“ঠাকুরঝি থাক না ওসব” শালুর মা থামিয়ে দেয় রাহী পিসিকে। গাঁ গঞ্জের মেয়ে বিয়ে হয়ে থাকবে কোলকাতা শহরে, এ তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। পাত্র খোদ কোলকাতা শহরের, আর তাদের গোপালগঞ্জে কোলকাতা শহর মানে যে লন্ডন প্যারিসের মতো একটা ব্যাপার।
শালু নিজেও অবশ্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। বিকেলের মরা রোদ্দুর গায়ে মেখে বসে বসে ভাবে- “একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। গোপালগঞ্জে সন্ধ্যা নামলেই ছমছমে ভূতের মতো অন্ধকার নেমে আসে। তবে কলকাতায় তা হবে না, ওখানে তো রাতকেও দিনের মতো লাগে। কত বড়বড় নাকি বাড়ি আর বড় লোকেরা কলকাতা শহরে থাকে, কত ধরনের খাবার খায় লোকজন। আচ্ছা সেসব খাবার কি হতে পারে, ভাবতে গিয়ে শালু আর শালুর দিদি পালং মাথা চুলকোতে থাকে। তবু বুঝে উঠতে পারে না।
পালং বলে-“ মানুষজনও ওখানের নাকি টিভি সিরিয়ালের মত সুন্দর সুন্দর দেখতে! টিভিতে সিরিয়াল করা লোকজন অবশ্য সব কলকাতা শহরেই থাকে। সে টিভি দেখেই জেনেছে।“
শালুর সামনে হেঁটে যায় কলকাতা শহরখানা, প্রশ্নরা হামাগুড়ি দিয়ে আসে। শালু মনে মনে ভাবে- “বীরু কাকিকে সময় সুযোগ বুঝে সব জিজ্ঞেস করতে হবে।“ বীরুকাকাই তো শালুর এ সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে।
সেই কত বছর আগে বীরুকাকা কলকাতায় গিয়ে ছাতাপট্টিতে কাজ করছে। প্রত্যেক বছর দুগ্গা পুজোতে বীরুকাকা বীরুকাকিকে কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায়। কাকি তখন ফিনফিনে শাড়ি পরে, চোখে মুখে রং লাগায়। কাকি বলে- “ওখানকার মেয়েদের সাজপোশাক দেখলে তাক লেগে যাবে রে তোর শালু।“
শালু উৎসুক হয়ে জানতে চায়- “কেমন গো কাকি?”
“মেয়েদের গায়ে টাইট টাইট ছোট ছোট জামাকাপড় পা, থাই দেখা যায়। শাড়ি পরলেও এমন কায়দা থাকে, তাতে করে ব্লাউজের ফাঁক গলে নজর অন্য জায়গায় আটকে যায়।”বলেই মিটিমিটি হাসে কাকি।
এই দেখ, পায়ের এই দাগটা। জানিস- “একবার ওখানকার মেয়েদের মতো ব্যাক হিল জুতো পরতে গিয়ে পা মচকে এই কাণ্ড”। শালু তার নিজের পা দুখানার দিকে ঘুরে ফিরে তাকায়।
“শহরের বড় বড় বাড়িগুলোর মাথা ছাড়িয়ে সূর্যের আলো নাকি রাস্তায় আসাতেই পারে না। এখন আবার কত উচুঁ উঁচু বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, দেখতে দেখতে ঘাড় ব্যথা করে।“
কাকির কথায় শালু ভাবে- “আচ্ছা কত উঁচু হবে বিল্ডিংগুলো, কত বড় হবে তার ছাদগুলো? এক তালগাছ, দু তালগাছের সমান উঁচু! তাদের গ্রামে জ্যোতি ঘোষালের বাড়ি শুধু পাকা দোতলা। শুনেছে তাদের ছাদ থেকে রায়দের তালপুকুরের সারি সারি তালগাছগুলোর মাথা দেখা যায়। তাদের অবশ্য গ্রামের অন্যদের মতো একচালার খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর। পাশের অশ্বত্থগাছ থেকে ঝরাপাতা রাতদিন চালের