তারা যে মুনিশ তিনি তাদের দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। সবার কাছে একটা করে নাইলনের ব্যাগ ছিল। ব্যাগের ভেতর গামছা, লুঙ্গি ও কাঁচি ভরা ছিল। বাইরে থেকে কাঁচির অর্ধেক অংশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। যে অংশটা ধরে তারা ধান কাটে। অর্থাৎ ডামাটের দিক। আর ধারের দিক ব্যাগের ভেতর ছিল এবং তা শাড়ির ছেঁড়া পাড় দিয়ে ভালো করে জড়ানো ছিল। না হলে বাসে, ট্রেনে ওঠানামার সময় কারও গায়ে ঠেকে গা কেটে যায় যদি। গা কেটে গেলে বিরাট ঝামেলা না!
অরিন্দমবাবু তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন--- তোমাদের বাড়ি কোথায়?
--- আমাধের বাড়ি মুর্শিদাবাদ, বাবু! ফকিরুলরা বলেছিল।
--- মুর্শিদাবাদের কোথায়?
--- ডোমকল থানা।
--- ডোমকল থানার কোথায়?
--- গ্রামের নাম লস্করপুর।
--- তোমরা এখানে কী করতে এসেছ?
--- আমরা ধান কাটতে এসেচি, বাবু! আমরা ধান কাটা মুনিশ।
--- কার ধান কাটতে এসেছ? তোমাদের গৃহস্থ কে?
--- আমাধের কুনু গিরচ নাই, বাবু! আমরা কুনু গিরচ ধরে আসিনি।
--- তাহলে তোমরা কার কাজ করবে?
--- যে আমাধের কাজে ডাকবে আমরা তারই কাজ করবো। আপনি ডাকলে আপনারই কাজ করবো।
--- তাহলে তোমরা আমারই কাজ করো। আমি মুনিশের সন্ধানেই এখানে এসেছি।
--- করবো। মুনিশ খরচ কতো দিবেন?
--- এখন আমাদের দিকে মুনিশ খরচ পাঁচশো টাকা চলছে। তোমাদেরও পাঁচশো টাকাই দিব।
--- বিড়ি দিবেন?
--- কেন দিব না? বিড়িও দিব।
--- আর খাতে ক'বার দিবেন?
--- তিনবার দিব। সকালে চা-মুড়ি। দুপুরে ও রাত্রে ভাত।
--- আর শুতে কুণ্ঠে দিবেন? গোহাল ঘরে?
--- মানুষ গোয়াল ঘরে শোয় নাকি? গোয়াল ঘরে গরু থাকে।
--- শোয় না। কিন্তুক আমরা শুই; অনেক মানুষ আমাধের গোহাল ঘরে শুতে দ্যায়। কারণ, আমরা তো মানুষ না। আমরা মুনিশ। মুনিশের গোহাল ঘরে শুতে দিবে না তো কুণ্ঠে শুতে দিবে?
--- যারা দেয় তারা দেয়। আমি দিই না। আমি বাড়িতে পাকা ঘরে শুতে দিই; ঘরে ফ্যান, মশারি, বালিশ সব কিছু থাকে...
কথা মতো তিনি সেবার বাড়িতে পাকা ঘরেই শুতে দিয়েছিলেন এবং ফ্যান, মশারি, বালিশ সব কিছু দিয়েছিলেন। কুড়ি দিন কাজ করে তারা বাড়ি এসেছিল। একেকজনের দশ হাজার টাকার কাজ হয়েছিল।
এক বছর বাদে গত পরশু দিন তিনি ফোন করেছিলেন। তারা বাড়ি আসার দিন তাদের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়েছিলেন। ফোন করে ফকিরুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন--- কেমন আছো গ?
--- ভালো আছি।
--- আমি কে, চিনতে পেরেছ?
--- না। কে?
--- আমি অরিন্দম রায়; তোমাদের বাবু। গতবছর তোমরা আমার ধান কেটেছিলে।
--- ও, বাবু! ক্যামুন আছেন, বুলেন!
--- আমি তো ভালো আছি। তোমরা সব কেমন আছো?
