হুলিও রিবেইরো, একদা ভারতীয় গোয়েন্দাবিভাগের অন্যতম সদস্য, রোমানিয়ায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবপ্রাপ্ত একজন খ্রিস্টান, ১৭ মার্চ, ২০১৫ একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লিখছেন—‘আজ, আমার ৮৬ বছর বয়সে, আমি নিজেকে আতঙ্কিত, অপাঙ্ক্তেয় এবং আমার নিজের দেশেই নিজেকে বহিরাগত বলে অনুভব করছি। আমার ধর্মের আরও বহু লোক আজ আমার কাছে ছুটে আসছেন আশ্রয় খুঁজতে, এমন কিছু ভয়ানক মানুষের হাত থেকে বাঁচতে, যারা কেবল আমাদের এই বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের কারণেই দেশের শত্রু বলে মনে করছে। আমি আর নিজেকে একজন ভারতীয় বলে মনে করতে পারছি না, অন্তত সেইসব লোকের চোখে, যারা ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানাতে চায়’।
একজন আশি-ঊর্ধ্ব প্রাক্তন ভারতীয় গোয়েন্দাপ্রধান যখন নিছক ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিস্টান হবার জন্য আতঙ্কিত বোধ করেন, তখন বুঝতে হবে, দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ কতোখানি গভীরে চারিয়ে গিয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে কট্টর ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর এই প্রকল্প অবশ্য দীর্ঘদিন আগেই নিয়েছে আরএসএস-বিজেপিসহ গোটা সঙ্ঘ-পরিবার। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সর্বাত্মক গতি পেয়েছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশে ক্ষমতায় আসার পরেই। ঠিক একবছর আগে, ২০১৩ সালে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই মোদি একাধিক প্রকাশ্য জনসভায় নিজেকে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পক্ষে একেবারেই নজিরবিহীন। গত শতাব্দীর অন্তিম বছরে, আরএসএস-এর ৭৫ তম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে সেইসময়ের সরসঙ্ঘচালক কে এস সুদর্শন সরাসরি দেশের মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে নিজেদের দেশপ্রেম প্রমাণ করার দাবিতে হুঙ্কার দিয়েছিলেন। এর ঠিক দু’বছর পরে, ৭ মার্চ ২০০২, আরএসএস-এর ব্যাঙ্গালোর অধিবেশনে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল, দেশের মুসলিমদের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরে। আর ঠিক গতবছর, ২০২২ সালে, প্রয়াগের ‘হিন্দু মহাসম্মেলন’ থেকে গেরুয়া-পরিহিত সাধুরা মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেয়। অর্থাৎ এ হল সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলবাদ, যাকে অনায়াসেই হিন্দু ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
মারিয়া কাসোলরি তাঁর অসাধারণ গবেষণায় দেখিয়েছেন, কীভাবে সেই ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হবার সময় থেকেই প্রথমে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি-র ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র এবং তার একদশকের মধ্যেই জার্মানিতে হিটলার-প্রতিষ্ঠিত জার্মান ফ্যাসিবাদে আপ্লুত ছিলেন ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বি এস মুঞ্জে ইতালি যান। তিনি সেখানে খোদ মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইতালীয় সমাজের ব্যাপক সামরিকীকরণ ও কঠোর অথরিটারিয়ান ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে হিন্দুত্ববাদী মারাঠি ‘কেশরি’ পত্রিকায় ইতালির ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর সমর্থনে অজস্র প্রবন্ধ ছাপা হতে থাকে। তাতে উদারতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে স্বৈরতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উত্তরণকে আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়। এই পত্রিকা সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত ছিল মুসোলিনির গণতান্ত্রিক সংসদ ভেঙে দিয়ে ‘গ্র্যান্ড কাউন্সিল অফ ফ্যাসিজম’ প্রতিষ্ঠার ঘটনায়। অর্থাৎ, নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপ্রতীপে