সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে ওঠেন মহিদুল। ভারী কাজের তো প্রশ্নই ওঠে না। বুকে টান ধরে। মাঝে মধ্যে কাশতে কাশতে রক্ত ওঠে। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সেই যেন বুড়ো হয়ে গিয়েছেন মহিদুল মোল্লা। মিনাখাঁর গলদা গ্রামের এই যুবক একদিন চাষের কাজ ছেড়ে আসানসোলের এক পাথর ভাঙার কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। সে আট বছর আগের কথা। মিনাখাঁর বহু যুবকই এই কারখানাগুলোতে কাজ করেন। সেই সূত্রেই তাঁর যাওয়া। দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা মজুরি।
দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে বালাকৃষ্ণ মিনারেলস, তারা মা মিনারেলস, লক্ষী স্টোন ফ্যাক্টরির মতো কারখানাগুলি কেউ ফায়ার ব্রিকস উৎপাদন করে, কেউ-বা ব্রিকস কারখানার জন্য কোয়ার্টজ পাথরের পাউডার উৎপাদন করে। মহিদুল এমনই এক কারখানায় কাজ করতেন। তবে তাঁর না ছিল কোনও নিয়োগ পত্র, না শ্রমিক পরিচয় পত্র। থাকবে কী করে! এ জাতীয় কারখানাগুলির সিংহভাগের এমনই রীতি। কারখানা চত্বরেই কাটে তাঁদের এক রকম বন্দি জীবন।
মহিদুল কাজ করতেন বল মিল, গ্রাইন্ডার ইউনিটে। সাধারণ ভাবে এই কারখানাগুলোয় বড়ো বড়ো ক্রাশার মেশিনে পাথর ভেঙে ছোট ছোট টুকরোগুলি মিলিং মেশিনে ফেলে পাউডার তৈরি করে। সারা কারখানা জুড়েই উড়ে বেড়ায় এই পাথরের ধুলো বা পাউডার। আশেপাশের গাছপালা, কারখানার শেড সবই সারা বছর ধুলোর চাদরে ঢাকা থাকে। কোনও কোনও ইউনিটে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের যে দু'হাত দূর থেকে কেউ কাউকে দেখতে পায় না। এতই ঘন সেই ধুলোর ধোঁয়া । সারা শরীর, জামা-কাপড় ধুলোয় ধূসরিত হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক দেয় বটে, তবে তা কাজে লাগে না। মাস্কের সঙ্গে গামছা জড়িয়েও লাভ হয় না এমনটাই দাবি শ্রমিকদের। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সিলিকা কণা এতটাই মিহি যে সাধারণ ভাবে ব্যবহৃত মাস্কে তা রোধ করা যায় না। তা হলে প্রয়োজন এই মিহি ধুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপযুক্ত সুরক্ষা উপকরণ বা যন্ত্রপাতি। তার কোনও বালাই নেই এই সমস্ত কারখানায়। তবে মুখ দিয়ে খাদ্যনালীতে প্রবেশ করা সিলিকা পাউডার যথাসম্ভব পরিষ্কার হয়ে শরীর থেকে যাতে বেরিয়ে যেতে পারে তার জন্য সহৃদয় মালিকেরা কলা খেতে দেন। কিন্ত, শ্বাস প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে জমা হয় এই ধূলিকণা। ফুসফুস পাথর কণা জমে জমে শক্ত হয়ে ওঠে। ফুসফুস অচল হয়ে কাজ করার ক্ষমতা হারায় শ্রমিকও।
গত ৪ এপ্রিল দিল্লিতে এই প্রথম সাফাই কর্মচারীদের সংগঠন 'সাফাই কর্মচারী আন্দোলন' মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকারের দাবি তুলে নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করছে। শহরের তাবড় আস্তাকুঁড়, নিকাশি নালা, ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী, আবর্জনার বৃহৎ তাগাড়, মরা পশুদের ভাগাড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে যাঁরা নগর ও নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষা করেন সেই সব দলিতের দলিত 'ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার' বা ধাঙরদের পেশাগত সুরক্ষা তো দূরের কথা বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও স্বীকৃত নয়। প্রায়শই গালি পিটে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়েন তাঁরা। অবশেষে জীবনের অধিকারের দাবিতে তাঁরা মুখর হয়েছেন। সর্বোপরি ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের বিলোপের দাবিতে। সমীক্ষা বলছে, কাজ করতে গিয়ে প্রতি তিনদিনে একজন জমাদারের মৃত্যু হয়। এ বছর প্রথম তিনমাসে মৃত্যু হয়েছে ৩১ জনের।
সিলিকোসিসেও মৃত্যু-মিছিলের বিরাম নেই পাথর খাদান কিংবা কোয়ার্টজ পাউডারের কারখানায়। দীর্ঘকাল ধরে রোগে ভুগে তিলে তিলে মরেন শ্রমিকরা। এ রোগ যার বুকে বাসা বাঁধে তাঁর জীবনের নিশ্চয়তা নেই। শুধু তো সিলিকোসিস নয়, কয়লাখনির শ্রমিকদের নিয়ামোকোসিস, আসবেস্টোসিস, চা বাগানে কীটনাশক বিষক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ শিল্পে যুক্ত শ্রমিকরা নানা পেশাজনিত রোগে জর্জরিত। আই এল ও'র এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ফি বছর বিশ্বে ২৪ লক্ষ মানুষ পেশাজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ২০.২ লক্ষ শ্রমিক এবং দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন ৩.