পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

খয়েরি শার্ট ও কলকাতা

  • 27 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 382 view(s)
  • লিখেছেন : অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
বিসর্জনের পরের পরের দিন পাঁচটি খড়ের নৌকো লেগেছে বাগবাজার ঘাটে। সুন্দরবন থেকে আসা খড়ের নৌকো। পাঁচটি নৌকো মানে ৯০ কাহন খড়। ষোলো মণে এক কাহন, বাণ্ডিলের হিসেব করলে ৮১ বাণ্ডিল খড়। যদিও চৈত্র-বৈশাখ অর্থাৎ সরস্বতীপুজোর পর থেকেই কাঠামোর কাজের তোড়জোড় শুরু, ওই সময় থেকেই বড় বড় কালীঠাকুর, দুর্গাঠাকুর গড়বার কাজে হাত লাগানোর কথা, কিন্তু এইবার আশ্বিনে দুর্গাপুজোর পরেই দু-আড়াই সপ্তাহের মধ্যে কার্তিকের কালীপুজো, তারপরে চৈত্রের বাসন্তী, অন্নপূর্ণার সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে, অসময়েই খড়ের নৌকো আনাতে হল।

 

শহরে খাটাল উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে কলকাতার সঙ্গে খড়ের যোগাযোগ কম। তাছাড়া সুন্দরবনের মতো ওইরকম ভালো জাতের শুকনো খড় আর কোথায় পাওয়া যাবে? আগে, আশপাশের গ্রাম থেকে কলকাতায় খড়ের জোগান ছিল। মধ্য কলকাতায় একাধিক খড়কাটা মেশিন দেখা যেত; চল্লিশ বছর আগে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের উলটোদিকে শত্রুঘ্ন ঘোষ লেন আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে গাড়িবারান্দার তলায় ছিল একটা, সব সময় হাঁপানি রোগীর টানের মতো ঘ্যাঁষঘ্যাঁষ করে চলত। এখন আর রাধাবাজার থেকে শ্যামবাজার, কোথাও খড়কাটা কল চোখে পড়বে না সহসা। কারণ, অধিকাংশ প্রতিবেশী গ্রাম এখন শহর।

ঘাট থেকে পাড়ে উঠতেই বামদিকে যে ছোট শিবমন্দির, খুব কিছু পুরনো নয়, তার পাশেই তামাটে রঙের এক ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিলেন; খয়েরি শার্ট নতুন হলেও, প্যান্টের রঙ ঠিক কালো আর বলা যাবে না। ঘাম ও তেল, এই দুই জৈব পদার্থ, কোনও যৌথ এবং জটিল এক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কালোর ওপর নানান মানচিত্র রচনা করেছে। কোনও অংশ দেখে মনে হয় আফ্রিকা, অন্য অংশ অস্ট্রেলিয়া; আবার কোনও কোনও জায়গা সুন্দরবন এলাকার বিভিন্ন বদ্বীপ! ওর নাম বললে যেহেতু এককথায় সবাই চিনবেন, বিশেষত লেখকেরা, ভদ্রলোক লজ্জাও পেতে পারেন, তাছাড়া বনমালী সরকার স্ট্রিটে ওদের বাড়ির একটা সম্মান আছে, ঠাকুরদাদা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সেইজন্যই পোশাকি নামটা আপাতত উহ্য থাক; ধরা যাক ওর নাম খয়েরি শার্ট! এবং আপাতত তিনি অনুসরণ করছেন খড়বাহী মজুরদের।

প্রথম কিস্তির খড় নামান হল ত্রিনয়ন পাল আর তার ভাই সুনন্দনের যে স্টুডিও, সেই গোলায়। ত্রিনয়ন বললেন, আমায় কত দিচ্ছ এখন?

-এবারে সব মিলিয়ে ২৫ বাণ্ডিল...

-সে কী আমি যে চল্লিশ বান্ডিল চেয়ে রেখেছি এখনই, অনেক অর্ডার...

-হ্যাঁ হ্যাঁ...সত্যবাবু বলেছেন, আরও আসছে...পরের নৌকো গেঁওখালি’তে এসে গেছে...মোবাইলে জানিয়েছেন বাবু...

-ঠিক আছে, চল্লিশের কমে কিন্তু হবে না...আরও লাগবে...

