পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভাতের লড়াইয়ে নামা জরুরি

  • 11 July, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 316 view(s)
  • লিখেছেন : ত্রিয়াশা লাহিড়ী
ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট না। রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি, বিজেপি এবং তার চালিকাশক্তি আরএসএস'এর নেতা-কর্মীরা যেভাবে দিনের পর দিন রাজ্যজুড়ে তথা দেশজুড়ে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি অনুশীলন করছে, তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ প্রয়োজন। সেই লড়াইটা কীভাবে হবে ?

ভারতে শিশুদের অপুষ্টি, স্কুলে অনুপস্থিতি এবং স্কুলছুটের হার কমাতে ‘মিড-ডে মিল’ প্রকল্প চালু হয়। এর সূচনা ১৯২৫ সালে, মাদ্রাজ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের উদ্যোগে, অনগ্রসর শ্রেণির শিশুদের জন্য দুপুরে খাবারের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। একই সময়ে কলকাতার কিছু স্কুলেও এই ব্যবস্থা চালু হয়। আশির দশকে গুজরাট, কেরালা, তামিলনাড়ু ও পন্ডিচেরির মতো কিছু রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এই কর্মসূচি চালু হয়। ১৯৯০-৯১ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বিস্তৃত হয় বারোটি রাজ্যে। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভারত সরকার জাতীয় পর্যায়ে 'জাতীয় পুষ্টিকর মধ্যাহ্নভোজন কর্মসূচি' শুরু করে। শুরুতে শুকনো রেশন দেওয়া হলেও পরে তা পুরোপুরি রান্না করা খাবারে রূপান্তরিত হয়। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, সমস্ত সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে পুষ্টিকর রান্না করা খাবার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর ফলে প্রকল্পটি একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে-মিল চালু হয় ২০০৩-এ। ২০০৪ সালে রান্নার খরচ ও খাদ্যশস্যের জন্য কেন্দ্রীয় সহায়তা বাড়ানো হয় এবং ২০০৬ সালে উচ্চ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদেরও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্রকল্প বিশেষভাবে দলিত, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলমুখী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার মিড-ডে-মিলের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়েছিল। প্রাথমিকে মাথাপিছু বরাদ্দ করা হয়েছিল ৬ টাকা ১৯ পয়সা। আর উচ্চ প্রাথমিকে ৯ টাকা ২৯ পয়সা। চলতি অর্থবর্ষে বাজেট প্রাথমিকে মাথাপিছু বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা। আর উচ্চপ্রাথমিকে ১০ টাকা ১৭ পয়সা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যখন আকাশছোঁয়া, সেই সময় এই যৎসামান্য পরিবর্তন কি আদৌ পড়ুয়াদের পক্ষে লাভজনক হবে? যারা এই বাজেট নির্ধারণ করেন, তারা জানেন আজকের বাজারে একটা ডিমের দাম কত? ৭টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, ততখানি বাজেট না বাড়ালে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণে খামতি থাকারই কথা। কেন্দ্র এবং রাজ্যের ৬০:৪০ অনুপাতে বাজেটের টাকা ভাগ হয়। রাজ্য সরকারও উদ্যোগী হয়ে এক্ষেত্রে টাকা বাড়াতে পারে। বরাদ্দ না বাড়ালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে মিড-ডে-মিলের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।

করোনা অতিমারির বছরে স্কুলছুট পড়ুয়াদের সংখ্যা একেবারে একলাফে লক্ষ ছাড়িয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে অনেক বাবা-মা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেন পড়াশোনার পাশাপাশি মিড-ডে-মিলের জন্য। একবেলার দু'হাতা ভাত যদি বাঁচে, সে ভাতে অন্যবেলা চালিয়ে নেওয়া যাবে। অভাবের সংসারের মেপে চলার ছবি যেমনটা হয়! ২০২০-২১ সালের সমগ্র শিক্ষা অভিযানের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, উচ্চ প্রাথমিকে পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৭ লক্ষ। মাধ্যমিক স্তরে সেটা কমে ২৫ লক্ষর সামান্য বেশি, আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাত্র ১৬ লাখ ছাত্রছাত্রী স্কুলে যাচ্ছে, পড়াশোনা করছে৷ তবে উচ্চ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে আসলে, লাখ লাখ পড়ুয়ারা নিখোঁজ কেন? এই উত্তর খোঁজার দায় ঝেড়ে ফেলেছে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকার।

