পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সাজানো বাগান

  • 24 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 807 view(s)
  • লিখেছেন : সায়ন্তনী নাগ
আজকাল বেশি রাত অবধি জেগে থাকতে কষ্ট হয় সান্ত্বনার। কিন্তু উপায় নেই, ডোডোর সাথে এ দেশের টাইম জোনের ফারাক প্রায় পাঁচ ঘণ্টার। সে ইউনিভার্সিটির কাজ সেরে, লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে, ডর্মে ফিরে যতক্ষণে মায়ের সাথে কথা বলার ফুরসৎ পায়, ততক্ষণ কোনো না কোনো উপায়ে জেগে থাকতেই হয় সান্ত্বনাকে।

টিভিটাকে জোর ভলিউমে চালিয়ে রাখেন সান্ত্বনা। তাও একঘেয়ে সিরিয়াল আর বোকা বোকা রাজনৈতিক তরজা দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে চোখ ঘুমে ঢুলে আসে। সোফা ছেড়ে বিছানায় যান না তিনি, পাছে ছেলের হোয়াটসঅ্যাপ কলে ঘুম না ভাঙে! আগে হয়েছে একবার। উৎকণ্ঠায় ডোডো সেবার মাঝরাতে পাশের ফ্ল্যাটের চক্রবর্তীবাবুকে ফোন করে ডেকে তুলেছিল, মা কেন সাড়া দিচ্ছে না দেখতে। ইশ, কী লজ্জাটাই না পেয়েছিলেন সান্ত্বনা! চক্রবর্তীবাবু ঘামতে ঘামতে হাই তুলতে তুলতে বেল বাজিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। যদিও মানুষটি ভীষণ ভদ্র, তবু মনেমনে নিশ্চয়ই ভেবেছেন, বাড়াবাড়ি!

‘বাড়াবাড়ি বোলো না তো মা, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর প্রতি এইটুকু কর্তব্য করবে না?’ ফট করে বলে বসে ডোডো। ধুর, আজকাল পাশের ফ্ল্যটের খোঁজ রাখে নাকি কেউ এ শহরে? একমাত্র পচে গন্ধ বেরোলে টনক নড়ে। একটা আস্ত মানুষকে যে কদিন ধরে দেখা যাচ্ছে না, তার দরজার সামনে খবরের কাগজ কি দুধের প্যাকেট জমে যাচ্ছে…এসব যেন কারোর নজরেই পড়ে না! সান্ত্বনাদের এ আবাসন অবশ্য বহু বছরের পুরোনো, তাই এখানে সবাই সবার মোটামুটি খোঁজ রাখে, এই আর কি!

‘আমাদের এখানে সরকারের একটা ভালো স্কিম আছে, বুঝলে? একটা ছোটখাট অ্যামাউন্ট দিয়ে সার্ভিসটা কিনতে হয়। রোজ দিনে একবার রাতে একবার ওরা ফোন করবে, টুকটাক কথাবার্তা বলবে, শরীর কেমন আছে জানতে চাইবে। যদি বাই চান্স কেউ ফোন না তোলে, তবে সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ডাক্তার নার্স হাজির হবে তোমার দোরগোড়ায়।‘

‘কী রাঁধলি আজ?’ সান্ত্বনা ভিডিও কলে ছেলের খাবারের প্লেটটার দিকে তাকাতে চেষ্টা করেন।

‘খুব কাজের চাপ ছিল আজ। সকালে উঠে স্যান্ডউইচ খেয়ে চলে গেছি। আজ আর রাঁধা হয়নি।‘

‘তাহলে রাতে কী খাবি?’

‘ভাত বানিয়ে নেব।‘

‘ভাতের সাথে খাবি টাকি?’

‘বৈষ্ণবী পনিরের ঝোল রেঁধেছে, শেয়ার করে নেব।‘

‘ওহ!’ একটা নিঃশ্বাস পড়ে সান্ত্বনার। আজকাল হামেশাই বৈষ্ণবী রেঁধে দিচ্ছে ডোডোকে। গুজরাটি মেয়ে। নিষ্ঠাবান নিরামিষাশী। ওর ডর্মেরই অন্য ফ্লোরে থাকে। প্রথমদিকে শুনে সান্ত্বনার একটু দুঃখই হয়েছিল, ছেলে তাহলে নিজেই বৌমা ঠিক করে ফেলল! তারপর ভেবেছেন, কে জানে, ও ভাবে বলা যায় নাকি কিছু! এর আগে মাস্টার্স করার সময় তো অন্য একটা মেয়ের সাথে পোল্যান্ড না কোথায় ঘুরতে গেছিল ডোডো। এও হয়তো স্রেফ বন্ধু। তাও দেশের রান্না খেতে পারছে! নাহলে তো সারাদিন ওই হ্যামবার্গার আর স্যান্ডউইচ চিবিয়েই কাটায়!

