পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ছোপ ও ছিছিক্কার

  • 28 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 4144 view(s)
  • লিখেছেন : শতাব্দী দাশ
মে মাসের আঠাশ তারিখ, অর্থাৎ ২৮/০৫ তারিখটি প্রতিবছর ইদানীং পালন করা হয়, বিশ্ব ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস হিসেবে। সাধারণত মেয়েদের বয়ঃসন্ধির পরিবর্তন শুরু হয় দশ থেকে এগারো বছরের মধ্যে। একটি ছেলের শরীরেও বয়ঃসন্ধিকালে নানা বদল ঘটে- কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, দাঁড়ি গোঁফ ওঠা, বীর্যপাত। কিন্তু যে অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুতা, লোক-লজ্জা ও বিধিনিষেধ মেয়েদের ঋতুস্রাবের জন্য বরাদ্দ,তার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় নয়। এই বিষয় নিয়ে একটি জরুরী লেখা।

মে মাসের ২৮ তারিখ। তা স্বস্বীকৃত হয়েছে বিশ্ব ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস হিসেবে৷ জার্মানীর WASH UNITED ২০১৩ সালে এই দিবস পালন শুরু করে। ২৮/৫ কে বেছে নেওয়ার কারণ, সচরাচর মাসিক ঋতুস্রাব ঘটে পাঁচ দিন ধরে ও সচরাচর তা ২৮ দিনের চক্র। অর্থাৎ প্রতি আটাশ দিনের মাথায় তা ফিরে আসে। অবশ্য স্থায়ীত্ব আর দুটি ঋতুস্রাবের মধ্যের ব্যবধান, দুই-ই বদলাতে পারে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। কারও ঋতুস্রাব হতে পারে ৩৫ দিনের মাথায়, আবার তিন থেকে সাত দিনের মধ্যের যে কোনো সময়কাল ধরেই তা চলতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেহেতু ২৮ আর ৫ এর হিসাবটির দেখা মেলে, তাই এই দিন নির্বাচন। লক্ষ্য ছিল ঋতুস্রাব নিয়ে নীরবতা ভাঙা, সচেতনতা বাড়ানো, তা নিয়ে বৈষম্যমূলক সামাজিক আচরণবিধির বদল ঘটানো, ঋতুস্রাবের সম্মুখীন যাতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে হওয়া যায়, যাতে পরিচ্ছন্ন জল, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি নারী ও কিশোরীদের কাছে সহজলভ্য হয়, সেসব সুনিশ্চিত করা।

এই সুযোগে কিছুদিন আগের এক ঘটনার উল্লেখ করা যাক। মেদিনীপুর শহরে সম্প্রতি এক 'নামী' হোটেলে এক অধ্যাপিকাকে চারশ টাকা ফাইন দিতে হয়েছে। কারণ, বিছানায় রক্তের দাগ লেগে ছিল। পরে অবশ্য সোশাল মিডিয়ায় জনমত তৈরি করে সেই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা গেছে হোটেলের ম্যানেজারকে। আমরা বাইরে যাই কাজে বা অকাজে। হোটেলে থাকি। হোটেলটিতে টয়লেট্রির আয়োজন থাকে। তিন, পাঁচ বা সাত, যত তারা হোটেলের মুকুটে, সে অনুপাতে আয়োজন। পাঁচ বা সাত তারায় শেভিং কিটসও থাকে। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিনের কিট দেখা যায় না সচরাচর। তা আমাদের মনে প্রশ্নও জাগায় না। ঋতুস্রাব শুরু না হলেও আমরা চুপচাপ ব্যাগে ভরে নিই 'হুইস্পার'। কারণ 'যদি শুরু হয়', তাহলে সহসা বিপদে যেন পড়তে না হয়! ঋতুস্রাব সকলের আটাশ দিনের চক্র মেনে হয় না। তা অনাকাঙ্ক্ষিত সময়েও শুরু হতে পারে। বরং একদিন শেভ না করলে বিরাট কিছু সমস্যা হয় না। তবু সগৌরবে হোটেলের বেডরুম লাগোয়া ওয়াশরুমে শেভিং কিটটি বিরাজ করে। ব্যক্তিগত স্যানিটারি ন্যাপকিন থাকে নিজ নিজ ব্যাগের কোণে৷

এই দৈনন্দিন অসংবেদনশীলতাকে অনেকগুণ বিবর্ধিত করলে মেদিনীপুরের ঘটনাটি ঘটানো যায়। রক্তের দাগ অবশ্য স্যানিটারি ন্যাপকিন থাকলেও লাগতে পারে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে৷ রক্তের দাগ দেখলে যখন আমরা নাক সিঁটকোই, চোখ মটকাই, ওয়াক তুলি, বা ফাইন চাই, তখন কেন একবারও মনে হয় না, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নারীটির, মানুষটির কষ্ট হচ্ছে না তো? দাগ দেখি, ব্যথা দেখি না কেন?