-বাবুকে বলে দেব। খড়বাহকেরা মাথা নেড়ে চলে যায়।

কালীঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিনয়নের গোলায়। ডাকিনী-যোগিনীর কাজ শুরু স্টুডিওর বাইরে রাস্তার ওপর। এইসব প্রেত-পিশাচদের কাঠামো পাওয়া যায় নদীর পাড়ের ছেলেগুলোর থেকে। কাঠামোর অবস্থা অনুযায়ী দাম--দু’শো থেকে পাঁচশো, কখনও সাতশো টাকাও হাঁকে ওরা। নদী থেকেই আনে কাঠামো। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরেই দুর্গার দিকে তত নজর থাকে না নদীর পাড়ের ছেলেগুলোর, যতটা থাকে সরস্বতী-কার্তিক-লক্ষ্মী-গণেশের দিকে। বিসর্জন হলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে গঙ্গায়; দুর্গা প্রতিমায় হাত দেয় না, পুতুলে দেয়। পুতুল মানে? কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী। বিচ্ছিরিভাবে মাটি গলতে শুরু হওয়ার আগেই একটু জল ঝরিয়ে কুমোরের দুয়ারে ফেলে দাও, নগদ টাকা নিয়ে আবার দৌড়োও পরের খেপের জন্য।

নদী থেকে পাওয়া পুতুলগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হবে কয়েক ঘণ্টা। তারপর তাদের সুন্দর মুখগুলো ভেঙেচুরে অন্যরকম করে দেওয়া...। ওই ভাঙাচোরা পুতুলের গায়েমুখে বিদঘুটে রঙ লাগিয়ে, চোখগুলো অস্বাভাবিক বড় করে, মুখে রক্তলাল ছোপ লাগিয়ে, কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী থেকে ডাকিনী-যোগিনী-প্রেত-পিশাচ বানানোটা যে তেমন শক্ত কিছু নয়, এ-কথা কুমোরপাড়ার স্কুলপড়ুয়ারাও জানে! তাদের অনেকেই ভুতপেত্নী বানিয়ে স্টুডিওতে বিক্রি করে হাতখরচের টাকা তুলে নেয় কালীপুজোর আগে।

খয়েরি শার্ট, সাড়ে পাঁচ ফুট, মধ্যবয়সী; আপাতত, ত্রিনয়নের গোলার সামনে দাঁড়িয়ে ডানহাতের আঙুল নাড়াচ্ছেন, হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটও নড়ছে, কিন্তু যে কোনও লোক, যার চোখকান সামান্য সজাগ, বুঝবে খড়ের কাঠামোর দিকে চোখ থাকলেও, পুতুল ভেঙে পিশাচ তৈরির দিকে নজর থাকলেও, খয়েরি শার্টের মনটা অন্যত্র।

(২)

রংরুট এক সময়ের নামী সাহিত্যিক। যাদের বয়স ষাট পেরিয়েছে, বাংলা সাহিত্যের খবর রাখে, তারাই ওর নাম জানে। যদিও ছদ্মনাম, তবু এই নামেই তিনি জনপ্রিয়। আসল নাম জানার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। এই দাদার ডায়েরি থেকে টুকে, চলতি-উঠতি দুই ধরণের লেখকদেরকেই গল্পের প্লট জোগান দিয়ে থাকেন খয়েরি শার্ট। নাহ্‌, দাদা মারা যান নি, কিন্তু তার থেকে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে খয়েরিদের বাড়িতে। ডায়েবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে রংরুটের চোখ চলে গেছে! মধুমেহ রোগ বড় সাংঘাতিক। নিঃসাড়ে ক্ষতি করে চলে। তারপর থেকে অকৃতদার ভাই খয়েরি নিয়েছেন দাদার দায়িত্ব, দাদা মানে দাদা-বৌদি দুজনেরই। বৌদি তো বরাবরই বাড়িতে, ঘর সামলেছেন; ফলে সারা মাসের সম্বল বলতে দাদার যৎসামান্য পেনশন। বেসরকারি চাকরিতে অবসরের পর যা হাতে আসে, তাতে তো তিনজন কেন দুজন পূর্ণবয়স্কের সংসারও চালান যায় না এই বাজারে। সে বড় সংবাদপত্রের চিফ সাব-এডিটরের চাকরি হোক আর যাই হোক, অবসরের পর তুমি নখদন্তহীন কানা বাঘ! যত তাড়াতাড়ি এর পরের নাম-না-জানা স্টেশনে যেতে পারছ, তত ভালো।