ইতিমধ্যে নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ এনেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ২০২০-২১ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুট শুধুমাত্র মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ১,২০,৯৩৬। ছাত্র এবং শিক্ষক-সমাজ জানিয়েছে, এই নীতি শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ এবং গৈরিকীকরণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎকে আরও এক ধাপ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্কুল থেকে কলেজ প্রাঙ্গনেই গিয়ে উঠতে পারছে না অধিকাংশ পড়ুয়া। কলেজের আসনসংখ্যা ফাঁকা পড়ে থাকছে। উচ্চশিক্ষায় যাওয়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঝোঁক কমছে। শিক্ষা মন্ত্রকের স্কুল শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিভাগ তাদের নিজস্ব পোর্টালে বিভিন্ন রাজ্যের স্কুল পড়ুয়াদের এবং স্কুলছুট শিশুদের তথ্য প্রকাশ করে। তথ্য বলছে, সারা দেশে ১১.৭০ লক্ষেরও বেশি শিশু স্কুলছুট হয়েছে। গেরুয়াশাসিত রাজ্যগুলোর অবস্থা আরও ভয়ানক। মিড-ডে-মিল শিক্ষাব্যবস্থার হাড় বেরোনো কঙ্কালসার ছবিটার একটা অংশ মাত্র।

মিড-ডে-মিল প্রকল্পে যারা স্কুলের রান্নাঘর সামলে রাখেন, যত্ন করে রান্না করে বাচ্চাদের খাওয়ান, সেইসমস্ত গরীব ঘরের মেয়েরা বেতন বাবদ পায় মাত্র ২,০০০ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে মিড-ডে-মিল কর্মীরা সংগঠিত ভাবে এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। হরিয়ানায় কর্মীরা পান মাসিক ৭,০০০ টাকা , কেরলে দিনপ্রতি ৬০০ টাকা, হিমাচল আর কর্ণাটকে পান মাসিক ৪,০০০ টাকা। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য নিজস্ব অর্থ তহবিলের মাধ্যমে এই টাকার জোগান দেয়। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের 'মা-মাটি-মানুষের' সরকার এই প্রশ্নে এতখানি পিছিয়ে কেন? মহিলারা ১২ মাস কাজ করে ১০ মাসের টাকা নিতে বাধ্য হয়। এই মহিলা কর্মীদের সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটি নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। উৎসব ভাতা নেই। সামাজিক সুরক্ষা নেই। এমনকি সরকারি কর্মীর স্বীকৃতিটুকু নেই। এত না পাওয়া নিয়েও দরিদ্র ঘরের মহিলারা অভাবের জ্বালায় কর্মীরা বেগার খাটেন।

সরকারি তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ৮২০৭টি সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে পড়ুয়াদের অভাব৷ এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠবে, বন্ধ হয়ে যাওয়া বা বন্ধ হওয়ার মুখে থাকা স্কুলগুলোর মিড-ডে-মিলের কর্মীদের কী হবে? অন্যত্র কর্মসংস্থানের উপায় বাতলে দেওয়া কি সরকারের কাজ নয়?