ছাদের উপর ঝরে ঝরে পড়ে। চৈত্র মাসে গাছের শুকনো পাতায় ভরে যায় চালের ছাদ, সে আর দিদি মিলে ঝাড়ু দিয়ে ছাদের উপর থেকে পাতা সরায়, নাহলে বর্ষার সময় ঝরাপাতা বৃষ্টির জল পেয়ে পচে খড়ের চাল নষ্ট করে দেবে।” বাবা বলে- “ছাদের যত্ন নিতে হয়।” মা বলে- “মাথার উপর ছাদ না থাকলে, ছাদ নষ্ট হলে তারা থাকবে কোথায়?” বিপিন স্যার বলতেন- মাথার উপর একটা শক্ত মজবুত ছাদ মানুষের বেঁচে থাকাকে আস্বস্ত করে, মানুষের বেসিক প্রয়োজন ওটা। দিনের শেষে বিশাল পৃথিবীর বুকে তাই মানুষের চাই মাথার উপর শক্ত একটা টুকরো ছাদ। যা হবে তার আশ্রয়।”
“শালু মা কোথা রে, তোর বীরুকাকা এসেছে। উনুনে চায়ের জল বসা।” বাবার ডাকে এতক্ষণের সুখবিলাস থেকে শালু সরে এসে উত্তর দেয়- “আসছি বাবা।”
চায়ের জল গরম করতে করতে রান্নাঘরের জানালাটা খুলে দেয় । ওখান থেকে বাবা আর বীরুকাকার মধ্যেকার কথা স্পষ্ট শোনা যাবে।
বীরু কাকা বলে- “ফাল্গনেই ওরা বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে।”
“ফাল্গুনেই! তাই হবে। আমি মেয়ের বাবা, আমার আর আপত্তি কী!” মাথা নেড়ে সায় দেয় শালুর বাবা।
পালং এসে আনন্দে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শালুকে- “বিয়েটা তাহলে তোর ওখানেই হচ্ছে রে শালু।”
এটা অবশ্য পাত্রের দ্বিতীয় বিয়ে, আগের স্ত্রী মারা গেছে। স্ত্রী মারা গেলে পুরুষমানুষ যেমন বিধবা হয় না, তেমন তাদের হৃদয়ের নির্জলা অম্বুবাচীও সম্ভব নয়। সুতরাং বিয়ে তো করবেই। কিন্তু প্রথমপক্ষের দুটো মেয়েও আছে যে!
“বা রে, বিবাহিত পুরুষ মানুষের সন্তান থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক!”
“হাঁ, এখন তো এরকম পাত্র বিয়ে করাই রীতি। সিনেমার নায়িকারাও নাকি এখন এরকম পাত্রই পছন্দ করছে।” বলে রাহী পিসি ফোড়ং কাটে।
পালং এসে ফিসফিস করে বলে- “ছাড় তো শালু ওসব, পাত্তর ভীষণ হ্যান্ডসাম,লম্বা, গায়ের রং কাঞ্চন ফুলের মতো। শহুরে জীবনের আদবকায়দায় অভ্যস্ত।”
শালু তো গেঁয়ো ভূত। তাহলে শালুর কপাল নয়!
পালং আরও বলে- “জানিস শালু! পাত্তর হলো বাস কন্ট্রাক্টর। মাঝে মাঝে মালিকের গাড়িও চালায়। বুঝলি।”
শালু সলজ্জে হাসে। গাঁ গঞ্জে বাস কন্ট্রাক্টর মানে বিরাট ব্যাপার, যেন প্লেন চালানোর মতো একটা কাজ।
“এ কথাটা বলাই হয়নি শালুরে তোর হবু বরের ঘরে কি সুন্দর ছাদ আছে, বাবা নিজে দেখেছে। যেদিন বাবা জেঠুরা পাত্তর দেখতে গেছিল, সেদিন তারা পাত্তর ঘরেই বসেছিল। তাকিয়ে দেখে মাথার উপর কি সুন্দর সাদা একখানা ছাদ।” বাবা বলছিল- “পালং রে কি সুন্দর সাদা রঙের ঝকঝকে ছাদ, পাকার দেয়ালগুলোও রঙ করা।” “শালু তুইও ঘোষালদের বউদের মতো সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠবি, মাথার উপর শক্ত ছাদ, সিঁড়ি বেয়ে সেই ছাদে যাবি। আকাশ ছুঁবি! আচ্ছা শালু! উঁচু ছাদ থেকে আকাশ বেশি দূরে না, তাই নারে!”