দাদা নিঃসন্তান, ফলে এই দম্পতির দেখাশুনোর দায়িত্ব খয়েরির। কুমোরটুলির নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়িতে এখনও এই নিয়ম চালু। এ কোনও ত্যাগ বা বীরত্বের কথা নয়, এই রাজত্বে এইটাই রীতি। খয়েরি তার শেয়ার বিক্রি, মিউচুয়াল ফাণ্ড, এবং হরেক কিসিমের স্বাস্থ্যবীমা বিক্রির পাঁচমিশেলি ব্যবসার সঙ্গে গল্পের প্লট বিক্রিটাও জুড়ে নিয়েছে, ফলে সব কিছু জোড়াতাড়া দিয়ে চলে যায়। বনমালী সরকার স্ট্রিটে ঠাকুরদাদার আমলের বাড়িটা আছে বলে মাথার উপরে ছাদ পাওয়া যাচ্ছে, নাহলে হয়তো নদীর পাড়ে চক্ররেলের লাইনে আচমকা মাথা রাখতে হতো। খয়েরি যে বিবাহ করেনি তাতে নিশ্চয় তিনজনেরই মঙ্গল।

দাদার গল্পের খাতায় অন্তত পাঁচশো গল্পের প্লট লেখা; নানা রকম গল্পের প্লট। সেই ব্যাঙ্কে খয়েরিও কিছু কিছু গল্পের ভ্রূণ জমা করে, তবে তা দাদার হাতে গড়া ভ্রূণের মতো নয় কখনওই! ওই গল্পের ব্যাঙ্ক থেকে যে প্লট বিতরণ করে খয়েরি শার্ট, তা অবশ্যই দাদা এবং বৌদিকে না জানিয়ে। না জানিয়েই করতে হয়, কারণ, এইসব ব্যাপারে রংরুটের মতামত বড় বেয়াড়া। কেন দেব? চোখ চলে গেছে তো কী? তুমি ‘গল্পভ্রূণ’ নামে বই ছাপাও, তা বের হলে আমার নামে, রংরুটের নামে প্রকাশ পাবে, কিন্তু আমার চিন্তার কণা চুরি করে একজন অ্যাটম বোমার মতো অভিঘাতময় কিছু বানিয়ে পুরস্কার পাবে, তা মানা যায় না। আরে ওই চিন্তাটাই তো আসল, ওইটা আমার ঔরস, জীবনের উৎস, তার স্বত্ব ছাড়ব কেন?

দাদাকে বহুবার বুঝিয়েছেন খয়েরি; বোঝাতে বোঝাতে জিভ শুকিয়ে ফেনা উঠে এসেছে, কিন্তু দাদা অনড়। বলেছে, তুমি এই ঠাকুরদাদার বাড়ির স্বত্ব চাও, এখনই লিখে দিচ্ছি, কিন্তু আমার ভ্রূণের নয়।

তারপর থেকে দাদাকে আর কিছু বলেননি খয়েরি। একদিন কিছু না বলেকয়ে ওই খাতার গল্পের প্লট বিতরণ করতে শুরু করে দেন তিনি, অবশ্যই বিনামূল্যে নয়। দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকা অবধি পাওয়া যায়। তা খরচও হয় এই তিনজনের সংসার চালাতেই; সেইজন্যই খয়েরির মনে এই কাজ নিয়ে কোনও পাপবোধ নেই।

জীবনযাপন যে একটা লড়াই, এখানে অত অনড় থাকলে বাঁচা যায় না, তা কৃষ্ণ-অর্জুন, পাণ্ডব-কৌরব, কর্ণ-কুন্তী, ভীম-দুর্যোধন প্রমুখ কুরুক্ষেত্রের সবাই বুঝেছিল, দাদা বুঝলেন না। অন্ধদের এই এক মুস্কিল, তারা নিজের ভেতরে দেখা জগৎ নিয়ে বাঁচতে চায়, সত্যিকারের জগৎটিকে অনুভব করে না!

