পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাংলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও বামপন্থী দলের ভূমিকা

  • 09 August, 2022
  • 1 Comment(s)
  • 4409 view(s)
  • লিখেছেন : সৌভিক ঘোষাল
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ৪২ এ কিছু দুর্বলতা থাকলেও বাংলার অন্যান্য বাম শক্তি এই আন্দোলনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দক্ষিণপন্থী শিবির ও প্রচার মাধ্যম গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অসামান্য ভূমিকা বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ থেকে কেবল ৪২ এর অবস্থানকেই যেমন দাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে, তেমনি এই ৪২ এর আন্দোলনেই কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য বামেদের সক্রিয় ভূমিকাকে আড়ালে রাখে।ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলার বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে একটি আলোচনা।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন ইউরোপীয় রণাঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়া জার্মান আক্রমণের প্রেক্ষিতে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং সমাজতন্ত্রের মাটিকে রক্ষার জন্য মরণপণ সংগ্রাম চালাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে চিহ্নিত করে এবং ফ্যাসিবাদ নাজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা নেবার কথা বলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর সোভিয়েত রাশিয়া উভয়েই তখন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে চলা আন্তর্জাতিক লড়াইকে দুর্বল করবে এবং তা গোটা দুনিয়ার ভবিষ্যতের পক্ষে ভয়াবহ হবে - এই বিশ্লেষণ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতো আরো কিছু বামপন্থী দল – যেমন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বাধীন র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বিশ্বনাথ দুবে, শিশির রায়, প্রমোদ সেন, মনোরঞ্জন রায়, হাফিজ জালালউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টিও জনযুদ্ধ নীতির সমর্থক ছিল এবং তারাও ৪২ এর আন্দোলন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে অন্য অনেক বাম শক্তিই সক্রিয়ভাবে ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়।

ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের আপোষহীন শক্তি হিসেবে ৪২ এর আগে পরে বরাবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কর্মীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের জেল, মিথ্যা মামলা মোকদ্দমা ও অত্যাচার ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কমিউনিস্ট পার্টির সেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামী ইতিহাসে ৪২ ছিল এক ব্যতিক্রম।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ৪২ এ কিছু দুর্বলতা থাকলেও বাংলার অন্যান্য বাম শক্তি এই আন্দোলনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দক্ষিণপন্থী শিবির ও প্রচার মাধ্যম গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অসামান্য ভূমিকা বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ থেকে কেবল ৪২ এর অবস্থানকেই যেমন দাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে, তেমনি এই ৪২ এর আন্দোলনেই কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য বামেদের সক্রিয় ভূমিকাকে আড়ালে রাখে।

সেই ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া, তার চর্চা ও প্রচার তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১) সোশালিস্ট পার্টির ভূমিকা -

অবিভক্ত বাংলার বেশ কয়েকটি জেলায় সোশালিস্ট পার্টির সংগঠন ছিল। গুজরাতের সোশালিস্ট নেতা ছোটুভাই পুরানি বাংলায় গণ আন্দোলনকে শক্তিশালী রূপ দিতে সোশালিস্ট সদস্য এবং কর্মীদের বোমা তৈরি ও অন্তর্ঘাতের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। বিশিষ্ট নেত্রী অরুণা আসফ আলিও কিছুদিন হাওড়া জেলার একটি গ্রামে আত্মগোপন করে থেকে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যান। সোশালিস্টদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সফল অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মগুলি চলতে থাকে। মেদিনীপুরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সবথেকে শক্তিশালী চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। এইখানের সহিংস আন্দোলনে সোশালিস্ট পার্টির নেতা কর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

২) ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা -

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ফরওয়ার্ড ব্লক নিষিদ্ধ ছিল। দলের অনেক সদস্যই ছিলেন কারারুদ্ধ। তবে আত্মগোপন করে থাকা বহু কর্মী ও নেতা এই আন্দোলন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষ করে মেদিনীপুরের গণসংগ্রামে তাঁদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ফরওয়ার্ড ব্লক নেতাদের মধ্যে ছিলেন জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বক্সী, লীলা রায়, অনিল রায়, হেমন্ত বসু, পঞ্চানন চক্রবর্তী প্রমুখ। বিদেশ থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পাঠানো নির্দেশনা তাঁদের দিশা দিত, উদ্বুদ্ধ করত।

৩) রিভোলিউশনারি সোশালিস্ট পার্টি - আর এস পি র ভূমিকা -

আর এস পি তৈরি হয়েছিল বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতি থেকে। অবিভক্ত বাংলার স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোপন প্রতিবেদনগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে কলকাতা, ঢাকা, ফরিদপুর, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন সহিংস চেহারা পেয়েছিল আর এস পির এইসব জায়গায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর আগেই এই দলের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু দলের অপেক্ষাকৃত তরুণেরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। আর এস পির বহু কর্মী সমর্থক গ্রেপ্তার হন, নির্যাতন ভোগ করেন এবং শহীদ হন।

