গোবরের কথা বলতে হলে আমার সুন্দর বোনেদের কথা বলতে হয়। ওই সুন্দর বোনেদের সুন্দরবনে আমার ছোটবেলা কেটেছে। নিজের আর মাসতুতো পিসতুতো নিয়ে কতগুলো বোন, ভাই বলে সবেধন নীলমণি আমি। দিদিরা সকলে আমাকে ডাকত গোবু বলে। ছোটবেলায় আমার নাকি ফুলকো লুচির মতো নাদুসনুদুস চেহারা ছিল,ফলে ছেলেবেলাটা আমার বোনেদের আদরের অত্যাচারে কেটেছে। এছাড়া খুব বোকার মতো সরল ছিলাম। যে যা বলত নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতাম, ফলে অনেক ঠকেছি। বোনেদের চোখের ঝিকির-মিকির আলো আর মুখের রহস্যময় হাসির মানে মাথায় গোবর পোরা আমি কোনও দিন বুঝিনি। আসলে ওরা যেটা বলতে চায় সেটা বলে না, যেটা বলে সেটা মনের কথা নয়। ওদের মনের এই হযবরল ধাঁধা আজও আমার মাথায় ঢোকে না। যেমন মল্লিকাদি। আমার পিসতুতো দিদি। তখন আমি টিন এজের একটু উপর দিকে। দুজনে বাড়ির দোতলায় বারান্দায় কিছু একটা করছিলাম। ঠিক কী করছিলাম এখন মনে নেই। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চকাম করে একটা চুমু খেয়ে মল্লিকাদি রাস্তার দিকে ইশারা করে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল --- ওই দেখ গোবু।
আমাদের বাড়ি রাস্তার উপরে। তাকিয়ে দেখি টাইট প্যান্ট আর জংলা শার্ট গায়ে টেরি বাগিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন যুবক। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম --- কী দেখব রে দিদি?
দিদি মিটমিট করে হেসে বলল --- ও হল শম্ভুনাথ। ওকে আমি বিয়ে করব জানিস।
এর দু'তিন বছর পর মল্লিকাদির বিয়েতে সপরিবারে পিসির বাড়ি গিয়ে আমি অবাক। শম্ভুনাথ নয়, এক ডাক্তারকে বিয়ে করে মল্লিকাদি দিব্যি শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। শুধু মল্লিকাদি কেন, গোবর পোরা মাথায় নারী জাতিকেই আজও চিনে উঠতে পারলাম না।
বোকাদের আর কবে আক্কেল হয়েছে। এত ঠকেও বিশ্বাস করার রোগটা এখনও গেল না। এই রোগ পুরনো চুলকানির মতো। থেকে থেকে বিশ্বাস করার জন্য চুলকে ওঠে। তখন যুক্তি-তর্ক সব ডকে ওঠে। বিশ্বাস করার জন্য প্রাণ আনচান করে। এ রোগ সারার নয়।
তখন আমি যৌবনের মধ্যগগনে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। বন্ধুদের খুব বিশ্বাস করি। ক'জন ছিল আমার প্রাণের বন্ধু। তাদের একজন যেমন বেজো, অর্থাৎ আমার বাল্যবন্ধু
ব্রজগোপাল। ওর কথায় গ্রাম্য টান এখনও থেকে গেছে। একদিন কথায় কথায় ফস্ করে বলল --- হ্যাঁ রে গোবরা, তুর মাথাটা যি এক্কেরে শাকপুস্ত হয়ে গেইছে।
বেজোর বলায় শাকপোস্ত কথাটা ঘ্যাচাং করে মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। শাকপোস্ত আমার খুব পছন্দের একটা খাবার। পোনকা শাক আর পোস্ত বাটা দিয়ে মায়ের হাতের দারুণ এক প্রিপারেশন। মায়ের কাছেই শুনেছি শাকপোস্তর জন্য নাকি আমি ছেলেবেলায় বায়না করতাম। বেজোর কথায় আবার শাকপোস্ত ফিরে এল, শুধু ফিরে এল না, মাথায় চড়ে বসল। মাথার কাঁচা-পাকা চুলের মিশেলকে যে শাকপোস্ত বলা যায়, সেটা বেজোর কাছেই শেখা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে মেয়েদের সামনে একটু মাথা নীচু করে চলতে হত। সরাসরি চোখ তুলে কথা বলতে পারতাম না, যদি মামু বা কাকু বলে ডেকে ওঠে।