--- আমরাও সব ভালো আছি।
--- ভালো থাকলেই ভালো। যাই হোক, ধান যে পেকে গেল। ধান কাটতে তোমরা কবে আসছ? তোমাদের জন্যই আমি বসে আছি; অন্য মুনিশ দেখিনি।
--- আজ সন্ধ্যাবেলায় সবার সঙ্গে কথা বুলে আপনাকে ফোন করে বুলছি।
--- ঠিক আছে, বলো।
ফকিরুল সন্ধ্যাবেলায় সবার সঙ্গে কথা বলে ফোন করেছিল--- বাবু, আমি ফকিরুল বুলছি!
--- বলো।
--- বুলছি, কাল বাদ পোশু দিন আমরা আসচি...
--- আচ্ছা; এসো।
এবার এসে তারা খুব বেশিদিন থাকতে পারে না। মাত্র কয়েক দিন কাজ করে বাড়ি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অরিন্দমবাবু তাঁর বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে প্রচুর দান সামগ্রী পেয়েছিলেন। এসবে ঘরবাড়ি ভর্তি ছিল। ফলে বাড়িতে বিরানা লোকের থাকার জায়গা ছিল না। অরিন্দমবাবু তার জন্য বাড়ি থেকে খানিক দুরে খামারে তাদের থাকার জায়গা করে দেন। খুঁটি পুঁতে পলিথিন টাঙিয়ে তার ভেতর।
একদিন রাতে সেখানে ত্রিশূল হাতে জনা ছয়েক লোক ঢুকে তাদের জিজ্ঞাসা করে--- এই, তোরা কারা শুয়ে এখানে?
--- আমরা অরিন্দমবাবুর জন।
--- বাড়ি?
--- মুর্শিদাবাদ।
--- হিন্দু? না মোচলমান?
--- মুসলমান।
--- জয় শ্রীরাম বল।
তারা না বলতে চাইলে তাদের ধরে মারে এবং পেটে ত্রিশূল ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
অরিন্দমবাবু প্রতিদিন ভোরবেলায় যে সময় মোরগ ডাকে তাদের কাছে আসেন। এসে তাদের ঘুম ভাঙান। এই তোমরা সব ওঠো; সকাল হয়ে এলো। মুখে এই আওয়াজ করেন। না হলে ঘুম ভাঙতে তাদের দেরি হয়ে গেলে কাজে লাগতে দেরি হয়ে যাবে। আর কাজে লাগতে দেরি হলে কাজ কম হবে। এতে গৃহস্থের কাজের ক্ষতি। নিজের কাজের ক্ষতি তিনি চান না।
যাই হোক। ঘুম ভাঙাতে এসে তিনি দেখেন, তারা কেউ শুয়ে নেই। সবাই বসে। দেখে তিনি প্রশ্ন করেন--- কী ব্যাপার? আজ আমি আসার আগেই তোমরা সব উঠে বসে আছো!
তারা বলে--- আমরা আর কাজ করবো না, বাবু; আমরা বাড়ি যাবো। আপনি আমাধের কাজের টাকা পয়সা মিটিয়্যা দেন!
--- সে কী! হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন?
--- আজ রাতে কিছু লোক আমাধের ডেরায় ঢুকে...যেকারণে আমরা আর কাজ করবো না। আমাধের খুব ভয় করছে। আবার যদি অরা আসে!
অরিন্দমবাবু তখন জিজ্ঞাসা করেন--- লোক গুলো সব দেখতে কেমন ছিল? চিনতে পেরেছ?
