সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর। পেছনে ছেড়ে এসেছি দশাশ্বমেধ ঘাটের ভিড়। সেখানেই কেটেছে সকাল থেকে অনেকটা সময়। দেখেছি স্রোতের মত পূণ্যার্থীর দল কিভাবে আসছেন সেই কোন ভোর বেলা থেকে। স্নান, সূর্য প্রণাম, পিতৃপুরুষের মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় পূজা— সে সব নিয়ে শত ব্যস্ততা। অল্প বয়স্ক পূজারী ঘাটের ওপর জলের খানিকটা ভেতরে এগিয়ে থাকা কাঠের লম্বা পৈঠার এক প্রান্তে স্থির হয়ে বসে অনাসক্ত ভাবে অপেক্ষা করছেন ভক্তের জন্য। কারো আবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে; পৈঠা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে ডাক দিয়ে যাচ্ছেন ভক্তদের উদ্দেশ্যে। অদ্ভুত দর্শন পোশাকে ছাইমাখা সাধুকে ঘিরে হুড়োহুড়ি। বারংবার ঝলসে উঠছে পিঠে ব্যাকপ্যাক লাগিয়ে বের হয়ে পড়া সদা উৎসুক বিদেশি ভ্রমণপিপাসুর দামি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ঈশ্বরপ্রীতি, জ্ঞানতৃষ্ণা আর বিত্তবাসনা যেন স্রোতের ধারার মত বয়ে চলেছে পতিতপাবনি গঙ্গার সমান্তরালে। বেলা বাড়তে ভক্তের ভিড় কিছু কমে এল। আমরা পা বাড়ালাম আরো দক্ষিণে, সেদিকেও একের পর এক ঘাট। সেগুলি তুলনামূলক ভাবে নিরালা।
সেই রকম একটি ঘাটের সোপানে বসে চেয়ে আছি দূরের পানে। আশপাশে যারা আছেন তাঁরা মনে হল বেনারস শহরেরই বাসিন্দা। সবাই সবাই কে চেনেন। অনেকেই তেল মাখছেন, কেউ বা কিছুটা ব্যায়াম করে নিচ্ছেন। কেউ কেউ কাপড় কাচতে বসেছেন। ভক্তির চেয়ে যেন এখানে প্রত্যহিক পরিচিতির মধ্যে জন্ম নেওয়া ভালবাসা বেশি করে চোখে পড়ে। দূরে মাঝ নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত স্টীমার যাবার সময় ঢেউ উঠছে জোরে। বাঁধানো পাড়ে জলের ধাক্কায় কিসের যেন সুর। এখানে ঘাটের কাছে জল বেশ গভীর। পরিষ্কার জলেও তল দেখতে পাওয়া যায় না। যেখানে জল বেশি গভীর সেখানে নদীর ধারে রেলিং দেওয়া আছে। সেই রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বসে রয়েছেন একজন মানুষ। তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে কয়েকটা ছাগল। একটি দুটি আবার দার্শনিকের মত চোখ বুজে বসে রয়েছে সেই মানুষটির পাশে। প্রথমে মনে হয়েছিল ভদ্রলোক বুঝি বা এই দার্শনিকদের সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন। কিন্তু কাছে গিয়ে টের পেলাম তিনি আপন মনে নিজের সাথে কথা বলে উঠছেন মাঝে মাঝে। নাকি নদীর সাথে কথা বলছেন? পাশে এক টুকরো খবরের কাগজে রাখা আছে এক তাল আটা। জলে মেখে ভাল করে ঠেসে লেচির মত করা হয়েছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে মুখ ফেরালেন আমাদের দিকে। সাদা দাড়ি, মুখে আলগা হাসি লেগে আছে। মাথায় ফেজ টুপি। হিন্দিতেই কথোপকথন শুরু করলেন। আমাদের কুশল মঙ্গলাদি জিজ্ঞাসা করার পর নিজের পরিচয় দিলেন। ধর্ম পরিচয়ে তিনি মুসলিম। বেনারসের বাসিন্দা কিন্তু ইদানিং কর্মসূত্রে দিল্লীতে থাকেন। যখন তিনি বেনারস ফেরেন দিনের বড় একটা সময় তার কাটে এই ঘাটে। আটার তালের দিকে আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তিনি একটু হাসলেন। কিছুটা আটা হাতের তালুতে নিয়ে গোল করে