কুম্ভ বা মহাকুম্ভ যাই হোকনা কেন, যেটা মুল বিষয় এই মেলা কে কেন্দ্র করে বিশাল মানুষের জমায়েত হয়েছিল। ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ পূণ্য অর্জনের জন্যই হোক বা পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য হোক বা উদেশ্য যাই থাকুকনা কেন ধর্মীয় কেন্দ্রিক আহ্বান এটাই ছিল এই মেলার আয়োজনের প্রধান লক্ষ্য। এই মেলাকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যসরকার এবং কেন্দ্রিয় সরকার আয়োজনের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা ও করেছিলেন। কিন্তু এই মেলাকে কেন্দ্রকরে যা কিছু প্রশ্ন বারে বারে ঘুরে ফিরে আসছে সেই গুলো এখানে প্রধান আলোচ্য বিষয়।
এক-
এই মহাকুম্ভ মেলা যে ১৪৪ বছর পর হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে তা কতটা যুক্তি পূর্ণ? যদি সত্যি তাইহয় তাহলে ১৪৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮১ সালের যে এই মহাকুম্ভ হয়েছিল তার কোন ঐতিহাতিক প্রমাণিত তথ্য তারা কেন দেখাতে পারলেন না। একদিকে ১৮৮১ সালের এই মহাকুম্ভর কোন তথ্য নেই। অপর দিকে ১৯৮৯, ২০০১ ও ২০১৩ সালের কুম্ভ মেলাকেও মহাকুম্ভ বলে প্রচার করা হয়েছিল তার তথ্য ত সব জায়গায় আছে। এমন কি বর্তমান এই উত্তর প্রদেশ সরকার যারা এই মেলাকে মহাকুম্ভ বলে প্রচার করছেন তাদের ২০২৩ সালের সরকারি দলিলেই কিন্তু ২০১৩ সালের কুম্ভকেই মহাকুম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে ১২ বছরের ব্যবধান কেই কি ১৪৪ বছর বলে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে?
দুই-
লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ যে জলে স্নান করলেন সেই জল যে বহু ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া ও জীবানুতে ভর্তি ছিল সেই ব্যপারে রাজ্য সরকারের থেকে কেন কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি? নিজেদের কেন্দ্রিয় সরকারের সংস্থা ‘সেন্ট্রাল পলিউশান কন্ট্রোল বোর্ড’ জলে স্নান করার জন্য যে BOD লেভেল থাকার কথা তার থেকে অনেক বেশি ছিল। যে কারণে এই দুষিত জলে স্নান করা শুধু ক্ষতিকর নয় এক জীবন হানির মতো বীপজ্জনক ও হতে পারে। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে গেছেন যে এই জল স্নানের ও খাওয়ার ও উপযোগী। তাহলে কোন টা ঠিক? কেন্দ্রিয় সরকারের রিপোর্ট না নিজের মুখের কথা? এই ব্যপারে তিনি কেন্দ্রিয় সরকারের রিপোর্ট যে ভুল তার ও কোন তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেন নি কেন? ধর্মের নামে কোটি কোটি মানুষকে দুষিত জলে স্নান করার যে পরিনাম ভুগতে হবে বহুদিন ধরে তার জবাব কে দেবে?
তিন-
মেলায় যে ব্যপক জনসমাগম হয়েছিল রাজ্য সরকারের থেকে তা জানানো হল তার সংখ্যা প্রায় ৬৫ কোটি মানুষ। অর্থাৎ ভারতের মোট জসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। যারা জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণা করেন তাদের কথা মতো একটি মানুষ দাঁড়ানোর জন্য যতটা জায়গা প্রয়োজন সেই হিসাবে ঐ এলাকায় ৪৫ দিনে ৬৫ কোটি মানুষের উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। আবার যে রাস্তা গুলো দিয়ে মানুষ এই মেলায় প্রবেশ করেছে সেই রাস্তা দিয়ে ও ৬৫ ৬৫= ১৩০ কোটি মানুষের ৪৫ দিনে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তারা জানালেন যে ৬৫ কোটি মানুষের উপস্থিতি? যে সরকার ঐ মেলায় অল্প কিছু মানুষের মৃতদেহ গুনে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারে না তারা ৬৫ কোটি মানুষ গুনল কিভাবে? এর পুরোটাই ধর্মীয় অন্ধতার নামে এক চমক নয় কি?