পালংয়ের কথায় শালু হাসে- “কি করে জানবো রে দিদি, আমিও তো কোনদিন ছাদে উঠিনি।” আবেগে জড়িয়ে ধরে শালু পালংকে।
“উঃ”। পালং কঁকিয়ে ওঠে।
শালু তাড়াতাড়ি দিদিকে ছেড়ে দেয়, দিদির পিঠের আঁচল সরিয়ে পরম মমতায় হাত বোলায়- “পিঠের ঘা গুলো এখনো দগদগে। সারতে দেরি লাগবে রে দিদি। চল ওদিকটায়, উঠোনে লাগানো গাঁদাগাছ থেকে গাঁদাপাতা তুলে, একটু রগড়ে রস বের করে লাগিয়ে দেব। তাহলে ব্যথাটা কমে যাবে।”
“ও এমনি এমনি সেরে যাবে রে শালু।” বলে মুখে আঁচল চাপা দেয় পালং। কিন্তু মনটাকে যে কোন কিছু দিয়ে চাপা দেওয়া যায় না। চাপতে গেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে মানুষটা। সে তো ভোলার চেষ্টা করেই চলেছে! নেশা করা ছাড়া আর মানুষটার ভেতর তেমন কিছু তো ছিল না। আকণ্ঠ গিলে সব উগরে দিত ঘরে এসে, হাতের সামনে যা পেত, তাই দিয়ে পালংয়ের পিঠে এঁকে দিত সোহাগচিহ্ন। পালংয়ের এখন সব সয়ে গেছে, চোখে আর জল আসে না। কতদিন পালং ভেবেছে- “মানুষটা শুধরোবে। পালং গুছিয়ে সংসার করবে।“ আশা বেঁচে থাকার বড় বালাই। কিন্তু কি হলো? শেষমেস ওরা পালংকে ফেরৎ দিয়ে গেল। মা পালংকে ফিরে আসতে দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কতদিন কেঁদেছে, বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে থেকেছে দাওয়াতে। ঠাকুমা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সত্যিটা বলে ফেলেছে- “মেয়ে মানুষের মাথায় ছাদ না থাকলে যে হাঁড়ির হাল হয় গো। স্বামী যে মেয়েমানুষের মাথার ছাদ। এখন আমার পালংয়ের কি হবে? বাবা মা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে!” ধূর্ অত ভেবে কী হবে? কপালে যা লেখা থাকবে, তাই তো হবে। কপাল কি কেউ কারো পাল্টাতে পারে? পালং তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- “শালু রে বাবা আর বীরুকাকাকে তাড়াতাড়ি চা টা দিয়ে আয়, নাহলে জুড়িয়ে যাবে যে।“
পালং ধীর পায়ে সেখান থেকে উঠে পড়ে, ঘরের পেছনে পুকুরের সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটটার প্রথম ধাপে এসে বসে। অনেক সময় এখানে একা একা বসে থাকতে তার ভালো লাগে। দেখতে থাকে ঘাটের সিঁড়ি, সিঁড়ির বুকে জড়িয়ে থাকা জল। শেষ সিঁড়িতে জল আর সিঁড়ি মাখোমাখো হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে। পাশেই গলা তুলে মরালটা মরালীকে আদর করছে, তার ডানায় মুখ লুকিয়ে ঘষছে। চোখ বন্ধ করে মরালীটা সে আনন্দ শুষে নিচ্ছে। পালংয়ের মনটা হু হু করে। একটা মাটির ঢেলা তুলে শান্ত, স্থির পুকুরের জলে ছুঁড়ে দেয়। বৃত্তাকার তিরতির তরঙ্গ তুলে ডুব শব্দ করে ডুবে যায় ঢেলাটা, বেশ কিছুদূর জলকে নাড়িয়ে দেয়, সেই তরঙ্গের ভেতর ওঠে আসে সুন্দর কারুকার্য করা একটা ছাদ, তারপর পুরো রাজপ্রাসাদটা। ছোটবেলায় ঠাকুমা বলতো- “এই রাজপ্রাসাদের ভেতর সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে সোনারবরণ রাজকন্যা। তার ঘুম কিছুতেই ভাঙে না। তার মাথার পাশে রাখা সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি। একদিন সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এল রাজপুত্র আর সে যেই সোনার কাঠি ছোঁয়ালে রাজকন্যার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তারপর রাজপ্রাসাদ আলোয় ঝলমল করে উঠল। ছাদে বেজে উঠল নহবতের সুর।” পালং শুনতে পারছে নহবতের করুণ রাগিণী,,লোকটা পিছমোড়া করে ধরেছে পালংকে। আর পুরুষাঙ্গটা ঠুসে ধরেছে পালংয়ের মুখে। দম বন্ধ হয়ে আসছে পালংয়ের । নিশ্বাস নিতে যে কষ্ট হচ্ছে,,,।
“দিদি সন্ধ্যে হয়ে গেল, পুকুর ঘাটে কি করিস? মা ডাকছে ঘরে আয়।”
শালুর ডাকে সম্বিত ফিরে পালং বলে- “যাই।” আরেকটা মাটির ঢেলা তুলে পুকুরের জলে ছুঁড়ে দেয় পালং। মুখে বলে-“ হুঁ রাজপুত্তর!” তারপর সন্ধ্যাদেবীর কাছে প্রার্থনা করে- “শালুর পাত্তর যেন সত্যিই রাজপুত্তুর হয়।”
দুই।
ফাল্গুনের প্রথম লগ্নতেই শালুর বিয়ে। তিন কাঠা পাঁচ ছটাক জমিতে বছরে দুই বার কাঁচা সব্জি ফলানোর পুঁজিটুকু নিয়ে শালুর বাবা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে। মাঝে মাত্র আর কটা দিন! দু’বোন এক সঙ্গে ঘুমোয়। অনেকরাত পর্যন্ত গল্প করে। মা চেঁচায়- “এ’বার ঘুমো তোরা।”
শালু বলে- “ঘুম আসে না রে দিদি।”
“কেন রে?”
