শ্রীরূপা বলে, স্বার্থপর জামাই মশাই! লোভ তো কম নয়। বাবা একটা মেয়েকে পুরো দান করেছে আর বাকি দুজনকেও তোমার খিদমতেই রাখবে বলছ? সৃজিত চোখ মেরে বউকে বলে, না অতটা ওভারডোজ সইবে না ম্যাডাম। শুধু ভাবছিলাম...।
শ্রীরূপা মুঠি করে কিল দেখাতেই সৃজিত বাজারের ব্যাগখানা হাতে ঝুলিয়ে হাঁটা দেয়। রবিবারের বাজার বৌকে চটালে, খুব মুশকিল সে জানে।
এসব কথা এবং তার উপর কথা চলতে চলতেই মাস দুতিন কোথা দিয়ে কেটে যায়। শ্রীরূপাদের বাড়ি গিয়ে খানিক বিয়ের বাজারও করে ফেলে সবাই মিলে। সৃজিতের ইচ্ছা শালীদের নিয়ে একটা ভালো ট্যুর করে। শ্রীরূপারও সেরকমই ইচ্ছে। এরপর অনেকদিন হয়ত তিন বোন মিলে কোথাও যাওয়াই হবে না। শ্রীরূপার বন্ধু প্রিয়ার ট্যুরস এন্ড ট্র্যাভেলসের ব্যবসা। এর আগে ওর ব্যবস্থাতেই সিকিম থেকে কোডাইকানাল অনেক জায়গায়ই ঘুরেছে ওরা।
প্রিয়াই বলল, বোনেদের নিয়ে দক্ষিণ ভারতের পাহাড় আর জঙ্গল ঘুরে এসো, এ পাহাড় হয়ত হিমালয়ের মত অত উঁচু নয় কিন্তু রিল্যাক্সড হয়ে যাবে এ দেখে নিও। প্রিয়া নিজে দক্ষিণের মেয়ে, তাই হয়ত দক্ষিণের প্রতি তার অপ্রতিরোধ্য টান। এ কথাও ঠিক প্রিয়ার উদ্যোগেই দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গা দেখা হয়ে গেছে।
শ্রীরূপা মাথা নাড়ে। সৃজিতও।
প্রিয়া বলে, আবে পাহাড়ের গায়ে সাইলেন্ট ভ্যালি বুক করছি তাহলে। ফেরার পথে উটি হয়ে ফিরে এসো। দেখ ভাল লাগবে খুব।
সেভাবেই সব ব্যবস্থা হল। ট্রেন ধরে ভোর রাত্রে মাইসোর স্টেশন। মাইসোর স্টেশনে থাকবে প্রিয়ার ঠিক করা গাড়ি। চলল গাড়ি। নির্জন রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ। মাটিতে রোদ আর ছায়ার ইকড়ি মিকরি।
নীলগিরি বনের রাস্তায় এক রেস্তোরাঁয় দাঁড়াল গাড়ি। জঙ্গলের মধ্যে অচেনা পাখির ডাক শুনতে শুনতে চলল দোসা, ইডলি আর চাটনি খাওয়া। আবার চলল গাড়ি আর তার সঙ্গে দুপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসতে থাকল কত যে পাখির ডাক।
জানলার দুধারে দুই বোন, মাঝখানে তাদের দিদি। ড্রাইভারের পাশে সৃজিত। ব্যাগের মধ্যে ঘুমাচ্ছে ক্যামেরা। তার ডানদিকে বসেছে অপা, অপরাজিতা।
অপার চীৎকারে চমকে উঠল শ্রীরূপা। এত নিশ্চিন্ত নির্জনে কখন যেন ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল চোখ। ধমকে উঠল, এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন? সে বলে, হাতি।
-কোথায়?
