরক্ষকের দুটি অসাধারণ সেভ আর কিছুটা গোল হারানোর ব্যাপারে ব্রাজিলের দুর্ভাগ্য। নইলে এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলকারী দেশের গোলসংখ্যা প্রথমার্ধেই আরও বাড়ার কথা।
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য প্রথমার্ধের ব্রাজিলকে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ার্ধ ব্রাজিল শুরু করল অনেকটা ঝিমিয়ে। হয়ত তাদের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিপক্ষকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিধ্বংসী রূপ দেখাতে চাইলেন না তিতে। সেইসঙ্গে রিজার্ভ বেঞ্চের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে নামিয়ে নতুন কিছু পরীক্ষা করে দেখে নিতে চাইলেন তিনি। সেই সুযোগে দক্ষিণ কোরীয়রা নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারল। সারা প্রথমার্ধ জুড়ে সেভাবে মাঝমাঠই অতিক্রম করতে পারেনি কোরীয়রা, এবারে দ্বিতীয়ার্ধে তারা কিছু আক্রমণ তুলে আনল। ৭৬ মিনিটে সেই সুযোগে পাইক সিউং-হো একটা চোখ জুড়ানো গোল করে ব্যবধান কিছুটা কমিয়ে এশিয় ফুটবলের কিছুটা মুখরক্ষা করতে চাইলেন। গোলের পর বাকি সময় আবার দেখা গেল জোগো বোনিতোর ছটা, আবার সাম্বার ছন্দেই যেন দুলে উঠল হলুদ জার্সি। যদিও আর গোলসংখ্যা বাড়েনি কিন্তু ব্রাজিল বুজ্ঝিয়ে দিল তাদের প্রতিভার ছটা কোন পর্যায়ে পৌছতে পারে। এই ফুটবল নিঃসন্দেহে অসুস্থ ফুটবল সম্রাটকে কিছুটা হলেও আনন্দ ও প্রশান্তি দেবে। ব্রাজিলের এবারের কাতার বিশ্বকাপের দলটা কিন্তু বারেবারেই সুন্দর ফুটবলের পরিচয় রাখছে, একাধিক প্রতিভার উজ্জ্বল শিখায় দীপ্যমান তিতের এই দলটি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে ব্রাজিলের সবচেয়ে প্রতিভাধর ও আকর্ষক দল তেলে সান্তানার প্রশিক্ষণাধীন ব্রাজিল কিন্তু ১৯৮২-র স্পেন বিশ্বকাপ ও ১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে কিন্তু জোগো বোনিতোর উজ্জ্বল ছটা ছড়িয়েও কিন্তু বিশ্বকাপ জয় করতে পারেনি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ (৫ বার) বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ লুকা মডরিচের ক্রোয়েশিয়া। যদিও এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ রানার্সরা তাদের রাশিয়া বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের ধারেকাছেও পৌছতে পারেনি এবং লুকা মডরিচও আগের বিশ্বকাপের ফর্মে নেই তবু দল হিসাবে ক্রোয়েশিয়া বরাবরই বিপজ্জনক, তবে ব্রাজিল নিঃসন্দেহে ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখের এই ম্যাচের আগে ধারে ও ভারে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। একটা অদ্ভুত জিনিস কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্রাজিলের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে রাষ্ট্রপতি লুলার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ফুটবল আগুন কিন্তু ঝলসে উঠছে লাল-জার্সির বিরুদ্ধেই। সার্বিয়া, সুইটজারল্যান্ড (১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে প্রথম সাক্ষতের ৭২ বছর পর কাতারেই প্রথম ব্রাজিল সুইটজারল্যান্ডকে হারালো) এবং দক্ষিণ কোরিয়া তিনটি দলই ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলে লাল জার্সি পরে এবং ব্রাজিল এই তিনটি দলের বিরুদ্ধে খেলেছে তাদের হলুদ চিরাচরিত ঐতিহ্যশালী হলুদ জার্সি খেলে। নীল জার্সি পরে তারা খেলেছিল অ-লাল রঙের জার্সি পরিহিত ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে এবং ঐ ম্যাচটিই তারা হেরেছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কাকতালীয়। তবে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া কোয়ার্টার ফাইনাল উপভোগ্য হবে আশা করাই যায়। তবে এ সবের মধ্যে এশিয়ার মাটিতে আয়োজিত হয়ে চলা ফিফা বিশ্বকাপ থেকে এবারের মত এশিয় স্বপ্নের এখানেই ইতি।