“আচ্ছা দিদি তোর শ্বশুরবাড়ির মতো আমার শ্বশুরবাড়িও যদি হয়! আমাকেও যদি তোর মতো,,।”
“ কি যা তা ভাবচিস! তোর পাত্তর ভালো আমি দেখেছি। তুই খুব ভালো থাকবি রে শালু।”
দিদির আর একটু কোল ঘেঁষে শোয় শালু। পালং মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে- “শালু, শহরে গিয়ে তুই আমাদের ভুলে যাবি না তো।”
“ভুলব কেন?”
“তবে তুই যখন আসবি শালু, আমাকে ওখানের শাড়ি দু একখানা দিস। বীরুকাকার বউয়ের মতো পরে ঘুরব।”
“কেন তুই ওখানে যাবি না দিদি!”
“যাবো তো। তবে সে তোর ছেলেমেয়ে হলে দেখতে। আমি গেলে তোর শ্বশুরবাড়িতে তোকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে । তাই এমনি যাওয়া যাবে না রে।” পালংয়ের কথায় শালু চুপ করে যায়, পালংয়ের নিঃশ্বাস পড়ে। জানলার গরাদ বেয়ে চাঁদের আলো রাত্রির ভার নিয়ে মুহূর্তকে ছাপিয়ে এগিয়ে যায়।
গোপালগঞ্জ থেকে কোলকাতা আসার একমাত্র উপায় বাস যাত্রা। গোপালগঞ্জ থেকে ঘাটাল পর্যন্ত লোকাল বাস যাতায়াত করে। এই বাসে হাঁস মুরগির সঙ্গে গাদাগাদি করে গায়ে গা ঠেকিয়ে নিত্য কাজে মানুষ যায়। ঘাটাল সাবডিভিশন থেকে হাওড়াগামী সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস বাসে অবশ্য এ গাঁয়ের বেশিরভাগ মানুষ কখনো চড়েনি। রাস্তার উপর এসব ঝকঝকে বাস অহমিকা তুলে হর্ণ দিতে দিতে বেরিয়ে গেলে এরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে। যথাদিনে বিয়ে করে শালুকে নিয়ে শালুর বর চড়ে বসল এরকম হাওড়াগামী সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস বাসে। হাওড়া থেকে শিয়ালদা। তারপর এন্টালি।
শালু জানলার ধারে সিটে বসেছে। হাওয়ায় মুখের ঘোমটা সরে যাচ্ছে। কপালের উপরের কুচোচুল মুখে এসে পড়ছে। দুচোখে বিস্ময় নিয়ে শালু দেখতে থাকে বাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুপাশের ঘরবাড়ি গাছপালা খেতখামার দোকান পাট কেমন সব দৌড়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। বাসটা টার্ন নিয়ে ঘুরতেই বদলে গেল রাস্তাঘাট। রাস্তার দুপাশে তাদের বাসের কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে কত গাড়ি, উল্টো দিক থেকেও আসছে গাড়ির সারি। রাস্তার পাশে কত কিছু লেখা, ছবি আঁকা সাইনবোর্ড । সাইনবোর্ডগুলো কত বড় আকারে। একে যে হোর্ডিং বলে শালু তা জানেনা। শালু পেছনে ফেরে। বাসের পেছনের লম্বা ফাইবার গ্লাসের ওপাশে দ্রুত সবকিছু সরে সরে যাচ্ছে, তার বাপের বাড়ি, গাঁয়ের মানুষজন, তারাও কি তবে,,,,, না নেই, পেছনের জিনিষ কিছু আর দেখা যায় না। শুধু বাসের সঙ্গে বয়ে চলা হু হু হাওয়া জানলা দিয়ে গলে এসে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার।
হাওড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে শালুর মুখ হাঁ হয়ে যায়। “এত মানুষ! থিকথিক করছে মানুষের সমুদ্র। মিছিল যে। একসঙ্গে এত মানুষ সে গেরামে টিকিট কেটে যাত্রা দেখতে গিয়ে, যাত্রা শেষে ফেরার সময় একবার দেখেছিল। সে তো অনেক বড় যাত্রা কোম্পানির যাত্রা ছিল। প্যান্ডেল তুলে দিতে হয়েছিল যাত্রা কমিটিকে। গেরামের রথতলায় একবার সার্কাস বসেছিল। ছোটবেলায় সে দেখেছে- সে সার্কাসে কত মানুষের ভিড়! কিন্তু এরা কেন এসেছে? এরাও কি,,,,,?” হাতে টান পেয়ে পেছনে ঘোরে। দেখে- তার স্বামী তার হাতটা ধরেছে।