সৃজিত বলে, ঐ তো। বোঝা গেল, সে ছাড়া অন্য সবাই দেখতে পাচ্ছে হাতিকে।
ড্রাইভারের চাপা গলার ধমক আসে, চুপ করে বসুন।
ড্রাইভারই বলে, এ সম্ভবত নীলগিরির জঙ্গল থেকে আসা হাতির দল। মাঝে মধ্যেই নেমে আসে এরা। ক্ষেতের পর ক্ষেত ফসল খেয়ে, বাকি ধ্বংস করে ফিরে যায়। হাতিকে এখানকার লোকজন খুব ভয় পায়। জঙ্গলের নিজস্ব লোকজন আছে হাতি তাড়ানোর, তবে তারা যে ক্যানেস্তারা পেটায় আর চেঁচায় তাকে হাতি খুব বেশি ভয় হয়ত পায় না। ভয় পায় আগুনকে। এক তো আগুন জ্বালতে লাগে কেরোসিন, তার ওপর আছে ফসলের ক্ষেত; সেখানে আগুন জ্বালালে চাষীর নিজেরই বিপদ তাই আগুন জ্বালতে রাজি হয় না কেউ খুব একটা...।
রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার যখন এসব বলছে চাপা গলায়, তখন একটা বাচ্চা হাতি শুঁড় নাচিয়ে গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল। হয়ত তার মা, মাসি, কাকা, পিসো পিছনেই আছে ভেবে গাড়িটা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকল। আর কোনো হাতি এলো না।
হয়ত বাচ্চাটা দলছুট হয়ে গেছে, বলল ড্রাইভার। এরপর ওকে খুঁজতে আসবে বড় হাতির পাল।
এরপর সে বেশ দ্রুত গাড়ি চালিয়ে হুম হাম করে পেরিয়ে এল জঙ্গল। আরো বেশ খানিকটা গিয়ে এবারে সে গাড়ি ঢুকে পড়ল এক মাটির রাস্তায়। এরপর যেখানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গাড়িটা দাঁড়ালো, মাটির রাস্তাটা সেখানেই দুম করে শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে একদিকে রিসর্টের টালি পাতা রাস্তা আর অন্যদিকে ঢালু মেটে পথ নেমে গেছে। ড্রাইভারের কাছেই শুনল, ঐ ঢালু পথে একটু এগোলেই আছে কফি ক্ষেত আর তাও পেরিয়ে গ্রাম। গ্রামে আসা যাওয়ার রাস্তা অন্যদিকে।
বুঝতে পারলো, ড্রাইভার ছেলেটা যদিও দেখতে একেবারে বাচ্চা ছেলের মত তবে সে শুধু ভালো ড্রাইভার নয়, স্থানীয় গাইড হিসেবেও যথেষ্ট ভালো।
পরদিন ভোরের আগেই ঘুম ভেঙে যায় শ্রীরূপার। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখে বাইরে অন্ধকার। কাকভোর; কাকের আওয়াজ নেই যদিও।
বারন্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে সে। দেখে রিসর্টের রাস্তায় জ্বলছে নেভা, নেভা আলো। রিসর্টের ম্যানেজার বলেছিলেন রাত্রে ঐ অঞ্চলে বিদ্যুৎ থাকে না। সোলার পাওয়ার একমাত্র ভরসা।
এসবের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ফোঁসস শব্দে ফিরে ভোরের ফ্যাকাশে আলোয় দেখে একটা বিশাল মথ ওদের দরজায় বসে ওরকম শব্দ করছে। তার আশেপাশে অন্তত তিরিশখানা বিভিন্ন ধরনের মথ; তবে তারা কেউ আয়তনে এর ধারে পাশে যায় না। মথ যে এমন শব্দ করে তা কখনো শোনার সুযোগ হয়নি। এমন নিঃশব্দ রিসর্টে না এলে হতও না। এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল খেয়াল করেনি সৃজিত কখন এসে তার পাশে এসে বসেছে। সামনে তাকিয়ে দেখে কফি ক্ষেতের মাথায় ঝুলে আছে আধখানা বিশাল কুমড়ো।