এমতাবস্থায় এ নিয়ে যখন সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করি, গোয়া থেকে দিল্লি, সর্বত্রই হোটেলে অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানান মহিলারা। কেউ বলেন, দাগ লাগার পরে ফাইন দিয়ে বিছানা চাদর মুড়ে বাড়ি আনতে হয়েছিল। কেউ হোটেলের বিছানায় অয়েলক্লদ পেতে শোওয়ার কথা বলেন। আরও করুণ কাহিনী শোনান এক শিক্ষিকা। বলেন,

''আমার এন্ডোমেট্রিওসিস আছে। গতকাল স্কুলে আমার রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। আমি ওয়াশরুম থেকে স্টাফরুম পর্যন্ত আসতে আসতে রক্ত মাটিতেও পড়ে। এহেন অবস্থায় আমার সহশিক্ষকগণ সহমর্মিতার বদলে আমায় নিয়ে খিল্লি করেন। কেউ আবার বলেন, আমি করিডোর নোংরা করেছি। শিক্ষিকারা আমায় সাহায্য করেন। আমি বাড়ি এসে ডায়াপার পরে, শাড়ি পরে আবার স্কুলে যাই (প্যাডে হয় না, এত বেশি রক্তক্ষরণ হয়)। প্রচন্ড ব্যাথায় যখন ১৮-১৯ দিন ধরে কষ্ট পাই, তখনও কারুর কাছে সহানুভুতি পাইনি কখনও। এমনকী নিজের গর্ভধারিণীর কাছেও না। আমার শাশুড়ি বলেছেন, 'এই রোগ জানার পরেও আমার ছেলে তোমার সাথে আছে, তোমার ভাগ্য'। মা বলেন, 'তোর মেয়ে হলে তার কপালেও দুর্ভোগ ছিলো।' নিজের লোকজন যদি এরকম করে তবে হোটেলের থেকে আর কি আশা করবো বলুন তো?'' প্রসঙ্গত, এন্ডোমেট্রিওসিসে ঋতুস্রাবকালে প্রবল রক্তক্ষরণ ও প্রচণ্ড পেটব্যথাই প্রাথমিক লক্ষণ৷

অতএব, শুধু হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে নয়, এই অসংবেদনশীলতা সর্বত্র৷ মেয়েকে মেনার্ক বা ঋতু-আগমন সম্পরতক আগাম না জানানো দিয়েই এই অসংবেদনশীলতা শুরু হয়। আমি নিজেও তেমন পরিবারেই বড় হয়েছি যেখানে মা প্রথম ঋতুদিনের আগে পর্যন্ত মেয়েকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না৷ আমার প্রথম রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ক্লাস সেভেনের গ্রীষ্মাবকাশে। বোঝা গেল না, ভ্যাকেশনের বদলে যদি স্কুলেই প্রথমবার রক্ত-দর্শন ঘটত, তাহলে কোনো প্রাক্-প্রস্তুতি ছাড়া আমি কী করতাম?

তবুও অন্তত আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থানে ‘প্যাড’ জুটত। ভারতে ত্রিশ কোটি মেয়েকে যে কাপড়ের ন্যাকড়া দিয়ে কাজ চালাতে হয়, যা কিনা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নয়, তা জানতে তখনও ঢের বাকি ৷ আমাদের স্কুলে অন্তত ছিল চেঞ্জ করার আড়াল, মানে উপযুক্ত ছাত্রী শৌচালয়৷ অনেক পরে জানতে পারব, ভারতে ২৩% মেয়ে ঋতুস্রাব শুরু হলেই স্কুলছুট হয়। বাকিরা গড়ে তিন থেকে পাঁচ দিন স্কুল কামাই করে ‘সেইসব দিনে’। পশ্চিমবঙ্গে একটি-দুটি মাত্র সরকারি স্কুলে সম্ভবত স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন আছে। সেগুলি বসেছে প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে৷ এমনিতে সরকারি স্কুল তো দূরস্থান, মহার্ঘ্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেণ্ডিং মেশিন ডুমুরের ফুল, আজও।

