সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে সঙ্ঘপরিবারের মাথাব্যথাটা বড্ড বেশি রকমের উৎকট। কারণ বাঙালি আইকন যে আর পাওয়া যাচ্ছে না। শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে আর চলছে না। তাকে যতই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, বাংলার মানুষ তাঁকে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করছেন না, এটা বিজেপি-আরএসএসওয়ালারা ভালোই বোঝে। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রকে বাঙালিরা আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী, তীব্র ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি আইকন হিসেবে মান্যতা দিয়ে থাকেন। সমকালের বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এই সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছিল, তা-ও এই বিজেপি-আরএসএসঅলাদের মনে সুভাষচন্দ্রকে ‘আমাদের লোক’ হিসেবে গণ্য ও প্রতিষ্ঠা করার পথে একটা জুতসই ইস্যু হয়েছে। ফলে সুভাষচন্দ্রকে যদি কোনরকমে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা এবং কাজে লাগানো যায় তবে বাংলায় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির ভোটের ঘড়া অনেকটাই পূর্ণ হতে পারে।
আর মুখ্যত এই উদ্দেশ্যেই আরএসএস-এর প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি এবং বিজেপি সরকারের প্রধান নরেন্দ্র মোদি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর জন্মদিন ২৩ জানুআরির দিনটিকে সহসাই ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। গান্ধিজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক বিরোধের বিষয়টিকেও সুভাষচন্দ্রকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার ব্যাপারে বিজেপি-আরএসএসওয়ালারা অত্যাগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তো তাঁর ডায়েরিতে অবলীলায় লিখেছিলেন যে সুভাষচন্দ্র যখন সসৈন্যে সীমান্ত পার হয়ে এদেশের বিদেশি ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন নাকি তাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন!
আর সুভাষচন্দ্রের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদি তো আবেগের অতিশয়তার তাঁর ভাষণে বলেই ফেলেছিলেন : ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুআরি ভারতে নতুন এক সামরিক পরাক্রমের জন্ম হয়েছিল! আর এই সামরিক পরাক্রমের প্রতিভূ সুভাষচন্দ্র অবশ্যই ছিলেন ‘হিন্দু’! এখানেই মোদির রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি পরিষ্কার হয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত নেতারা সবসময়ই তাদের অন্বিষ্ঠদের মধ্যে হিন্দুত্বের আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে আনন্দবাজার পত্রিকার ৭ পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে দেখা গিয়েছে সুভাষচন্দ্র হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন যা এই হিন্দুত্ববাদীদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ১২ মে মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে সুভাষচন্দ্র এক সভায় বলেছিলেন যে হিন্দু মহাসভা তাদের দলের সাধু-সন্ন্যাসীদের মহাসভার হয়ে ভোটভিক্ষে করতে পাঠিয়েছে আর এভাবেই তারা ধর্মের নামে ভোটের রাজনীতি করেছে। সুভাষচন্দ্রের এই বক্তব্য দুদিন পর আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৪ মে) প্রকাশিত হয়েছিল।
জনৈক সুভাষ-গবেষক এই তথ্যকে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যে প্রচার হিসেবে প্রমাণ করার আপ্রাণ প্রয়াস পাওয়ার পর ব্যর্থ হয়ে অবশেষে এই সংবাদ প্রতিবেদনের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এত সহজে দমে না গিয়ে তিনি আবার লিখেছিলেন যে সুভাষচন্দ্র সাভারকারের বিরোধী ছিলেন না! আবার এই গবেষকই বলেছেন যে, সুভাষচন্দ্র সাভারকারের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার তীব্র সমালোচনা করা সত্ত্বেও সাভারকারকে রীতিমতো শ্রদ্ধা করতেন!—অর্থাৎ সুভাষচন্দ্রের মতো বাঙালি আইকনকে তাঁরা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চান না! কিন্তু এই ১২ মে-র বক্তব্যেই সুভাষচন্দ্র এই অভিযোগ করেছিলেন যে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ম্যুনিসিপ্যালিটি-র নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে হিন্দু মহাসভা-র জোট ভেঙে দিয়েছিলেন এই সাভারকারই। সুভাষচন্দ্র বিদেশি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই প্রধান এবং জনসাধারণের সাধারণ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দ্বিধাহীন ভাষায় বলেছিলেন যে হিন্দু মহাসভা কিম্বা মুসলিম লিগ—এদের কেউই ‘আমাদের’ শত্রু নয়, আমাদের শত্রুই হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
এর পাশাপাশি সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন : কংগ্রেসের মধ্যে দুটি দলের যে সৃষ্টি হয়েছে তার জন্যে দায়ী হিন্দু মহাসভাই। তাঁর মতে হিন্দু মহাসভা যদি নিজেদের কাজ করে এবং কংগ্রেসও তাদের নিজেদের কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারে তাহলে তো সমস্যা হয় না। কিন্তু হিন্দু মহাসভা তা না করে বারবার কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ‘অনিবার্য’ বিরোধের সৃষ্টি করে চলেছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন: হিন্দু মহাসভা যদি কংগ্রেসের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হয় তবে যখন বাংলার কংগ্রেস কর্মিরা কারান্তরালে ছিলেন তখন হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ কেন তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়নি, কেন বন্দি কংগ্রেস কর্মিদের মুক্তির দাবি করে নি?
