শাবিরা ভয়ে ভয়ে বলল, খুলে দেখিনি। খান্দুয়া ক্যাম্পের দু-জন বিএসএফ এসে দিয়ে গেল। কোলখালি বাঁকের কাছে পদ্মার পাড়ে ওরা এটা কুড়িয়ে পেয়েছে। এটা নাকি আমাদের কালুভায়ের! আজ ক-দিন হয়ে গেল কালুভাই পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে। আমরা তার কোনো হদিশ পাইনি। অগত্যা এখন দেখতে হবে সত্যিই এটা আমাদের ভাই কালুর না অন্য কারো!
কাবিরা জিজ্ঞেস করল, এটা কালুর হবে কী করে? পদ্মায় তো অনেকেই মাছ ধরতে যায়। স্নান করতে যায়। তাছাড়া খান্দুয়া ছেড়ে অদ্দূরে কোলখালির বাঁকে কালু কী করতে যাবে?
শাবিরা বলল, খান্দুয়া ক্যাম্পের বিএসএফরা বলছিল কোলখালি বাঁকের ঘূর্ণিতে সেদিনের একমাত্র একটি মাছ-ধরা ডিঙির ডুবে যাওয়ার সাক্ষী ছিল তারা। সেটা যে কালুভায়েরই এ-ব্যাপারে তারা নিঃসন্দেহ। তাছাড়া সেই দিন আমাদের কালুভাই ডিঙি নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল এটাও তো সত্যি। মা-কে আবার এ-ব্যাপারে কিছু বলতে যাস না যেন। শুনলে যে ক-দিন তাঁর বাঁচার কথা তার আগেই তিনি মরে যাবেন।
কাবিরা চিন্তামগ্ন হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কি সেদিন মা-কে বলেছিলি বাহাদুরকে পদ্মায় যেতে বারণ করতে?
শাবিরা : বলেছিলাম। ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিয়েছে। হু হু করে পদ্মায় পানি বাড়ছে। পদ্মায় পানির স্রোত খুব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভাঙন শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই।
কাবিরা : শুনে মা কী বললেন?
শাবিরা : সব শুনে তিনি বললেন, “ আমি ওকে বারণ করব কী, কালুকেও তো বারণ করতে পারিনি। কালুর যাওয়া আজ ক-দিন হয়ে গেল! এখনো ফেরেনি। তবে আজকালে সে নিশ্চয় ফিরে আসবে। তোমরাও ভীত হয়ো না। আমি তো সবসময় তোমাদের জন্য প্রার্থনা করি। সর্বশক্তিমান আল্লা যেন আমার কাছ থেকে তোমাদের কেড়ে নিয়ে আমার কোল আর খালি না করেন। "
কাবিরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কিসের গর্জন শুনি যেন! তাহলে কি পদ্মায় সত্যি সত্যি আবার ভাঙন শুরু হয়ে গেল নাকি?
শাবিরা বলল, হ্যাঁ বুবু। খুব ভয়ঙ্কর ভাঙন। আল্লা যেন আমাদের প্রতি সহায় হন। উত্তর-পশ্চিমে পদ্মা স্রোতে যে গর্জন উঠছে তা যেন আমাদের ভিটেহারা না করে! ভাগ্যিস সেই স্রোতের বিপরীতে বাতাস বইছে না। বইতে শুরু করলে পদ্মা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। হাজার হাজার মানুষকে ভিটেহারা করবে।
কাবিরা বলল, আল্লা যেন আমাদের সবাইকে রক্ষা করেন! তারপর একটু থেমে বলল, আচ্ছা শাবিরা- পুঁটলিটা খুলে দেখেছিস সত্যিই কি এই পুঁটলিটা আমাদের ভাই কালুর?
শাবিরা বলল, কখন খুলে দেখব? সময় কোথায়? হাতে পেয়েই তো বাড়িতে ছুটে এলাম। এখন এটা খুলতেই মা যদি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন! এমনিতেই আমরা দু-জনেই কেমন উদ্ভ্রান্ত। আমাদের দু-জনের চোখেই পানি। এতে করে মা যদি টের পেয়ে যান যে তাঁর কালু আর এই দুনিয়ায় নেই!
বলতে বলতে শাবিরা চমকে উঠল। বলল, ওই দেখ মা বুঝি জেগে উঠেছে। ঘর থেকে মায়ের নড়াচড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে।
কাবিরা সতর্ক হয়ে বলল, পুঁটলিটা আমাকে দে। আমি এটা এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখবো মা কিছুই টের পাবে না।
শাবিরা পুঁটলিটা বড় বোন কাবিরার হাতে দেয়। কাবিরা বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে যেখানে রাখা আছে মাছধরা ডিঙির সাজসরঞ্জাম, সেখানে সেটা নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে।
ইতিমধ্যে মা মরিয়ম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, আজ দিন-রাত চলার মতো বাড়িতে চাল-ডাল কি কিছু আছে?