এমনিতে এগারো থেকে চোদ্দর মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া স্তনের বিকাশ, যৌনকেশ ও বাহুমূলে কেশের আগমন ইত্যাদির মতোই বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েবেলার একটি স্বাভাবিক ঘটনা৷ ঋতুস্রাব বলতে সহজ কথায় বোঝায় নারীসুলভ হরমোনগুলির তৎপরতায় ডিম্বাশয় থেকে নির্গত একটি পরিণত ডিম্বাণুর জরায়ুতে এসে পড়া এবং পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলিত হতে না পেরে জরায়ুপর্দা বা এন্ডোমেট্রিয়ন ফেটে রক্তক্ষরণ সহ বেরিয়ে আসা, যা কমবেশি ২৮-২৯ দিন অন্তর চক্রাকারে চলে। এর মধ্যে রক্তক্ষরণে কাটে ৩-৭ দিন। একবিংশ শতকেও প্রথম ঋতুস্রাবের আগে ভারতের শতকরা ৪১ ভাগ কিশোরী তার সম্পর্কে থাকে অন্ধকারে। এদিকে, তাদের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগই কিন্তু জানে এ’সময়ে কী কী সামাজিক ট্যাবু মেনে চলতে হয়। শতকরা ৫৮ ভাগ মনে করে এ হল দূষিত রক্ত; শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। ফলত, তারা এ-ও বিশ্বাস করে যে পিরিয়ডের সময় তাদের নিজেদের শরীর অপবিত্র থাকে। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে আজও রজঃস্রাবকালে মেয়েরা পারিবারিক টয়লেট ব্যবহার করে না, শরীর ও ব্যবহৃত কাপড় ধোওয়ার জন্য পরিষ্কার জলও ব্যবহার করতে পারেনা, রক্ত আটকাতে প্যাডের বদলে কাপড় ব্যবহার করলেও সেই কাপড় ধুয়ে খোলা জায়গায় মেলতে পারে না। ‘ওয়াটার এইড’ ও ‘ইউনিসেফ’-এর যৌথ সমীক্ষা এই সব তথ্য তুলে এনেছে৷ এ সময়ে আমিষ খাওয়া, রান্না করা,রান্নাঘরে যাওয়া, পুরুষদের স্পর্শ করা, স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই বিছানায় শোওয়া, এমনকী একই ঘরে থাকা, ধর্মীয় উপাসনালয় তথা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ — অনেককিছুই বন্ধ হয়ে যায় তাদের।

অথচ একটি ছেলের শরীরেও বয়ঃসন্ধিকালে নানা বদল ঘটে- কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, দাঁড়ি গোঁফ ওঠা, বীর্যপাত। কিন্তু যে অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুতা, লোক-লজ্জা ও বিধিনিষেধ মেয়েদের ঋতুস্রাবের জন্য বরাদ্দ,তার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় নয়। ঋতুস্রাব নিয়ে ট্যাবু যেহেতু সরাসরি প্রভাব ফেলে শিক্ষার অধিকারে, স্বাস্থ্যের অধিকারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকারে, সুতরাং তাদের প্রত্যক্ষভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলাই যায়।

মনু সংহিতা ৪:৪১ শ্লোকে আছে, ‘যেদিন প্রথম রজঃদর্শন হবে সেদিন থেকে তিন রাত্রি পর্যন্ত রমণী সবকিছু পরিত্যাগ করে ঘরের মধ্যে সর্বদা আবদ্ধ থাকবে, যাতে অন্য কেউ তাকে না দেখতে পায়। স্নান করবে না, অলংকার পরবে না। এক বস্ত্র পরিধান করবে। দীনভাবে মুখ নিচু করে বসে থাকবে। কারো সাথে কোন কথা বলবে না। নিজের হাত, পা ও চোখ থাকবে স্থির। দিনের শেষে মাটির হাঁড়িতে তৈরি করা ভাত সে খাবে এবং ভূমিতে সাধারণভাবে শয্যা করে নিদ্রা যাবে।’ মনু সংহিতায় আরও আছে: ‘রজঃস্বলা নারীতে যে পুরুষ সঙ্গত হয়, তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু ও চক্ষু ক্ষয় পায়।’ আজও কুমারী পূজার জন্য যে বালিকাটিকে নির্বাচন করা হয়, তাকে প্রাক-ঋতুমতী হতে হয়। কিছুদিন আগে নেপালে এক সনাতনী অমানবিক প্রথা বে-আইনি ঘোষিত হল। সে প্রথার নাম ‘ছৌপদী’, যার মাধ্যমে ঋতুমতী কিশোরীকে ঘরের বাইরে, ছোট্ট কুঁড়েঘর বা গোয়াল ঘরে থাকতে বাধ্য করা হত। ইসলাম ধর্মে ঋতুমতী নারীকে উৎসবে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোরান স্পর্শ করা ও নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এ সময়ে রোজা রাখারও বিধান নেই (সুরা বাকারা, আয়াত ২২২)। খ্রিস্টান ধর্মমতে, রজঃস্রাবরত মহিলাদের ‘শুচিতা’ নিয়ে বিশেষ কোনো বিতর্ক নেই। তবে মহিলাদের যাজক না হতে পারার একটা প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে রজঃস্রাবের প্রসঙ্গ বারবার এসে পড়েছে৷