কাঠামো বাঁধবার কাজের সঙ্গে গল্প বাঁধবার নিশ্চয়ই কোনও যোগসূত্র আছে, নাহলে এই সময়েই তাকে নামী লেখকেরা ডাকাডাকি করতে শুরু করে দেন কেন? যে ভদ্রলোকের বয়স আশি ছুঁতে চলল, সেই মুখে মেচেতার দাগ বসে যাওয়া লেখক বলেন, বাবা খয়েরি, এইবার একটু ভক্তিরস স্পেশাল কিছু ছাড়, বাজারে চলছে। খয়েরি হাসতে হাসতে বলেন দেখুন গোলোকবাবু, আমরা প্রভুর দাস, প্রভুর পুত্র, প্রভুর লীলা সহায়ক--এই বিশ্বাসে স্থিত থেকে কাজ করে যেতে হবে; আমি আপনাকে জয়রামবাটির কিছু গল্প দিচ্ছি, সেই যে ঠাকুর যেবার গেছেন, সে সময়ের গল্প...।

যিনি সদ্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন বাহান্ন বছরের সেই অনিল দত্তরায়ের  চাহিদা, কাম আর কর্ম মেশান গল্প। খয়েরি হাসেন, সে তো আমাদের সারদা মা বলে দিয়েছেন, কামকর্ম করবে বই কি, কাজে মন ভালো থাকে। তবে জপধ্যান, প্রার্থনাও বিশেষ দরকার। অন্তত, সকাল সন্ধ্যায় একবার বসতেই হয়। ওটি হল যেন নৌকার হাল। বলতে বলতেই গল্পের কাঠামো বলতে শুরু করে দেন খয়েরি শার্ট--মেয়েটা সেপারেটেড, বয়স চল্লিশ; ছেলেটা সিঙ্গল, আটত্রিশ। ফেসবুকে আলাপ; প্রথম মিটিং, কফিশপে এসেছে, এই আজকাল দোকানগুলো যেমন হয়; নাম্বার ফাইভ ব্রডওয়ে ক্যাফে অথবা টেনথ স্ট্রিট কাফে--এমনই কায়দার নাম। ছেলেটা ক্যাপুচিনোর অর্ডার করল, মেয়েটার পছন্দ কাফে ল্যাটে। কথা বলতে বলতে ঠিক হল, ট্রায়াল দেওয়ার জন্য ওরা এক সঙ্গে থাকবে ছ’মাস। বিবাহ নয়, তার ট্রায়াল, জাস্ট এক সঙ্গে থাকা। ডিলটা হল--এক সঙ্গে বাজার করা, সপ্তাহে একবার, এক সঙ্গে সিনেমা দেখা, সে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে হোক অথবা বাড়িতে হোক, সপ্তাহে একবার। নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা, সপ্তাহে একবার, সমস্যা খুব জটিল হলে দু-বার, তার বেশি নয়; আর সপ্তাহে একদিন আদর করা, তাতে কোনও সময়সীমা নেই; কিন্তু ওই একদিনই, তার বেশি নয়। যদি না জমে, তাহলে সাতদিনের নোটিস দিয়ে আলাদা। চলে যাবার আগে অবশ্যই কোনও খাতে টাকা বাকি থাকলে দিয়ে যেতে হবে; এবং অবশ্য ইলেকট্রিক বিল আর বাড়িভাড়ার আনুপাতিক অঙ্কটাও!

এতটা শুনেই অকাদেমি-প্রাপ্ত বলে উঠলেন, ওহ, লাভলি, আই ক্যান সি আ গ্রেট স্টোরি ইন ইট! তিন হাজার টাকা দিয়ে দেন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক।

যা নিয়ে এই মুহূর্তে ভেবে চলেছেন খয়েরি, সে গল্পের প্লটটা এক মহিলার সঙ্গে এক জিগোলোর সম্পর্ক নিয়ে। ঔপন্যাসিক ভদ্রমহিলা কাগজে নিবন্ধ লিখেছেন, উইমেনস রাইট টু জিগোলো, টেলিভিশন চ্যানেলে জোরগলায় বলেছেন, যৌনতৃপ্তি পাওয়া নারীর অধিকার; মেয়েটি বিবাহিত কিন্তু কোনও এক অতৃপ্তি থেকে সে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। জিগোলো ছেলেটা চাকরি করে। কোনও প্রাইভেট বিজনেস স্কুলের কোঅর্ডিনেটর; তার অভিজ্ঞতা অনেক, বহু নারীকে সে সঙ্গ দিয়েছে, শুধু সঙ্গই দিয়েছে, ভালো ভালো কথা বলেছে, রেস্টোরাণ্টে গিয়ে একসঙ্গে কফি পান করেছে, ওর সঙ্গে থাকাতেই তৃপ্তি পেয়েছে মেয়েরা। শুধু সঙ্গ দিয়ে, কথাবার্তা বলে সে রোজগার করেছে! এক শ্রেণির মানুষ এখন তার কথাবার্তা শোনাবার জন্য টাকা দিতে প্রস্তুত!...