কাবিরা পুঁটলিটা লুকিয়ে ফিরতে ফিরতে বলল, আছে মা। এই তো রুটি গড়ছি। একটু দাঁড়াও, তোমায় খেতে দিচ্ছি।
মা মরিয়ম আপন মনে বলে উঠল, নদীর উত্তর-পশ্চিমে ভয়ঙ্কর গর্জন হচ্ছে। পদ্মা আরো উথালপাথাল হবে। পাড় ভাঙবে। মানুষ ভিটেমাটি হারাবে। তার আগে আল্লা যেন আমার কালুকে ফিরিয়ে দেন।
শাবিরার নাকে তখনও বিএসএফের দিয়ে যাওয়া পুঁটলিটার গন্ধ। সে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না, বলে উঠল, মা তোমার আল্লা কালুভাইকে আর আমাদের মাঝে ফেরাবেন না। যেভাবে আব্বা, বড়ভাই ফিটুকে কেড়ে নিয়েছেন ঠিক সেভাবেই কালুভাইকেও কেড়ে নিয়েছে।
মা মরিয়ম প্রচণ্ড রেগে উঠলেন। বললেন, মুখপুড়ি- কী অকথা কুকথা বলছিস তুই? তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, বাহাদুর কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?
শাবিরা সংযত হয়ে বলল, পদ্মায় ভাঙন শুরু হয়েছে। মাছ ধরতে নৌকা ছাড়বে কি-না দেখতে গেছে। মনে হয় শিগগির ফিরবে।
কাবিরা ওদের কথা শুনতে শুনতে রুটি গড়া শেষ করে। ক্লান্তি দূর করতে নিজেকে সটান দাঁড় করায়। আর আঙিনার পাটকাটির বেড়া পেরিয়ে তার চোখ পড়ে পদ্মাপাড়ের কোলখালি বাঁকের দিকে। যেখান থেকে পদ্মার স্রোত বাঁক নিয়ে এই খান্দুয়া ছুঁয়ে বয়ে গেছে বাংলাদেশের ভিতর। কাবিরা দেখতে পায় ওই উথালপাথাল স্রোতে একটা মাছধরা ডিঙিকে ভেসে আসতে। আর সে আনন্দে বলে ওঠে, কে যেন বড় বড় ঢেউ পেরিয়ে ডিঙি নিয়ে এগিয়ে আসছে।
শাবিরাও সেদিকে তাকিয়ে ছিল। সে আনন্দে উল্লসিত হয়ে বলল, কালুভাই আসছে মনে হয়। ওকে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে। নিশ্চয় প্রচুর মাছ পেয়েছে।
দুই
কালু নয়, ওই ডিঙি খান্দুয়ার ঘাটে নোঙর করে বাড়ি এসে ঢুকল বাহাদুর। জিজ্ঞেস করল, আমাদের মাছ ধরার নতুন জালটা কোথায় রে কাবিরাবুবু?
কাবিরা বলল, ওটা তো বারান্দার দেওয়ালের বাঁশে ঝোলানো আছে। আজ সকালেই ওখানে রেখেছি। আঙিনায় টাঙানো ছিল বলে কুরবানির খাসিটা ওটা চিবোচ্ছিলো।
বাহাদুর বারান্দার বাঁশ থেকে জালটাকে হাতে নিতেই মা মরিয়ম তাকে বলল, ওটা যেমন ছিলো তেমনি রাখলেই ভালো করবি বাহাদুর! আমি বলছি, ওটা কাজে লাগবে। কাল কিংবা পরশু বা সপ্তাহের যে কোনো দিন তোর আব্বার, তোর বড় ভায়ের, কিংবা কে বলতে পারে কালুর দেহ পদ্মায় ভেসে এলে আল্লার রহমতে ওদেরকে একটা বড় কবরে শুইয়ে দিয়ে ওই জাল দিয়ে কবরটাকে ঢেকে দেওয়া যাবে। যাতে কুকুর-শেয়াল ওদের লাশ কবর খুঁড়ে খেতে না পারে!