চার-
যে রেল ব্যবস্থা ভারতের যোগা যোগ ব্যবস্থার এক অন্যতম মাধ্যম, অতিরিক্ত কয়েক হাজার ট্রেন কে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চালানো হয়েছে ভক্তদের মেলায় পৌছে দেওয়ার জন্য। অথচ সারা ভারতের এখন ট্রেন যোগাযোগ ব্যস্থার একটাই ছবি তাহল প্রতিটা ট্রেন দেরিতে চলছে। ফলে অফিস, ব্যবসা বা চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু মানুষ নানা হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন প্রতিদিন। কুম্ভ মেলার জন্য সরকার যে তৎপরতা দেখালো, কয়েক হাজার বাড়তি ট্রেন চালানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করল, তারা যদি মানুষের সমস্যার কথা ভেবে ট্রেন গুলো টাইমে চালনা ও বিভিন্ন রুটে যেখানে ট্রেনে প্রচুর ভিড় হয় সেখানে অতিরিক্ত ট্রেন চালাতেন তাতে মানুষের অনেক উপকার হতো। তাহলে কেন সরকার দিনের পর দিন পছরের পর বছর সাধারন মানুষের গন পরিবহন কে গুরুত্ব না দিয়ে কুম্ভ পরিবহন কে গুরত্ব দিল সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
পাঁচ-
কুম্ভ মেলায় কেন্দ্রিয় ও রাজ্য সরকার মিলিয়ে প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা খরচ করেছেন মানুষের ধর্মের আবেগ কে মান্যতা দিয়ে। কিন্তু যে বিজ্ঞান চিন্তা বা বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কারণে সমাজ আজ এতটা উন্নত হয়েছে সেই বিজ্ঞান কে এই সরকার এত অবহেলা কেন করছে। প্রতিবছর যে ভারতে বিজ্ঞান কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষনার উন্নতির জন্য সরকার এই বছর থেকে সেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে বন্ধ করে দিল এবং সেই বরাদ্দ টাকাও বন্ধ করে দিল। তাহলে সরকারের এ রকম ই উদ্দেশ্য যে বিজ্ঞানের পরিবর্তে ধর্মীয় চর্চার প্রসার বাড়ুক?
ছয়-
দেশের প্রধান মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলে ছিলেন যে তিনি গঙ্গামায়ের সন্তান। গঙ্গামা তাকে এই সেবা করার জন্য এই পদে পাঠিয়ে ছেন। সেই গঙ্গা মায়ের সন্তান হিসাবে ঘোষনা করেছিলেন যে তিনি এই গঙ্গা নদীকে দুষন মুক্ত করবেন। গঙ্গা নদীকে দূষন মুক্ত করার জন্য ২০১৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু গঙ্গা নদী দুষন মুক্তত হয়নি উলটে সেই নদীতে এখন স্নান করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ ও নেই। তাহলে কি দেশের প্রধান মন্ত্রী গঙ্গা মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে তার নিজের সরকারের দপ্তর সেই গঙ্গা নদীকে স্নান করার ও উপযুক্ত জল নয় বলে সার্টি ফিকেট দিতে হল?
সাত-
এই কুম্ভ মেলায় নানা অপ্রীতিকর ঘটনার প্রতিবাদে যখন বিরোধী নেতারা নানা প্রশ্ন তুললেন। যেমন পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু, অগ্নি কান্ডের মৃত্যু, সহ নানা অব্যবস্থার প্রতিবাদ জানালেন সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই বিরোধীদের “শুয়োর” বলে তাদের প্রতিশোধ নিলেন। এটা কি আমাদের দেশের কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষা হতে পারে? তার উপর তিনি নিজে গেরুয়া বসন পরে থাকেন। রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দের বক্তব্যকে পাথেয় করে মানুষকে ধর্মের কথা শোনান। তাহলে বিবেকানন্দের কাছ থেকে তিনি গেরুয়া বসন পেয়েছেন কিন্তু ধর্মীয় চেতনা কি তিনি পান নি। না এটাই আসলে তার ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ।
সব শেষে যে বিষয় টার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, কুম্ভ মেলাকে এমন একটা সময় মহাকুম্ভ মেলা বলে প্রচার করে সরকারি টাকায় এক ধর্মীয় আয়োজন করা হল যেই সময় দেশের বেকারত্বের হার এক রেকর্ড পরিমান বৃদ্ধি হয়েছে। দেশের কোথাও কোন কাজ নেই। কি কেন্দ্রিয় সরকার বা রাজ্য সরকার সমস্ত জায়গায় সরকারি নিয়োগ বন্ধ। বেসরকারি যা কিছু আছে তাও অনেক টা ভিক্ষা দেওয়ার নাম করে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। অন্যদিকে দেশের গুটি কতক পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বের সেরা ধনি ব্যক্তির তালিকায় নাম উঠছে। দেশের খনি, সম্পদ সব এই কোম্পানীগুলোকে জলের দরে বেচে দেওয়া হচ্ছে। সেই পুঁজিপতিদের ব্যঙ্ক লোন গত দশ বছরে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা মুকুব করে দিয়েছে। দেশের সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থের বেহাল অবস্থা, মানুষকে বাঁচার জন্য সর্বস্য বিক্রি করে এই অত্যাবশ্যকিয় পরিষেবা টাকার বিনিময়ে পন্যের মতো কিনতে হচ্ছে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও বেকারত্বের উন্নতি নাহলে দেশের উন্নতি কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এই রকম এক পরিস্থিতিতে কুম্ভ মেলার আয়োজনের মাধ্যমে মানুষ কে এই মিথ্যা ধর্মীয় আবেগে মাতিয়ে দিয়ে দেশের লুঠের রাজত্বকে শক্তিশালী করা এটাই উদ্দেশ্য নয় কি?