পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এবারের বসন্ত পঞ্চমী ও কিছু স্মৃতিকথা

  • 08 February, 2025
  • 2 Comment(s)
  • 667 view(s)
  • লিখেছেন : আজমল হুসেন
এবছর সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুৎসিত নাটকের সাক্ষী থেকেছে আনন্দ নগরী কলকাতা। এর কাণ্ডারি ছিলেন মূলত তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশ। তাঁদের এই কৃতকর্মে সক্রিয় সহযোগিতায় ছিল সম্পূর্ণরূপে নীতিভ্রষ্ট আজকের মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া। তা সত্ত্বেও এই লেখকের আশা একদিন পৃথিবী আবার শান্ত হবে, মনের বিদ্বেষ কাটিয়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে।

আমি যখন গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন প্রথমবারের মতো কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট বিভাগে বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখি। পুজোর দিনই সিনিয়রদের কাছে জানতে পারি যে আমাদের নৃতত্ত্ব বিভাগে এই পরম্পরা শুরু করেন তদানীন্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবু নিসার মুহাম্মদ ঈরশাদ আলী। সেই বছরই আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়। রমজান মাসে একদিন বিকেলে ইফতারের আয়োজন করা হয়, সেদিনই জানতে পারি যে ইফতারের আয়োজক তখনকার সচিব (Secretary, University Classes) ডঃ রাজেশ্বর শর্মা। চিরকাল একটা বিভাজিত পরিবেশে ধর্মীয় উৎসব পালিত হতে দেখে এসে এই দুটো অভিজ্ঞতাই আমার কাছে যারপরনাই চিত্তাকর্ষক এবং আনন্দদায়ক ছিল। এছাড়াও আমাদের স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত বর্ষে বসন্ত পঞ্চমীতে উৎসব পালনের মূল উদ্যোক্তা ছিল আমার সহপাঠী বন্ধু প্রেম কিরণ নাথ (সে তখন আমাদের স্নাতকোত্তর ছাত্র সংস্থার বিভাগীয় প্রতিনিধি), আর সহায়ক ছিলাম আমি। এর মাঝামাঝি তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে শরাইঘাট সেতুর নিচে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে । আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী হচ্ছে বা কীভাবে হচ্ছে তা জানি না। তবে সদ্য প্রয়াত ঈরশাদ আলী স্যারের মৃত্যুতে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হতে দেখলাম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাপুকন চৌধুরীকে। দুজনই পরস্পরের অত্যন্ত কাছের মানুষ। দুজনই আমার পরম প্রিয়, পরম শ্রদ্ধেয়। ঘটনাচক্রে আমার পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থের কাজ চৌধুরী স্যারেরই তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। এখনও তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। বিহুর সময় আমি যোগাযোগ করি, ইদের দিন স্যার ফোন করেন। কলকাতা এলে স্যার আমাকে আগেই জানিয়ে দেন, আর দেখা না করে শহর ছাড়েন না। সময় থাকলে বাড়িতেও আসেন। এই সহমর্মিতাই আসলে আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য, যা কাঁটাতারের সঙ্কীর্ণতা বা অন্য কিছু দিয়ে মাপা অসম্ভব।                        
গত একুশ-বাইশ বছর ধরে আমি যে পাড়ায় থাকি সেখানে অধিকাংশ সময়ই শারদোৎসব, দীপাবলি  আর বসন্ত পঞ্চমীর আগে চাঁদা সংগ্রহ আমার বাড়ি থেকেই শুরু হয়। শুরুর দিকে যাঁরা আসতেন তাঁদেরকে দাদা বলে ডাকি। মাঝামাঝি কয়েক বছর নতুন একটি প্রজন্ম, আমি তাদের দাদা। এখন যারা আসে তারা আমাকে কাকু বলে ডাকে – কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে বা কেউ কেউ সদ্য চাকরী পেয়েছে। এদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে আমি এই পাড়ায় আসার পর। চোখের সামনে এদেরকে বেড়ে উঠতে দেখেছি। এরা সবাই আমার স্নেহভাজন। চাঁদা হাতে পাওয়ার পর এদের চোখে মুখে যে আনন্দ দেখতে পাই সেটা আমার কাছে সাত রাজার ধন। হাজার প্রতিকূল অবস্থা থাকলেও যা চায় তাই দিয়ে দিই আমি।  