যদি প্রবীণাদের প্রশ্ন করেন, তাঁরা বলবেন, যৌবনে তাঁদের ঋতুকালের শারীরিক ঝক্কি পুইয়েও ঘরের কাজ করতে হয়েছে, কাউকে হয়ত সেই সঙ্গে ক্ষেতের কাজও করতে হয়েছে৷ এরপরে যে আবশ্যিক স্বামীসঙ্গ করার ধকল নিতে হত না, এ একরকম ভালোই৷ এমনকি ছত্তিশগড়ের মহিলাদের মধ্যে গত দশকের সমীক্ষাও দেখাচ্ছে যে তারাও ঋতুস্রাবের সময় আলাদা থাকতেই পছন্দ করেন, তাতে শরীর বিশ্রাম পায়। কিন্তু তাঁরা বলছেন, আলাদা থাকার জায়গাটি স্বাস্থ্যকর হলে ভালো হত। অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে হয়ত মহিলাদের বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল; মুখ্য লক্ষ্য না হলেও একটি গৌণ লক্ষ্য৷ কিন্তু কালক্রমে তা অস্পৃশ্যতার পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ঋতুস্রাব স্বাস্থ্যেও কোপ বসিয়েছিল লকডাউনও। ২০১৬-১৭ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাই জানিয়েছিল ভারতে মাত্র ৫৭.৬% নারী প্যাড ব্যবহার করেন, বাকিরা কাপড়ে কাজ সারেন। ২০২০-২২ সালে সে সংখ্যা যে এক ধাক্কায় অনেকটাই নেমেছে তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গে গরীব মানুষ চাল ডালের জন্য ফুড কুপন পেয়েছেন, কখনও পেয়েছেন মাস্ক-স্যানিটাইজার। একই সঙ্গে কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিনও দেওয়া সরকারের কর্তব্য ছিল।

পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার করুণ চিত্রকল্পটি আমাদের মাথায় গেঁথে গেছে। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবেছি পরিযায়ী নারী শ্রমিক সেই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময় রজঃস্বলা হয়েছিলেন কিনা? কীভাবে পরিস্থিতি সামলে ছিলেন তাঁরা? স্যানিটারি ন্যাপকিন দূরস্থান, কাপড়ই বা পেয়েছিলেন কোথায়? সেই কাপড়ের প্যাড পাল্টেছিলেন কীভাবে ও কোথায়? ঋতুস্রাবের রক্তক্ষরণের সময় মাইলের পর মাইল হাঁটতে তাঁদের কষ্ট হয়নি? নিশ্চয় এমন অনেক দিন গেছে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরা কাপড় বদলাতে পারেননি। হয়ত গণ শৌচাগার পেয়েছেন কোথাও। কোথাও হয়ত ঝোপে-ঝাড়েই আড়াল খুঁজতে হয়েছে। নিশ্চয় সহ-পথিকদের সে কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেননি। ঝাড়খণ্ডের এক মহিলা শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যে দিল্লি থেকে মালবাহী ট্রাকে করে ফিরেছিল সপরিবার নিজের রাজ্যে। সে বলেছিল, ‘রক্তে ভেজা কাপড় বদলাব, এই বলে তো আর ট্রাক থামাতে পারি না৷ যখন থামত, তখনই বদলাতাম ঝোপে-ঝাড়ে।' সে আরও বলেছিল, ট্রাকে মহিলারা পানীয় জল খেত না প্রায়। কারণ প্রস্রাব করার জন্য পুরুষকে ট্রাক থামাতে বলাটা ভারি লজ্জার। এই সূত্রে মনে পড়ে মহারাষ্ট্রের বিড় জেলার মেয়েদের কথা, ২০১৯ সালে যাদের নিয়ে হঠাৎ সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়েছিল, কারণ তাদের বেশির ভাগেরই জরায়ুচ্ছেদ হয়েছে। একটা গোটা গাঁয়ের (হাজিপুরের) মেয়েদের মেয়েদের নাকি জরায়ু নেই, কারণ তারা আখের সময়ে আখ কাটার কাজ নেয় এবং কনট্রাকটার চান না, তাদের ঋতুস্রাব জনিত কারণে কাজে কোনো বিচ্যুতি হোক। অর্থাৎ নারীর জন্য স্যানিটারি সামগ্রী ও শৌচালয় নির্মাণকে মালিক পক্ষ তার দায়িত্ব ভাবে না, বরং নারীই নিজের শরীরকে কেটেছেঁটে অঋতুমতী হয়ে যায় কাজ পাওয়ায় জন্য। আরও মনে পড়ছে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি ‘শিক্ষিত’ রাজ্য কেরালার কোচিতেও ‘আসমা রাবার ফ্যাক্টরি’-তে টয়লেটে একটি ব্যবহৃত ন্যাপকিন পাওয়া গেছিল বলে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন নারী কর্মীর নগ্ন তল্লাশি করে দেখা হয়েছিল, তারা কেউ সেই ঋতুমতী কিনা। যদিও তার জন্য সারা দেশ থেকে অনেক ব্যবহৃত-অব্যহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন পাঠানো হয়েছিল ওই কারখানায়, ‘রেড অ্যালার্ট ক্যাম্পেইন’-এর নামে, কিন্তু তাতে ঋতুরক্ত ঘিরে দেশের সামগ্রিক সামাজিক ট্যাবু কেটেছিল কিনা, তা বলা মুশকিল।

