বিষয়টি ব্যক্তিগত। তবু নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনের এই আতঙ্কের আবহে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আসলে সমাজের আয়না। তাই তাকে বুঝে নেওয়া জরুরি। ঘটনাক্রমের সূচনা ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের কিছু আগে। ভোটের আগে হঠাৎ আবিষ্কার হল আমার আর আমার মায়ের নামের ভোটার স্লিপ আসে নি। অথচ আমার জ্যাঠতুতো দাদা, বৌদি, তাদের ছেলেমেয়ে সবার নামে ভোটার স্লিপ এসেছে। প্রথমে মনে হল হয়ত স্লিপ হারিয়ে গেছে। তখন মনে হল ওয়েবসাইটে থাকা ভোটার লিস্ট দেখি। দেখা গেল,সেখানে আমার বৃহত্তর পরিবারের সবার,এমনকি বহুদিন আগে গত হওয়া আমার জেঠিমা’র থাকলেও আমার আর আমার মা’র নাম বাদ গেছে। কিন্তু কেন? আমরা কি ভোট দিই না? তাও তো নয়। আমি ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন অবধিও ভোট দিয়েছি। আমার মা’র বয়স এখন ৮৮। তাও বহুদিন পর্যন্ত তিনি ভোট দিয়েছেন (সম্ভবত ২০১৯ মা’র দেওয়া শেষ ভোট)। আমাদের নাম বাদ দেওয়ার আগে কেউ কি এসে আমার বাড়ি এসে খোঁজ নিয়েছিলেন? না! তাহলে নাম বাদ গেল কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। আমার বুথের তৃণমূল এবং সিপিআইএম এজেন্ট আমাকে ভালো করে চেনে, রাস্তাঘাট বা বাজারে তাদের সঙ্গে দেখাও হয় নিয়মিত। তাহলে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর কারো কাছে নেই। ফোন করলাম ভোট সহায়তার টোল ফ্রি নাম্বারে। তাঁরা দেখে জানালেন আমার এপিক নম্বরের অস্তিত্বই তাঁদের সাম্প্রতিকতম ডেটাবেসে নেই। তাঁরা বললেন সেবারে তো আর ভোট দেওয়া হবে না,আমি যেন ফর্ম ৬ পূরণ করে নতুন করে নাম তুলি।
২০২৪ এর নির্বাচনে আমার আর ভোট দেওয়া হল না। এর কিছুদিন পরে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হলে আমি আমার বুথে গিয়ে নাম তোলার চেষ্টা করলাম। প্রথমদিন গিয়ে জানা গেল বিএলও সেখানে আসেন বটে, কিন্তু দুপুর একটার আগে না। পরের দিন ছুটি নিয়ে সেখানে গেলাম। দুজন ভদ্রমহিলা সেখানে বসে ছিলেন। তাঁরা ফর্ম দিলেন কিন্তু জানালেন বিএলও একটু বাইরে গেছেন সুতরাং ফর্ম জমা দেওয়ার জন্য আরেকদিন আসতে হবে। দুদিন ঘুরে আসার পরে আমি দুত্তরি বলে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করলাম। মা’র ফর্ম আর ভরি নি। কারণ জানতাম এর পরে শুনানিতে গিয়ে অংশ নিতে হবে, সেটা মা’র পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এরপর আমাকে ফোন করে জানানো হল যে একটি নির্দিষ্ট দিনে শুনানিতে যেতে হবে আলিপুরে। আবার ছুটি নিয়ে গেলাম এবং প্রায় দু-তিন ঘন্টা লাইন দিয়ে অবশেষে নাম তুলতে পারলাম। এক্ষেত্রে বলে রাখা যাক এই যে ফর্ম ৬ ব্যবহার করে নাম তুলতে হল সেটা কিন্তু নতুন ভোটারের নাম তোলার জন্য। সেখানে এক জায়গায় হলফনামাও দিতে হয় যে আপনি নতুন ভোটার, আগে আপনার নাম তালিকায় ছিল না (এক্ষেত্রে আমি ইন্টারনেটে দুরকম ফর্ম পেলাম। বাংলায় যে ফর্ম ব্যবহার হয় সেটি শুধুমাত্র নতুন ভোটারের জন্য। অনলাইন ফর্মটিও তাই ছিল। অন্ততঃ আমি যখন নাম তুলেছিলাম। কিন্তু দিল্লির ফর্ম ৬ -এ তালিকায় আগে নাম ছিল এই সম্ভাবনার কথা লেখা আছে।)। অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশনের ভুলে যদি আপনার নাম বাদ যায়, তাহলে এই মিথ্যা হলফনামা দিয়েই আপনাকে নাম তুলতে হবে। মা’র নাম আর তোলা হল না। তাই সাম্প্রতিক সার (SIR) প্রক্রিয়ায় মা আর অংশও নিতে পারল না। মা’র নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেল চিরতরে।
এই গল্পটা বলার কারণ একটাই। ভোটার তালিকার প্রস্তুতিতে নির্বাচন কমিশন নানারকম ভুল করতে থাকে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু কমিশনের যেকোন ভুলের দায় বহন করতে হয় সাধারণ নাগরিককে; তাকে তখন অন্য কাজ ফেলে ঘুরতে হয় সরকারি অফিসের দরজায় দরজায়। কতটা ভুল করতে পারে নির্বাচন কমিশন? বিহারের নিবিড় সংশোধনীতে আমরা দেখেছি প্রথম দফায় ৬৫ লাখ নাম বাদ গেছিল। কিন্তু তারপর নাম তোলেন প্রায় ২০ লাখ এবং শেষমেশ প্রায় ৪৭ লাখ নাম বাদ যায়। তার মানে এই ২০ লাখ নাম নির্বাচন কমিশনের ভুলে বাদ গেছিল এবং সেটা যাওয়ার পরে তাঁদের নিজের উদ্যোগে সেই নাম তোলার ব্যবস্থা করতে হয়। কী ধরণের ভুল হতে পারে? নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিসর থেকে কিছু উদাহরণ দিই। নিবিড় সংশোধনীতে আপনি তিনভাবে নাম তুলতে পারেনঃ যদি ২০০২ এর তালিকায় আপনার নাম থাকে, যদি ২০০২ এর তালিকায় আপনার বাবা-মা’র নাম থাকে বা এর কোনটাই না থাকলে তালিকাবদ্ধ নথির একটি পেশ করার মাধ্যমে। এবার ২০০২ এর তালিকায় যে আপনার নাম ছিল তা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার। ২০০২ এর একটি তালিকা ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে বটে কিন্তু আপনি ২০০২ তে কোন বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন তা না জানলে সেই তালিকায় নিজের নাম খুঁজে বের করা অসম্ভব। কারণ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন তালিকাটিকে সার্চেবল করেন নি।(প্রক্রিয়া শেষ হবার আগে অবশ্য আর একটা পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও ২০০২ সালের ভোটকেন্দ্র জানতে হবে) কিন্তু ঐ যে! দায় তো নাগরিকের! তাঁকেই জানতে হবে কোথায় ভোট দিয়েছিলেন। ২৩ বছর আগে কোন কেন্দ্রে ভোট ছিল সেটা মনে রাখা খুব কঠিন তাঁদের পক্ষে যাঁরা ঐ সময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন নানা জায়গায়, পরিবর্তন করছিলেন বাসস্থান। এই সম্ভাবনাটি কাল্পনিক কিছু নয়। আমার এক সহকর্মীর এক বন্ধুর মনে নেই ঠিক কোন কেন্দ্রে তাঁদের পরিবারের ভোট ছিল। তাই, তিনি বা তাঁর বাবা কারোরই নাম তিনি সরাসরি তুলতে পারেন নি। নিজের নাম তিনি পাসপোর্ট ব্যবহার করে তুলতে পারলেও, বাবার ঐ এগারোটি নথির একটিও না