নীপাও এল। অপা চিরকালের লেট রাইসার। ঠিক এইসময় রিসর্টের ছেলেটা নিঃশব্দে রেখে যায় চায়ের পট আর কাপ। কালকেই জেনে নিয়েছিল, সকালে ওদের কফি নয় চা চাই। চা না থাকলে গরম জল। চা পাতা শ্রী ব্যাগে নিয়েই এসেছে। সবসময় নিয়ে যায় যেখানেই যায়।
অপাকে ডেকে নিজে স্নানে ঢোকে। সাতটায় বেরনো। আবে ফলস দেখে কাছাকাছি ঘুরবে। এদিকে এসে মনে হচ্ছে জঙ্গল যেন একেবারে অনুঢ়া যুবতী কন্যা। একেই বোধহয় বলে প্রিস্টিন। যদিও যুগ যুগ ধরে মানুষ এসব জঙ্গলে কম থাকেনি বুনো জানোয়ারের পাশাপাশি। তবুও আশেপাশে কোথাও কাটা গাছ চোখে পড়ে না তাদের।
জঙ্গলের এই রূপে, গন্ধে ওদের সকলেরই কেমন নেশা ধরে যায়। এর সঙ্গে মাঝে মাঝেই আছে ড্রাইভার ছেলেটার ছোট ছোট বক্তৃতা। ওর নাম মহেশ সেটা আজ জিজ্ঞেস করে জানল।
সৃজিত বলল, ছেলেটার ব্যাক্তিত্ব কিন্তু বেশ। বাড়তি বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয় না অথচ দরকারিটুকু বলে দিচ্ছে।
ছোট ছোট ধাপ পেরিয়ে সামনে থেকে দেখে আবেকে। কাবেরী এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে আচমকাই যেন জঙ্গলকে ছোঁয়ার ইচ্ছেয় লাফ দিয়েছে ঝুপ করে।
আবেকে দেখা শেষ করে ফিরে আসতেই হয় একসময়। পেটে সকলেরই ছুঁচো ডাকছে। জলপ্রপাতের আশেপাশে কোন খাওয়ার জায়গা নেই এখানে। ওপরে উঠে চিরাচরিত ম্যাগি আর চা। ড্রাইভার ছেলেটির সঙ্গে দেখা হতেই বলে, দেখে আসুন মান্দালপেটি। গাড়ি ওখানে যায় না। অটো নিয়ে যাবে।
আক্ষরিক অর্থেই রাস্তা বিহীন এবড়ো খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে অচেনা ফুল আর চেনা সূর্য মুখীর বন পেরিয়ে নীল পাহাড়ের মাঝে সবুজ ঘাসের ওপর ঘড়াং করে থামে অটো।
সেখানে পৌঁছাতে দেখে সে যেন এক স্বর্গোদ্যান। ঘাস ভরা ছোট ছোট সাদা, হলুদ আর বেগুনী ছিটের ফুল। সাবধানে পা ফেলে ওরা। পাহাড় এখানে খানিকটা দূরে সরে গেছে আর সে পাহাড় একেবারে ঘনশ্যাম। সেই নীল পাহাড়ি দেশে এক গাছ হাল্কা গোলাপী ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা একটা গাছ। প্রাণী বলতে, ওরা ছাড়া একটা কুকুর। সেই যেন রক্ষক সে উদ্যানের। কে জানে সে কোত্থেকে এলো সেখানে। আশে পাশে কোনো গ্রাম তো নেই। খায় কী? জলের বোতল থেকে জল আর ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে দিলে সে মহানন্দে লেজ নাড়ায়।
এভাবেই এক দুই তিন করে ফুরিয়ে যায় দেখার জায়গাগুলো। নীল পাহাড়কে পিছনে ফেলে নামার দিন চলে আসে। ফেরার পথে ড্রাইভার বলে, চলুন নিয়ে যাব হাতিদের হাসপাতালে। এসব আপনারা মনে হয় দেখেননি।