পশ্চিমবঙ্গে না হলেও, বহু রাজ্যে স্কুলের ছাত্রীদের বিনা পয়সায় স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়। স্কুল বন্ধ মানে তাদের কাছে শুধু মিড-ডে মিলের জোগান বন্ধ হওয়া নয় শুধু, স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগানও বন্ধ হওয়া। তাদের যে মাসিক মিড-ডে মিলের র‍্যাশনের সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিনও দেওয়া কর্তব্য ছিল, তা সরকারের মাথায় আসেনি। বস্তির এক কি দুটি কুঠুরিতে বিশাল পরিবারের বাস। লকডাউনে পুরুষেরা সারাক্ষণই ঘরে। এমতাবস্থায় ‘কাপড় ব্যবহার করলেও লুকোবো কোথায়, শুকাতে দেব কোথায়, তাও এক চিন্তার ব্যাপার,’ বলেছিল পঞ্চাননতলা বস্তির এক কিশোরী।

কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করত নিজেরা মেশিন বসিয়ে। লকডাউন হতে সেই ছোট কারখানাগুলির কর্মীরা বাড়ি ফিরে গেল। তাই সস্তার স্যানিটারি ন্যাপকিনের আকাল পড়ল। শুধু ব্র্যান্ডেড জিনিসই পাওয়া গেল। এই সস্তার ন্যাপকিনের ক্রেতা ছিল গ্রাম ও বস্তি অঞ্চলের মেয়েরা। আরও মাথায় রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু লকডাউন শুরু করার সময় বলেছিল যে শুধু অত্যাবশ্যক পণ্যের উৎপাদন চলবে এবং প্রাথমিক ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে অত্যাবশ্যক পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। সে কারণেও ছোট কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে গেছিল। জোগান কমেছিল। ওষুধের দোকান বা মুদির দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল না স্যানিটারি প্যাড। পরে অবশ্য সে ঘোষণা সংশোধন করা হয়েছিল।

