এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে লড়াই সর্বাত্মক বলা যায়। বিরোধী দলগুলি যেমন আগের থেকে অনেকটাই সংহত ও কার্যকরী ইণ্ডিয়া জোট নিয়ে ঝাঁপিয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন এনডিএ-র নেতৃত্বকারী দল বিজেপি তার আস্তিনে লুকানো ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে আগামী কেন্দ্র সরকারকে পাখির চোখ করে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে শেষ বিচারে শেষ কথা যারা বলতে পারে সেই আমজনতার সামনে সময়টা বড় বিপর্যয়কর—রুজি-রোজগারের মতো প্রাথমিক চাহিদাগুলি হোক বা সামাজিক ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তা, সবদিক থেকেই। ফলে মোদি ম্যাজিক উধাও। বিজেপি এসব বিলক্ষণ জানে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির নিয়মে ব্যবহার্য এমন কোন হাতিয়ার তার হাতে নেই, যার সুবাদে যুদ্ধজয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। অগত্যা যা তারা ভাল পারে, এবং বহু পরীক্ষিতও বটে—জুমলা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি, তাতেই শান দিয়ে চলেছে। নির্বাচনের দফা যত এগিয়েছে, দেখা গেছে, হিন্দু মেরুকরণেই তারা বেশি বেশি ভরসা করছে—অন্তত গোবলয়ে।
বিজেপি রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষের চাষের মরশুমী ফসল ঘরে যা তোলার তা তো তোলেই, উপরন্তু সংসদীয় ব্যবস্থার ঘেরাটোপে থাকার বাধ্যবাধকতায় সেসবকিছুকে নির্বাচনী গিমিকে পরিণত করতে হয় তাদের। ২০১৩-র আগষ্টে উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলা ও শামলি জেলায় ঘটা বড় আকারে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াকে তারা ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল গোবলয়ের এক বড় অংশে হিন্দু মেরুকরণের উদ্দেশ্যে। ফলও মিলেছিল। ২০১৯-এ পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় সেনামৃত্যুর বেদনা-বিক্ষোভ ও পাল্টা পাকিস্তানের বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উত্তেজনার আবহে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও তার রঙে রঞ্জিত দেশপ্রেম ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ঝুলি ভরে দিয়েছিল। ভারতের পূর্বের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে, অনুপ্রবেশকারী ও সিএএ-র গিমিক, যার মোড়কে ঠেসে দেওয়া ছিল সূক্ষ্ম মুসলমান বিদ্বেষ, তা ছিল বিজেপির আশানুরূপ নির্বাচনী সাফল্যের অনুঘটক। ফলে এবারের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তারা ঘৃণা-বিদ্বেষকে সহায় করতে চাইবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
প্রথমে বিজেপি আওয়াজ তুলল, কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে মুসলিম লীগের ছায়া আছে। তারপর রাজস্থানের বাঁসওয়ারায় জনসভায় স্বয়ং মোদি বিষোদ্গার করলেন— কংগ্র্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের সম্পদ, এমনকি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দেবে। মুসলিমরা কারা? না, তারা অনুপ্রবেশকারী, গাদা গাদা বাচ্চা পয়দা করে তারা। তার পরে পরেই এসে গেল প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের আর্থিক পরামর্শদাতা কাউন্সিল (EAC-PM)-এর রিপোর্ট। মুসলিম অনুপ্রবেশ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বললেন, এই রিপোর্ট তার প্রামাণ্য নথি হয়ে শোভা পাচ্ছে এখন। রাজসভায় যেমন হত—রাজার কথায় ধুয়ো দেওয়ার জন্য পারিষদবর্গ সদা প্রস্তুত থাকত, সেরকমই ব্যাপার-স্যাপার। EAC-PM দেখিয়েছে, ভারতে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যার আনুপাতিক হার উদ্বেগজনকভাবে কমে গিয়েছে (৮৪.