সৃজিত বলে, দেখিনিই তো। তবে শুনেছি, কাগজে পড়েছি।
মহেশ হাসে। শ্রীরূপার মনে হয় আহা বড় সরল ছেলেটার হাসি।
সে ছেলে আবার বলে, এই অঞ্চল এমন, এখানকার লোকে হাতিকে ভয় পায় যেমন, আবার ভালোবাসে ততখানি। দেখবেন অসুস্থ হাতিদের সেবা।
ওদের সকলেরই উৎসাহ বেড়ে যায় শুনতে শুনতে। আরো শোনে, হাতিতে চড়ে ঘোরার ব্যবস্থাও আছে। এরপর না যাওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। সৃজিতের উৎসাহ সকলের থেকে বেশি।
জঙ্গলের ভিতর হাতির পিঠে চড়ে খানিক ঘোরা হয়। ছবি তোলা হয়।
মহেশ পরিচয় করিয়ে দেয় হাতি ক্যাম্পের চিকিৎসকের সঙ্গে। সে ওদের গ্রামের ছেলে। ডাক্তার ওদের কফি খাওয়ায়। ওরা শোনে জঙ্গলের গল্প। শোনে কিভাবে অসুস্থ হাতিদের নিয়ে আসা হয় মন্দির আর বিভিন্ন জায়গা থেকে। ডাক্তার ছেলেটি বলে কিভাবে বাঘ অসুস্থ আর বাচ্চা হাতিদের তাক করে রাখে; সন্ধে নামলেই আক্রমণ করে। সেই ভয়ে কয়েকদিন আগেই একটি গর্ভিনী হাতি পালিয়েছে এখান থেকে। তাকে প্রচুর খোঁজা হয়েছে কিন্তু পাওয়া যায়নি।
বেলা পড়ে আসতে থাকে। জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে হুড়মুড়িয়ে। গাছের মাথা থেকে পাতা হয়ে জমিতে নামতে তার মোটে সময় লাগে না। ড্রাইভার তাড়া দেয়। এরপর প্রায় অন্ধকার জঙ্গল পেরিয়ে মাইসোরের কাছাকাছি এক গেস্ট হাউসে রাত কাটায় ওরা। পরদিন মহীশুর রাজার বাড়ি দেখে, উটির পথে রওনা।
যে রাস্তা ধরে উটির পথে চলেছে তাদের গাড়ি, সে রাস্তায় হুস হুস করে মাঝে মধ্যে দু একখানা তামিলনাড়ু আর কর্নাটক সরকারি ছাপ মারা বাস দেখা গেলেও সেটাকে রাস্তা কম জঙ্গল বেশি বলেই মনে হল। ড্রাইভার যদিও বলল এখানেও আশে পাশে গ্রাম আছে বেশ কয়েকটা, তবে দেখে মনে হয় না।
গাড়ি থামিয়ে ফটো নেওয়া হল। গাড়িতে বসে আড্ডা চলছে এমন সময় সেই জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ করে বন্ধ হল গাড়ি। ড্রাইভার, সৃজিত দুজনেই খুট খাট চেষ্টা করল কিন্তু গাড়ি নট নড়ন চড়ন। না সে আর কোনো শব্দই করে না। ঠিক যেন ঘুম পেয়েছে বলে রাস্তার মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়ল।
রাস্তায় লোক বলতে সাইকেলে চড়ে যাওয়া দুএকজন ফরেস্ট গার্ড। যানবাহন বলতে সেই সরকারি ছাপ মারা বাস।
এক বাসের পেটে চড়ে রওনা দিল ড্রাইভার।
অপা বলে, এই জঙ্গলেই আমাকে বাগে খাবে। হানিমুনে রক্তিম সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবে বলেছিল। সে আর দেখা হল না। বেশি ভয়ে গ, ঘ ঘুলিয়ে গেছে। তার জামাইবাবু বলে ওরে ওটা বাগ নয়, বাঘ। বাঘে আর ছারপোকায় তফাত রাখলি না। বেচারা রক্তিমের কি যে হবে! ধাঁই ধপাধপ কিল পড়ল জামাইবাবুর পিঠে।
ড্রাইভার ফিরছে দেখা গেল, ভটভটি ভ্যানে চড়ে। সঙ্গে মেকানিক। যাক!