“ চলো রাস্তার ওপাশে, ওখানে গাড়ি আছে, ও গাড়ি একেবারে বাড়িতে নিয়ে যাবে, আর কষ্ট হবে না।”
শালুর লজ্জা লাগে। এই প্রথম মানুষটার দিকে তাকায় ।
রাস্তা পার হতে গিয়ে শালুর চোখ চলে যায় মার্কেটের দিকে, সেখানে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে পানিফল! আরে এ তো দেশগেরামে পুকুরে ভর্তি হয়ে আছে। মনে মনে ভাবে- “শহরের লোকেরা এসব কেনে? আর ওগুলো! শালুকফুল! বিক্রি হচ্ছে পয়সা দিয়ে? ওমা! পুকুর পরিস্কার রাখতে এসব তো পুকুর থেকে তুলে ফেলে দেয় গেরামে। চলতে চলতে শালুর পা থেমে থেমে আসে।
পেছন থেকে মানুষটা বলে ওঠে- “শহরে এসব নেই কিনা। শহরে অনেক কিছু নেই, আবার আছেও।”
মানুষটাকে শালুর ভালো লাগতে শুরু করে।
তিন।
শ্বশুর বাড়িতে এসে শালু নিয়ম- নীতি মন মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে আরও একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করে- ঘরের এই সাদা ছাদটার সিঁড়িটা কোথায়? সিঁড়িটা দেখতে তার মন উৎসুক হয়ে ওঠে। চোখ দুটো ছটপট করে। কিন্তু নতুন বউ সে- কাউকে জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে! তারচেয়ে নিজেই বুদ্ধি করে, দুপুরে বাড়িতে সকলে ঘুমিয়ে পড়তেই চুপিচুপি এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে সিঁড়িটা।
“কি খোঁজো বোমা?” শাশুড়ি পেছন থেকে ডাকে।
“আজ্ঞে সিঁড়ি। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে শালুর ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটা।”
“সিঁড়ি! ছাদ! পাকা ছাদ তো নেই আমাদের।”
“তাহলে ঘরে সাদা ছাদ!”
“ওটা তো ফলস সিলিং।” ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা খেয়াল করেনি।
“কেন এ যে টালির ছাদের ঘর বীরু তোমাদের বলেনি! বীরুকে তো সব বলা হয়েছে। আমরা কিছু তো লুকায়নি।” শাশুড়ি মা ভুরু তুলে বলেন।
শালু বিস্মিত হয়। তবে বিস্ময়ের তখনও খানিকটা বাকি ছিল। সেইদিনই শালু মুখোমুখি হয় আরেক গভীর সত্যের, যা বীরুকাকা বলেনি- “তার স্বামীর আগের বিয়ের যে দুটি মেয়ে আছে, তাদেরকেই আপন সন্তান স্নেহে তাকে মানুষ করতে হবে, নিজের কোন সন্তান নিতে পারবে না।”
শালু তাকিয়ে থাকে শাশুড়ি মায়ের মুখের দিকে। তার পা নড়ে না, হাত সরে না। ফলস সিলিংটার দিকে মুখ করে বিড়বিড় করতে থাকে- “ও তাহলে মিথ্যে ছাদ!”
শালুর কেমন যেন ছায়া ছায়া লাগতে থাকে দিনগুলো ক্রমশঃ। দেশের কথা মনে পড়ে। একটা রং করা দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দেখতে থাকে ফ্যাকাশে অন্য দেয়ালটার দিকে। বারবার ভাবে- “কি করবে সে? দেশে ফিরে যাবে? মা বাবাকে বলবে? দিদিকে? না, তা হয় না। দিদি বাড়িতে ফিরে এসেছে, সেও ফিরে গেলে,,, পাঁচ লোকে আঙুল তুলবে, তারচেয়েও বড় বাবা মা চাপ নিতে পারবে না, তারা কীভাবে বাঁচবে!”
