আসুন আবার কাগজ খুঁজি। এই যে মনে হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত হয়তো যে দেশে জন্মেছি সে দেশই আমার দেশ, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, সকল দেশের রানী বলে আমরা যাকে গান শোনাই, আমি সেই দেশেরই নাগরিক, কিছুকাল বিরতির পর আবার দরজায় দাঁড়িয়েছে নাগরিকত্বের ভূত, "কাগজ চাই"। কারণ, ভোট এসেছে দরজায়।
কাগজ? এ পোড়া দেশে কাগজ কি আমাদের কিছু কম আছে? লাইনে দাঁড়িয়ে আধার কার্ড করা, তার সাথে সব অ্যাকাউন্টের সংযুক্তি করা, ছোটদের বদলাতে থাকা হাতের ছাপ বার বার ধরা,তার সাথে আবার বছর বছর ভোট দেওয়ার কার্ড, বুভুক্ষু মানুষের জন্য রেশনের কত রকম কার্ড, এই কার্ড নিয়েই তো মানুষ বাঁচে। কিন্তু না, যখন যেটা চাইলে মানুষ দিশেহারা হবে তখন ঠিক সেটাই চাই। না হলে তো মানুষ মৌলিক অধিকারের জন্য লড়তে থাকবে। আর চাইছেন কারা? নির্বাচন কমিশন, যাদের কাজ এই বিষয়টি নিশ্চিত করা যেন সমস্ত নাগরিক ভোট দিতে পারে। বর্তমানে তারা ঠিক বিপরীত উদ্যোগ নিয়েছেন, কত জনকে বাদ দেওয়া যায় সেটাই এখন তারা দেখছেন।
সামনে এখন বিহারে ভোট। সেই বিহার, কাশ্মীরে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোজা পৌঁছেছিলেন এই বিহারে, কারণ ভোট। আর ভোটের ঠিক আগেই হঠাৎ শুরু হল নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে এস আই আর বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন অর্থাৎ কিনা ভোটার তালিকা একেবারে নতুন করে তৈরি করা। বছর বছর ভোটার তালিকার সংশোধন হয়। যারা মারা গিয়েছেন, যারা দেশান্তরী হয়েছেন তাদের নাম যেমন বাদ পড়ে তেমনি নতুন নাম যুক্ত হয়। এটা বরাবরের কাজ কিন্তু SIR একটি সম্পূর্ণ অন্য প্রক্রিয়া যার সাথে ২০০৩ এর নাগরিকত্ব আইনের বেশ খানিকটা মিল পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক কাজ হল ভোট ব্যবস্থাটি চালানো, তাদের কাজ নাগরিকত্ব যাচাই নয়, তার জন্য আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর।কিন্তু এখন দেখা গেল এই গভীর সংশোধনের নাম করে আসলে নাগরিকত্বের প্রশ্নটাই তুলে আনা হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন যখন ভোটার তালিকা পরিমার্জন করেন তখন পুরনো তালিকাটা ধরেই এই কাজটা করা হয়। ১৯৯৫ সাল এবং ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে এই বক্তব্যটি উঠে আসে যে ভোটার তালিকায় যার নাম আছে তাকে ধরে নিতে হবে এ দেশের নাগরিক। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিহারের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে ২০০৩ সালের পর যারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন তাদের নির্বাচন কমিশন নাগরিক বলে মানতে রাজি নন।
আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভোটার তালিকা থেকে কারোর নাম বাদ দিতে গেলে নিয়ম অনুযায়ী তাকে নোটিশ দিতে হবে। তার কাছ থেকেই জানতে হবে তার নাম কেন থাকবে। এখানে কিন্তু সে রকম কোনো সুযোগ না দিয়েই নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। নিজেকে ভোটার প্রমাণ করার জন্য যে ১১ দফা নথি লাগবে সেগুলো খুব সহজলভ্য নয়, বিশেষ করে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ এগুলো কোনভাবেই জোটাতে পারবেন না। যেমন ধরা যাক চাওয়া হয়েছে জন্মের তারিখ ও জন্মস্থানে লিখিত নথি। এটিকে প্রমাণ করার জন্য স্কুল