বাহাদুর বলল, আব্বা-বড়ভাই-কালুভাই ফিরবে না মা। ওদের লাশও আর ফিরবে না। পদ্মা সমুদ্রের মতো মহান নয়, যে লাশ ফিরিয়ে দেবে। পদ্মা একটা নদী মাত্র। আর নদী কিছু ফিরিয়ে দেয় না। হয় গিলে খায় না হয় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আব্বা, বড় ভাই, এমনকি কালুরও লাশ বর্ডার পেরিয়ে এতদিনে ভেসে গেছে ভিনদেশে। কিংবা পদ্মা গিলে খেয়েছে। তাই আজ থেকে এই জাল নিয়ে আমাকেই মাছ ধরতে যেতে হবে। অন্য কাজ করতে অভিজ্ঞতা লাগে। আমার তা নেই। তবু আমাকে পদ্মায় যেতে হবে। সামনের দু-তিন দিন আবহাওয়া ভালো থাকবে না। সমুদ্রে গভীর নিম্নচাপ। তা ঘূর্ণি ঝড়ে পরিণত হতে পারে। যে-কারণে পদ্মায় কোনো নৌকা ভাসবে না। আমি অভিজ্ঞদের বলতে শুনে এলাম। সেই কারণে এখনই যতটা সম্ভব মাছ ধরতে হবে। সবাই পদ্মায় যাচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় নাকি পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক ঘুরপাক খায়। আর এখন বাজারে ইলিশের খুব ভালো দাম। আমিও ওদের সঙ্গে যাব মা। প্রচুর ইলিশ ধরে আনব। সেই ইলিশ বিক্রি করে আবার নতুন জাল কিনব।
মা মরিয়ম বললেন, এ কী বলছিস তুই? লোকে কী বলবে! তোর আব্বা কত দাম দিয়ে এই জাল কিনেছিল তুই জানিস? অথচ তার কবর ঢাকার জন্য এই জাল ব্যবহার হবে না!
বাহাদুর বলল, হ্যাঁ মা- আমি ঠিক বলছি। যারা যাবার চলে গেছে। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। এক কাজ করো- আমার ফিরতে দেরি হলে কুরবানি খাসিটাকে বিক্রি করে দিও। ওই টাকায় সংসার চালিও। আমি এখন মাছ ধরতে বেরুচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে আসব প্রচুর ইলিশ নিয়ে। সেসব বিক্রি করে বেশ তাগড়া দেখে একটা কুরবানির খাসি কিনব।
মা মরিয়ম বললেন, আল্লার নামে রাখা খাসি বিক্রি করা কি ঠিক হবে? তাছাড়া খাসির দাম আর কত পাব?
বাহাদুর বলল, ঠিক বেঠিক জানি না মা। যা দাম পাবে ওতেই বিক্রি করে দিও। আমি ফিরে এসে আল্লার নামে আর একটা তাগড়া দেখে কুরবানির খাসি কিনব। তোমার চিন্তা করার কিছু নেই।
মা মরিয়ম ভয়ে ভয়ে বললেন, যদি তোর আব্বা- তোর ভাইদের মতো তুইও ডুবে মরিস তাহলে আমাদের কী হবে? সেদিন যে সত্যিই আমাদের কপাল পুড়বে। একবার ভেবে দেখেছিস? তাছাড়া এমনিতেই আমার বয়স হয়েছে। এক পা আমার কবরে, এই অবস্থায় তোর দুই বোনকে নিয়ে আমি কিভাবে বাঁচবো।
বাহাদুর বলল, ফিরে এসে আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব মা। আধঘণ্টার মধ্যে আমাকে খান্দুয়ার ঘাটে পৌঁছতে হবে। ফিরতে দুদিন বা তিন দিন, আবহাওয়া খারাপ হলে তার আগেই চলে আসব।। আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ফিরে আসবই।
মা মরিয়ম বললেন, কী কঠোর তুই? কী নির্মম! একজন বুড়ি মায়ের একটা কথাও শুনছিস না, যে কি-না তোকে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে চাইছে!
কাবিরা এতক্ষণ চুপ ছিল। এতক্ষণে বলে উঠল, মা- জোয়ান ছেলের জীবনই তো উপার্জন করতে যাওয়ার জন্যে। তাছাড়া একজন বুড়ির ঘ্যানঘ্যানই বা কে শোনে?
বাহাদুর বলল, আমি যাচ্ছি। আল্লা তোমাদের সহায় হোক ।
বাহাদুর চলে যেতেই মা মরিয়ম কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, চলে গেলো! ও চলে গেল! আল্লা, তুমি কত নিষ্ঠুর! ওর সাথে আর আমার দেখা হবে না। ও চলে গেলো। আগামী পূর্ণিমায় আমি থাকি না থাকি, আমার ছোট ছেলেটা এই দুনিয়ায় থাকবে না। হায় আল্লা!
কাবিরা মা-কে জিজ্ঞেস করল, দরজায় দাঁড়িয়ে ভাই যখন ফিরে তাকালো তখন ওকে আশীর্বাদ করলে না কেন? আমরা সবাই তো তো বিষণ্ণ! অমন অশুভ, নির্মম কথা ওর বিদায় মুহুর্তে শুনিয়ে দিলে।
শাবিরা কাবিরাকে জিজ্ঞেস করল, বুবু- রুটি গড়লে অথচ ভাইকে খাওয়ার কথা বললি না?