৬৮ শতাংশ থেকে ৭৮.৮৯ শতাংশ), যেখানে মুসলিমদের ক্ষেত্রে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (৯.৮৪ শতাংশ থেকে ১৪.০৯ শতাংশ)। এই রিপোর্ট সামনে আসতেই গোদি মিডিয়া, বিজেপির আইটি সেল সমান তালে লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিয়েছে—হিন্দু খতরে মে হ্যায়, অদূর ভবিষ্যতে ভারতে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, মুসলিমরা জনসংখ্যায় এক নম্বরে চলে যাবে, ইত্যাদি। এবং এখানেও কংগ্রেসকে দোষারোপ করা শুরু হয়েছে, কংগ্রেসের মুসলিম তোষণনীতির জন্যই নাকি এভাবে মুসলিমরা সংখ্যায় বেড়ে উঠেছে।
যদি মুসলিমদের মধ্যে হিন্দুদের সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া, মঙ্গলসূত্র ছিনতাই হয়ে যাওয়ার অভিযোগে কংগ্রেসকে জড়ানোর বিজেপির চালাকি খতিয়ে দেখি, দেখব, তপশিলী জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির জন্য কংগ্রেসের আগে-পরের যেসব পদক্ষেপ ও বক্তব্য রয়েছে, সেখান থেকে সংখ্যালঘু বিধায় মুসলমান প্রাসঙ্গিকতাকে চুরি করে বিভাজনের রাজনীতির রঙ মাখিয়েছে। তাকে একঘেয়ে মুসলিম তোষণের দোষারোপের গাড্ডায় ফেলেছে। মুসলিম জনবিস্ফোরণের কথা নতুন কিছু নয়, ইতিপূর্বে এ নিয়ে বিজেপি ও তার বিদগ্ধ মহল হামেশাই শোরগোল তুলেছিল। যা নতুন-- অভিযোগটিকে প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব দেওয়া হল। অপরদিকে ভারতীয় হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার দাবির বিপরীতে জনসংখ্যা বিশারদদের ব্যাখ্যা-বিশ্লষণও কিন্তু কম নেই। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির অতিকায় ছবি জনসংখ্যা বিশারদদের মূল্যায়নের ধারেকাছে দাঁড়াতে পারবে না। এইসব পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে National Committee to Review the Family Welfare Programme-এর প্রাক্তন চেয়ারপার্সন দেবেন্দ্র কোঠারি ২০২৩-এর প্রথম দিকে বলেছেন, দেশে হিন্দু জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী ৭৯.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে পরবর্তী জনগণনাকালে প্রায় ৮০.৩ শতাংশে দাঁড়াবে। এসব বিজেপির কর্মকর্তারা জানে না, এমন নিশ্চয় নয়; জানে বলেই জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে তাদের এই পাঁচকাহন।
বিজেপি নেতারা বিদ্বেষ ভাষণে মুসলমান তোষণের অভিযোগকে তামাম হিন্দুদের বিষয়-সম্পদ-মর্যাদা রক্ষার আশঙ্কার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। মুসলিমদের অধিক সন্তান প্রসবের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অতিরিক্ত চাপের এতদিনকার অভিযোগকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুস্থিত অস্তিত্বের সামনে বিপদের আশঙ্কায় পর্যবসিত করেছে। এবং সরকারিভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করিয়ে অভিযোগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এ এমন অভিযোগ, যার সাথে অনায়াসে মুসলমান অনুপ্রবেশ প্রশ্নকে জড়িয়ে নেওয়া যায়। বিদ্বেষ ভাষণে তাই-ই করা হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, এসটি, এসসি, ওবিসি বনাম মুসলমান, পাকিস্তানকে টেনে আনা, এরকম আরও সব বিষয় টেনে এনে ঘৃণা-বিদ্বেষের তালিকা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। ফলে স্পষ্ট যে, বিজেপি হিন্দু মেরুকরণের জন্য সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে।
তাদের বিদ্বেষ ভাষণের পাংশুমুখ দেখে মনে হতে পারে, পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে তারা তূণ থেকে লুকানো তীরগুলি একে একে বের করছে। ব্যাপারটা কিন্তু উল্টো, ক্রমান্বয়ে মুসলিমদের নামে বিদ্বেষ প্রচার, মুসলিমদের সম্পর্কে EAC-PM থেকে ও আরও নানাভাবে প্রতিকূল ভাষ্য রচনা করে হিন্দুমনকে বিষিয়ে দেওয়া ও শঙ্কিত করে তোলার ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যায়, গোটা চিত্রনাট্য আগে থেকেই সাজানো ছিল। সাজানো ছিল, কারণ আগের দিনগুলো তাদের তেমন ভালো যাচ্ছিল না। লকডাউন, নোটবন্দির মতো প্রবল জনবিরোধী পদক্ষেপগুলো জনজীবনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, বেকারত্বের ভয়াবহতা জনজীবনে কতখানি ছায়া ফেলেছে, তা না-বোঝার মতো বেকুব তারা নিশ্চয় নয়। তিন কেন্দ্রীয় কৃষি সংক্রান্ত আইন প্রত্যাহার যে কৃষক আন্দোলনের ফলশ্রুতি, তা আজও সক্রিয় ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের দাবিতে। ‘ইণ্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চন’, হিণ্ডেনবার্গ বিতর্ক থেকে মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরসের মোদি জমানায় ক্রোনি পুঁজির বাড়বাড়ন্তের নিন্দা বিজেপির কর্মকর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলার মতো ব্যাপার বৈকি। এরকম এক শক্ত জমির ওপর অবশেষে ঘুরে দাঁড়ানো অনেকটাই সংহত, অনেকটাই প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ‘ইণ্ডিয়া জোট’ মানুষের আশা-ভরসার জায়গায় এক জোরালো আবেদন হয়ে দেখা দিয়েছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোদি শিবিরকে চিত্রনাট্য সাজিয়ে রাখতেই হয়েছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে মুসলিম বিরোধী বাতাবরণ সৃষ্টি করে চলা-- এ কিন্তু আগের নির্বাচনগুলির সময় যেমন করা হয়েছিল, এখন সেরকম নয়, তাদের আগের বিভাজন-মেরুকরণের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ছাড়িয়ে গেছে। এবার আর কুশলী পদক্ষেপ নয়, ঠারেঠোরে নয়, তারা সরাসরি মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াতে নেমে পড়েছে, দেশের গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে খোলাখুলি নিশানা করেছে। যদি এনআরসি-র কথা বিবেচনা করি, দেখি, ‘উইপোকাতুল্য ঘুসপেটিয়া’ খুঁজে বার করার নামে বর্শামুখটা মুসলিমদের দিকেই ঘোরানো ছিল। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বুলডোজার অভিযান কোনো স্থানিক পীড়নের বিষয় ছিল না, আইন-শৃঙ্খলা, জবর দখল থেকে অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কেই নিশানা করা হয়েছিল। হরিদ্বার ও দিল্লির ধর্ম সংসদে মুসলমান নিকেশ করার ডাক দেওয়া কিছু সাধুর নিছক মুসলমান বিদ্বেষবশত বালখিল্য প্রদর্শন ছিল না। ধর্ম সংসদের পরে উত্তর-পূর্ব দিল্লির সাম্প্রদায়িক গণহিংসা থেকে শুরু করে আসাম থেকে উত্তর প্রদেশ সহ একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বুলডোজার অভিযান চালানো-- এসবের উপক্রমণিকা হিসাবেই উপস্থিত হয়েছিল ধর্ম সংসদ। দেশে যতদূর মুসলমান বিরোধী আবহ তারা সৃষ্টি করতে পেরেছে, এখন নির্বাচনে তার ষোলোআনা উশুল করতে বদ্ধপরিকর তারা। ব্যাপারটা এই যে, এই নির্বাচনের আগে ও এই নির্বাচনে হিন্দু মেরুকরণের রাজনীতি, এ হল বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মুখ। এ তাদের ভবিষ্যত-কল্পের ব্যাপারও বটে। যদিও হঠাৎ তিনি সুর বদল করেছেন, কিন্তু তাও প্রধানমন্ত্রীকে কি বিশ্বাস করা যায়?