ঋতুস্রাব সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরস্পরবিরোধী। একে একদিকে 'স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক, জৈবিক' প্রক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর যা কিছু স্বাভাবিক, তাকে যন্ত্রণাহীন আমরা ধরে নিই। অথচ গর্ভধারণ বা প্রজননের মতো ঋতুস্রাবও যন্ত্রণাহীন নয়। অন্যদিকে আবার 'স্বাভাবিক' এই প্রক্রিয়া ঘিরে গোপনীয়তাই নাকি বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে ছেলেদের কাছ থেকে একে লুকিয়ে রাখাই দস্তুর। পিতৃতন্ত্রের এজেন্ট হিসেবে মেয়েরাই এই গোপনীয়তা রক্ষা করতে মরিয়া। ফলত, ছেলেরা যখন মাসিক সম্পর্কে শেখে, তখন প্রায়শই শেখে নানা আধসেদ্ধ বা বিকৃত আলোচনার ভিত্তিতে। প্রায়শই বাড়ির বা স্কুলের কোনো মেয়ের হঠাৎ রক্তপাত না দেখলে তাদের কাছে এই প্রসঙ্গই তোলা হয় না। আর প্রসঙ্গ উঠলে বলা হয়, 'সময় হলে বুঝবে।' বালকদের কাছে তো তো বটেই, পুরুষদের কাছেও যথেষ্ট তথ্যের অভাব। ঋতুস্রাব সম্পর্কে মনোভাব তাদের মূলত নেতিবাচকই। মাসিককে তারা নোংরা ও অশূচি মনে করতে করতে বড় হয়৷ সঙ্গিনীর পিরিয়ডের খোঁজ রাখে মূলত যৌনমিলনের তারিখ স্থির করার জন্য। আবার মেনোপজ কথাটির সঙ্গে তাদের ভাসা ভাসা পরিচয় রয়েছে, মেনার্কের সঙ্গে নয়। পিরিয়ড নিয়ে টিজিং, পিরিয়ড জোকস তাদের বেড়ে ওঠার অঙ্গ হয়ে ওঠে। মহিলাদের পিরিয়ডকালে অশূচি আর খিটখিটে ধরে নেওয়া হয়। এমনকী সহপাঠিনীর জামায় রক্তের দাগ লাগলেও তারা অপমান করতে ছাড়ে না। স্কুলগুলিতে মেয়েরা আরেকটি সমস্যার সম্মুখীন হয়। পুরুষ শিক্ষকরা ক্লাস চলাকালীন মেয়েদের টয়লেটে যেতে দেয় না। ২০১৭ সালে দক্ষিণ ভারতে স্কুলে শিক্ষকের দ্বারা পিরিয়ড জনিত রক্তের দাগের জন্য অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল এক বারো বছরের মেয়ে ।

যদিও কিছু পুরুষের ঋতুস্রাব হয় (ট্রান্সপুরুষের ক্ষেত্রে) এবং সমস্ত নারী ঋতুমতীও হয় না, তবু পিরিয়ড শুধুমাত্র নারীদের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। অথচ জেন্ডার বাইনারির পৃথিবীতেও কিন্তু ঋতুস্রাবকে দেখার, বোঝার যথেষ্ট সুযোগ পুরুষের থাকে। পুরুষদের মধ্যে রয়েছে পিতা, স্বামী, বন্ধু, ভাই, ছাত্র, সহকর্মী, শিক্ষক, সম্প্রদায়ের নেতা, নিয়োগকর্তা, এবং নীতিনির্ধারকরা। এই সব পুরুষদের থেকে লুকোনোর তাড়নায় প্রভাবিত হয় ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য। যেমন, মাসিকের সময় স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে দিনে অন্তত তিন থেকে চার বার প্যাড পরিবর্তন করা উচিত। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায়, মহিলারা দুবার মাত্র কাপড় পরিবর্তন করে, সন্ধ্যার সময় এবং ভোরের দিকে, যাতে অন্ধকারে দেখতে না পায়। ভাবলে অবাক লাগে যে, এমনকী অনেক মেয়ে ঋতুস্রাবের সময় ওয়াশরুম ব্যবহার করা এড়িয়ে চলে কারণ ড্রেনে নিষ্কাশিত জলেও যদি রক্তের রঙ থাকে, তাও নাকি বাবা বা ভাইয়ের কাছে লজ্জার। এ অন্ধকার কাটাতে স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য ব্যাপক বয়ঃসন্ধি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা আশু দরকার। অভিভাবকদের জন্য দরকার কমিউনিটি পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

মহিলাদের ঋতুস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার আরেক কারণ হল তাদের সম্পদ নিয়ন্ত্রণের অভাব। NFHS-4 (২০১৫-১৬) অনুসারে, বর্তমানে বিবাহিত মহিলাদের মাত্র ১২% (১৮-৪৯ বছর বয়সী) স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব দেহ ও স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ ঋতুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নারী তিনটি স্তরে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন: প্রথমত, লেনদেন স্তরে— এর মধ্যে রয়েছে স্যানিটারি পণ্য, অন্তর্বাস এবং আরও অনেক কিছুর ক্রয়ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, পরিকাঠামোগত স্তরে— যার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত স্থান, জল, টয়লেট, নিষ্পত্তি ব্যবস্থা ইত্যাদির অনুপস্থিতি। এবং তৃতীয়ত, মানসিকতার স্তরে — এর মধ্যে রয়েছে নারীর মর্যাদা এবং স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগের অভাব, আর লজ্জা এবং নীরবতার একটি বিস্তৃত সংস্কৃতি।