কাবিরা কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আল্লা যেন আমাকে মাফ করেন বোন। আমি ওকে খাবার কথা বলতে ভুলে গেছি।
শাবিরা বলল, ক-দিন ভাই বাড়ির বাইরে থাকবে। কী খাবে না খাবে! এমনিতেই আজ সকাল থেকে ওর পেটে কিছুই পড়ে নি। হয়ত এই কারণেই ও মারা পড়বে।
কাবিরা বলল, হ্যাঁ- অবশ্যই মারা পড়বে। যে বাড়িতে একজন বুড়ি সবসময় ঘ্যানঘ্যান করে সেখানে কারো মাথা ঠিক থাকতে পারে না।
কাবিরা একটা গামছায় কয়েকটি রুটি আর তরকারি একটা গামছায় জড়িয়ে শাবিরার হাতে দিয়ে বলল, এক্ষুনি এটা নিয়ে তুই খান্দুয়ার ঘাটে গিয়ে ওকে দিয়ে আয়। ওর সাথে তোর দেখা হবে। দূর হবে আমাদের সব অশুভ কথার অভিশাপ। ওর মনটা সুস্থির করতে তুই একবার বলিস, “ ভাই- তোর যাত্রা শুভ হোক। "
মা মরিয়ম বললেন, শাবিরা কি ওকে ধরতে পারবে ?
কাবিরা বলল, এখনই বেরিয়ে পড়লে এবং দ্রুত হেঁটে গেলে নিশ্চয় ধরতে পারবে।
মা মরিয়ম আপন মনে বলে উঠলেন, পোড়া কপাল আমার! এই বয়সে তাহলে আমাকেই হাঁটতে হবে। শাবিরা ওকে ধরতে পারবে না।
শাবিরা জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে?
মা মরিয়ম বললেন, হ্যাঁ- আমি যাব। বলে আসব- “ তোর যাত্রা শুভ হোক। ”
কাবিরা উদ্বিগ্ন হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, হাতে একটা ছড়ি নেবে মা? নাও। না হলে রাস্তায় আবার হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
মা মরিয়ম জিজ্ঞেস করেন, কোন্ ছড়ি?
কাবিরা বলল, বড়ভাই ফিটু যেটা তোমার জন্য নিয়ে এসেছিলো নবাবগঞ্জের হাট থেকে।
ইতিমধ্যে শাবিরা ঘর থেকে ছড়িটা নিয়ে এসে হাজির হয়। সেটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। মা মরিয়ম সেটা হাতে পেয়ে বলেন, দুনিয়ার সবখানে বাবামায়েরা তাদের সন্তানদের আশীর্বাদ করে বিদায় নেয়। আর এখানে সন্তানরাই বাবামায়েদের জন্য প্রার্থনা রেখে চলে যায়। আর ফেরে না।
কাবিরা বলল, শাবিরা তুই মায়ের সঙ্গে যা। দেখে নিয়ে যাস!
তিন
মা মরিয়ম বাহাদুরকে বিদায় করে এসে ক্লান্তিতে ঘরে গিয়ে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাবিরা দুপুরের ডাল-ভাত রান্না করছিল। পাশে বোন শাবিরা বসে। হঠাৎ কী মনে হয়, কাবিরা উঠে গিয়ে বিএসএফের দিয়ে যাওয়া পুঁটলিটা লুকোনো জায়গা থেকে বের করে আনে। খুলতে চেষ্টা করে। পারে না। পানিতে ভেজা পুঁটলিটা গিঁট পাকিয়ে একেবারে জট বেঁধে গেছে।
শাবিরা বলে, পুঁটলিটা পানিতে ভিজে অমন হয়েছে। যতই চেষ্টা কর, খুলতে পারবি না।
বিরক্ত হয়ে কাবিরা বলে, হেসোটা দে তো!
পাশেই সব্জি কাটা হেসোটা রাখা ছিল, শাবিরা এগিয়ে দিল।
কাবিরা গিঁট কেটে পুঁটলিটা খুলে ফেলল। দেখল- একটা প্যান্ট, একটা গেঞ্জি আর একটা গামছা।
কাবিরা আৎকে উঠে বলল, এগুলি তো ভাই বাহাদুরের। একটু আগে এগুলি পরে বাড়ি ছেড়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে ছিল!