মাথার আর দোষ কী। জিন ফ্যাক্টর। শুনেছি ঠাকুরদা বাবা সকলেরই ভরা যৌবনে চুলে পাক ধরেছিল। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সেই আমার মাথার কিছু চুল পেকে গিয়ে এক আশ্চর্য আলো-আঁধারি সৃষ্টি করেছিল। আর সেই থেকে আমার মনে একটা কমপ্লেক্স তৈরী হয়ে যায়। তখন থেকে সুন্দরী মেয়েরা আমার জীবন থেকে দূরে চলে গেল। এই শাকপোস্ত চুলের কারণেই প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও সুন্দরীদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। ভয় হত যদি ওরা আমাকে অগ্রাহ্য বা উপহাস করে।
তখনও আমার বিয়ে হয়নি। বয়স তিরিশের নীচে। ট্রেনে বোলপুর থেকে কলকাতায় ফিরছিলাম। জানলার পাশে বসার সিট পেয়েছি। এর পরেই এক বিবাহিত যুবতী কোলে আট-নয় মাসের বাচ্চা আর হাতে জিনিসপত্রে ঠাসা একটা বড় ব্যাগ নিয়ে আমার উল্টোদিকে জানালার পাশের সিটে এসে বসল। দেখতে দেখতে কামরা প্যাসেঞ্জারে ভর্তি হয়ে গেল। যুবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। বুকের ভিতরটা গুরগুর করে উঠল। যুবতী অসামান্য সুন্দরী। যেমন নজরকাড়া রূপ, তেমনি ফিগার। ও যা করছে তাই মানিয়ে যাচ্ছে। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এমন একটা সুন্দরী কেন আমার জীবনে এল না। তবু যুবতীর দিকে সরাসরি তাকাতে ভরসা পেলাম না। উদাসীনভাবে আড়চোখে যুবতী আর বাচ্চাটার কাণ্ডকারখানা লক্ষ করে যাচ্ছিলাম।
বাচ্চাটা খুবই দামাল। কোনও সময় স্থির থাকছে না। ক্লান্তিহীনভাবে কেবলই হাত-পা নাড়ছে আর মুখে আউ-আউ আম্-আম্ বু-বু এরকম নানান দুর্বোধ্য শব্দ করে যাচ্ছে। যুবতীটিও খুব চটপটে আর সপ্রতিভ। হাতের ব্যাগ সিটের নীচে ঠেলে দিয়ে হাসি মুখে ছেলে সামলাচ্ছে --- না না না... ও ও ও... হুই দেখো বাবু গাছ... কুকুল দেখেছো কুকুল... গোয়ু গোয়ু...
কিন্তু ভবি ভোলার নয়। শুধুই হাত-পা ছুঁড়ে আউ-আউ আম-আম করেই যাচ্ছে। কী ভেবে যুবতী বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে সুর করে বলল--- ও ও ও... বাবুর খিদে পেয়েছে। দাঁড়াও দিচ্ছি।
এরপর যুবতীর নজর আমার দিকে পড়ল। আমার মাথা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বাচ্চাটাকে ঝপ করে আমার কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল --- কাকু, বাবুর খিদে পেয়েছে। একটু ধরুন। ততক্ষণে আমি বাবুর খাবারটা তৈরী করে নি। বলে আমার উত্তরের কোনও তোয়াক্কা না করেই ব্যাগ থেকে বেবি ফুডের কৌটো, দুধের ফ্লাক্স বাটি-চামচ ইত্যাদি বের করতে থাকল।
যুবতী আচমকা আমার কোলে বাচ্চাটাকে বসিয়ে দেওয়ায় আমি কেমন ভ্যাবলা হয়ে গেলাম। তখন আমার কী করা উচিত না পারছি ভাবতে, না পারছি যুবতীকে কিছু বলতে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার কোলে বসে বাচ্চাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখতে দেখতে একবার আউ শব্দ করল, তারপর আমার নাক খামচে ধরে টানতে টানতে মুখে পোরার চেষ্টা করতে থাকল। অসহায়ভাবে যুবতীর দিকে তাকিয়ে দেখি, বাটিতে চামচ দিয়ে খাবার নাড়তে আমার দুর্দশা দেখে যুবতী মিচকি মিচকি হাসছে।
এ তো গেল যুবক বয়সের কথা। এরপর বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছি। তারপর কর্মজীবন শেষ করে সিনিয়র সিটিজেন হয়েছি। তবু নারীদের ঠিকঠাক বুঝে ওঠা গেল না। সে যা হোক, তখনও কিন্তু মাথার শাকপোস্তর সমস্যাটা গেল না।