...সবদিন সমান যায় না। একদিন, একদল মানে তিনজন মহিলা, ভাড়া নিল জিগোলো ছেলেটিকে। ওরা  তার আবরণ উন্মোচনের পর হাত বাঁধল, পা বাঁধল, তারপর বেঁধে দিল চোখ; তারপরেই ওদের কেউ আঙুল দিয়ে তার লিঙ্গ নাড়াচ্ছে, টোকা মারছে, তার উত্থান ঘটছে, ওরা নিজেদের মধ্যে যে কী করছে, তা চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটা, ব্যস ওই অবধিই...। আসলে ওদের সবাই, সবাই ভয়্যারিস্ট, দেখনসুখ পেতে চায়...।

এক সকালে ছেলেটাকে ভাড়া করল চার নারী। দুজনের পরিপূর্ণ সঙ্গম হওয়ার পরে, তৃতীয়জন মিলিত হল। কিন্তু এই তৃতীয় নারীর পূর্ণ তৃপ্তি হল না। সে হঠাৎ বলে বসল জান, আমি হোম সেক্রেটারির বউ, তোমাকে জেলে দিতে পারি? এই গল্পকণার পাশে, খয়েরি লক্ষ করল, দাদার নোট--সেক্সুয়ালিটি আর শুধু অভ্যাস হিসাবে নেই, মেয়েরাও চায় অ্যাসারশন, তারাও পূর্ণমাত্রায় তৃপ্তি পেতে চায়, এ তাদের অধিকার...।

কাস্টমারকে ঠকায় না খয়েরি। এই গল্পভ্রূণ বিক্রির সময়, দাদার নোটটাও মুখে-মুখে শুনিয়ে দিয়েছিল। কারণ, তার মনে হয়েছিল, ওই মন্তব্যটি গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করছে।

গল্পের শেষটা দুঃখের। ছেলেটা হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে, কোনও কারণে সে উত্থানশক্তি হারিয়েছে। সে কী করবে এখন? উত্থান বজায় রাখতে সে তো নানান ওষুধ খায়, তাহলে? তবে কেন এমন হল? এ কি ওই অতৃপ্ত সচিব-বউয়ের অভিশাপ? তাহলে? কেমনভাবে, কতদিন চলবে এই অনিশ্চিতের জীবন? কোনও আকস্মিকের খেলায় সে আবার কী ফিরে পাবে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত উত্থান?

সরোজেশ গঙ্গোপাধ্যায় নাচতে শুরু করে দিলেন, খয়েরি তুমি জিনিয়াস, এ নিয়ে আমি উপন্যাস লিখব, এই সময়ের আধুনিক উপন্যাস। এর স্তরে স্তরে দুঃখের বীজ, সমাজের নানান স্তরের সমস্যা বপন করা থাকবে। এই জিগোলোর চোখ দিয়ে দেখাব সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিকে। তুমি দেখে নিও, এ লেখা হবে তুলনাহীন! ভদ্রলোক চারহাজার টাকা দিলেন। বললেন, লেখা বের হলে আরও দুই দেব। এ লেখা প্রথমে বাংলায়, তারপরে ইংরেজি অনুবাদ বের হবে। ইংরেজি বের হলে আরও টাকা। তুমি দেখে নিও, মুম্বই থেকে সিনেমাওলারা আসবে, এর প্রচুর পসিবিলিটি। আর সিনেমা বানান হলে, বুঝতেই পারছ শুধু আমি নয় তুমিও পাবে।

সবটা শুনে খয়েরির মনটা উড়তে শুরু করেছিল। তাহলে এই ভ্রূণটা হতে চলেছে তাদের উত্থানবিন্দু! মনে মনে দাদাকে প্রণাম করেছিলেন খয়েরি। বৌদিকেও।

(৩)