শাবিরা বলল, না- বাহাদুর ভায়ের নয়। এগুলি কালুভায়ের।
কাবিরা বলল, না- বাহাদুরের। আমার মনে পড়েছে বাহাদুর আজ ভোরে প্যাটরা থেকে বের করছিল। আমি ঘুমঘোরে দেখেছিলাম।
শাবিরা বলল, সব একই পোশাক দিদি। ভকতদের দোকান গুলোতে ওই পোশাক কিনতে পাওয়া যায়। আব্বা পরতেন। বড়ভাই ফিটু পরত। মেজোভাই কালুও পরত। আরও অনেকেই পরে, অন্তত যাঁরা পদ্মায় মাছ ধরতে যায়। তবে এটা বাহাদুরের নয়, কালু ভায়ের। আল্লা যেন ওর আত্মার মঙ্গল করেন।
কাবিরা জিজ্ঞেস করল, মা জানলে কী হবে?
শাবিরা বলল, জানি না। আব্বা, বড় ভাই ফিটুর মতো সেও ভেসে গেছে। কিংবা পদ্মা গিলে খেয়েছে। তার জন্য বিলাপ করার অবকাশ টুকু আর রইলো না? মা জানলে বিলাপ করবে। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেবে। তাঁর শরীরটা ভেঙে যাবে। হয়ত মরেই যাবে। তার চেয়ে এটাই ভালো- যা পুঁটলিটা কোথাও লুকিয়ে আয়। মা যেন খুঁজে না পায়!
কাবিরা শোকে দুলতে দুলতে পুঁটলিটা নিয়ে যেতে যেতে নিজেই নিজেকে বলে, কী ভয়ঙ্কর এই জীবন!
তারপর মুহূর্ত খানেক থেমে বলল, কেউ বুঝি আসছে শাবিরা? কার যেন পদশব্দ শুনছি!
শাবিরা বলল, হ্যাঁ, আমিও শুনছি। মা আসছেন নিশ্চয়। বোধহয় দরজা পর্যন্ত এসে গেছেন।
কাবিরা চুপিচুপি বলল, মা বাইরে আসার আগেই ওগুলো লুকিয়ে ফেলতে হবে। বাহাদুরকে আশীর্বাদ করে আসার পর তিনি বোধ হয় স্বস্তি বোধ করছেন। পদ্মা থেকে বাহাদুরের ফেরার আগে পর্যন্ত তাকে আমরা কিছু জানতে দেবো না।
কাবিরা পুঁটলিটা লুকিয়ে এসে আবার রান্নায় বসে। শাবিরাকে জিজ্ঞেস করে, আমরা যে কাদঁছিলাম, সেটা কি মা বুঝতে পারবে?
শাবিরা বলল, পিঠ ফিরিয়ে বসে থাক। মা যাতে তোর মুখ দেখতে না পায়!
মা মরিয়ম অতি ধীর পায়ে ওদের কাছে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, রান্না হল?
কাবিরা বলল, হ্যাঁ মা- হয়ে এসেছে। তুমি গোসুল করে নাও। একটু অস্থির হয়ে বোন শাবিরাকে বলল, যা তো, মা-কে গোসুল করিয়ে আন। খেতে দেব।
মা মরিয়ম বললেন, আজ আমি খাব না। আজ আমার কিছু ভালো লাগছে না। বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে।
কাবিরা জিজ্ঞেস করল, কেন মা? খান্দুয়া গিয়ে তুমি কি বাহাদুরের দেখা পাও নি?
মা মরিয়ম বললেন, পেয়েছি। তাকে আশীর্বাদও করেছি। কিন্তু তা বাদেও আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছি আজ।
কাবিরা জিজ্ঞেস করল, কী দেখেছো?
মা মরিয়ম কাঁপতে কাঁপতে বললেন, পদ্মার স্রোতে সারি সারি লাশ ভেসে যেতে।
কাবিরা বলল, সারি সারি লাশ! তুমি ভুল দেখেছো মা। কিংবা এটা তোমার মনের ভ্রম। তাছাড়া তুমি আজকাল চোখেও কম দেখো।
মা মরিয়ম রেগে উঠলেন। বললেন, আমার মনের ভ্রম? আমি চোখে কম দেখি? তাহলে একটু আগে তোরা দুই বোনে কী করছিলি একটা পুঁটলি নিয়ে?
কাবিরা-শাবিরা মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, এ তুমি কী বলছো মা? কী দেখেছো আমাদের বলো ।
মা মরিয়ম বললেন, আমি মনে মনে কালুর জন্য আল্লার কাছে দোয়া চাইছিলাম। অথচ দেখছিলাম, কালু তার মাছধরা ডিঙি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই কোলখালি বাঁকের দিকে। সবাই জানে কোলখালি বাঁকেই ইলিশের ঝাঁক পাক খায়। কালুও সেটা জানত। আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম কালু যেন সেদিকে না যায়! সেদিকে গেলে মৃত্যু অবধারিত, কালুও সেটা জানত। তবু ইলিশের ঝাঁক তাকে লোভ দেখাচ্ছিল। আর লোভে পড়ে কালু ওই বাঁকেই তার ডিঙি নিয়ে পাঁক খাচ্ছিল ...
