রিয়া চক্রবর্তী জেলে গেলেন। এক মাস ধরে মিডিয়ায় তুমুল হৈ চৈ, নাটক-তামাসার পরে, খুন নয়, আত্মহত্যায় প্ররোচনা নয়, অবৈধ টাকা তোলা বা আর্থিক লেনদেন নয়, কেন্দ্রীয় ন্যারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) শেষ পর্যন্ত ৯ সেপ্টেম্বর রিয়াকে গ্রেপ্তার করল গাঁজা খাওয়ার জন্য। তিনি নাকি তার প্রয়াত প্রেমিক বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতকে গাঁজা সাপ্লাই দিতেন। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তার কাছে ৫৯ গ্রাম (কারোর মতে, ১৬৫ গ্রাম) গাঁজা পাওয়া গেছে, যদিও এনসিবি জানিয়েছে সঙ্গে গাঁজা রাখার কোনো অভিযোগ তারা আনছে না। রিয়ার বিরুদ্ধে তারা ড্রাগ কার্টেলের সাথে সংযোগের অভিযোগ এনেছে, যে কারণে বম্বে হাই কোর্ট জামিনের আবেদন নাকচ করে তাকে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। রিয়ার আইনজীবি সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তিনি পুরো ব্যাপারটাকে ‘ন্যায়ের অপলাপ’ – ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস – আখ্যা দিয়েছেন। রিয়া এখন মুম্বাইয়ের বাইকুলা জেলে আলো-বাতাসহীন কুঠরিতে দিন কাটাচ্ছেন।
এর আগে, এনসিবি রিয়ার ভাই শৌভিক চক্রবর্তী যিনি সুশান্ত সিংয়ের বিজনেস পার্টনার, সুশান্তের হাউস ম্যানেজার স্যামুয়েল মিরান্ডা এবং হাউস হেল্প দীপেশ সাওয়ান্তকে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে। রিয়া এবং এদের কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ কিন্ত কেউই আজ পর্যন্ত দিতে পারে নি। অথচ বিশ্বের সমস্ত জরুরি সমস্যা শিকেয় তুলে মিডিয়া, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ টিভি চ্যানেলগুলি, দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রিয়া এবং তার পরিবারের নামে নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে। রিয়াকে সুশান্তের মৃত্যুর জন্য দায়ি করে ‘খুনি’, ‘ডাইনি’ ‘বিষকন্যা’ ইত্যাদি নানান নামে ভূষিত করেছে। তদন্তের আগেই তাকে কাঠগোড়ায় তোলা হয়েছে, বিচারের আগেই ফাঁসিকাঠে। এভাবে কোনও ব্যাক্তির চরিত্রহনন করা, বিনা তদন্তে, বিনা বিচারে কাউকে দোষি সাব্যস্ত করা কেবলমাত্র সাংবাদিকতার নৈতিকতার মান লঙ্ঘন করে না, আইনত তা ভয়ংকর অপরাধও।
রিয়ার বিরুদ্ধে মিডিয়াতে এই ব্যাপক অপপ্রচারের পিছনে আসলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সরকারি দলের হাত রয়েছে। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন বিহার সরকার পাটনায় অবস্থিত সুশান্ত সিংয়ের বাবার আনা অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের পুলিশকে মহারাষ্ট্র পুলিশ, যারা সুশান্ত সিংয়ের মৃত্যুর ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করেছিল, তাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে দেয় এবং শেষমেশ তদন্তভার বিহার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনা পুরোপুরি সংবিধান বিরোধী, কেননা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় – ফেডেরাল – ব্যাবস্থায় এক রাজ্যের পুলিশ আরেকটি রাজ্যের পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। অথচ, দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্বিবাদে বিহার সরকারের এই বেআইনি কাজের অনুমোদন দেয়।