   
পাড়া থেকে একটুখানি এগিয়ে এলে দেখা যায় রাস্তার দুইধারে একেবারে মুখোমুখি মন্দির আর মসজিদ। সেখানে কিছু মুসলমান বসতবাড়ি আছে, তাঁদেরও কেউ কেউ আমাকে চেনেন, তবে কোনও মুসলমান ইদ বা মিলাদের জন্য আমার কাছে চাঁদা বা অন্য কোনওরকম অর্থসাহায্য চাইতে আসেন না। এলেও আমার আপত্তি ছিল না, প্রয়োজন হলে হয়তো সাধ্যমতো তাঁদের পাশেও একইভাবে থাকতাম।         
এই অব্ধি ঠিক আছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে একটা ব্যাপার দেখা যায় যা আগে কখনও দেখিনি। আমার উপস্থিতির মধ্যে একটা বিভ্রান্তিকর ব্যাপার আছে, শিক্ষিত বাবুরা যাকে বলতে পারেন deceptive presence. চেহারায় প্রতীকী তেমন কিছু নেই, তাই নাম জানা না থাকলে ভদ্রলোকেরা আমাকে মানুষ বলেই ধরে নেন । অর্থাৎ আমাকে দেখলে যবনদের মতো কম মানুষ কিংবা অমানুষ বলে মনে হয় না। কেউ কেউ অবলীলায় তাঁদের মনের কথা বলে দেন। একদিন একজন বলে ফেললেন, “মোদিজির প্রশংসা করতেই হয়। দম আছে। দেখেছেন কেমন করে মোল্লাদের টাইট দিয়েছে! ইউপিতে আর আসামে তো বুলডোজার চালিয়ে একেবারে কোমর ভেঙে দিয়েছে শালাদের।” আরেকবার নাগেরবাজার এলাকায় একটা ফলের দোকানের কাছাকাছি একজন অচেনা ‘ভদ্রলোক’ সহসা আমার হাত ধরে বললেন, “জানেন মশাই, হতে পারে লোকটা মহমেডান, কিন্তু যথেষ্ট রিজনেবল দাম নেয়।“ ওই ফল বিক্রেতার কাছ থেকে আমিও নিয়মিত ফল কিনতাম। কিন্তু সে যে মুসলমান, ভদ্রলোকেরা যাকে বলেন ‘মহমেডান’, সেদিন প্রথম জানতে পারলাম। এটাও প্রথম জানতে পারলাম যে সে ‘মহমেডান’ হওয়া সত্ত্বেও ন্যায্য দাম নেয়। 