এরপর মা মরিয়ম চুপ করে গেলেন। তাঁর মুখে কথা সরল না। তাঁর মুখ হা হয়ে রইল। কাবিরা মায়ের গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল মা? তুমি আর কী দেখেছো?
মা মরিয়ম বললেন, আমি দেখেছি আমার কালুকে ।
কাবিরা বলল, না মা- তুমি কালুকে দেখোনি। ওর লাশ সেই কবেই পূর্ব-দক্ষিণে ভেসে গেছে।
মা মরিয়ম বললেন, আমি আজই ওকে দেখেছি। ডিঙিটায় চড়ে কোলখালি ঘূর্ণির দিকে এগিয়ে যেতে। আমি যখন খান্দুয়ায় বাহাদুরকে বিদায় জানিয়ে বললাম, “ তোর যাত্রা শুভ হোক। ”
কিন্তু তাঁর কথাগুলো গলায় আটকে গেলো। কোনও রকমে “ আল্লা সবার মঙ্গল করুন ” বলে দ্রুত চলে গেলো ঘরে।
কাবিরা-শাবিরা আর কিছু বলতে পারল না, তাদের চোখে ভেসে উঠল সেই পদ্মার কোলখালি বাঁকটা। কাবিরা বিলাপের স্বরে বলে উঠল, আজ থেকে আমরা বোধহয় শেষ হয়ে গেলাম। একেবারে শেষ হয়ে গেলাম ।
শাবিরা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ধর্মে কি কোথাও বলে নি- সর্বশক্তিমান আল্লা অসহায়ের একমাত্র জীবিত পুত্রকে কেড়ে নিয়ে তার কোল খালি করবে না।
কাবিরা কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
ওদিকে মা মরিয়ম নিজের বিছানায় শুয়ে আপন মনে বিড়বিড় করেন, ও নদীর কী জানে! ও হারিয়ে যাবে। এরপর আমি আর বাঁচতে চাই না। স্বামী চলে গেলেও আমার তরতাজা তিনটি ছেলে ছিল। প্রত্যেকের জন্মের জন্য আমি অসহ্য কষ্ট সহ্য করেছি। তাদের দু-জনের লাশ পাওয়া যায়নি। পদ্মার স্রোত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, নাকি পদ্মা গিলে খেয়েছে, আমি কিছুই জানি না। আজ বাহাদুর ওই স্রোতে মাছ ধরতে গেল। তার কী পরিণতি হবে, কে জানে!
চার
রাত্রিকাল। মা মরিয়ম একটা ভাঙা চৌকির ওপর আর দুই মেয়ে কাবিরা-শাবিরা তাদের ভাঙা ঘরের মেঝেতে ছেঁড়া বিছানায় শুয়ে ছিল। শাবিরা ফিসফিস করে বলল, নদীপাড়ে কে যেন কাঁদছে! কিছু শুনতে পাচ্ছিস বুবু?
চৌকির ওপর থেকে শুয়ে মা মরিয়ম বললেন, কে কাঁদবে আবার! কাঁদছে পদ্মাপাড়ের স্বামীহারা সন্তানহারা সব মেয়েরা। এমনই এক কালো রাতে ভেসে গিয়েছিল ছিদাম হালদার। সূর্য উঠলেও ওদের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় নি। তারপর ডিঙি উল্টে মরলো পাচু। বাহাদুর তখন বাচ্চা, আমি ওকে কোলে করে বসেছিলাম বাড়ির বাইরে। একজন, দু’জন, তিনজন, চারজন করে মেয়েমানুষ কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যাচ্ছিল খান্দুয়ার ঘাটের দিকে। পেছনে ছিল সব নাবালকের দল। আমিও বাহাদুরকে কোলে নিয়ে ওদের পিছু নিয়েছিলাম। সবাই বলাবলি করছিল কোলখালি বাঁকের কবলে পড়লে কেউ ফিরে আসে না। হয় তাকে পদ্মা গিলে খায়। না হয় তার লাশ ভেসে যায় ভিনদেশে।
শাবিরা জিজ্ঞেস করল, এটা কবেকার কথা মা?
মা মরিয়ম বললেন, এটা যেমন সেদিনের কথা হতে পারে, আজকের কথাও হতে পারে।
কাবিরা: তাহলে কি আমার আব্বা, বড়ভাই, মেজোভাই সবাই কি ওই কোলখালি বাঁকের বলি?