এর পর, একে একে তিন তিনটি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে – সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং ন্যারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) - মাঠে নামানো হয়। তিনটি মহাপরাক্রমশালী সংস্থা দিবারাত্রি লেগে পড়ে ২৮-বছর বয়সী একজন মেয়ের পিছনে। জেরার পর জেরা করা হয়, তল্লাসি চালানো হয় তার পরিবারের বাসগৃহে। এত কান্ডের পর শেষে গাঁজা কেসে পাকড়াও করা হয় রিয়া চক্রবর্তীকে।
উল্লাসে ফেটে পড়ে গোদী মিডিয়া। প্রচারের ঠেলায় পাব্লিকের একটা বিরাট অংশও আনন্দে দুবাহু তুলে নৃত্য করতে নেমে পড়ে। যেন, তাদের জীবনের সহায়-সম্বলহীন অবস্থা, চরম দারিদ্র, ক্ষুধার জ্বালা, দেশে ভয়াবহ বেকারি, বেহাল অর্থনীতি, রেকর্ড করোনা সংক্রমণ, সব কিছুই মায়া, ওই দুশ্চরিত্র মেয়েটার হাজতবাস, সেটাই আসল। বোলো, ভারত মাতা কি জয়।
শিউড়ে উঠলেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন। এ কোন ভয়ংকর সময়! কোন আঁধার ঘনিয়ে এল! সব দেখেশুনে, ভারত সরকারের এক প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপাদেষ্টা বললেন, জনতার এই উল্লাস তাকে সতীদাহের সময় খোল-কর্তাল বাজিয়ে আনন্দোৎসবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ছেলে গ্রেপ্তার হবার পরেই রিয়ার বাবা তীক্ষ্ণ ভাষায় টুইট করে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধ্বংস করতে সফল হবার জন্য।
*****
রিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ন্যারকোটিক্স, ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রোপিক সাবস্টেন্সেস্ অ্যাক্টে (এনডিপিএসএ)। এই আইনের ধারাটি ভারতে চালু হয় ১৯৮৫ সালে। এটি ঔপনিবেশিক আমলের ওপিয়াম অ্যাক্ট, ১৮৫৭ এবং ড্রাগস্ অ্যাক্ট, ১৯৩০-এর সংশোধিত রূপ। মূলত মাদক সংক্রান্ত এবং মাদক সেবন সীমিতকরণের উদ্দেশ্যে রচিত। গঞ্জিকা সেবন এই ধারায় পড়ে কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে, যদিও ১৯৮৫ সালেই গাঁজা চাষ, গাঁজা বিক্রি এবং গাঁজায় দম দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বস্তুত, গাঁজা – অন্য নামে ক্যানাবিস্, মারিয়ুয়ানা, পট, গ্রাস, উইড - কোনও ড্রাগ নয়, যে অর্থে কিছু নেশার বস্তু - ব্রাউন সুগার, কোকেন, এলএসডি ইত্যাদি - হার্ড ড্রাগস্। কেননা, গাঁজা সিন্থেটিক ড্রাগের মতো কোনও রাসায়নিক বস্তুর মিশেল নয়, প্রকৃতির অবদান। এ এক ধরণের উদ্ভিত - পোষাকি নাম ক্যানাবিস্ স্যাটাইভা - যা শীতল, আর্দ্র আবহাওয়ায় অনাবাদিত জঙ্গলের মতো বেড়ে ওঠে। এর শুকনো পাতাই গাঁজা। চরস বা হ্যাশিস এমনকি ভাংও এই উদ্ভিতের বৃন্ত ও কান্ড থেকে নির্গত নির্যাস দিয়েই তৈরি করা হয়।
আনন্দদায়্ক ও মুক্তিদায়ক বলে গাঁজা গাছকে অথর্ববেদে পবিত্র বলা হয়েছে। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে এই উদ্ভিতের প্রয়োগের ওপর। একসময় একে আয়ুর্বেদের পেনিসিলিন বলা হত। আজকের বাজারি দুনিয়ায় মারিয়ুয়ানা থেকে তৈরি হেম্প ব্যবহৃত হয় বডিকেয়ার পণ্যে, খাদ্যদ্রব্যের সম্পূরক হিসাবে, প্লাস্টিকের নানান জিনিষে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হেম্প উৎপাদিত বস্তুর বাজার প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার।