--- না, চিনতে পারিনি।
অরিন্দমবাবু এরপর বলেন--- তোমরা কেউ ভয় পেও না; তোমাদের সঙ্গে আমি আছি। আজ থেকে তোমরাও কাছে ত্রিশূল রেখে শোবে; আমি দেব। তারপর যে ব্যাটা তোমাদের কাছে আসবে তাকেই এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। তোমরা মুর্শিদাবাদের মানুষ; তোমরা পারবে। তোমাদের যথেষ্ট সাহস এবং শক্তি আছে। তারপর কেউ কিছু বলতে এলে আমি দেখে নেব। তোমাদের বাড়ি যেতে হবে না। তোমরা থাকো; খাও আর কাজ করো। আজ থেকে তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিলাম। আজকের পর থেকে তোমাদের কিছু হলে আমাকে বলবে।
এর উত্তরে ফকিরুলরা বলে--- না বাবু, তা হয় না; আমরা বিদ্যাশি মানুষ। আমরা অসব পারবো না। তাছাড়া আপনি রাতে বাড়িতে শোন। আর আমরা এখ্যানে খামারে শুই। অতোদূর থেক্যা আপনি রাতে আপনার চোখের মহামূল্যবান ঘুম কামাই করে আমাধের পাহারা দিতে আসবেন? আসবেন না। তাহলে আপনি আমাধের নিরাপত্তা দিবেন কীভাবে? তার থেক্যা আমরা বাড়ি যাই, বাবু!
অরিন্দমবাবু বলেন--- বাড়িতে থাকলে কী হবে? তোমাদের কাছে ত্রিশূল তো থাকছেই।
ফকিরুলরা বলে--- আমরা ত্রিশূল চাই ন্যা, বাবু; আপনি আমাধের বাড়ি যাতে দেন!
কিন্তু তিনি তাদের বাড়ি যেতে দেন না। বলেন--- তা কী করে হয়? এখনও তো কাজই শেষ হল না। আগে কাজ শেষ হোক তারপরে বাড়ি যেও! সবে তোমাদের আসা পাঁচ দিন হল। আরও পনেরো-বিশ দিন কাজ করো। তোমরা এখন বাড়ি গেলে আমি জন পাবো কোথায়? আর হ্যাঁ, আমার কথা অমান্য করে তোমরা যদি বাড়ি যাও, আমি তোমাদের একটা টাকাও দিব না। না তোমাদের কাজ করা টাকা, না তোমাদের পকেট খরচের জন্য বাড়ি থেকে আনা আমাকে রাখতে দেওয়া টাকা। কী করবে তোমরা এবার ভেবে দ্যাখো! কাজ করবে? না বাড়ি যাবে? আমি বাড়ি গেলাম।
ফকিরুলরা কাজ করে না। বাড়ি আসার জন্য তারা তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কারও কাছে পয়সা না থাকায় তারা বাসে চাপতে পারে না। কোনও বাস তাদের নেয় না। কিন্তু বাড়ি তো আসতে হবে। কীভাবে আসবে? শেষে তারা হাঁটতে শুরু করে দেয়। বাইশ কিলোমিটার পথ একেবারে কম নয়। তবু তারা অতখানি পথ পায়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছে যায়।
স্টেশনে ট্রেনে চেপে কিছুদূর আসা পর এক টাই কোট পরা ভদ্রলোক তাদের কাছে আসেন--- আপনাদের টিকিট দেখান! কোথায় নামবেন?
--- আমরা খাগড়াঘাট স্টেশনে নামবো, বাবু!
--- টিকিট দেখান!
--- আমাধের টিকিট নাই, বাবু!
--- নেই কেন?
--- আমরা টিকিট কাটিনি।
--- কাটেননি কেন? ট্রেনে চাপলে টিকিট কাটতে হয় জানেন না?
--- জানি, বাবু!
--- জানেন তা-ও টিকিট কাটেননি কেন?
--- আমাধের কাছে টিকিট কাটার পয়সা নাই। আমরা ধান কাটা মুনিশ। বর্ধমানে আমরা ধান কাটতে গেলছিনু। কিন্তুক আমাধের কাজের একটা টাকাও পানু না। গিরচ দিলো না। আমাধের সব টাকা মেরে দিলো...
--- পয়সা নেই তো ট্রেনে উঠেছেন কেন? নেমে আসুন!
একটা স্টেশনে তিনি তাদের নামিয়ে নেন এবং আলো-বাতাস হীন ছোট্ট একটা ঘরে পাঁচ ঘণ্টা বন্দি করে রাখেন। এরপর ছেড়ে দেওয়ার সময় সবার হাতের তালুতে একটা করে সীল মেরে দেন। এরকম বিদ্যাশ খাটা আর জাহান্নাম খাটা এ দুটোর মধ্যে কোনও ফারাক নেই।