মনোনীত সাংসদদের পার্লামেন্টে পাঠানোই তাদের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছিল। আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার যে এখন সরাসরি দেশের সংবিধান ভেঙে দেওয়া, কন্সটিটিউশনের বদলে সাভারকার-প্রস্তাবিত ‘মনুস্মৃতি’ চালু করার কথা বলছে, সংবিধান থেকে ‘সেকুলার’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাদুটো হটিয়ে দিতে চাইছে, তার একটা পূর্বাপর ইতিহাস আছে। তা নাহলে ভারতের পুরোনো পার্লামেন্ট ভবনকে্ সরিয়ে নতুন সেন্ট্রাল ভিস্তায় সংসদ উদ্বোধনের দিন একপাল সাধুসন্ত জোগাড় করে, চোল সাম্রাজ্যের রাজদণ্ড ‘সেঙ্গোল’ হাতে নিয়ে নরেন্দ্র মোদির প্রবেশ এবং সাধুদের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম এক প্রতীকী হিন্দুরাষ্ট্রের আগমন-বার্তা ঘোষণা করত না। সেদিনের অনুষ্ঠানে দেশের রাষ্ট্রপতিকে ডাকা হয়নি, কারণ তিনি আদিবাসী জনজাতিভুক্ত। সঙ্ঘ পরিবার যে হিন্দু ভারতের স্বপ্ন দেখে, তা মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, নারীবিদ্বেষী, সংখ্যালঘু ও শূদ্রবিদ্বেষী এক টক্সিক রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
তিরিশের দশকের মাঝামাঝি পৌঁছে আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকর সরাসরি জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি গণহত্যাকে সমর্থন করেন। তাঁর ইউ অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড (১৯৩৯) বইতে তিনি নাৎ্সি জার্মানির ভূয়সী প্রশংসা করে লেখেন—‘জার্মানি গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে নিজেদের দেশে সেমেটিক ইহুদিদের গণহত্যা ঘটিয়ে। জাতিগর্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে এরকমটাই ঘটে। জার্মানি এটাও দেখিয়েছে যে, শিকড় থেকে আলাদা একাধিক সংস্কৃতির জাতিগুলোর পক্ষে একই রাষ্ট্রে সহাবস্থান করা অসম্ভব। তাদের একটাই সমন্বিত চেহারার মধ্যে আনাও অবাস্তব। আমরা, যারা হিন্দুস্থানের বাসিন্দা, তাদের পক্ষে এই বিষয়টি অত্যন্ত শিক্ষনীয়’। অর্থাৎ, গোলওয়ালকরের ভাবনায়, ভারতে হিন্দু ও মুসলিমের সহাবস্থান এককথায় অসম্ভব। একই কথা বলেছেন মোদি মন্ত্রীসভার সদস্য কর্নাটকের অনন্তকুমার হেগড়ে। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ‘ব্রাহ্মণ যুব পরিষদে’ দেওয়া ভাষণে তিনি ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে ভারতকে ‘মেজরিটারিয়ান হিন্দু স্টেট’ করার ঘোষণা করেছেন ও সংবিধানের বদলে ‘মনুস্মৃতি’-র বিধানকে স্থাপন করার কথা বলেছেন। গোটা পৃথিবী জুড়েই আজ একের পর এক দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসছে। ইতালি, পোলান্ড, অস্ট্রিয়া, ইজরায়েল, তুরস্ক, কিছুদিন আগের ব্রাজিল থেকে ভারত সর্বত্রই এই শক্তির আজ জয়জয়কার। এই বছর, অর্থাৎ ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন ঠিক করে দেবে আমরা ভারতকে বহু ধর্ম-জাতি-সংস্কৃতির সমন্বিত চেহারায় দেখব, না কি সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্রে মাথা নীচু করে বাঁচব। কারণ সেই তিরিশ-চল্লিশের দশক থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের শত্রু হিসেবে দেখেছে মুসলিম, খ্রিস্টান সহ প্রগতিশীল শিবিরের সমস্ত মানুষকেই। একইসঙ্গে এটাও বোঝা দরকার, বিজেপি কিন্তু দেশের আর যেকোনও দলের চেয়ে আলাদা। তারা দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত ভারতীয় জনগণের যেটুকু অধিকার, স্বাধীনতা, বাক্শক্তি রয়েছে, সবকিছু নিমেষে খতম করে দিতে পারে। দেশের সোশ্যাল ফ্যাব্রিক বদলে দিতে চায় তারা।
প্রত্যেকটা ভোটে, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক ইস্যুতে, প্রতিটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরির খেলায় আরএসএস-বিজেপি টেক্কা দিচ্ছে বিরোধী শক্তিকে। ২০২৪-এর নির্ণায়ক লোকসভা ভোটে যদি বিরোধী জোট এই প্রবল অর্থ ও পেশিশক্তিতে বলীয়ান ফ্যাসিস্ত দলটিকে পরাস্ত করতে না পারে, ভারতের কপালে নিশ্চিত দুঃখ রয়েছে।