পাস করার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। খবর নিলেই জানা যায় যে স্কুল সার্টিফিকেটে জন্মের তারিখ অবশ্যই লেখা থাকে কিন্তু জন্মস্থানের উল্লেখ থাকেনা, তাহলে সেটাও অসম্পূর্ণ । নির্বাচন কমিশনের নিজের দেওয়া ভোটার কার্ডের উপরেও আস্থা নেই। আবার যে আধার নিয়ে এত কান্ড সে আধার কার্ডকেও এখানে মানা হচ্ছে না। আধার, রেশন কার্ড জব কার্ড কিছুই নাকি চলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে যে রাজ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোতে পারেনি, তারা কোথা থেকে ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট আনবে? আর তাদের কাছে যে কার্ডগুলো থাকে, আধার কার্ড রেশন কার্ড জব কার্ড কোনটাই নাকি কার্যকরী হবে না।
বিহারের পরে পরেই এই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। অতএব আমাদের দরজাতে ও এসে গেল নির্বাচন কমিশনের এই নতুন তুঘলকি ফরমান। অনুমান করা হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই এখানেও এই প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা হবে।। কি এক অসম্ভব পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে। ইতিমধ্যে বিহারে এই নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ৯ই জুলাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বহু গণসংগঠন বিহার তথা ভারত বনধে যোগ দিয়েছেন। তারা নির্বাচন কমিশনের দপ্তর ঘেরাও করেছেন এবং অবিলম্বে এস আই আর এর নামে গরিব দলিত আদিবাসীদের নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করার তাঁরা দাবি জানিয়েছেন। বিহারের ভোটারদের বড় অংশ পরিযায়ী। তাঁদের কাছে যে সমস্ত নথি চাওয়া হয়েছে তার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এত ধরনের নথি এদেশের প্রধানমন্ত্রীর আছে কি না সন্দেহ। তাহলে কেন এই অত্যাচার?
মহারাষ্ট্রে নির্বাচনের সময় থেকেই ভোটার তালিকায় কারচুপির অভিযোগ উঠেছে বিরোধী মহলে। যুদ্ধের সিঁদুর দিয়ে যখন কাজ হচ্ছে না, তখন এই নাগরিকত্বের হাওয়া নিয়ে আর এক অপচেষ্টা শুরু হতে চলেছে। ইতিমধ্যে SIR এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মনোজ ঝা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আদালতে গেছে। সঙ্গে আছে গণসংগঠন। বিভেদের রাজনীতিই যাদের একমাত্র সম্বল তারা আবার নাগরিকত্বের প্রশ্নে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ইতিমধ্যে গোটা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু বাংলায় কথা বলার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। ওড়িশায় ডবল ইঞ্জিন সরকারের মহিমায় বহু বাঙালি শ্রমিককে সেখানে আটক করে চূড়ান্ত হেনস্থা করা হচ্ছে। এর মধ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন।
এখন সময় জোটবদ্ধ হয়ে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। নাহলে সমূহ বিপদ সামনে।
ইতিমধ্যে ১০ জুলাই, ২০২৫ সুপ্রিম কোর্ট ভারতের নির্বাচন কমিশনকে (ইসিআই) ন্যায়বিচারের স্বার্থে, বিহারে ভোটার তালিকার এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) -এ ভোটার নিবন্ধনের প্রমাণ হিসেবে আধার কার্ড, ভোটারদের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র (ইপিআইসি) এবং রেশন কার্ড বিবেচনা করতে বলেছে। এর ফলে বহু মানুষের স্বস্তি হবে। এই তিনটি প্রায় সকলেরই আছে।