সুভাষচন্দ্র সরাসরি হিন্দু মহাসভা-কে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’দের ঘাঁটি বলে আখ্যাত করে এই বক্তৃতায় বলেছিলেন : ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ব্যক্তিরা হিন্দু মহাসভার অভ্যন্তরে ঢুকে এই দলটিকে ‘কলুষিত’ করে তুলেছিল (এখানে অবশ্য এমন ধারণা করার অবকাশ থেকে যায় যে, সুভাষচন্দ্রের মতে হিন্দু মহাসভা দলটা খারাপ ছিল না, এইসব ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ লোকজন ঢুকেই মহাসভাকে ‘কলুষিত’ করেছে)!
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে যখন সাভারকার কলকাতায় এসে হিন্দু মহাসভার বাংলা য়ুনিট-টিকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন, সেইসময় সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই ‘ফরওআর্ড ব্লক’ শীর্ষক একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও তীব্র করে তোলার আহ্বান জানাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই পত্রিকার ৩০ ডিসেম্বর (১৯৩৯) সংখ্যায় তিনি সাভারকারের কলকাতা বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করে একে নিছক ‘গলাবাজি’ বলে আখ্যাত করেছিলেন। এই পত্রিকায় সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন : হিন্দু মহাসভা সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রচারের মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের জাতি ও জাতিয়তা সম্পর্কিত ধারণাটির অপরিসীম ক্ষতি করে চলেছে। মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি যে আবেগদীপ্ত আগ্রহের স্ফূরণ ঘটতে চলেছে সাভারকার তাকে সম্মান জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেন। সুভাষচন্দ্র একদিকে যেমন মুসলিম লিগ-কে বিদ্বিষ্টপরায়ণ বলে অভিহিত করেছিলেন, তেমনই একইসঙ্গে হিন্দু মহাসভাকে বলেছিলেন বিশ্রীরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ। অর্থাৎ এই দুই সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে তিনি আদৌ সুনজরে দেখেন নি।
সুভাষচন্দ্র তাঁর দর্শনগত দিক থেকেই হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধী ছিলেন। মতাদর্শিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে তিনি তাঁর ‘গুরু’ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকেই অনুসরণ করতেন। তিনি মুসলিম জনসাধারণকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য জনগোষ্ঠী বলে মনে করতেন। অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র কোনরকম সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুআরি তাঁর ‘ফরওআর্ড ব্লক’-এ তিনি লিখেছিলেন : সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিনষ্টি না ঘটলে সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ ঘটা সম্ভব নয়।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র তাঁর গৃহবন্দিত্বের আগে জিন্না এবং সাভারকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম লিগের সমর্থনের বিনিময়ে জিন্নাকে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রিত্বের আসনে বসানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর বিপ্রতীপে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার সমসময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা বিস্মৃত হয়ে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিরাপত্তার ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।—সুভাষচন্দ্র যেটা বলেন নি তা হলো : এসময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা যোগাতে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান রেখেছিলেন!
আর এরপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অগাস্ট আজাদ হিন্দ রেডিও-র মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর বক্তৃতায় সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন : সাভারকার এবং জিন্নার মতো দুই নেতাই ব্রিটিশ রাজশক্তির সঙ্গে আপস করার চিন্তাভাবনাতেই নিমজ্জিত রয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস এই যে সাতচল্লিশ-উত্তরকালে দেখা গিয়েছে, জিন্না এবং তাঁর সাকরেদরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তান নামক একটি নবজাত রাষ্ট্রের নেতৃত্বপদে বহাল হয়েছিলেন আর বিপরীতে সাভারকার এবং তাঁর সাকরেদরা এদেশেই থেকে দেশটা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের পথে নিয়ে চলেছেন এবং তাঁরা তাদের এই মিশনে বারবার সুভাষচন্দ্রকেই তাঁদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ক্রমাগত ব্যবহারের চেষ্টা করে চলেছেন এবং নিজেদেরই একমাত্র দেশপ্রেমিক হিসেবে জাহির করার প্রচেষ্টায় ব্রতবদ্ধ রয়েছেন।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন স্বাধীন ভারবর্ষের অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন, আর এর ঠিক আট বছরের মাথায় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের এই ২১ অক্টোবর তারিখেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গঠন করেছিলেন ভারতীয় জনসঙ্ঘ। এটা নাকি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের নিদর্শন! সেদিন দিল্লিতে এক বৃহৎ জনসভায় বক্তৃতাদানকালে শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন : আজ থেকে আট বছর আগে সুভাষচন্দ্র এই দিনে গঠন করেছিলেন আজাদ হিন্দ সরকার, আর আজ আমরাও এই দিনটিতেই ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুভাষচন্দ্রের সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যকেই বহন করবো এবং তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবো। সেই ভারতীয় জনসংঘ আজ বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির নামান্তরে সারাদেশ জুড়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের মহড়া দিচ্ছে। এটাই নাকি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকারের আদর্শিক ঐতিহ্যের অনুশীলন!
ধাপ্পাবাজির একটা সীমা থাকা উচিত। বিজেপি-আরএসএসওয়ালারা এই সীমাকে অবলীলায় অতিক্রম করে গিয়েছে।
কৃজ্ঞতাস্বীকার :
দ্য ওয়ার, মে ২৮, ২০১৯, জানুআরি ২৯, ২০২২, এবং এপ্রিল ১৫, ২০২৪
ওপিনিঅন, জুলাই ৬, ২০২৩
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী : লিভস ফ্রম আ ডায়েরি। অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস। কলকাতা। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ সংস্করণ।