            
এতক্ষণ এই শিবের গীত গাওয়ার একটা কারণ আছে। মুসলমানদেরকে নিয়ে গড়পড়তা ভদ্রলোক’ বাঙালির এটাই ধারণা যে ওরা মূলত খারাপ লোক। যদি ভালো কিছু এদের মধ্যে পাওয়া যায় তখন ভদ্রলোকদের উপর এই বাড়তি কথাটা বলে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় যে মুসলমান থুড়ি মহমেডান হওয়া সত্ত্বেও লোকটা তেমন খারাপ নয়। এভাবেই আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী মনে করতেন আমি খুব উদার মনের একজন মানুষ। আমার উদারতার প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি একবার মনের কথাটা বলে ফেলেন, “আজমল স্যার ইজ সাচ অ্যা নাইস পারসন! কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট ফ্রম অ্যানি আদার মুসলিম!” আমার সেই কনভেন্ট এডুকেটেড সহকর্মীর এই কথাটি আগেও একবার অন্য কোথাও অন্য এক প্রসঙ্গে লিখেছি । মোদ্দা কথা মুসলমানরা বড্ড খারাপ, এদের মধ্যে ভালো কিছু দেখা গেলে সেটা ব্যতিক্রম, এবং জগৎসংসারকে এ ব্যাপারে এভাবেই অবগত করা ভদ্রলোক বাঙালি নিজের একান্ত কর্তব্য বলেই মনে করেন।                    
আমি এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি যেখানে সরস্বতী পুজো নিয়ে কোনওরকম আড়ম্বর গত ১৬ বছরে আমার চোখে পড়েনি। এমনকি প্রতিবছর সরস্বতী পুজোর ছুটিও পাওয়া যায় না। যেসকল সহকর্মী বাড়িতে সরস্বতী পুজো করেন, তাঁদেরকে আলাদা করে ছুটির জন্য আবেদন করতে হয়। নিজেদের জমানো প্রাপ্য ছুটি থাকলে তবেই ছুটি মঞ্জুর হয়, অন্যথা অনুপস্থিতির জন্য বেতন কাটা যাবে। আগে থেকে জানিয়ে রাখি যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিংবা অন্য ক্ষমতাধর কেউ কিন্তু মুসলমান নন। অধ্যাপক বা অন্য কর্মীদের মধ্যেও মুসলমান এক শতাংশেরও কম। কিন্তু এখানে সরস্বতী পুজোর ছুটি কেন পাওয়া যায় না? পুজোই বা কেন সারা বাংলার মতো এতটা জাঁকজমকপূর্ণ হয় না? এর কারণ এই প্রতিষ্ঠান হিন্দি বলয়ের নিয়ন্ত্রণে। বসন্ত পঞ্চমী এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির অংশ হলেও বাগদেবীকে বাঙালির  মতো আর কেউ এতটা নিজের করে নিতে পারেনি। সীমান্তের এপার হোক কিংবা ওপার, বাঙালির চিন্তা চেতনায় আর আরাধনায় বাগদেবী যেমনভাবে রয়েছেন তা আর অন্য জাতির ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে আজকের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতেও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই এবছর ৭৪টি সরস্বতী পুজোর প্যান্ড্যাল ছিল। হিন্দি বলয়ে এমনটা অকল্পনীয়। পশ্চিমবঙ্গে তো এর অন্যথা হওয়ার প্রশ্নই ছিল না, হয়ও নি যথারীতি। প্রতিবারের মতোই এবছরও বিশ্বাসী বাঙালির চিন্তা-চেতনায়, তাঁদের আরাধনায় বীণাপাণি তাঁর বীণা হাতে ছিলেন স্বমহিমায়।             
তবে এবছর সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুৎসিত নাটকের সাক্ষী থেকেছে আনন্দ নগরী কলকাতা। এর কাণ্ডারি ছিলেন মূলত তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশ। তাঁদের এই কৃতকর্মে সক্রিয় সহযোগিতায় ছিল সম্পূর্ণরূপে নীতিভ্রষ্ট আজকের মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া। দুটো দলের রাজনৈতৈতিক লড়াইকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার সবরকম চেষ্টা হয়েছে একটি কলেজের সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে। সেই উদ্দেশ্য খানিকটা সফলও হতে দেখা যায় যখন হাইকোর্টের নির্দেশে কলেজে পুলিশি প্রহরায় সরস্বতী পুজো হয়। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আশা করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন তথাকথিত ভদ্র সমাজের কতিপয় গুণীজন। অথচ যে দুটো দলের পুজোকে কেন্দ্র করে এতসব নাটক, একটাতে হর্তাকর্তা নিজেই মুসলমান।

           
পুজোর মূল উদ্যোক্তা মুসলমান, ইদ কিংবা মিলাদের অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় একজন হিন্দু - এমন ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে একেবারেই বিরল নয়। আমি প্রতি বছরই এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী থাকি, এবারও ছিলাম। বসন্ত পঞ্চমীতে এমন একটি সংস্থায় আমি প্রতিবছর আমন্ত্রিত থাকি যাতে কিনা মূল উদ্যোক্তা একজন মুসলিম মহিলা, তাঁর হিন্দু স্বামী এবং তাঁদের কন্যা। যখন অন্যত্র নাটকের প্রোটাগনিস্টরা গেল গেল রব তুলে বিদ্বেষের উৎসবে মাতোয়ারা, তখন আমি সেই হিন্দু-মুসলমান দম্পতি এবং তাঁদের কন্যার আন্তরিক আমন্ত্রণ পেয়ে বসন্ত পঞ্চমীর আনন্দে ভাগ বসাতে গেছি। রাস্তায় যেতে যেতে  দেখলাম পরিস্তিতি ঠিক ততটাই স্বাভাবিক যতটা প্রতিবছর থাকে। চারিদিকে আনন্দময় উৎসবমুখর  পরিবেশ। সেজেগুজে বেরিয়েছে অগণন ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ সর্বত্র। 

