পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তদন্ত শেষ হয়নি বলে, দিনের পর দিন কাউকে গ্রেপ্তার করে রাখা অন্যায়

  • 04 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 714 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
অনেকে হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে বাংলার শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করছেন, অনেকে হয়তো দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে কাঠগড়ায় তুলছেন, কিন্তু তাঁরা কি একবার ভেবে দেখবেন, এই সর্বোচ্চ আদালতই এখনও অবধি কেন্দ্রের শাসকদলের পুরো বিচারব্যবস্থাকে করায়ত্ব করার প্রয়াসকে কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে। তদন্ত শেষ হয়নি বলে, দিনের পর দিন কাউকে গ্রেপ্তার করে রাখা অন্যায় এই রায়ের মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত কি সেই চেষ্টাই করলেন না?

 

কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশন তিনটি রাজনৈতিক দলের জাতীয় দলের মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। এই নিয়ে আগামীতে হয়তো আইন আদালত হবে, তার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, তার থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখেছে নির্বাচন কমিশন যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, যা নিয়ে আলাপ আলোচনা যদি না হয়, তাহলে আগামীদিনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আদৌ থাকবে কি না, তাই নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এই যে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, নানান রাজনৈতিক দলের নেতা মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে রেখেছে, তদন্তের স্বার্থে, তা কী কারণে? এই বিষয়টি নিয়ে কি কোথাও কোনও আলোচনা হচ্ছে? সবাই তো ভাবছেন, মিডিয়াতে যখন দেখা গেছে এতো বড় দুর্নীতি হয়েছে, সুতরাং নিশ্চিত এই মানুষগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই তাঁদের শাস্তি হওয়াই উচিৎ। অবশ্যই উচিৎ, কিন্তু তা তো এই তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে প্রমাণ করতে হবে। শুধুমাত্র বলে দিলেই তো হবে না। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কী বলছে, তাও জানা জরুরী।

এক আবেদনকারীর আবেদনের প্ররিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি মামলার ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে, কোনও তদন্তকারী সংস্থাই তাঁর নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে, কোনও অভিযুক্তকেই আর গ্রেপ্তার করে রাখতে পারবে না। বিচারপতি কৃষ্ণ মুরারি এবং সি টি রবিকুমারের একটি বেঞ্চ সেই মামলার শুনানির সময়ে বলেন, যে কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যদি তদন্তকারী সংস্থা উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সহ চার্জশিট না দাখিল করতে পারে এবং বারংবার তাঁরা আদালতের কাছে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে রাখার চেষ্টা করে, তাহলে আদালত সেই আটক করে রাখাকে কখনোই সমর্থন করে না। তাঁদের বক্তব্য, যে কোনও অভিযুক্তেরই জামিন পাওয়ার অধিকার আছে। সর্বোচ্চ আদালত মনে করে, এই তদন্তকারী সংস্থাদের তদন্ত করার স্বার্থে যে মাঝে মধ্যেই তাঁরা অভিযুক্তদের নিজেদের হেপাজতে নেন এবং তারপরে বারংবার যে তাঁরা আদালতে আপিল করে বলেন, এখনও তদন্ত শেষ হয়নি, তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এখনই জামিন দেওয়া যাবে না, তা সংবিধান বিরোধী। সংবিধানের ৩২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যে কোনও মানুষের জামিন পাওয়ার অধিকার একটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে এবং সর্বোচ্চ আদালত কখনই সেই অধিকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। অনেকেই হয়তো এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু যে আদালত সংবিধানকে সামনে রেখে এমন একটি রায় দিচ্ছে, তাকে কি কোনও সরকার বা তাঁদের অঙ্গুলিহেলনে চলা তদন্তকারী সংস্থারা উপেক্ষা করতে পারে?    