ডোডোর ঘরটা বেশ ঝলমল করছে। বাইরে রোদ্দুর। ওদেশে সন্ধ্যে নামে অনেকটা দেরি করে। জানলার ওপাশে উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। আর একটা কী যেন গাছ! ‘ওটা কী লাগিয়েছিস রে টবে?’

ডোডো জানলার কাছে উঠে এসে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখায়। একগুচ্ছ সাদা ফুল। বুকের কাছটা হলুদ। পাশে শুকোতে দেওয়া ওর কালো ভারী বুটজুতো। বরফে ভিজিয়েছে বোধহয়!

‘গতকাল হাটে গিয়ে কিনেছি। টবটা একজন সিনিয়রের থেকে চেয়ে এনেছি। কী ফুল বলতো?’

‘ডেজি! অত বোকা ভাবিস না আমায় ডোডো!’

‘আরে না! আমি জানি মা, তোমার বটানি ছিল!’ হাসতে থাকে ডোডো।

‘কবে আসবি তুই? ছুটি পাবি কবে? তোর প্রোজেক্টের কাজ কতদূর এগোলো?’ সান্ত্বনা হাজার চেষ্টা করেও গলার আকুলতা লুকোতে পারেননা।

‘আরে, শোনোই না। প্রোজেক্টের গল্পই তো বলতে যাচ্ছিলাম! কী মজার একটা কাজ করছি শোনো!’

‘মজার কাজ?’

‘হ্যাঁ গো! আমাদের এই প্রোজেক্টটা ইনডোর এগ্রিকালচারের ওপর।‘

‘তুই সফটওয়্যারের লোক, তোর সাথে এগ্রিকালচারের কী সম্পর্ক? সে তবু আমি একটু আধটু –‘

‘আহা, শোনোই না! ‘ সান্ত্বনাকে থামিয়ে দেয় ছেলে। ‘আমরা একটা যন্ত্র বানাচ্ছি। এমন একটা যন্ত্র, যা তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার ঘরের গাছগুলোর দেখাশোনা করতে পারবে। ধরো, একটা টবে জল দেওয়া দরকার, যন্ত্র সেটা দিয়ে দেবে। কিম্বা কোনো গাছের ডালপালা একটু ছেঁটে দিতে হবে, যন্ত্র সেটা করে দেবে। বা ধরো, কোনো গাছে পোকার আক্রমণ হয়েছে, সেটা কী ধরনের পোকা ডিটেক্ট করে ঠিকঠাক ওষুধ স্প্রে করে দেবে এই যন্ত্র।‘

হাঁ হয়ে যান সান্ত্বনা। একি যন্ত্র, না রোবট?

‘রোবট না, রোবট না, যন্ত্রই।‘

‘এরকম আবার হয় নাকি?’

‘হয় গো হয়!’ ডোডোর গলায় এবার গর্বের সুর। মাঝেমাঝে সে তার মাকে চমকে দিতে পেরে ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে ওঠে। ‘একটা যন্ত্র অলরেডি বানানো হয়ে গেছে। একটা ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারও হচ্ছে। রেজাল্ট বেশ ভালো পাওয়া গেছে। এখন সেই ডিভাইসটাই আরো উন্নত করতে হবে আমাদের। যাতে আরো নতুন নতুন কাজ করতে পারে যন্ত্রটা। আমি প্রোগ্রামিং-এর দিকটা দেখছি। হার্ডওয়ারের সব দরকারি পার্ট এখনো এসে পৌছোয়নি, এলে অ্যাসেম্বেল করা হবে। সে সবের জন্য তাইওয়ানে অর্ডার দেওয়া হয়েছে।‘

‘কতদিন লাগবে বানাতে?’