৮ লক্ষ জন। পরিসংখ্যানটি কিছুটা পুরনো এবং মনে রাখতে হবে চিত্রটি সার্বিক নয়। আমাদের মতো দেশে যেখানে পেশাজনিত রোগের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের অধিকার তো দূরের কথা। কারখানার খাতায় যেখানে শ্রমিকদের নাম-ধাম-পরিচয়টুকুই থাকে না, সেখানে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার পরিসংখ্যান সত্যের থেকে বহুদূরেই অবস্থান করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাথর ভাঙা ক্রাশার এবং র্যামিং মাস (ramming mass) ইউনিটে এবং দূষণকারী শিল্পে সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা ২৫-৩০ লক্ষ। ৫৫ শতাংশ ক্রাশার শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিস পাওয়া গিয়েছে। ভয়াবহ তথ্য এই যে কোয়ার্টজ কারখানার র্যামিং মাস উৎপাদনকারী শিল্পে সিলিকোসিসে মৃত ও আক্রান্ত শ্রমিক ৮০ শতাংশ। এই শিল্পে শ্রমিকদের গড় আয়ু ৩৩ বছর।
২০১৮ সালের ২২ অগস্ট পর্যন্ত ওসাজ-এর তথ্য অনুযায়ী শুধু মাত্র মিনাখাঁ ব্লকে দু'শোর বেশি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৯-২০ জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। সন্দেশখালি ব্লকে ১৫০ জন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। হাড়োয়া ব্লকে মিলেছে আরও ৫০ আক্রান্তকে। এঁরা সকলেই আসানসোল, রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন সিলিকা গুঁড়ো উৎপাদনকারী কোয়ার্টজ চূর্ণ , কয়লা খনির বর্জ্য পেষাই এবং ফায়ার ব্রিকস তৈরির কারখানায় ২০০৫ সাল থেকে কাজ করতেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকেও শত শত পরিযায়ী শ্রমিকও এই কাজে যুক্ত। সারা রাজ্যে সমীক্ষা করলে দেখা যাবে সংখ্যাটি ঢের ঢের বেশি। ২০১৪ সালে মিনাখাঁয় সিলিকোসিসে আক্রান্তদের বিষয়টি ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের নজরে আনে অকুপেশনাল সেফটি অয়ান্ড হেলথ অয়াসোসিয়েন অফ ঝাড়খণ্ড বা ওসাজ। কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী সিলিকোসিসে মৃত ৯ জনের পরিবারকে রাজ্য সরকার ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এছাড়াও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৩৩ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এক্স রে করা হয়। সম্প্রতি কলকাতায় ওসাজের পক্ষ থেকে ওই অঞ্চলের আরও ৪৫ জনের এক্স রে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী আক্রান্তদের কেউ এখনও নির্দিষ্ট ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পায়নি। রাজ্যের শ্রম ও স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এটুকু আলোর রেখা দেখা গিয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির পরামর্শ মেনে মিনাখাঁ হাসপাতালে এই রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৩০০ মিলি এম্পায়ার এক্স রে মেশিন বসিয়েছে স্বাস্থ্যদপ্তর।
পরিতাপের বিষয় কী রাজ্যে, কী কেন্দ্রীয় স্তরের এই ধুলো, পাথর-কয়লার মিহি গুঁড়োর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিষয়ে আদৌ কোনও শ্রমিক-স্বাস্থ্য নীতি নেই। ফ্যাক্টরি আয়ক্ট ১৯৪৮, দ্য মাইনিং অয়াক্ট ১৯৫২, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনি অধিকার ইএসআই ১৯৪৮ এবং ১৯২৩ সালের ওয়ার্কমেন কম্পেনসেশন অয়াক্ট সহ অন্যান্য আইনে শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক অধিকার রয়েছে। এই কারখানাগুলি প্রমাণ করে এই সমস্ত আইন, আইনি রক্ষাকবচগুলিকে মালিকরা চূড়ান্ত অবহেলা করে চলেছেন। চলতে পারছেন সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির চরম উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই।
নির্বাচনের প্রাক্কালে সাফাই কর্মচারীরা জীবনের অধিকার দাবি করে ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। জীবনের অধিকার মহত্তম মৌলিক অধিকার। সিলিকোসিসে আক্রান্তদের জন্য লেখা হয়ে ওঠেনি কোনও নির্বাচনী ইস্তাহার। শ্রমিক সংগঠনগুলিকেও সিলিকোসিস কিংবা এই জাতীয় পেশাগত রোগের প্রতিরোধে কোনও বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে লক্ষ্য করা যায় না। এই শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য এখনই নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা জরুরি। শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার অধিকার, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণকে এই নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকার, শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিকপক্ষকে দায়বদ্ধ করে তুলতে হবে। সর্বস্তরে সচেতনতা প্রসারও জরুরি। কারখানা নামক এই ডাস্ট চেম্বারগুলি আসলে এক একটি হত্যাপুরী । এই গণহত্যাকাণ্ডের দায় কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।
0 Comments
Post Comment