“শালু!” মানুষটা শালুর পিঠে হাত রেখে আদর করে।
ভালোবাসা, আদর! মানুষটা তাহলে তাকে ভালোবাসে! শালু মন হাতড়ায়। মনের কোনে এককণা সোনালী বালু চিকচিক করে। রিক্ত মাটির কাছে আকাশের এটুকু বাঁধনই তো যথেষ্ট। বাঁধন তো ভরসাও। চোখের কোণ থেকে একফোঁটা মুক্তোর দানার মতো জল ঝরে পড়ে শালুর।
চার।
অনেকদিন পর শালু কথাটা বলতে পারে- “মেয়েরা স্কুলে চলে গেলে, একা একা তখন আমার আর ভালো লাগে না, আর তেমন কাজও কিছু থাকে না। গাঁ গঞ্জের মেয়ে আমি, এভাবে বসে থাকতে আমার গা হাত পায়ে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”
“ঢি ভি তে সিরিয়াল দেখো সময় কেটে যাবো।”
মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে শালু বলে- “ও আমার ভালো লাগেনা।” দেশে থাকতে পালং এসব দেখলেও সত্যি শালু টিভিও দেখতে পছন্দ করত না। ঘরের বেশির ভাগ কাজ শালুই করত। এবার আসল কথাটা বলে- “আমি কাজ করতে চাই।”
“কি কাজ?” হাসে মানুষটা।
“কাল শ্বাশুড়িমায়ের সঙ্গে কেউ একজন গল্প করছিলেন, কি একটা অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করেন শুনলাম, ওরকম যদি হয়।”
“ও! রীতা মাসি! উনি পাঞ্জাবিতে বোতাম লাগানোর কাজ করেন। দোকান থেকে অর্ডার নেন, তারপর কাজটা করে দোকানে দিলে পাঞ্জাবি পিছু পয়সা পান।”
“ আমিও পারি রীতা মাসির কাজ।”
“বেশ করো।”
শালু বাইরের জগতে পা রাখে। বুদ্ধিমতী সেই সঙ্গে পরিশ্রমী শালু কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে যায় এ কাজে বেশি পয়সা নেই, পাঞ্জাবির এমব্রয়ডারির ডিজাইন করতে পারলে বরং বেশি পয়সা হাতে আসবে। সরাসরি দোকানের মালকিনকে বলে বসে- “ম্যাম আমি ও কাজটা মানে পাঞ্জাবিতে এমব্রয়ডারি ডিজাইনের কাজটা পেতে পারি?”
“তুমি ডিজাইন করতে পারো?”
“হাঁ।” মাথা নাড়ে শালু।
“বেটার কিছু হলে নিশ্চয় দেব। কয়েকদিনের মধ্যে স্যাম্পল নিয়ে এসো।”
“এই চান্স।” কিন্তু বাড়িতে এসে শালু মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, ডিজাইন কিভাবে করবে? সে তো ড্রয়িং কি জিনিস তাই জানে না, কখনো শেখেনি। গাঁগঞ্জে এসবের চল নেই, রঙ পেন্সিল তুলি কেনার পয়সা থেকে আঁকানোর মাষ্টার কিছু ছিল না। কিছু শেখেনি, ছেলেবেলা তো কেটেছে গাঁয়ের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে কুমির ডাঙা, লুকোচুরি, গুলিডান্ডা হা ডু ডু চু কিতকিত ,,, এসব খেলা খেলে। তাহলে!
শালু তো পালং নয়। পাঁকে ফোটা শালুক ফুল। সে অভিযোজন করতে জানে। মনে পড়লো ছোটতে তাদের একটা প্রিয় খেলা ছিল- এলাটিং বেলাটিং সইলো/ কিসের খবর আইলো/ রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো ,, মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে যায় “আইডিয়া!” রাজামশাইয়ের পাঞ্জাবির মতো ডিজাইন, না, না, তাতে মিক্সড ম্যাচ করে যদি কথাগুলো রেখে দেয় কেমন হয়! কিংবা লতাপাতা, চাঁদ সূর্যের, আঁকিবুঁকির ভেতর যদি সুতো দিয়ে লেখে-
লেবুর পাতা করম চা/ যা বৃষ্টি ধরে যা।
কিংবা,
আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদুর মাষ্টার শ্বশুরবাড়ি
ইকিড় মিকিড় চামচিকিড় / চামের মাথা খা
মনের আরাম চোখের বিরামের মতো কিছু ব্যাপার।” গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করা শালুর কতকিছু মনে হলো- “ডিজাইন করে তাতে যদি রেখে দেওয়া যায় কবির চিরন্তন কবিতা, গায়কের গানের লাইন।”
তবে!
বলা বাহুল্য মালকিন লুফে নেয় আইডিয়াটা।
শালু এসে দাঁড়ায় আলোর বৃত্তের সামনে।
পাঁচ।
মালকিনের দোকানের হাল বদলে যায়। শালু অবশ্য এখনও তার মজুরিটুকুই পায়। এটাই নিয়ম। শালু বলে- “ম্যাম আমার দিকটা যদি একটু দেখেন।”
মালকিন হাসে। বলে- “তোমাকে বেশিই দিই, ভেবো না।”
শালু চুপ করে যায়। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। আর ফলো করে- “তার দক্ষতা আছে, মেধা সম্পদ আছে, কিন্তু একটা জিনিস নেই, তা হলো তার মালকিনের মতো তার বিপননের ক্ষমতা। সে কারণেই সে টেবিলের এদিকে দাঁড়িয়ে আর টেবিলের ওদিকে বসে তার মালকিন!”