ত্রিনয়নের স্টুডিও থেকে একশো মিটার পশ্চিমে নদীর দিকে এগোলেই অমলকান্তি কর্মকারের রেডিও সারাইয়ের দোকান। বুশ মারফি ফিলিপস টেলিফানকেন সারিসারি তাকে ঘুমোচ্ছেন! বামদিকের তাকে ঊনিশশো বাহান্ন’র ফিলিপস হল্যাণ্ড, তার পাশেই বাষট্টির মারফি! এ নিয়েও গল্পের ভ্রূণ আছে দাদার খাতায়! ঊনিশশো বাহান্ন’র ফিলিপস হল্যাণ্ড চালালে সংবাদে বাহান্ন’র খবর শোনা যায়, সর্বভারতীয় নির্বাচনের খবর। স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচন! বাষট্টির রেডিওতে ভেসে আসে চিন-ভারত যুদ্ধের প্রাত্যহিক সংবাদ! কে কত ইঞ্চি এগোলো, কে পিছলো? এই রে! চিন বমডিলা দখল করে নিয়েছে! একাত্তরের ট্রপিকানাতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশ যুদ্ধের খবর; সকালে গান বাজে, শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি...বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ! সন্ধে-রাত্তিরে অনুরোধের আসর, রবিবার দুপুরে বাংলা নাটক...তাহার নামটি রঞ্জনা!

কুমোরটুলি পাড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খয়েরি আজ দেখছেন, নদী থেকে তোলা দুর্গার সঙ্গে প্যাণ্ডেলে অধিষ্ঠান করা সরস্বতীকে দুয়েক পোঁচ কালো রঙ মাখিয়ে, মুখে রক্তলাল ধারা লাগিয়ে করা হচ্ছে প্রেত, লক্ষ্মীকেও পিশাচ বানাবার আয়োজন! গণেশের পেট ফাটিয়ে ভেঙে তাকেও কোনও বাঘাভূত বানাবার চেষ্টা...!

হ্যাঁ, যাদের চোখ-কান-মন সামান্য কাজ করছে, তারাই বুঝবে আজ খয়েরিবাবু ভালো নেই, না হলে একবার ত্রিনয়নের স্টুডিও থেকে অমলকান্তির দোকান, অমলের রেডিও থেকে নদীর শিব মন্দির, আবার মন্দির থেকে স্টুডিও হয়ে রেডিও-দোকান করতেন না। তারা একটু ভাবলে, একটু সহানুভূতি দেখালে, খয়েরিই কর্পোরেশনের কলের মতো গলগল করে বলে দিতেন সমস্যাটা।

সরোজেশবাবু এখন বলছেন ওই জিগোলোর গল্পের কাঠামোটা বদলাতে হবে। অর্ডার দিয়েছিলেন দুঃখের গল্প, ডেলিভারি নিয়েছেন, খুশিও হয়েছিলেন, কিন্তু এখন বলছেন, কীভাবে একটু হাসির করা যায়? সম্পাদক নাকি বলেছেন এর কাঠামোটা হাসির করলে ভালো হয়, নিদেনপক্ষে স্যাটায়ার, যিনি ফিল্ম করবেন বলে ভাবা হয়েছিল, তিনিও নাকি বলেছেন, এর মধ্যে হাসির এলিমেন্ট আনা প্রয়োজন! ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি...এইরকম একটা সিরিয়াস সামাজিক সমস্যার মধ্যে হাসি? তার চেয়ে আবার টাকা খরচ করে নতুন গল্পের প্লট কিনছ না কেন বাপু? দাদার প্লটের খাতাটা ভালোভাবে উলটে দেখলেন খয়েরি; গভীর ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে তাতে হাসির স্তর লাগিয়ে দেওয়া, মানে কালো এঁটেল বা চিট মাটির কাঠামোর উপর সাদাটে বেলে মাটির স্তর, এমনভাবে ঠাকুরের বুক-পেট তৈরি হয়, সেই রকম হাসির গল্প আছে, বেশ কিছু। চাইলে সেই প্লট কিনে নাও, কিন্তু এইটা পালটাবার চেষ্টা কেন? এই গল্পের প্রতিমাকে বদলান মানে দুর্গাকে কালী বানান, এ-কাজ কুমোরটুলির কেউ করে না!

এই গল্পকে কীভাবে হাসির করা যায়? ভাবতে ভাবতে কখন যে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে পৌঁছে গেছেন খয়েরি, জানা নেই। হঠাৎ মাথার ভেতরে ফট করে আওয়াজ...