মা মরিয়ম: হ্যাঁ। তবে কারও কারও ক্ষমতা থাকে, লাশ হয়েও ওরা ইচ্ছে মতো ভেসে বেড়ায়। আমার বিশ্বাস বাহাদুর মরে গেলেও ওর লাশ ভেসে বেড়াবে পদ্মার স্রোতে। তার লাশ ভিনদেশে যাবে না। কারন, আমি আর এই পদ্মার পাড় ছাড়া তার আর কোনও দেশ ছিল না।
পাঁচ
কাল ভোর। দুই বোন কাবিরা-শাবিরা ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজে ব্যস্ত। কাবিরা এঁঠো বাসনপত্র মাজছে। শাবিরা ঝাঁট দিচ্ছে। তার মধ্যেই ওরা কথা বলছে।
কাবিরা : আর কোনও সন্দেহ নেই যে ওই পুঁটলিটা কালুর।
শাবিরা আঙিনা ঝাঁট দিতে দিতে কোমর সাট করতে সটান দাঁড়ায়। আর আঙিনার পাটকাটির বেড়া পেরিয়ে তার চোখ পড়ে খান্দুয়া ঘাটের দিকে। সে চমকে ওঠে। কাবিরাকে বলে, বুবু- ও বুবু দেখ ওরা কিছু একটা বয়ে আনছে। যা থেকে ফোটায় ফোটা পানি ঝরছে। সেই ফোঁটা ফোঁটা পানি পদ্মার পাড়-বাঁধানো পাথরগুলোর গায়ে চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
কাবিরা বাসন মাজা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দেখে বলে, হ্যাঁ- ঠিক বলেছিস ওরা একটা লাশ বয়ে আনছে।
শাবিরা : লাশ বয়ে আনছে! কার লাশ?
কাবিরা : নিশ্চয় কোনো কোনো ভাগ্যবানের। যার লাশ ভিন দেশে ভেসে যায় নি। কিংবা পদ্মা গিলে খায়নি।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলা, শিশু এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে, ওদের আঙিনায়।
একজন নারী বলল, আল্লা তার আত্মার মঙ্গল করুন।
কাবিরা জিজ্ঞেস করল, কার?
কেউ একজন বলল, তোর ভাই বাহাদুরের।
কাবিরা : বাহাদুরের লাশ! কীভাবে ডুবলো ও? এই তো গতকালই বাড়ি ছেড়ে পদ্মায় গিয়েছিল!
আর একজন প্রতিবেশী নারী বলল, আকাশ থেকে নেমে একটা ছাই-রঙা টাট্টুঘোড়া ওকে ডিঙি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কোলখালির বাঁকে। যেখানে সব বড় বড় ঘূর্ণি। আমি দেখেছি। আমি তখন সেখানেই।
কাবিরা : তারপর?
ডিঙিটা ডুবে গেল। তবে বাহাদুর ভেসে উঠল। কোলখালি বাঁকের ঘূর্ণিতে সে ঘুরতে থাকল। তারপর একসময় ডুবে গেল। আবার ভেসে উঠল লড়াই করতে করতে। আবার ডুবে গেল। শেষপর্যন্ত ভেসে উঠল খান্দুয়ার পদ্মাপাড়ে।
ইতিমধ্যে বাহাদুরের লাশ এসে পৌঁছেছে আঙিনায়। ঘর থেকে মা মরিয়ম বিবির চৌকিটা বের করে আনা হয়েছে। বাহাদুরের লাশ তার ওপর শোয়ানো।
মা মরিয়ম সেই লাশের কাছে গিয়ে চৌকির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মৃদু স্বরে প্রতিবেশী মহিলারা দুলে দুলে বিলাপ করছে। কাবিরা-শাবিরা চৌকির অপর প্রান্তে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। প্রতিবেশী পুরুষেরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে।
এমন পরিবেশে মা মরিয়ম বলে উঠলেন, ওরা সবাই হারিয়ে গেলো। পদ্মা আর এখন আমার কিছুই করতে পারবে না। যতই উঠালপাথাল হোক কিংবা তার দামাল ঢেউগুলো ভীষণ শব্দে পাড়ে আঘাত করুক তখন আমাকে আর কেঁদেকেটে কারো জন্য প্রার্থনা করতে হবে না। পবিত্র জমজমের পানির বয়ামটা নিয়ে আয় তো মা শাবিরা!