সমস্যাটা হল মাথার শাকপোস্তর আলো-ছায়াটা এই বয়সে এসেও একই রকম থেকে গেছে। কিছুতেই পুরো সাদা হয় না। ফলে এখনও আমাকে নানা রকম বিপত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। একদিন বাসে সিনিয়র সিটে বসে বইপাড়ায় আসছি, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে এসে টের পেলাম পিছন থেকে কেউ একজন আমার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি একজন মাঝবয়সী লোক, বয়সে আমার থেকে ছোটই হবেন, বললেন --- এটা সিনিয়র সিট।
বললাম --- জানি। আমি ঠিক সিটেই বসেছি।
শুনে ভদ্রলোকের ঠোঁটজোড়া ইংরেজি ও অক্ষর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে বললেন --- ওহ্। স্যরি।
আর একদিন ধর্মতলা থেকে মিনিবাসে উঠেছি। উপরের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছি সিনিয়র সিটের কাছে। একটা সিট খালি হতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক আমাকে ঠেলে ঝাঁপিয়ে সেই সিটে বসে পড়ল। বললাম --- ভাই, এটা সিনিয়র সিট।
যুবকটি অনেক ক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করে গম্ভীর গলায় রায় দিল --- আপনি সিনিয়র নন।
বরাবর দেখছি নারী জাতি আর আমার ভাগ্য আমার কাছে দুর্বোধ্য অজানা এক মহাদেশ হয়ে থেকে গেছে। বিশেষ করে আমার ভাগ্য ভিতরে নয়, বাহিরেও নয়, মাঝামাঝি কোনও এক জায়গায় বেমক্কা ঝুলে থাকে। সেই কথাটাই এখন বলতে হয়।
মেট্রো রেলে প্রায়ই চোখে পড়ে তরুণ-তরুণীরা সিনিয়র সিটে বসে কপোত-কপোতীর মতো কূজন করে। সিনিয়ররা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওদের মধ্যে বিশেষ হেলদোল লক্ষ করা যায় না। আমার ক্ষেত্রেও এমন কয়েকবার হয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের নিবিষ্ট কূজন দেখে গেছি, ওদের বিশ্রাম্ভালাপে বাগড়া দিতে ভরসা পাইনি। উদাসীনভাবে রড ধরে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে একটার পর একটা মেট্রো স্টেশন পিছন দিকে সটকে যেতে দেখেছি।
দুপুরের দিকে মেট্রো ট্রেনগুলো তুলনামূলকভাবে ফাঁকা থাকে। নন-এসি ট্রেনগুলোতে সিনিয়র সিট আর দেওয়ালের মধ্যে ইঞ্চি ছয়েকের মতো একটা ফাঁক থাকে। এক দুপুরে মেট্রোয় উঠে দেওয়ালের দিকে সিনিয়র সিটে বসেছি। আমি ছাড়া সেখানে আর একজন সিনিয়র বসেছিলেন। তিন জনের সিট। মাঝের সিটটা খালি। পরের স্টেশনে অন্য কোথাও জায়গা না পেয়ে এক কপোত-কপোতী জুটি আমাদের সিটের সামনে এসে দাঁড়াল। সিটের খালি জায়গাটার দিকে ইঙ্গিত করে তরুণী তরুণকে বলল --- তুমি বসো। তরুণ বলল --- না, তুমি বসো। এইভাবে কিছুক্ষণ 'তুমি' আর 'না, তুমি' চলার পর তরুণীটি অপর সিনিয়রকে নয়, আমার দিকে তাকিয়ে বলল --- হ্যালো আঙ্কেল, এখানে বসব? ওকে বসার সুবিধা করে দিতে আমি দেওয়ালের দিকে একটু সরে যেতে তরুণী দাঁড়ে পাখি বসার মতো ঝুপ করে মাঝখানে বসে পড়ল। তরুণ ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ওরা অনবরত কথা বলে যাচ্ছে।
আমার সহযাত্রী সিনিয়র হালকা-পাতলা, আমিও খুব মোটাসোটা নই। সেটা লক্ষ করে তরুণীর মুখ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠল। তরুণকে বলল --- অ্যাই, তুমি এখানে বসো না। চারজনের হয়ে যাবে। তারপর আমার দিকে ঘুরে বলল --- আঙ্কেল প্লীইইজ। বলতেই তরুণটি তরুণী আর আমার মাঝের সংকীর্ণ জায়গায় ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো ঢুকে গেল। সেই ধাক্কায় আমি হড়কে দেওয়ালের গায়ে সেঁটে গেলাম। তিনজনের সিটে চারজন বসলে যা হয়, সেটাই হল। সিট আর দেওয়ালের মাঝখানের শূন্য জায়গায় আমার অর্ধাঙ্গ ঝুলে থাকল --- ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলতেই থাকল।