কিন্তু শালু যে থেমে যাওয়ার মেয়ে নয়। চুলচেরা রাস্তায় হাঁটলেও খোঁজ করতে থাকে আর কতটা পথ গেলে তবে বড় রাস্তায় উঠতে পারবে।
বেশীদিন অপেক্ষা করতে হলো না। পথিকের যেমন পথের দরকার, তেমন পথেরও কখনো কখনো পথিককে দরকার পড়ে। ‘সোনারপুর মেলা একজিবিশনে’ পরিচয় মিসেস মালহোত্রার সঙ্গে। ডিজাইনার গারমেন্ট এক্সপার্ট ইমপোর্টের ব্যবসা ওনার। জহুরি জহর চেনেন। শালুর পাঞ্জাবিতে এমব্রয়ডারির ডিজাইন তাঁর চোখে পড়ে।
এসব তোমার ডিজাইন?
আজ্ঞে হাঁ।” মাথা নাড়ে শালু।
“বা, বেশ তো। তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারো”।
জীবন কাকে কখন যে কী দেয়! মালকিনের দোকানে শালুর যে কদর কমে আসছিল। হ্যান্ড মেড এমব্রয়ডারির বদলে মেশিন মেড এমব্রয়ডারির দিকে ঝুঁকছিল মালকিন।
শালুর ভেতর তোলপাড় করে। আবারও একবার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। মনে পড়ে ঠাকুরমার কথা। ঠাকুমা শীতের সময় উঠোনে মাদুর পাতিয়ে বসত। তারপর বাড়ির পুরানো শাড়ি জামাকাপড় সেলাই করে করে শীত রোদ্দুরের ওম গায়ে মাখতে মাখতে সবার জন্য কাঁথা বানাতো। পুরানো শাড়ির পাড় থেকে রঙিন সুতো তুলে তা সূঁচে পরিয়ে কাঁথার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে আঁকতো হরগৌরি রাধাকৃষ্ণ মূর্তি আরো কতকিছু আর সুর করে গাইতে গাইতে ফুটিয়ে তুলতো হৃদয় নিংড়ানো কত গানের কলি- বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা।”
শালুর রক্তে আছে। শালু পারবে নতুন নতুন এমব্রয়ডারি করতে, ফ্রেবিকের গায়ে ডিজাইন ফুটিয়ে তুলতে।
শালু কাজ শুরু করে মিসেস মালহোত্রার আন্ডারে। দিনরাত, রাতদিন। বিরামহীন অবিরত। আর একটা জমানো স্বপ্ন প্রতিদিন তাকে ধাক্কা দিয়ে যায়। লালিত হতে হতে চলমান হয়ে ওঠে- কলকাতা শহরের বড় বড় ছাদওয়ালা বাড়িগুলো, ফ্ল্যাটগুলো ।
মিসেস মিত্রা ডাকেন- “শালু সাপ্লাই যে ঠিক সময়ে দিতে পারছি না। বড়বড় জোনাল পার্টির অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে।”
শালু বলে- “ ম্যাম অর্ডার গুলো আমায় দেবেন?”
“তুমি পারবে?”
“চেষ্টা করবো “। অন্তত চেষ্টা।
প্রোডাক্ট উৎপাদন থেকে বিপনন শালুর বুক কাঁপে, ভয় লাগে। কিন্তু কখনো কর্তব্যে গাফিলতি করতে শেখেনি সে তো! মালহোত্রার থেকে যে দায়িত্ব নিয়েছে।
শালু অসামান্যা নয়। সফল না হলে বিফল হতে হবে। কিন্তু পেছিয়ে গেলে মূল্যায়ন সম্ভব নয়, রিক্স না নিলে জয় সম্ভব নয়। শালু দাঁতে দাঁত চেপে ধরে।
মার্চের ইয়ার এন্ডিং এ মিসেস মালহোত্রা জানান তাদের কোম্পানি দশ কোটি টাকার টার্ণ ওভার দিয়েছে। যার ম্যাক্সিমাম কৃতিত্ব গোজ টু শালুক মিত্র।
ছয়।
জীবন নদীর মতো পরিবাহিণী। তার চলার বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে কত ঘাতপ্রতিঘাত । তবু জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় না। যেমন যেতে পারেনি শালুর স্বামী। দোতলার ব্যালকনি থেকে ডাকে- শালু! একবার এসো।
শালু জানে মানুষটার আর এক জায়গায় বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, শাশুড়ি মা গত হয়েছেন। একা হয়ে গেছে বাড়িতে। ক্রাচ নিয়ে বেশি দূর যেতেও পারে না। দীঘা থেকে প্যাসেঞ্জার বোঝাই বাস নিয়ে আসার পথে দুর্ঘটনায় কতদিন হলো মানুষটা তার পা হারিয়েছে!