আর, শিব ঠাকুরের আপন দেশে গাঁজার কলকে বা ছিলিম জ্বলে আসছে পাঁচ হাজার বছর ধরে, হয়ত তারও আগে থেকে। হিমালয়ের কোলে জটাধারী সাধুবাবার ডেরায়, গঙ্গাসাগর কিংবা কুম্ভ মেলায় গেরুয়াধারী পূণ্যযাত্রীদের মধ্যে, বাউল-ফকিরদের আখড়ায় গঞ্জিকা সেবন তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। শিবরাত্রি, হোলি ইত্যাদি উৎসবের দিনে ভাং সেবন তো সর্বজনগ্রাহ্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, বন্ধুবান্ধবের আড্ডায়, পাড়ার রকে, মন্দিরে-মাজারে, শ্মশান ঘাটে কোথায় নেই গাঁজা-ভাংয়ের নেশা! ২০১৯-এ কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় মন্ত্রকের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের ১০-৭৫ বছর বয়সিদের ২.৮৩ শতাংশ বা ৩.১ কোটি মানুষ ভাং, গাজা বা চরস সেবন করেন। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।
শুধু ভারতে নয়, প্রাচীন চীন ও প্রাসিয়ায়, সেল্টিক সাম্রাজ্যে, পুর্বযুগের মধ্য-এসিয়া ও আফ্রিকায়, এমনকি মায়া ও ইনকা সভ্যতায় হেম্প-মারিয়ুয়ানার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যাবহারিক জীবন ছেড়ে আধ্যাত্মিক ও বিদ্রোহী জীবনে গাঁজার প্রবেশ ঘটে আধুনিক শিল্পসভ্যতার সময়ে। শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন, “Why write I still on one, ever the same/And keep invention in a noted weed.” (Sonnet LIIVI)
ষাটের দশকে হিপি বা বিটনিক জেনারেশন প্রকাশ্যে ক্যানাবিস সেবন করে বস্তুকেন্দ্রীক ও প্রাচুর্যপূর্ণ পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। ১৯৬৯ সালে উডস্টকে তিন দিন ব্যাপী সঙ্গীত সমারোহ এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। যুব সমাজের প্রতিবাদ ছিল পুর্বপ্রজন্মের নীতিহীনতা, কালো মানুষের মানবাধিকার হরণ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বর্বরতার বিরুদ্ধে। মতাদর্শের দাসত্ব অস্বীকার করে মুক্তমনা পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা, যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা অর্জনের আকুলতা, আর প্রেম-ভালবাসাকে চলার পথে পরাণের কড়ি হিসাবে পাওয়ার কামনাই এদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। Make Love, not war.
ষাট-সত্তরের দশকেই এধরণের নিহিলিস্স্ট প্রতিবাদ (অনেকের মতে, বিটনিক প্রজন্মের আদিগুরু হলেন ফ্রেড্রিক নীটশে) মূর্ত হয়েছিল জ্যামাইকার আধ্যাত্মিক-বিদ্রোহী রাস্তাফেরি সঙ্গীত ‘রেগে’ ও নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস্ অঞ্চলে কালো মানুষের ‘হিপ-হপ’ সঙ্গীতে। রেগে সঙ্গীতধারার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বব মার্লের তো বিখ্যাত উক্তিই ছিল, “ভেষজ উদ্ভিত একটি দেশকে রোগমুক্ত করে, যেখানে অ্যালকোহল দেশকে ধবংশ করে।” নিয়মিত মারিয়ুয়ানা সেবন করে এই ক্যানাবিস বিপ্লবে সাথী হয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার বহু দিকপাল শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সঙ্গীতকার-ফিল্মমেকাররাও – বিটলস্, বব ডিলান, রোলিং স্টোন্স, জিমি হেন্ড্রিক্স্, জিম মরিসন, জ্যানিস জপলিন, অ্যালেন গিন্সবার্গ, নরম্যান মেইলার, কার্ল সাগান, অলিভার স্টোন, রোমান পোলান্সকি, তালিকা বাড়িয়েও শেষ করা যাবে না। এদের অনেকেই খোলাখুলি জানিয়েছেন, মারিয়ুয়ানা তাদের শিল্পকর্মকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
মারিয়ুয়ানা বা গাঁজা প্রভাবিত ওই প্রেমিক মন, বিদ্রোহী মেজাজ ও সৃষ্টিশীলতা দেখেই হয়ত ১৯৭০ সালে, ওয়াটারগেট-খ্যাত রিচার্ড নিক্সন জমানার প্রারম্ভে, মার্কিন দেশে ক্যানাবিস নিষিদ্ধ করা হয়।