থাকায় আর তোলা যায় নি। এই প্রসঙ্গে এই এগারোটি নথির প্রসঙ্গে আসি। এই নথিগুলি হলঃ সরকারি চাকরির প্রমাণপত্র, ১৯৮৭ র আগে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর দ্বারা দেওয়া পরিচয়পত্র, জন্ম শংসাপত্র, পাসপোর্ট, শিক্ষার প্রমাণপত্র, রাজ্য সরকারের দেওয়া স্থায়ী বসবাসের শংসাপত্র, অরণ্য অধিকারের শংসাপত্র, জমি বা বাড়ির নথি, পারিবারিক রেজিস্টার, বিহারের ২০০২ এর সার তালিকায় নাম। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আধার এই তালিকায় আধার ঢুকলেও শুধু আধার দিয়ে নাম তোলা যাবে না। একটু খেয়াল করলে দেখবেন এই নথির বেশির ভাগটাই সমাজের ওপরের দিকে থাকা লোকেদের কাছে থাকার সম্ভাবনা বেশি, গরিব লোকেদের কাছে থাকার সম্ভাবনা কম। ভেবে দেখুন কারা সরকারি চাকরি করে? পাসপোর্ট থাকে কাদের? জমি-বাড়ির মালিক কারা হয়? ২০১১ এর সালের জনগণনা অনুযায়ী মাধ্যমিক পাশ করেছেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ১১%। শিক্ষার শংসাপত্র কীভাবে দেবেন তাহলে বাকিরা? আর জন্মের শংসাপত্র এখন যত সহজে পাওয়া যায় আগে তা ছিল না। ২০০৫-০৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী সেই সময়ের ৬১% শিশুই জন্মেছে বাড়িতে। তার আগে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল। এবার বাড়িতে শিশুদের জন্ম হয় যে পরিবারে তারা নিশ্চিত ভাবেই দরিদ্র। তাই তাদের পক্ষে বাড়িতে জন্মানো শিশুর জন্ম শংসাপত্র জোগাড় করা অসম্ভব না হলেও কঠিন। অর্থাৎ, আপনার নাম যদি আপনি ২০০২ এর তালিকায় খুঁজে বের করতে না পারেন -- যার সম্পূর্ণ দায় নাগরিকের ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে – তাহলে নথি দিয়ে নাম তোলা বড়লোকের পক্ষে যত সহজ, গরিবের পক্ষে তত সহজ নয়।
এতো গেল নাম খুঁজে পাওয়ার সমস্যা। এবার হল সেই নাম তোলার সমস্যা। আপনি হয়ত সংশোধনীর ফর্ম পূরণ করে বিএলও’র হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু তারপরে সেই নাম তোলার দায়িত্ব বিএলও-দের। কারা এই বিএলও? তাঁরা স্কুল শিক্ষক। তাঁদের পড়াশোনা, ট্রেনিং সবই ক্লাসরুম কেন্দ্রিক। আজ যদি হঠাৎ তাঁদের বলা হয় স্মার্টফোনে এই সব ভোটারের তথ্য তুলতে হবে তা একরকম অন্যায় চাপ দেওয়া। অনেকক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি এই চাপ সহ্য করতে না পেরে বিএলও রা মারা যাচ্ছেন না অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এই অন্যায়ের শিকার একদিকে যেমন বিএলও রা হচ্ছেন, অন্যদিকে হচ্ছেন নাগরিকরা। নাম তুলতে গিয়ে কোন ভুল যদি বিএলও রা করেন তার ফল কিন্তু বৈধ ভোটারদেরই ভুগতে হবে। কী রকম ভুল? আমি নিজে আমার ফর্ম অনলাইনে ভরেছি। অনলাইনে নাগরিকরা যে ফর্ম ভরছেন, বিএলও রাও কিন্তু সেই একই ফর্ম ভরবেন তাঁদের মোবাইল থেকে। সেখানে যদি কোন ভুল তথ্য তাঁরা তুলে ফেলেন, তার ফল কিন্তু ভুগতে হবে সাধারণ নাগরিককে। একটা উদাহরণ দিই। যদি আপনি দাবি করেন যে ২০০২ এর তালিকায় আপনার নাম ছিল তাহলে অনলাইন ফর্মে আপনি বুথ, সিরিয়াল নম্বর ইত্যাদি দিলে আপনার ২০০২ এর রেকর্ড দেখাবে। সেখানে আবার ভয়াবহ বানান ভুল আছে। যদিও ২০০২ এর প্রকাশিত তালিকায় সব ঠিকই আছে। এক্ষেত্রে ভুল থাকলে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আপনার কিছু করার নেই। প্রাথমিক ভাবে বিএলও দেরও কিছু করার ছিল না। পরে সংবাদপত্রে দেখলাম বিএলও দের তথ্য পরিবর্তন করতে দেওয়া হচ্ছে। যদিও বিএলও রা ঠিক কী পারছেন আর কী পারছেন না এর বিশদ তথ্য কমিশন জানায় নি। কিন্তু এর পরেও একটা অন্য ভুল হতে পারে। ধরুন অবিনাশবাবুর সিরিয়াল নম্বর ১০১। আর ১০২ তে আছেন অনিমা। এবার কোন বিএলও ক্লান্ত হয়ে যদি ১০১ এর বদলে ১০২ দিয়ে, খেয়াল না করে ক্লিক করে দেন তাহলে ১০২ এর রেকর্ড অবিনাশবাবুর সঙ্গে চলে গেল। এবার অনিমা যদি পরে নিজের ১০২ এর রেকর্ড দিয়ে অনলাইনে করতে যান তাহলে তিনি তা পারবেন না এবং দেখবেন যে ওই রেকর্ড আগেই ম্যাপ হয়ে আছে। এরকমটা হয়েছে আমার এক সহকর্মীর স্ত্রী-এর সঙ্গে। তিনি ২০০২ এর রেকর্ড অনলাইনে দিতে গিয়ে দেখেন আগেই সেটি ম্যাপ হয়ে বসে আছে। তারপর তিনি অফলাইনে ফর্ম জমা করেন। যদি বিএলও রা এই ভুল সংশোধন করতে পারেন তো ভাল, নাহলে কিন্তু ভোগান্তি কাল্পনিক অবিনাশ এবং অনিমা দুজনেরই। আর যদি বিএলও নিজেই অ্যাপে সংশোধন করতে পারেন, তাহলেও কিন্তু তাঁর হাতে একটা বাড়তি ক্ষমতা গেল যা তিনি কীভাবে প্রয়োগ করবেন কেউ জানে না।
ওপরে যে সমস্যাগুলো বললাম সেগুলো উদাহরণ। এর বাইরেও অন্য অনেক সমস্যা সম্ভব এবং সেই আতঙ্কে আত্মহত্যাও করেছেন বেশ কিছু মানুষ। এর সবটাই এড়ানো যেত যদি একটু সময় নিয়ে নিবিড় সংশোধনীর কাজ হত। বা রাষ্ট্র আশ্বস্ত করত মানুষকে যে ভোটার তালিকায় নাম না তোলার মানে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়া বা পড়শি রাষ্ট্রে পুশব্যাক নয়। নিবিড় সংশোধনী কোন নতুন কাজ নয়, বহু বছর ধরে তা হয়ে চলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের অবিবেচক নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে (সোনালী বিবির ঘটনা যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ) এই সাধারণ একটি প্রক্রিয়া এক অভূতপূর্ব আশঙ্কার ছায়া নামিয়ে এনেছে সাধারণ মানুষের ওপর। তারা নিজেদের বৈধতা প্রমাণের জন্য পাগলের মত নথি খুঁজে চলেছেন। সমস্ত রাজ্যেই গরিব মানুষেরা এই প্রক্রিয়ায় বিপদে পড়বেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত একটা রাজ্যে, যার অধিবাসীদের একটা বড় অংশের পূর্বপুরুষরা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া এক নিষ্ঠুর পরিহাসের মত। বাঙালি হিসেবে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্লীন আতঙ্কের বিরূদ্ধে আওয়াজ তোলা আমাদের কর্তব্য, না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।