এমতাবস্থায় যতক্ষণ না পুরুষদেরও এমএইচএম সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে, ততক্ষণ তারা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (MHM)-এ অংশ নিতে পারবে না। MHM-এর মধ্যে পড়ে মহিলাদের জন্য জামাকাপড়, সাবান এবং জলের ব্যবস্থা, তাদের গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করার জন্য একটি পরিষ্কার ব্যক্তিগত স্থান এবং তাদের স্যানিটারি উপকরণের জোগান ও সেই বর্জ্য নিষ্কাশনের করার জন্য ডাস্টবিন। অথচ MHM কে 'মহিলাদের সমস্যা' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তা নিয়ে চার দেয়ালের মধ্যে পুরুষ সদস্যের অবর্তমানে আলোচনা করা হয়। যেন এ সম্পর্কে পরিবার, সম্প্রদায় বা সমাজের উদ্বেগের প্রয়োজন নেই।

ধীরে ধীরে হলেও পরিস্থিতি কিছুটা হয়ত পাল্টাচ্ছে। যে ফেসবুক পোস্টের কথা বলছিলাম, সেখানেই এক মা বললেন, তাঁর অষ্টাদশী মেয়ে স্বচ্ছন্দে জিমে গিয়ে হঠাৎ পিরিয়ড হওয়াতে নিজের ছেলে বন্ধুকে ন্যাপকিন আনার অনুরোধ জানায়। সে-ও নির্দ্বিধায় এনে দেয়। কিছু বায়োলজি শিক্ষক যেমন বিষয়টি এড়িয়ে যান, তেমনই আবার, জানতে পারি, কেউ কেউ সুন্দরভাবে বোঝান পিরিয়ডের কারণ থেকে শুরু করে এই সময় ব্যথা কমাতে কোন ওষুধ খাওয়া যাবে আর কোনটা খাওয়া যাবে না, বা কেন ওষুধের সাহায্যে তারিখ এগোনো বা পেছনো ভালো নয়— এই সব কিছু। কিন্তু এসবই ঘটে শহুরে পরিসরে৷ প্রত্যন্ত গ্রামে যা যা উপকরণ মহিলারা আজও ব্যবহার করেন ঋতুস্রাবকালে, তা পিলে চমকে দেয়। এর মধ্যে কাপড় ছাড়াও আছে ছাই, বালি, পাট, সংবাদপত্র এবং আরও অনেক কিছু। যে কোনো দিনে, পৃথিবীর ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মেয়ের ঋতুস্রাব হয়৷ তবু ঋতুস্বাস্থ্য এখনও রাজনৈতিক দলগুলির উন্নয়নমূলক অ্যাজেন্ডায় অনুপস্থিত। যে নারী আরও নিপীড়িত— যেমন দরিদ্র, দলিত, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী নারী, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী মহিলা, তাদের মাসিকের অভিজ্ঞতা আরও ভয়ংকর।

ঋতুরক্তকে উদযাপন করার ঝোঁকও আছে আমাদের সংস্কৃতিতে। অসমের কামাখ্যা মন্দিরে ভরা বর্ষায় দেবী স্বয়ং নাকি ঋতুমতী হন। বর্ষাকালে কামাখ্যায় যে অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তা আদতে একটি ফার্টিলিটি রিচুয়াল৷ লক্ষ মানুষ আসলে শ্রদ্ধাবনত হন দেবীর তথা নারীরূপী প্রকৃতির উর্বরতার আদিম রহস্যের সামনে। তন্ত্রসাধকরাই মূলত ঋতুস্রাবের এই ধর্মীয় উদযাপনে অংশ নেন৷ আবার কিছুটা সহজিয়া বৌদ্ধ দর্শন, কিছুটা তান্ত্রিক তত্ত্ব মিশে যে সহজিয়া বাউল দর্শন, সেখানেও রজঃস্বলা নারীর সঙ্গে মিলনই নাকি মুক্তির পথ। কিন্তু ঋতুমতী নারীর কোনো দেবীর সম্মান দরকার নেই। দরকার মানুষ হিসেবে মানুষের সচেতন সহমর্মিতা।