*****
ফিরে আসা যাক রিয়া চক্রবর্তী গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে। প্রশ্ন জাগে, সাধু-সন্তদের ছাড় দিয়ে ভারত রাষ্ট্র কেন রিয়াকে গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে দিল। অনেকে মনে করেন, আগামী দিনে বিহারে নির্বাচন আর সুশান্ত বিহারের ছেলে, তাই ভোটে ফায়দা তোলার লক্ষ্যেই সরকারি পক্ষের এই পদক্ষেপ - এই কারণেই রিয়াকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। হয়ত তাই, কিন্তু তাকে জনসমক্ষে এইভাবে হেনস্থা করার পিছনে আরও বড় কারণ আছে বলেই মনে হয়।
আসলে, রিয়া একজন আধুনিক নারী, তার একটা মন আছে, নিজস্বতা আছে। সে স্বাধীনচেতা, ভালবাসতে জানে, ভালবাসার মর্যাদা দিতে জানে, বিয়ে না করে প্রেমিকের সঙ্গে লিভ-ইন করেছে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতেও তার কোনও দ্বিধা নেই (‘স্ম্যাশ পেট্রিয়ার্কি’ টি-সার্ট পরে মাথা উঁচু করে সে জেলে গিয়েছে)। এ নারী তো হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে আদর্শ নারীর মানসপ্রতিমার সঙ্গে খাপ খায় না। অতএব তাকে জবাই করা হোক।
হিন্দুত্বের ভাবনায়, পুরুষের পদতলেই নারীর স্থান। প্রথম জীবনে পিতার, বিয়ের পরে স্বামীর, মা হওয়ার পরে পুত্রের সেবা করা ছাড়া সমাজ ও পরিবারে তার অন্য কোনও ভূমিকা নেই। হেঁশেলে হাঁড়ি ঠেলা, বছর বছর সন্তানাদির জন্ম দেওয়া, তাদের লালনপালন করাই তার একমাত্র কাজ। কোনও বিষয়ে নারীর মতামত জানাবার, পারিবারিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। অধিকার নেই সম্পত্তিতে, কেননা সে ক্রীতদাস, পুরুষের কাছে ভোগ্যপণ্য ব্যতীত আর কিছুই নয়। তার শরীর আছে, মন নেই।
নারী সম্পর্কে হিন্দুত্বের এই অবস্থান তৈরি হয় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শতাব্দীতে মনুস্মৃতি বা মানব ধর্ম সুত্র রচনার মাধ্যমে। এই মনুস্মৃতিই আজকের হিন্দুত্ববাদীদের মার্গপ্রদর্শক। মনুকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর দ্বিতীয় সরসংঘচালক ‘গুরুজি’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার ‘ভগবান’ এবং ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইন-প্রণয়েতা’ বলেছিলেন।
মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, “সদগুণে নিঃস্ব হলেও, ভিন্ন স্থানে ইন্দ্রীয়সুখের সন্ধান করলেও, ভাল স্বভাবের না হলেও, স্ত্রী তার স্বামীকে ঈশ্বর রূপে পূজা করবে।” এই সুত্র ধরেই গোলওয়ালকার তার বহু-চর্চিত বাঞ্চ অফ থটস্ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “যে নারী স্বাধীনতাকামী, যে নারী পুরুষের সম-অধিকার দাবি করে, সে নারী ইতর, তাকে ঘৃণা করা উচিত।” এটাই হিন্দুত্ববাদীদের ‘জাতীয় সংস্কৃতি’। যে সংস্কৃতি সতীদাহ ও শিশুবিবাহের পক্ষে, যে সংস্কৃতি কঠিন বিধিনিষেধের বেড়াজালে মেয়েদের আবদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর। এই সংস্কৃতির বলে বলীয়ান হয়েই আজকের হিন্দুত্ব ব্রিগেড যে মেয়েরা আধুনিক সাজসজ্জা করে, যারা চলনেবলনে পশ্চিমী কায়দায় অভস্ত্য, যারা পুরুষের সাথে সমান তালে চলতে চায়, তাদের ওপর চড়াও হয়, বেধড়ক পেটায়, ধর্ষন করতেও পিছুপা হয় না। হিন্দুত্ব মতাদর্শের স্রষ্টা, বিনায়ক দামোদর সাভারকার তো শত্রু পক্ষের মেয়েদের ধর্ষনকে সোজাসুজি ‘জাতীয়তাবাদী আচরণ’ বলতেও দ্বিধা করেন নি। আর্, আরএসএসের বক্তব্য, “হিন্দু পুরুষ অহিন্দু মহিলাদের ধর্ষন করেই তার পুরুষত্বের প্রমাণ রাখবে।” অবাক লাগে, শুধু আরএসএস নয়, মূলস্রোতের রাজনৈতিক মহলে প্রায় প্রত্যেকেই এইরূপ নারী-বিদ্বেষী ধারণা পোষণ করেন।