(৪)

কালীতলার কাছেই যে চায়ের দোকান, ছেলেরা আড্ডা মারে। ওরাই দেখেছিল খয়েরি শার্টকে মন্দিরের গাড়ি বারান্দার থাম ধরে ফুটপাথে বসে পড়তে। ওরাই হইহই করে ছুটে এল। এই এলাকায় ট্যাক্সি পাওয়া সহজ নয়; মোবাইলে বুক করে দেখা গেল, অ্যাপ ক্যাবও আসতে দশ মিনিট। এইসব সময়েই হাতে টানা রিক্সার প্রয়োজন। সেও তো শহর থেকে উঠেই গেছে মনে হয়। অতএব চারজনে মিলে খয়েরি শার্টের অর্ধচেতন দেহটি কোলে তুলে নিল। বাকি দু’জন দৌড় লাগাল জগৎ মুখার্জি পার্কের দিকে, যদি কিছু করে ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

মদনমোহন তলার বিখ্যাত সাদা বাড়ি পেরিয়ে রাস্তার মোড়ে যে সুলভ কমপ্লেক্স, তার সামনেই একটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার সুলভের কাজ সেরে গাড়ি চালু করছিল, তাকে  ধরে ফেলল দু’জন। ড্রাইভার অবাঙালি। কাঁহা যানা হ্যায়? সবটা বোঝাতে বোঝাতে, চারজন দেহ সমেত পৌঁছে গেল। অসুস্থ মানুষ সঙ্গে থাকলে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ এখনও অনেক ছাড় দেয়। তখন জানালায় ড্রাইভারের ময়লা, তেলচিটচিট লাল গামছার আন্দোলন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, ফলত, পুরো সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ নামক রাজপথটি তাদের জন্য গ্রিন করিডোর! তখন চারজন সওয়ারির জায়গায় ছ’জন হলেও মাপ; ওরা দেখেও দেখে না! এমন সুবিধা পেলে, সোজা রাস্তা ধরে মেডিক্যাল কলেজের সাত নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে এমার্জেন্সি পৌঁছতে কতক্ষণই বা লাগে?

ডাক্তার এসে প্রথমেই রক্তচাপ মাপলেন; তারপরেই চোখের পাতা উলটে দ্রুত দেখে নিলেন চোখের মণি। পায়ের তলায় আঁচড় কেটে লক্ষ করলেন আঙুলের চলন। ততক্ষণে বাম হাতে সূঁচ ফুটিয়ে চ্যানেল তৈরির কাজ শেষ করে ফেলেছেন সাদা পোশাকের নার্স দিদিমণি। অক্সিজেন সিলিণ্ডার বেডের পাশে এসে গেছে; অক্সিজেন মাস্ক পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই স্যালাইন স্ট্যাণ্ড এসে গেল। চ্যানেলে নল লাগিয়ে স্যালাইন চালু। এর পরে বাকি থাকে ব্রেন স্ক্যান করানোর কাজ। এখনও সব কিছু ঠিকঠাক চললে, সরকারি হাসপাতালে এমনই দ্রুততায় কাজ হয়ে থাকে। অন্তত পাড়ার খয়েরিদার বিপদের বন্ধু ছ’জন তো সেই প্রমাণ পেল। ছ’জনের একজন নার্সের কাছে জানতে চাইল খয়েরিদার অবস্থা, কী মনে হয়, হার্ট অ্যাটাক? নার্স বললেন, স্যারকে জিজ্ঞাসা করুন, তবে মনে হয়...আচ্ছা এই ওষুধগুলো..., কথা শেষ না করে যে কাগজ ধরান হয় ওদের, তাতে স্যালাইনের বোতলের কথা লেখা। তরুণ ডাক্তার বেরা ওদের জানান, মনে হচ্ছে সেরিব্রাল, তবে স্ক্যান না করলে, কতটা কী বলা মুস্কিল...

ব্রেন স্ক্যানের জায়গায় অ্যানাস্থেসিয়ার গন্ধ পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু অর্ধচেতন খয়েরি ক্লোরোফর্মের গন্ধ পেলেন; এবং গন্ধ পেতেই জড়ান গলায় বললেন, আমার চলে যাওয়া মানে আজ থেকে পৃথিবীতে গল্প বলা শেষ!

কলকাতা শহর, যে এই আখ্যানের একটি চরিত্র, এতক্ষণ ঘাপটি মেরে ছেলেদের মধ্যে মিশেছিল, সে এই সময় যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দলাদলি, সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার ভুলে বলে উঠল, ওহে গল্প বলিয়ে, কলকাতা তোমায় মরতে দেবে না।

0 Comments

Post Comment