শাবিরা তৎক্ষণাৎ তাঁকে ওটা এনে দেয়।
মা মরিয়ম বাহাদুরের শরীর একটা সাদা কাপড় ঢেকে দিয়ে তার ওপর জমজমের পানি ছিটিয়ে দেন। তারপর বলেন, বাহাদুর- সর্বশক্তিমান আল্লার কাছে তোর জন্যে প্রার্থনা করিনি এমন নয়। সেই প্রার্থনায় কী বলেছি তা তুই জানবি না। কিন্তু আমি শুধু তোর জন্য নয়, দুনিয়ার সব সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। আল্লা আমার প্রার্থনা শোনেন নি। আর প্রার্থনা নয়, আমি এখন চির বিশ্রাম নেবো। আমার চির বিশ্রামের সময় করে দিলি তুই। এই জন্য তোকে আমার ধন্যবাদ।
কাবিরা একজন বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুমি আর সুভান কাল ভোরে একটা কবর খুঁড়ে দেবে। তোমাদের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই আমাদের।
শাবিরা চুপিচুপি কাবিরাকে বলে, বুবু- মাকে দেখ, মা এখন কত শান্ত! কত সুস্থির। কিন্তু ফিটুভাই যেদিন পদ্মায় হারিয়ে গেল, সেদিন তাঁর সে কী কান্না! চিৎকার! কোলখালি বাঁকও হয়তো শুনেছে তাঁর সেই কান্না-চিৎকার! মা হয়ত ফিটুভাইকেই বেশি ভালোবাসতো! একবার কি ভেবে দেখেছিস ব্যাপারটা?
কাবিরা খুব আস্তে কিন্তু স্পষ্টভাবে বলল, যে কোনো কাজেই একজন বুড়িমানুষ তো জলদি ক্লান্ত হয়ে পড়বেই। কান্নাও তো একটা কাজ। প্রচুর শক্তি ক্ষয় হয়। মায়ের সেটাই হয়েছে। তা বলে তিনি কি এতদিন কান্নাকাটি করেননি? তাঁর নিরবতা আমাদের বাড়িটাকে কি আচ্ছন্ন করে রাখে নি?
মা মরিয়ম জমজমের পানির বয়ামটিকে বাহাদুরের লাশের ওপরে উলটে রেখে বাহাদুরের লাশ স্পর্শ করে বললেন, ওদের জীবন-লীলা শেষে আজ ওরা সবাই এক হয়েছে। আল্লার রহমত যেন ওদের আত্মার ওপর বর্ষিত হয়। করুণা বর্ষিত হয়। শুধু ওদের নয়, আর যারা যারা কোলখালি বাঁকে হারিয়ে গেছে, সবার আত্মার ওপর বর্ষিত হয়।
মা মরিয়ম বিবি আপন মনে প্রার্থনা করছেন। আর তাঁর আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী মহিলারা বিলাপ করছে। সেই বিলাপের আওয়াজ পদ্মার গর্জনকে ঢেকে দিচ্ছে। অবশ্য মা মরিয়ম সেসব কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না, তিনি আপন মনে প্রার্থনা করছেন, মহান আল্লা- তোমার রহমতে আমার স্বামী, আমার দুই ছেলের লাশ পদ্মার পানিতেই দাফন হয়েছে। আমি তাদের লাশ স্পর্শ করতে পাইনি। এক দিক থেকে সেটা ভালোই হয়েছে। আজকাল মাটিতে দাফন হলে লাশের কী গতি হয়, প্রতিনিয়ত চোখে দেখি। কবরস্থানের মাটি চুরি যায়। সেই মাটি, যার ভেতর আমাদের লাশ মিশে থাকে। সেই মাটি চুরি হয়ে ইটভাটায় যায়। আগুনে পুড়ে ইট তৈরি হয়। তা দিয়েই উন্নয়নের নামে ইমারতের পর ইমারত গড়ে ওঠে। আকাশ ঢেকে যায়। মাটির সঙ্গে আকাশের কোনো সম্পর্ক থাকে না। যাইহোক, আপাতত আমার বাহাদুরের লাশ মাটি পাবে। হয়ত তা খুব অল্প দিনের জন্য। এটাই বা কম কী? তারপর হয়ত তার কবরের মাটি পদ্মা গিলে খাবে কিংবা মাটিচোরেরা কেটে নিয়ে গিয়ে ইট বানাবে। বিল্ডাররা তা দিয়ে ইমারত গড়ে তুলবে। আকাশ ঢেকে দেবে। তবু আমার বাহাদুরের লাশ অল্প হলেও কিছুদিনের জন্য আকাশের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক গড়ে তুলবে। আল্লা মহান। তাঁর কাছে এর চেয়ে আর কী বেশি আশা করতে পারি! সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে খুব নগণ্য সৃষ্টি আমরা মানুষ।
[ জন মিলিংটন সিঞ্জ-এর ‘রাইডারস টু দ্য সি’-র মতো মহান সৃষ্টিকে স্মরণে রেখে। ]