তাই তো ‘বেটি বাঁচাও’ বা ‘ভারত মাতা কি জয়’ মার্কা স্লোগানগুলিকে কোনও রাজনৈতিক দলই প্রশ্ন করে না। নারী কেবল কারোর ‘বেটি’ বা কারোর ‘মা’, এর বাইরে তার নিজস্ব পরিচয় থাকতে পারে না। যে নারী নিজের জীবন নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চায়, নারী-বিদ্বেষী এই সমাজ তাকে পিষে মারতে চায়। নারীর হাসি সদাই সুউচ্চ কন্ঠে, তাদের দুঃখ কোনও দুঃখই নয়, তাদের উদ্বেগ, কামনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, অনুভূতি, পোষাক, ভালবাসা সব তুচ্ছ, সব কিছুই ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়। এই আবহে কোনও মেয়ে ছোটো ছোটো স্বপ্নের স্বপ্নও দেখতে পারে না।
রিয়া চক্রবর্তী সেই ছোটো স্বপ্নটাই দেখতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সত্যিকারের ভালবাসতে। তাই, মিডিয়া, সরকার, আদালত, এক কথায় সমগ্র ভারত রাষ্ট্র, একাট্টা হয়ে সেই স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিতে উদ্যত। যাতে কোনও নারীই স্বপ্ন দেখার সাহস না দেখায়।
*****
পরের কথাঃ ওপরের লেখাটি সর্ম্পূণ হওয়ার সাথেসাথেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, এনসিবি মাদক-যোগের সন্ধানে বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনে, সারা আলি খান, শ্রদ্ধা কাপুর ও রাকুল প্রীত সিং, ডিজাইনার সিমন খাম্বাট্টা এবং সুশান্ত সিংয়ের প্রাক্তন ম্যানেজার শ্রুতি মোদীকে অবিলম্বে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে। এর আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দীপিকার ম্যানেজার করিশ্মা প্রকাশ ও সুশান্তের প্রাক্তন ট্যালেন্ট ম্যানেজার জয়া সাহাকেও। এনসিবি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে যে জয়া এবং করিশ্মার মধ্যে হয়াটস্ অ্যাপে বার্তা বিনিময়ে নাকি বলিউডের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সত্য কি মিথ্যা তা তদন্তেই প্রকাশ হবে, কিন্তু তদন্তের মাঝখানে ব্যাক্তিগত কথাবার্তা কিভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়? এভাবে বেছে বেছে গোপন তথ্য ফাঁস – সিলেক্টিভ লিকেজ – যে বেআইনি তা কি মিডিয়া এবং তদন্তকারীরা জানে না! সরকারের দিক থেকেও এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই। প্রসঙ্গত, জেনেইউতে গত বছর সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডারা ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাবার পরে প্রতিবাদ সভায় দীপিকা পাড়ুকোনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি কোনও বক্তব্য রাখেন নি কিন্তু তার নীরব উপস্থিতি অনেক কিছুই ব্যাক্ত করেছিল।
ইতিমধ্যে, এনডিপিএসএ আদালত রিয়া চক্রবর্তীর বিচার-বিভাগীয় হেফাজতের মেয়াদ আরও দু’সপ্তাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর বম্বে হাই কোর্ট তার জামিনের আবেদনের শুনানী অবলীলাক্রমে পিছিয়ে দিয়েছে। মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলার অধিকার বিচার অধিকর্তাদের কে দিল সে প্রশ্ন করাটাও তো বিপদ।
আরও বড় প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়ঃ ধরে নেওয়া যাক, রিয়া-দীপিকারা মাদকের সঙ্গে সত্যিই যুক্ত। কিন্তু এভাবে বলিউড ক্লিন-আপ করে দেশজুড়ে কৃষিজীবি-শ্রমজীবি এবং ক্ষুব্ধ বেকার যুবকের ক্রোধ-বিক্ষোভকে কি রুখে দেওয়া যাবে?
= = =