                   
এরমধ্যে কিছু আরবী নামধারী চাটুকারও নেমে পড়েন নিজেদের ঠুনকো প্রগতিশীলতার ভাবমূর্তি রক্ষায়। এই প্যাচওয়ার্ক ছাড়া কিন্তু তাঁরা একটা সাংস্কৃতিক সংকটে পড়ে যেতে পারেন। সাংস্কৃতিক মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো, সুদৃশ্য উত্তরীয় এবং সম্মাননা স্মারক - এসব তাঁদের দীর্ঘদিনের অভ্যেস। এসবের মায়া কাটানো মুখের কথা নয়। অগত্যা তাঁদের মহামূল্য কলম প্রগতিশীল মুখ এবং সাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী  বিদ্বেষ বিলাসী গুণীজনকে তুষ্ট করতে তড়িঘড়ি কিছু চাটুকারি কবিতা প্রসব করে। এঁদের চরিত্র ঠিক ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা এক এমবিবিএস পড়া আরবি নামধারী মুসলমান বিদ্বেষের পোষ্টার গার্লের মতো, যিনি কিনা একসময় ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কলম ধরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাছাড়া, একটা ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল করার অপচেষ্টা হয়। একজন নিজেকে পুরোহিত তথা বোলপুরের কোনও এক এলাকার একটি স্কুলের প্রাক্তনী বলে দাবি করেন এবং অভিযোগ করেন যে সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাকি তাঁকে স্কুলের ভেতরে পুজো করতে দেবেন না বলে চাবিটা নিজের কাছে রেখে দেন। সেই অভিযোগকারী কিন্তু স্কুল বা শিক্ষকের নাম ওই রিলটাতে কোথাও উল্লেখ করেননি। গুণীজনদের কেউ কেউ সেই রিলটি শেয়ার করেন তাঁদের ফেসবুক পেজে। এঁদের মধ্যে আবার কিছু স্বনামধন্য শিক্ষকও রয়েছেন।  ভিডিওটিতে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য যেটুকু ঘাটতি ছিল তা হল একটা স্কুলের নাম, এবং সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নাম যা অবশ্যই আরবিতে হবে, যাতে নাম পড়েই মনে হয় যে তিনি মুসলমান। তথাকথিত সভ্য সমাজে  এই ঘাটতি পূরণ করার লোকের অভাব  থাকার কথা নয়, ছিলও না। কেউ একটি স্কুলের ছবি পোষ্ট করলেন কমেন্টে। আরেকজন এসে একটি আরবি নাম জুড়ে বললেন এই লোকটাই স্কুলের হেডমাস্টার। অর্থাৎ ‘মুসলমান হেডমাস্টার স্কুলের ভেতরে সরস্বতী পুজো করতে দেয়নি, তাই বাধ্য হয়ে বাইরে পুজো সারতে হয়েছে।‘ কেউ কেউ আবার পুরো একটি সম্প্রদায়কে অকথ্য অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। কদর্য ভাষায় বাংলাদেশ বা পাকিস্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন । এই বাংলাদেশ বা পাকিস্তান যে কার পৈত্রিক সম্পত্তি কে জানে! যখন খুশি যাকে-তাকে সেখানে চলে যেতে বলা যায়।              
সামাজিক মাধ্যমে এই ‘শেয়ারিং অ্যান্ড কেয়ারিং’ পুণ্যকর্মে ভিডিওটিতে  শুধুমাত্র একজনকেই কথা বলতে দেখা যায়, কেবল একজন  মানুষেরই কথা শোনা যায়। আর তিনি হলেন নিজেকে পুরোহিত তথা সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রাক্তনী বলে দাবি করা সেই ব্যক্তি। যে হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁকে কোথাও দেখা যায়নি, যথারীতি গল্প পুরোটাই একতরফা। বিদ্বেষের এই আবহে আরও কিছু চিত্তাকর্ষক কবিতা পড়ারও সুযোগ হয়, যার সারবস্তু এই - মুসলমানদের জন্য সরস্বতী পুজো করা যাচ্ছে না। বোলপুর এবার বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে। একবছর আগে হলে বাংলাদেশ না বলে বলা যেত ‘পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে’। দীর্ঘদিনের জাতশত্রু হিসেবে চিহ্নিত প্রতিবেশি পাকিস্তান এখন তার সেই গ্ল্যামার হারিয়েছে। অগত্যা এবার নতুন প্রতিবেশি শত্রু বাংলাদেশ, আজকের দিনে ভীষণ টিআরপি-ফ্রেন্ডলি। 