 

আরও একটি বিষয়, যা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করেছে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে, যা সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এতোদিন অবধি নিয়ম ছিল, কোনও একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যদি কোনও কারণে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁর যদি দুবছর বা তার বেশী জেল হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পরবর্তী ৬ বছর কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।  এখন নির্বাচন কমিশন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রস্তাব রেখেছে, এখন থেকে যদি কোনও তদন্তকারী সংস্থা, কোনও একটি রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিটও পেশ করে, এবং তা যদি আদালত গ্রহণ করে এবং তাতে যদি প্রস্তাব করা থাকে যে সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিটির পাঁচ বছর বা তার বেশী সময়ের কারাদন্ড হতে পারে তাহলে তিনি আর নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন না। যে দ্রুততার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করা হয়েছে, আগামী দিনে যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব মেনে নেয়, তাহলে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের বা বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা নেত্রীদের নির্বাচনের ৬ মাস  আগে এইরকম কোনও চার্জশিট দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত করা হবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়? ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়ম ছিল, যতদিন না অভিযোগ প্রমাণিত হয়, ততদিন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি নির্দোষ, কিন্তু এই আইন যদি লাগু হয়, তাহলে কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকবে? যদিও ১৯৯০ সাল থেকে এই আইন চালু আছে, কিন্তু এবার নির্বাচন কমিশন রীতিমত হলফনামা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতকে এই আইনকে সংশোধন করার কথা বলেছে।  

অনেকে বলছেন, যদি কোনও ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, বা কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে থাকে, তাঁকে তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত করাই উচিৎ, কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশে কি বিচারব্যবস্থা সম্পুর্ণ পক্ষপাতহীন? আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, সিবিআই বা ইডি কি স্বশাসিত সংস্থা? তাঁরা কি কেন্দ্রের শাসক দলের অঙ্গুলীহেলন ছাড়া কাজ করতে পারে? যদি তাই হতো, তাহলে গত আট বছরে যে ১২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সিবিআই চার্জশিট দিয়েছে, তার ৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ১১৮ জনই বিরোধী দলের কি করে হয়? কর্ণাটক বা তেলেঙ্গানাতে বিজেপির নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কেন তাঁদের বিরুদ্ধে ইডি বা সিবিআই কোনও পদক্ষেপ নেয়নি? তাহলে কি বিষয়টা দুর্নীতি দমন না কি বিরোধী দমন? সেই জন্যেই কি নির্বাচন কমিশন এই প্রস্তাব রেখেছে, যে চার্জশীট পেশ করলেই আর কোনও ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না? আজকে হয়তো অনেকে ভাবছেন এই বিষয়টি দুর্নীতি বা নির্দিষ্ট অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, কিন্তু আগামীদিনে যে এই আইন সমস্ত বিরোধী দল বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়? আজ যা বাংলায় হচ্ছে, কাল যে তা কেরালা বা রাজস্থানে হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায়?

অনেকে হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে বাংলার শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করছেন, অনেকে হয়তো দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে কাঠগড়ায় তুলছেন, কিন্তু তাঁরা কি একবার ভেবে দেখবেন, এই সর্বোচ্চ আদালতই এখনও অবধি কেন্দ্রের শাসকদলের পুরো বিচারব্যবস্থাকে করায়ত্ব করার প্রয়াসকে কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে। যেভাবে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানইয়াহু বিচারব্যবস্থাকে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলার চেষ্টা করেছেন, এখানেও কি সেইরকম চেষ্টা হয়নি? আজকে সর্বোচ্চ আদালত যে কথাগুলো বলেছেন, এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে, তাতে হয়তো অন্যরকম মনে হতে পারে, কিন্তু তা যে আসলে সংবিধানকেই ঊর্দ্ধে তুলে ধরা, তা যদি বোঝা না যায়, তাহলে আগামীতে সমূহ বিপদ। এই আদালতই হয়তো নানান সময়ে নানান রায় দিয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ক্ষুণ্ণ করেছে, কিন্তু আজকের এই রায়কে স্বাগত না জানালে অন্যায় হবে। যেটা ভুল সেটাও যেমন বলা দরকার, যেটা ঠিক, সেটাও তো বলা জরুরী।

0 Comments

Post Comment