খানিক ভাবে ডোডো। ‘দ্যাখো, আমার সাথে এরা আপাতত ছ’মাসের কন্ট্র্যাক্ট করেছে। কিন্তু কাজটা শেষ হতে অন্তত এক বছর লাগবে। আর আমি যা বুঝেছি, এরা আমার কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করবেই। এমনিতেই আমাদের প্রোজেক্ট লিডার ডক্টর ফ্র্যান্সিস্কো মোরেনো আমার কাজে সন্তুষ্ট। তাছাড়া ছ’মাস পরে আবার নতুন করে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাখতে হলে তাকে আবার কাজটা শুরু থেকে বোঝাতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রোজেক্টের গতি কমে যাবে। ফলে ওরা কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করতেই আগ্রহী।‘

‘তার মানে তোর বাড়ি আসা আরো একবছর পিছিয়ে গেল?’

ম্লান হাসে ডোডো। ‘প্রোজেক্টের মাঝখানে কী করে ছুটি পাই বলতো মা? তাছাড়া আসা যাওয়ার টিকিটের খরচ কি কম?’

তা কি আর বোঝেন না সান্ত্বনা? তবু গলার কাছে বাষ্প জমে ওঠে। পাছে ডোডোর কাছে ধরা পড়ে যান, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দেন, ‘আচ্ছা, তোর এই টিশার্টটা আগে দেখিনি তো? নতুন কিনলি? কত ইউরো পড়ল রে? বেশ রঙটা!’

ডোডোও জানতে চায়, ‘তোমার দাঁত তুলবে বলছিলে, কবে ঠিক করলে? পিয়ালি মাসিকে বোলো না, সেদিন তোমার সাথে যেতে। আর তোমার মেড, তার কী খবর? বেশি ডুব মারছে না তো আজকাল?’

পৃথিবীর দুই প্রান্তে ঘড়ির কাঁটা আগুপিছু গড়িয়ে যায় গভীরতরো রাত কিম্বা সম্পূর্ণ নতুন দিনের দিকে…

  •  

সকালে ব্রাশ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান সান্ত্বনা। পারুলের মা ভোর ভোর বাসন মাজতে চলে এসেছে। রান্নাঘরে জলের শব্দ হচ্ছে। ঝুমকো জবার টবের মাটিটা একটু খুঁড়ে দেওয়া দরকার। নাগচম্পা গাছটা বেয়াড়া রকম লম্বা হয়ে গেছে তো! সান্ত্বনা এরিকা পামের শুকনো পাতাগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে থাকেন। একহাতে হয় নাকি! অর্কিডগুলোও নতুন করে কাঠকয়লা দিয়ে বাঁধা দরকার। চাইনিজ পামের পাতাগুলো ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হবে, যা ধুলো পড়েছে!

একগাল হেসে পারুলের মা পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘বৌদি, তুমি বলেচিলে না, কৃষ্ণতুলসীর চারা পেলে আনতে? এই দ্যাখো, এনিচি। ডি ব্লকের পিচনে একগাদা হয়ে আচে গো!’

‘শোনো না, পারুলকে একবার পাঠিয়ে দেবে? গাছগুলো একটু ঠিকঠাক করতে হবে। নয়নতারায় সেবার কী একটা সাদা সাদা পোকা হয়েছিল, পারুল জানে কী ওষুধ দিতে হবে। ওকে বোলো সেই ওষুধটা একবারে কিনে নিয়ে আসতে। কত টাকা লাগবে, ড্রয়ারে আছে, নিয়ে যাও তুমি বরং!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, তুমি কিচু চিন্তা কোরো না, ছানাটাকে ইস্কুলে পাটিয়ে পারুল চলে আসবে বেলার দিকি!’

ভোরের বুক থেকে সকাল ফোটে। পুরোনো হাউসিং-এর বাড়িগুলোর গায়ে এদিক সেদিক গজিয়ে ওঠা নাছোড়বান্দা বট-অশ্বত্থরা রোদের জন্য উঁকিঝুঁকি মারে। সান্ত্বনা ঝুঁকে দেখেন পারুলের মা একতলার গেট খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে, সাথে ঝোলায় দুএকটা কীসের যেন চারা, আর কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা কেউ চেয়েছে হয়তো। এদেশে এখনো যন্ত্ররা এসে পৌঁছয় নি। সান্ত্বনার সামনে সার সার পরিচিত বারান্দা, তার কোনোটায় সাজিয়ে রাখা মরশুমি ফুল। তাদের গায়ে রং। যত্নের। কিম্বা অপেক্ষার। আবার কোনো বারান্দায় জমে থাকা শুকনো পাতার রাশ! ডোডোরা সেখানে আর ফেরেই নি কোনোদিন!

 

 

এই লেখকের সহমনে প্রকাশিত আরো একটি গল্প পড়ুন

ভারা বেয়ে

 

 

 

0 Comments

Post Comment