নিজের গবেষণার স্বার্থে আমি সেইসব পোষ্টের স্ক্রিনশট নিয়ে রাখি, কারণ বিগত সব অভিজ্ঞতা বলছে, বিদ্বেষ বিলাসে অসত্য আর অর্ধসত্য-নির্ভর এইসব পোষ্টের আয়ু সাধারণত একদিনের বেশি হয় না। কারণ যিনি পোষ্ট করেন তাঁর মনে আজন্ম লালিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ একশোভাগ খাঁটি হলেও পোষ্টের সত্যতা নিয়ে তাঁর মনে সংশয়ও থাকে। তাই একটা সময়ের পর তিনি নিজেই পোষ্টটা ডিলিট করে দেন। এবারেও তাই হয়েছে। সেইসব গুণীজন একদিনের বেশি তাঁদের টাইমলাইনে পোষ্টগুলোকে জায়গা দেননি ।   

               
এতকিছুর পরেও একটা কথা হলফ করে বলা যায় যে এবছর বসন্ত পঞ্চমীতে বাঙালি প্রতিবারের মতোই আনন্দমুখর ছিল।  এপারে হোক বা ওপারে, কলকাতা হোক, ঢাকা হোক কিংবা শিলচর, সর্বত্রই বাঙালি সগৌরবে পরিচিত মেজাজে আনন্দে কাটিয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের সৌহার্দ আর ভালবাসা বিদ্বেষের মুখে চুনকালি মাখিয়ে বাঙালিকে বাঙালির মতোই উৎসবে মাতিয়ে রাখতে পেরেছে।  হিন্দু হোন বা মুসলমান হোন বা ব্রাহ্ম হোন, কিংবা অন্য যে কোনও ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হোন, গড়পড়তা বাঙালি মানুষ সাম্প্রদায়িক নন। তাঁরা ধর্মপ্রাণ হোন বা নাস্তিক হোন, তাঁরা সহমর্মিতায় আর সহাবস্থানে বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা ভিন্নমত-সহিষ্ণু। তাঁদেরকে দিয়েই চিনতে হয় প্রকৃত বাঙালিয়ানাকে। এই বাঙালিয়ানা চিরন্তন হোক এটাই কামনা।            


 

   
2 Comments

মালবিকা মিত্র

08 February, 2025

খুব ভালো লেখা। এই ধরনের অভিজ্ঞতা যত বেশি প্রচারিত হয়, যত বেশি অংশীদার পাওয়া যায়, সেটাই বাংলা বাঙালি ও দেশের পক্ষে মঙ্গল জনক। ধুলোর আস্তর সরালে সকলের জীবনে এমন অভিজ্ঞতার হদিস পাওয়া যাবে। সেগুলোও তুলে আনা প্রয়োজন। সবার আগে তো ধুলো ঝাড়তে হবে। ধূলো সড়াবে কে?

Manisha Banerjee

08 February, 2025

আমাদের ইস্কুলে বছরের পর বছর এই উৎসবে সব ধর্মের মেয়েদের বিশেষ অংশগ্রহণ দেখি। নিজে একটু তফাতে থাকি কারণ আমার পুজো আমার বাড়িতেই করা হয়। কোনোদিন ভাবিনি ইস্কুলের লেখাপড়ার মান, মিড ডে মিলের বরাদ্দ এই সব বাদ দিয়ে সরস্বতী পূজা একটা আন্দোলনের বিষয় হবে। লেখককে অশেষ ধন্যবাদ। খুব জরুরী এবং ভালো লেখা।

Post Comment