৪) রেভেলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি বা আর সি পি আই এর ভূমিকা -

আর সি পি আই এর প্রধান নেতা ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফ্যাসিবাদি আগ্রাসনের তীব্র সমালোচক হলেও আর সি পি আই কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ কেন্দ্রিক ভাবনার প্রেক্ষিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে সরে থাকার সিদ্ধান্তকে অন্যান্য বাম দলগুলির মতোই ভুল বলে মনে করেছিল। আর সি পি আই অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে মিশে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আর সি পি আই তীব্র কংগ্রেস বিরোধী ছিল। তাও কংগ্রেস নেতৃত্বের ডাকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে কেন তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তার ব্যাখ্যা দিয়ে আর সি পি আই নেতৃত্ব জানিয়েছিলেন যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেস আহূত হলেও তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণবিস্ফোরণের চেহারা পেয়েছে বলেই আর সি পি আই তাতে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে নদীয়া জেলায় আর সি পি আই এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়।

৫) বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা বি এল পি আই

নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার ও তাঁর অনুগামীরা ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা ছিলেন ট্রটস্কিপন্থী চতুর্থ আন্তর্জাতিকের অংশ। বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ তত্ত্বায়নের বিরোধী ছিল এবং তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁদের অভিমত ছিল বিশ্বযুদ্ধকে বিপ্লবী প্রয়োজনে ব্যবহার করা উচিত। জাতীয় কংগ্রেসের প্রবল বিরোধী হলেও আর সি পি আই এর মতো তারাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই দলটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই বলশেভিক পার্টির মধ্যে ভাঙনের সূত্রে তৈরি হয়েছিল।

বলশেভিক পার্টিও কমিউনিস্ট পার্টির মতোই জনযুদ্ধ অবস্থান নেয় ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। নীহারেন্দু দত্ত মজুমদারও ছিলেন বলশেভিক পার্টির অন্যতম নেতা। তিনি বলশেভিক পার্টির এই অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিলে পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করে। তখন তিনি বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা বি এল পি আই তৈরি করেন।

৬) কমিউনিস্ট কর্মীদের ভূমিকা -

কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের কারণে এই আন্দোলনে পার্টিগত সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকলেও অনেক কমিউনিস্ট কর্মী ব্যক্তিগতভাবে পার্টি সিদ্ধান্তের প্রতি সহমত ছিলেন না। অনেকেই সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।

সি পি আই এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অরুণ বসু জানিয়েছেন তিনি ও প্রখ্যাত নেতা বঙ্কিম মুখার্জী এই আন্দোলন থেকে পার্টির দূরে থাকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থান তাঁদের মতামত সে সময়ে খারিজ করে দিয়েছিল। ১৯৪৩ এর মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল। ভবানী সেন এর পেশ করা রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের "সংগ্রামপন্থী" হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

পার্টির ওপরের স্তরের নেতারা সেভাবে এই আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই সক্রিয় হতে পারেন নি। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের ত্রাণকার্যে তাঁরা সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট কর্মীরা কিন্তু বাংলার নানা জায়গায় ৪২ এর আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। জলপাইগুড়ি, বীরভূম, নদীয়া, ফরিদপুর, পাবনা ইত্যাদি জেলায় কমিউনিস্ট কর্মীদের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হবার কথা ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে। মালদহে কমিউনিস্ট কর্মীরা পিকেটিং ও বিক্ষোভে সামিল হন।

মেদিনীপুরে কমিউনিস্ট কর্মীরা ভালোমাত্রাতেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এখানকার নেতৃবৃন্দের মধ্যে রবি মিত্র, ভূপাল পাণ্ডা, হরেন মিত্র আন্দোলনে যোগ দেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বরিশালে বীরেন দাশগুপ্ত, নয়নারঞ্জন দাশগুপ্ত ও দিনাজপুরে শুচিন্দু চক্রবর্তীর মত স্থানীয় স্তরের নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।

কমিউনিস্ট পার্টির মতো মুসলিম লীগও পার্টিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয় নি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য অনেক বামপন্থী দল যেমন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল ছিলেন, তেমনি কোনও কোনও মুসলিম সংগঠন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হবার কথা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য জামিয়াত উল উলেমা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টে তাঁদের সদস্যরা এই আন্দোলনে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

1 Comments

Somenath pal

29 September, 2023

Bharat Charo andolone bamponthi ra dure sore giyechilo keno?

Post Comment