পাকালেন। তারপর ছুড়ে দিলেন নদীর জলে— যেখানে জল বেশ গভীর। একটু হেসে বললেন, “এহি তো করনে কে লিয়ে ইহা হাম বৈঠতে হ্যায়। দেখিয়ে আভি মছলি আ কর খা যায়েগা”। মৃদুমন্দ বাতাসে নদীর জলে আলপনা আঁকা হয়ে চলেছে। মানুষটি মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করছেন কোন মন্দির, কোন ঘাট দেখলাম। পরামর্শ দিলেন টুকরো টাকরা। আর মাঝে মাঝে আটার গোল্লা ছুঁড়ে দিচ্ছেন জলে। মাছেরা এসে খেয়ে যাবে। আটা শেষ হলে তিনি ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিদায় নেবার আগে বললেন, “বড়া শুকুন মিলতা হ্যায় ইহা আ কর। আপ লোগ ভি আইয়ে, হর সাল আইয়ে”। সেই সময় দুরের বা কাছের কোন মসজিদ থেকে ভেসে এল আজানের শব্দ। দ্বিপ্রহরের জোহরের নমাজের জন্য ডাক এসেছে বাতাসে।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে হিন্দু অধ্যুষিত পল্লীতে। কাছাকাছি মসজিদ ছিল না। আজানের শব্দ ভেসে আসত একটু দুরের কোন মহল্লা থেকে। মনে পড়ে আজান শুনতে পেলেই মা মাথায় কাপড় দিতেন, দিদিকেও বলতেন মাথায় কাপড় দিতে। নমাজ পড়ার জন্য ছোটবেলায় সেরকম জোরাজুরি না থাকলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজানের শব্দ শুনে এখন নমাজ পড়ার প্রস্তুতি নিই। বিকেলের ট্রেনে করে যখন কলকাতা ফিরি ট্রেন থেকে শুনতে পাই আজানের শব্দ। কখনো খালি চোখে, কখনও বা মনের চোখে দেখতে পাই গ্রামের পথে একজন দু’জন করে মানুষ চলেছেন মসজিদের দিকে; শহরের মসজিদের সামনে ইতস্তত জটলা; আবার মহিলারা নমাজের প্রস্তুতি শুরু করছেন বাড়িতেই। এক বিষণ্ণ প্রসন্নতায় মন ভারি হয়ে ওঠে আমার। প্রসন্নতা কারণ— কত যুগ ধরে ইশ্বরের ডাক এমনি করেই ভেসে আসছে আমাদের কাছে। এর মধ্যে আমি পাই এক অপরূপ সময়াতীত সৌন্দর্য্য। বিষণ্ণ কারণ— অনেক সময়ই আমি সেই ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হই। খানিকটা যেন রজনীকান্তের সেই চির চেনা গানের মত— “আমি সকল কাজের পাই হে সময় তোমারে ডাকিতে পাই নে… আমি কতই যে করি বৃথা পর্যটন তোমার কাছে তো যাই নে”।
সেদিন বিকেলে আরও একবার ডাক শুনতে পেলাম। পড়ন্ত বিকেল। শেষ সূর্যের আলো নদীর ওপারের বালুকারাশিকে আলোকিত করেছে। এ পারে আলো জ্বলে উঠছে একটা একটা করে। হাতে টানা নৌকায় আমরা তখন মাঝ গঙ্গায়। মাঝি এক জায়গার নৌকার দাঁড় ছেড়ে দিয়ে জানালেন যে বেনারসের গঙ্গার এই হল গভীরতম অংশ। আমাদের বাঁ দিকে কিছুটা দূরে হরিশ্চন্দ্র ঘাট। কয়েকটি চিতার আগুন এই মাঝ নদী থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই আগুনে চিকচিক নদীর জল যেন আমাদের নশ্বরতার চিহ্ন বহন করছে। ডান দিকে বেশ কিছুটা দূরে দশাশ্বমেধ ঘাটে জ্বলে উঠেছে অনেক আলো। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে পূণ্যার্থিদের উদ্দেশে ঘোষণা। সেখানে এখন শুরু হবে গঙ্গা আরতি। আর এরই মাঝে প্রথমে একটি, তারপর দু’টি, তারপর বেশ কয়েকোটি মসজিদ থেকে ভেসে এল আজানের শব্দ। সন্ধ্যা বেলার নমাজ— মগরিবের জন্য ডাক দেওয়া হচ্ছে। আজানের ভেসে আসা শব্দ, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, গঙ্গা আরতির সঙ্গীত ও স্তোত্র— সব যেন মিলে মিশে শুনতে পেলাম সেই চিরন্তনের ডাক।