ও বাবা! এ নাকি মেকানিক নয়। এ পাশের গ্রামের...। মেকানিক আসতে সময় লাগবে। ড্রাইভার ওদের চারজনকে ভ্যানে বসালো। নিজেও একটা কোনায় বসে পড়ল। ভগবান, ভ্যানচালক আর ড্রাইভার এরাই জানে ওরা কোথায় যাচ্ছে। পিচ রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরে ভ্যান চলছে গড়গড়িয়ে। বাইকের ইঞ্জিন ভ্যান টেনে নিয়ে চলেছে। বেড়ানোর মুড থাকলে এমন লাল মাটির রাস্তা, দুপাশে গাছের সারি, অজানা ফুল, দেখে মুগ্ধ হতো। বিশেষ করে বেড়ানোর মাঝখানে টুক করে একটা অজানা গ্রামে যখন এভাবে ঢুকে পড়ছে ওরা। কিন্তু...।
ওদের একটা বাড়িতে বসিয়ে, কফি খেয়ে ড্রাইভার সেই ভ্যানে চড়েই বেরিয়ে গেল আবার। মেকানিক এসে গেছে কি না কে জানে! বাড়ির লোকেরা ওদের কফি আর মুরুক্কু দিল। তবে কথা খুব একটা হচ্ছে না। এরা স্থানীয় ভাষা ছাড়া কিছুই জানেন না। খানিকক্ষণ পর একটা বাচ্চা মেয়েকে ওবাড়ির লোকই ডেকে আনল। মেয়েটা টুয়েলেভে পড়ে। টুকটাক ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। সেই দোভাষীর কাজটা নিল। নাম তার শ্রীবিদ্যা। শ্রীবিদ্যা ওদের নিয়ে গ্রামের চার্চ, শিব মন্দির দেখালো।
গ্রামের লোকজন খুব না হলেও খানিকটা কৌতূহলী।
যাওয়া আসার পথে দেখল, একটা জলাভূমিও আছে। লম্বা নয়ানজুলির মতো। শুনলো, বৃষ্টির জল যাতে গ্রামে আর চাষের ক্ষেতে না জমে তার জন্য এই ব্যবস্থা। জল রয়েছে তখনো সেই সরু খালে। শ্রীবিদ্যার কাছে শুনল, মাছও আছে অনেক। এসবেই মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসছিল; সেলফি তুলতে গিয়ে সেই বিয়ের কনে অপার পায়েই একটা জোঁক লাগল।
অপার দিদি ভাবে, জোঁকটা নাহয় দিদির গায়েই উঠতো। এসব কেন যে অপাকে দেখেই হয়। অপা কুকুরে ভয় পায় আর রাস্তার সব কুকুর যেন অপার হাত চেটে দেবে বলেই রেডি হয়ে থাকে। এখানেও সেই চীৎকার। কান্নাকাটি। অচেনা জায়গায় লোকজন জমা হয়ে একবারে যা তা কান্ড।
ফিরে এসে ওরা দেখল ওদের জন্য ইডলি ধোসা সম্বর সব তৈরী করে ফেলেছেন সে বাড়ির গৃহিণী। খেতে খেতে হঠাৎ নজর করল, এবাড়ির লোকেরা খানিক অস্থির। শ্রীবিদ্যা চলে গেছে; তাই ওরা বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। বেশ কয়েকজন এবাড়ির গেটের সামনে এসে এঁদের ডাকছেন। এঁরা বেরিয়ে কথা বলছেন।
দেখা যাচ্ছে সবাই খুব উত্তেজিত কিন্তু কেন তা ওরা বুঝতে পারছে না। ভাষা না জানাটা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। বেড়ানোর আনন্দটাই মাটি। গাড়ি সারিয়ে ড্রাইভার কখন আসবে কে জানে! বাড়ির ভদ্রলোক বার বার ইয়েনাই, ইয়েনাই মাদার বলছেন।
খানিক পরে ও বাড়ির ভদ্রমহিলা ওর হাত ধরে দরজার দিকে ইশারা করলেন। বেরিয়ে যেতে বলছেন ওদের? কি সর্বনাশ কোথায় যাবে? এই অন্ধকারে! দেখল, তা নয়; ওদের সঙ্গে ওনারাও বেরোলেন। রাস্তায় অনেকেই আছে। হাতে তাদের বড় টর্চ। মোবাইল টর্চ কারুর কারুর। সেই নয়ানজুলির দিকে দৌড়াচ্ছে অনেকেই। ওরাও চলল সকলের পিছন পিছন।
ঠিক সেই মুহুর্তে একটা আঁ-আঁ আওয়াজ ভেসে এলো। সে আওয়াজ বুকের রক্ত শুকিয়ে দেবে মনে হল। অপা, নীপা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। শ্রীরূপার মনে পড়ল বহু বছর আগে ডুয়ার্সে একবার শুনেছিল এই আওয়াজ। বৃহংণ! সৃজিতের দিকে তাকাতে সেও ঘাড় নাড়ল।
শেষ পর্যন্ত হাতি নেমে এলো নাকি গ্রামে! হায় ভগবান! এও ছিল কপালে! আর এরা পাগলের মত দৌড়াচ্ছে কি হাতি দেখতে? হাতির দল কি সাংঘাতিক হয়, তা তো এদের জানার কথা। আশ্চর্য মানুষজন তো! ভারি রাগ হয় শ্রীরূপার।
ওখানে পৌঁছাতে টর্চের আলোয় দেখল একটা হাতি জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড় দিয়ে ঠান্ডা জল ক্রমাগত নিজের গায়ে ছেটাচ্ছে। একটাই। খানিক পর, পর শুঁড় তুলে আর্তনাদ করছে জঙ্গল পাহাড় কাঁপিয়ে। চারিদিকে এত লোক, তাদের হাতের আলো ফিরেও দেখছে না সে হাতি।
দূর থেকে ওদের দেখে শ্রীবিদ্যাই ছুটে এল কাছে। অতগুলো টর্চ অন্ধকার দূর করতে পারছিল না বিশেষ। শহরে থেকে এমন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারকে ওরা চেনেনি কোনোদিন।
শ্রীবিদ্যাই বলল, ইয়েনাই হাতি। শুনল, এ হাতিটা গাভীন। পাশের গ্রামে দুদিন ধরে আখের আর আনারসের খেত তছনছ করেছে। ফসলের এত ক্ষতি গরীব চাষীরা মেনে নিতে পারে না কিন্তু হাতিকে তাড়াতেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আনারসের মধ্যে পটকা ভরে রেখে দিয়েছিল। খেয়েছে। সে পটকা এখন ওর পেটের মধ্যে ফাটছে।
শ্রীবিদ্যা বলে, আক্কা অসহ্য যন্ত্রণায় হাতিটা কাঁদছে। বাচ্চাটা নিশ্চয় এতক্ষণে মরে গেছে বল?