লড়াইটা হওয়ার ছিল ভাতের থালায়। অথচ, দুঃখের বিষয়, আজ সব সমস্যার মূলে এসে পড়ছে ধর্মীয় ভেদাভেদ। আর এই আকচা-আকচির সুযোগ কুড়োচ্ছে শাসকশ্রেণি। কয়েকদিন আগে খবরের পাতায় বড় বড় করে লেখা হয়েছিল, 'রাম-রহিমের আলাদা হাঁড়ি'। জানা গিয়েছিল, পূর্বস্থলীর কিশোরীগঞ্জ-মনমোহনপুর প্রাথমিক স্কুলে মিড-ডে মিলের রান্নার হেঁসেল, হাঁড়ি, রাঁধুনি সবই অনেকদিন ধরেই ছিল আলাদা। হিন্দু এবং মুসলমান – এই দুই সম্প্রদায়ের জন্য রান্না করত হিন্দু রাঁধুনি সোনালী মজুমদার এবং মুসলিম রাঁধুনি গেনো বিবি। মিড-ডে-মিল কেবল খিদে মেটায় না, বন্ধুদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে একই খাবার খাওয়ার মধ্যে ঐক্যের বার্তা আছে। সামাজিক বা পারিবারিক স্তরে যার যা অবস্থান, সব মিলেমিশে যায় ভাতের থালায়। ফলতঃ পূর্বস্থলীর ঘটনা ছিল বেদনাদায়ক। এই খবর নিয়ে শোরগোল বাধলে, প্রশাসনের নির্দেশে ধর্মীয় বিভেদ মুছে এক কড়াইতে রান্না করে দুই রাঁধুনি। কিন্তু হিন্দুদের অভিভাবকরা অনেকেই জানান, একসাথে রান্না হলে তাদের বাচ্চারা মিড-ডে-মিলের খাবার কিছুতেই খাবে না। যদিও মুসলিম অভিভাবকদের দিক থেকে এমন কোনও ভাষ্য আসেনি। তারা জানিয়েছেন, এই ব্যবধান মুছে যাওয়ায় তারা খুশি হয়েছেন। রান্না যেই করুক, তাদের বাচ্চারা অবশ্যই সেই খাবার খাবে।

বলাই বাহুল্য, ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট না। রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি, বিজেপি এবং তার চালিকাশক্তি আরএসএস'এর নেতা-কর্মীরা যেভাবে দিনের পর দিন রাজ্যজুড়ে তথা দেশজুড়ে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি অনুশীলন করছে, তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ প্রয়োজন। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে ক্রমশ নিজের জমি হারাচ্ছে। উগ্র হিন্দুত্বের মাঠে নেমে নরম হিন্দুত্বের চাষ করছে। তৃণমূল-সুপ্রিমোরা যতই সম্প্রীতির বার্তা দিক, আরএসএস প্রত্যেকের মগজ ধোলাই করার কাজ পাড়ার ক্লাব, খেলার মাঠ থেকে ট্রেনে-বাসে-ট্রামে সর্বত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তার ফল ভোগ করছে নতুন প্রজন্ম এবং তাদের বাবা-মায়েরা। যাদের সরকারকে প্রশ্ন করার কথা ছিল, মিড-ডে-মিলের বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না কেন– আজ তারা প্রশ্ন করছে, ধর্ম আলাদা হলে রান্নার হাঁড়ি এক হবে কেন? হাঁড়িতে কতটা চাল ফুটলো, তা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। স্কুলশিক্ষা বাঁচানোর প্রশ্নে, খাবারের গুণগত মান বাড়ানোর প্রশ্নে, পড়াশোনার খরচ কমানোর প্রশ্নে যাদের এক হওয়ার কথা ছিল– তারা আজ সরকারের বিরোধিতা করে না। বরং, এই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো নিজেদের সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে অন্য ধর্মের মানুষের। বিভাজন যখন শ্রমিক শ্রেণির ঘরে ঢোকে, তখন সেই লাভের গুড় খেয়ে যায় মসনদে বসে থাকা নেতারা। হিন্দুত্বের রাজনীতি আজ যতটা মানুষের ভেতরে গেঁথে গেছে, সেই রাজনীতিকে দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ খাইয়ে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না। এই কঠিন সংঘাতকে মোকাবিলা করতে কোনও সহজ-সোজা-সুগম পথ নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাকেই অস্ত্র করতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেসকে বুঝতে হবে বিজেপি'র মাঠে নেমে বিজেপি'কে হারানো সম্ভব না।

লড়াইয়ের একমাত্র বিষয় ধর্মের নয়– লড়াই হোক ভাতের জন্য, শিক্ষার জন্য, জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য– শাসকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই– অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই– নবজাতকের কাছে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তোলার লড়াই।

0 Comments

Post Comment