কিন্তু ২২ জুলাই নির্বাচন কমিশন শীর্ষ আদালতকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে তারা এ বিষয়ে একমত নয়। আধার একটি পরিচয়পত্র মাত্র, সেটি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সব কিছুর সঙ্গে এই সোনার পাথর বাটি আধারকে কেন জুড়তে হল? সরকারি যে কোনো টাকা পেতে গেলে অ্যাকাউন্ট এর সঙ্গে আধার সংযোজন বাধ্যতামূলক, তাহলে কি এই সব সুযোগ সুবিধা বিদেশীরা পেল? এমন কি ভোটার আইডিও নাকি চূড়ান্ত পরিচয়পত্র হতে পারে না? তাহলে এই আইডির উপর দাঁড়িয়ে আগের যে ভোট হল, সেটিও তো সম্পূর্ণ অবৈধ। শোনা যাচ্ছে ৫২ লক্ষ নাম না কি বাদ গেছে। তাহলে তো আগের গোটা ভোট প্রক্রিয়াই বাতিল করতে হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন আগে ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ নেহরু সংবিধান সভায় বলেছিলেন এমন একদিন আসবে যখন স্বাধীন ভারতের স্বাধীন নাগরিক হওয়াই একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় সম্মান হবে। প্যাটেল এর পরের দিন বললেন নাগরিকত্বের অধিকার এতটাই বিস্তৃত হোক যাতে অন্য দেশের মানুষ যেন বুঝতে পারে এই দেশ আধুনিক উদার সভ্য একটি দেশ। আপাতত যা ঘটছে এদেশে তাতে বর্বরতার চূড়ান্তে গিয়ে ঠেকছে দেশ। অদ্ভুতভাবে যার কাছে কাগজ নেই,
তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা। এই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত উদ্বাস্তু গোষ্ঠী। মায়ানমার থেকে নির্বাসিত, সেখানে থাকাকালীন চূড়ান্ত নির্যাতনের শিকার এই গোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, ভারতেও আছে কিছু ্। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, মাতৃভাষা আছে কিন্তু এখন বাংলা বললেই এবং মুসলমান হলেই রোহিঙ্গা। খোদ বিহারেই নাকি ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় প্রচুর রোহিঙ্গা, বাংলাদেশী, নেপালী ইত্যাদি পাওয়া গেছে বলে সব কাগজেই জোর খবর, ওদিকে নির্বাচন কমিশনের দাখিল করা সাতশ পাতারো বেশি দস্তাবেজে এমন কোনো তথ্য নেই। হচ্ছেটা কী? মিডিয়া নামক স্তম্ভটি এখন শাসকের খড়কে কাঠিতে পরিণত হয়েছে, মিথ্যা প্ররোচনামূলক তথ্য পরিবেশন ছাড়া তাদের কিছুই করার নেই। এদিকে জানা গেল আজ অবধি এ দেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। তাহলে সবই কি জুমলা!
নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়ে গভীরে গিয়ে ভাবার আছে।আজকের হিন্দুত্ববাদী শাসকের মতে নাগরিকত্ব একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীগত ধারণা, যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা তাদের সেখানে জায়গা নেই। এই ভাবনা ভারতের মূল ধারণায় কুঠারাঘাত। গান্ধী এবং নেহেরু তাদের নিজেদের মত করে নাগরিকত্বকে দেখেছেন, একজনের দৃষ্টি কিছুটা নৈরাজ্যবাদী স্বশাসনে আস্থাবান, অন্যজন একটি কল্যাণকারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা ভেবেছেন কিন্তু দুজনেই নাগরিকদের গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে নয় বরং ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করার কথাই ভেবেছেন। ভারত বৈচিত্র্যের দেশ। আজ তাকে একমাত্রিক করার উদ্যোগে যেভাবে সাধারণের উপর অত্যাচার নামছে, তার প্রতিবাদ করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। আর এখনই সেই সময়।