শ্রীরূপার মাথা ঘুরছে। ও মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। সে বুঝতে পারে না চারিদিকে কি হঠাৎ করে অক্সিজেন ফুরিয়ে গেল! শুধু মনে পড়তে থাকে ওর পেটের মধ্যে থেকে কুরিয়ে কুরিয়ে যখন ওরা চিন্টুকে বার করছিল, চিন্টু তখন একশো বত্রিশ দিন ধরে ওর পেটের মধ্যে বাস করছে। সে রোজ চিন্টুর সঙ্গে গল্প করে। ডাক্তাররা বলেছিল চিন্টুর হার্টে ফুটো আছে। সে জন্মালেও বাঁচবে না। সমস্যাটা এমনই ছিল দুজনকে নাকি কিছুতেই বাঁচান যেত না। শ্রী শুনছিল, চিন্টু তখনও চীৎকার করছে, মা! আমাকে বাঁচাও...।
জ্ঞান হতে দেখল ও গাড়িতে, সৃজিতের কোলে ওর মাথা। জলে ভেজা মাথা থেকে জামাকাপড় সব। গলা শুকিয়ে কাঠ। গাড়ি চলছে। ওর ইশারায় সৃজিত জলের বোতলটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। ঢকঢক করে পুরো বোতলটা শেষ করেও তৃষ্ণা মেটেনা ওর। সৃজিতকে জিজ্ঞেস করে, হাতিটা?
সৃজিত বলল, হাতিটা জলের মধ্যেই শুয়ে পড়ল। মনে হয় মরে যাবে। আমাদের গাড়ি স্টার্ট হওয়ার সময় বন বিভাগের থেকে বেশ কয়েকজন এসে গেছে দেখলাম। যে ছেলেটা এইভাবে পটকা আনারসের মধ্যে ভরে খাইয়েছে তাকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। এরা সত্যি খুব চটজলদি একশন নেয়। আমাদের ওখানে হলে! কতদিন কেন বছর গড়িয়ে যেত...।
অপা নিপার মুখেও দেখা গেল বেশ কথা ফুটেছে।
একটু পরে সৃজিতের মনে হল সে কিছুই বলছে না, হু, হাঁও না। অপা নিপাদের চুপ করিয়ে আবার ওকে দেখল। পাথর প্রতিমা দেখে কিছুই বুঝতে পারল না। বলল, কিন্তু শ্রী, তোমার হঠাৎ কী হল? মাথা ঘুরে ওভাবে পড়ে গেলে যে! তুমি তো এত দুর্বল নও- কী হয়েছে বলবে?
শ্রীরূপা বলতে গিয়েও থেমে যায়। চিন্টু তো ছিল শুধুই ওর, নাহলে কি সৃজিত আজ এই কথাগুলো ওকে জিজ্ঞেস করত?
সে জানলা দিয়ে দেখে অন্ধকারকে ফালা ফালা করে এগিয়ে চলেছে গাড়ির হেডলাইট। তবুও পিছনে ঘাড় ঘোরালে শুধুই চাপ চাপ অন্ধকার।