পাঁকে ফোটা পদ্মের কলির উপর পড়া সকালের স্নিগ্ধ আলোর মতো স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে শালু এগিয়ে এসে মানুষটার হাতে হাত রাখে। চুলে বিলি কেটে বলে- শিয়ালদার কাছে যে নতুন শোরুমটা হবে, ওখানে তুমি ক্যাশে গিয়ে বসো।
আমি! হাত দুটো উপরে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে মানুষটা বলে- আমি তো আর স্টিয়ারিং ধরতে পারি না, তাহলে গাড়ি চালাবো কিভাবে?
শালু হাসে- সবসময় চালকের আসনে কেন কখনো কখনো প্যাসেঞ্জার সিটে বসেও যাত্রাপথ উপভোগ করতে হয় বুঝলে! এবার মানুষটাও একটু হাসে।
শালু রেডি হয় বাড়ির নীচে শোরুমে যাওয়ার জন্য। বাড়িটা ভেঙে তিনতলা করে, নীচের দুটো তলা পুরো শাড়ির শোরুম করেছে। অনেকজন মেয়ে এই শোরুমে কাজ করে। এছাড়া আরো দুটো শোরুম আছে।
শোরুমে বসে বারবার পালংয়ের মেসেজটা পড়তে থাকে শালু। বাবা মা অনেকদিন মারা গেছেন, দেশবাড়িতে পালং একেবারে একা। শালু যে দিদির কাছে যেতে একেবারে সময় পাচ্ছে না। কি যে করে! এবার শালু পালংকে মেসেজ পাঠায়- “ দিদি তুই এখানে আয়। এবার থেকে আমার কাছে তুই থাকবি দিদি।”
“না, না, সে কি করে হবে? তোর শ্বশুরবাড়ি, সেখানে আমি কিভাবে থাকতে পারি?”
“পারিস দিদি। তুই এসেই দেখ না।”
সাত।
পালং আসছে শালুর কাছে। আসতে চায়নি, কিন্তু শালু তাকে অনেক বুঝিয়েছে। বীরুকাকি সঙ্গে করে নিয়ে আসছে পালংকে । বীরুকাকা নেই। কাকি এখনো কোনো দরকারে কলকাতা এলে মাঝে মাঝে ছাতাপট্টিতে এসে ওখানকার সবার সঙ্গে দেখা করে যায় ।
শালুর কাছে আসার সময় পালংকে নিয়ে ছাতাপট্টিতে আসে বীরুকাকি। সব ঘুরে ঘুরে দেখায় । কি সুন্দর কত রঙ কত ডিজাইনের সব ছাতা সেখানে। কাকি বলে- এইসব ছাতা বানানোর একজন খুব দক্ষ কারিগর ছিল তোর কাকা।” পালং মুগ্ধ হয়ে দেখে।
মুগ্ধ হয়ে দেখে শালুর বাড়ি ঘর।
শালু বলে- দিদি চল নীচের শোরুমে। দেখবি। ওখানে আমার এখন কাজ আছে। ওখানে থেকে অন্য শোরুমে আবার যেতে হবে জরুরি কাজ আছে শিয়ালদাতে। ওদের সঙ্গে মানুষটা ও নেমে আসে।
পালং হাঁ করে দেখে কত বড় শোরুম, ঠাণ্ডা মেসিন চলছে, কি সুন্দর করে সাজানো! কতজন মেয়ে সুন্দর ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব সামলাচ্ছে।
শালুর কানে কানে পালং বলে- এরা সব!
এরা এই শোরুমে কাজ করে। মাস গেলে সেলারি পায়।
সে,,লা,,রি! পালং শালুর কথাগুলো শুনে চুপ করে মেয়েদের দেখতে থাকে। প্রত্যেকই বেশ কাজ করছে, তাদের মুখে চওড়া হাসি। পালং চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায়- এদের সবার মাথায়, শালুর বরের মাথায়, এমনকি তার মাথাতেও একটা করে ছাতা ধরা। সে ছাতাগুলো ছাতাপট্টির মতো সুন্দর সুন্দর নানা সাইজ, নানা রঙের। আর সব কটা ছাতা একা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শালু। আর ওই ছাতাগুলো জুড়ে জুড়ে ঠিক ছাদের মতো দেখতে লাগছে- শক্ত পোক্ত মজবুত একটা ছাদ। যে ছাদে রোদের তাপ, বৃষ্টির ছাঁট এসে আটকে যাবে,,,,,।।