বর্তমানে নারীবাদী আন্দোলনগুলিতে ঋতুস্রাবকে উদযাপন করার যে ধারা, নারীকে অলৌকিক দৈব ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তার লক্ষ্য নয়৷ সে আন্দোলন ও উদযাপনের কারণ ও অভিমুখ আলাদা৷ গ্লোরিয়া স্টেইনেম বহুপূর্বেই বলেছিলেন, ক্ষমতাবানের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বৈশিষ্ট্য-চিহ্নই ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে, আর ক্ষমতাহীনের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত সবকিছুকেই অশুভ,মন্দ, দুর্বল দেগে দেওয়া হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাই মেয়েরা ঋতুমতী হয় বলেই ঋতুচক্র নিয়ে এত লুকোছাপা, এত নিন্দেমন্দ। তার বদলে ছেলেরা রক্ত ঝরালে তা-ই হয়ে উঠত শৌর্যের প্রতীক৷ ‘If Men Could Menstruate’’ প্রবন্ধে তাঁর সকৌতুক কল্পনাঃ

‘'So what would happen if suddenly, magically, men could menstruate and women could not?

Clearly, menstruation would become an enviable, worthy, masculine event.

Men would brag about how long and how much."

কৌতুকের আড়ালে যে ক্ষমতাতন্ত্র ও রাজনীতির ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছেন, তা না থাকলে ঋতুরক্ত উদযাপনেরও প্রয়োজন হত না৷

নারীবাদী লেখিকাদের কলমেও তাই ঋতুরক্ত ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠে। জেনেট উইন্টারসন ‘Written on the Body ‘’ তে লিখছেনঃ

‘When she bleeds the smells I know change colour. There is iron in her soul on those days. She smells like a gun.'

লুসিলি ক্লিফটন লেখেন -‘Poem in Praise of Menstruation:

‘...pray that it flows also

through animals

beautiful and faithful and ancient

and female and brave.’

শবরীমালা বিতর্ক থেকেই #হ্যাপিটুব্লিড ক্যাম্পেন শুরু হয়েছিল৷ কারণ, আলগোছে বলা হয়েছিল-মহিলা ভক্তরা রজঃস্বলা কিনা, তা মেশিন বসিয়ে যাচাই করে নেওয়া গেলে, তাদের মন্দিরে ঢোকার কথা পুনর্বিবেচনা করাই যায়। ২০১৫ সালে নিকিতা আজাদ ফেসবুকে হ্যাপিটুব্লিড হ্যাশট্যাগ দিয়ে যে ভার্চুয়াল আন্দোলন শুরু করেন, প্রবাসী ভারতীয় কবি রূপী কৌর তা অনুসরণ করে ইনস্টাগ্রাম-এ ঋতুস্রাব সংক্রান্ত একটি ছবি দিয়েছিলেন। ছবিটি সরিয়ে দেন ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদের ঝড় উঠলে অবশ্য ক্ষমা চেয়ে ছবিটি ফের প্রকাশ করে ইনস্টাগ্রাম।

ঋতুরক্তকে ঘিরে যে গোপনীয়তা, তা ঋতুমতীর জন্য নিয়ে আসে অপরিচ্ছন্নতা, অসুখ ও অস্বস্তি। আজও স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে হয় কালো মোড়কে। বিজ্ঞাপনে লালের বদলে নীল রক্ত ঝরে পড়ে প্যাডে। যে মহিলা আথলেট পিরিয়ড চলাকালীন স্যানিটারি প্যাড না পরেই প্রতীকী দৌড় দৌড়েছিলেন, তাঁর শারীরিক ভাবে কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়৷ কিন্তু গিমিক বলে উড়িয়ে না দিয়ে আমরা এটিকে দেখতে পারি ঋতুরক্তকে দৃশ্যমান করার এক রাজনৈতিক আজেন্ডা হিসেবে। বিশ্ব ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য দিবসে একটা কথা বোঝা সবার আগে দরকার। ঋতুরক্ত এবং তার কারণে ঘটা শারীরিক অসুবিধেকে আমরা যদি মানুষের (পড়ুন পুরুষের) পঞ্চেন্দ্রিয়র আড়ালে রাখতেই তৎপর হই, তাকে যদি না আসতে দিই চোখ-কান-স্পর্শের আওতায়, তাহলে বিমূর্ত ভাবনার ভিত্তিতে কোনো লড়াই যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করবে না। ঋতুস্রাব স্বাভাবিক, কিন্তু সমাজের ঋতুরক্তকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে শেখা এখনও বাকি। নিজেরা গ্রহণ করতে পারলে, তবেই তো শ্রেণি নির্বিশেষে নারীর ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও অন্যান্য সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা, পিরিয়ড লিভের বা নিঃশুল্ক স্যানিটারি উপকরণের উপযোগিতা, এক-দুই কিলোমিটার দূরে দূরে লেডিজ টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রকে বোঝানো যাবে!


0 Comments

Post Comment