পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

“চরক শপথ” দিয়ে হিপোক্রেটিসের “Oath”এর প্রতিস্থাপন

  • 02 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1815 view(s)
  • লিখেছেন : জয়ন্ত ভট্টাচার্য
ক্রমপরিবর্তনশীল চরিত্রই মেডিসিন, জ্ঞান, সমাজ এবং এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ মেডিক্যাল এথিক্সের জীয়নকাঠি। এভাবেই সমাজ ও জীবন এগোয়। পুরাতনের আরাধনার জন্য তাকে নতুন মোড়কে নির্মাণের পেছনে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য কাজ করে। আমরা এই সময়ের সাক্ষী। চরক শপথ দিয়ে হিপোক্রিটিক ওথের প্রতিস্থাপন নিয়ে লিখলেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য

১৮৭ বছরের প্রাচীন ভারতের তথা এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজের – ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ – প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ২৩.০২.২২ তারিখে প্রথম ক্লাসের আগে “চরক শপথ” পাঠ করানো হয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকার খবর হয়েছে – “Calcutta Medical College students read out ‘Charak Shapath’ during induction (২৩.০২.২২)”। চিকিৎসকমহলের প্রায় সর্বস্তর থেকে এ বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানানোর ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাণ্ডবিয়া আইএমএ-র প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন – “Charak Shapath (Oath of Charak) will not be forced on medical students and will be optional, Union Health Minister Dr Mansukh Mandaviya assured an IMA delegation on Monday.” (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, “Charak Shapath optional, will not be forced: Mandaviya assures IMA”, ২২.০২.২২)

এতসবের কারণ কি? কয়েকদিন আগে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত “হিপোক্রেটিক ওথ” আর নয়। একে প্রতিস্থাপিত করা হবে একেবারে নির্ভেজাল ভারতীয় “চরক শপথ” দিয়ে। এতে একদিকে হয়তো আমাদের নিজস্বতার এক দৃঢ় বিজ্ঞাপন হবে, অন্যদিকে একটি জাতীয়তাবাদী মানসিকতার নবজাগরণ ঘটবে। কিন্তু মুশকিল হল “চরক শপথ” বলে যা বলা হচ্ছে সেটি কর্তিত এবং নবনির্মিত। তাহলে চরক শপথ কি? এ নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।

আজ ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে যে শপথ নেওয়ানো হয়েছে সে শপথটি এবং এর শেষ বাক্যটি নীচে দিলাম। দেখা যাবে দ্বিজত্বের ধারণাকে প্রসারিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র নিজের ক্ষমতাবলে নতুন শব্দার্থ নির্মাণ করে। রাষ্ট্র সবাইকে তার কাঠমোর মধ্যে আত্মীকৃত করতে চায়।

এখানে তিনটি বিষয় বলতে হবে – (১) শব্দটি Charak নয়, সঠিক ইংরেজিতে Caraka, (২) দ্বিজ শব্দটিকে ইংরেজিতে সঠিকভাবে লিখলে Dvija হবে, Dwij নয়, এবং (৩) শব্দটি Shapath নয়, Shapatha (শপথ)। স্বল্প বা অর্ধশিক্ষিতের পাল্লায় পড়ে বেচারা চরক কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন বা কাটাবেন জানিনা।

লুডভিগ এডেলস্টাইন ইউরোপের প্রাচীন মেডিসিনের মান্য গবেষক। তাঁর বহুল পঠিত গ্রন্থ Ancient Medicine (ed. Owsei Temkin and C. Lilian Temkin, 1987) হিপোক্রেটিয় “ওথ”-এর ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। এডেলস্টাইন তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই জানাচ্ছেন – “The Hipocratic Oath clearly falls into two parts.” (পৃঃ ৭) এই দুটি অংশ কি কি? তিনি বলছেন – প্রথম অংশ হচ্ছে যেখানে ছাত্রদের শিক্ষকের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি কর্তব্য এবং চিকিৎসার জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে ছাত্রদের বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় কিছু নিয়মকানুনের কথা।

এই ওথ-এর এক জায়গায় রয়েছে – “Nor shall any man's entreaty prevail upon me to administer poison to anyone; neither will I counsel any man to do so. Moreover, I will give no sort of medicine to any pregnant woman, with a view to destroy the child.

Further, I will comport myself and use my knowledge in a godly manner.”

Poison বা বিষ দেবার অংশটি নিয়ে বিভিন্ন শতাব্দীতে, বিশেষত আধুনিক সময়ে, গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে – সে সময়কালের গ্রীসে কি আত্মহত্যা করা বিষপ্রয়োগে মেরে ফেলা একটি সাধারণ প্রাকটিস ছিল, নাহলে এ প্রসঙ্গ আসবে কেন? অ্যারিস্টোটল, প্লিনি, ট্যাসিটাস, অ্যাপুলিয়াস (Apuleius) এবং থিওফ্র্যাসটাসের মতো দার্শনিকদের রচনা উদ্ধৃত করে এডেলস্টাইন দেখিয়েছেন – “If the sick felt that their pains had become intolerable, if no help could be expected, they often put an end to their own lives.” আমাদের এক্ষেত্রে মনে আসবে নিশ্চয়ই ইউথ্যানাশিয়া নিয়ে তুমুল বিতর্কের কথা।

ইংরেজিতে “ওথ” শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে, যেগুলো সময়ের সাথে বদলে গেছে। পরিবর্তনশীল শব্দার্থের জন্য এডেলস্টাইনের মতো প্রাচীন গ্রেকো-রোমান মেডিসিনের বরেণ্য গবেষক অনেকক্ষেত্রেই “ওথ”-এর পরিবর্তে “covenant” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্যাকরণগতভাবে “ওথ”-এর আমরা তিনটি প্রধান অর্থ পাচ্ছি – (১) “A solemn promise, often invoking a divine witness, regarding one's future action or behaviour”, (২) “A sworn declaration, such as the promise to tell the truth, in a court of law”, এবং (৩) “A coarse or blasphemous word or phrase used to express anger or other strong emotion”। তাহলে মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ, আইনী শপথ থেকে কুবাক্য বলা বা গালিগালাজ করা – সবকিছুই ওথ শব্দটি দিয়ে বোঝানো সম্ভব। আমরা সাধারণভাবে প্রথম অর্থটি আমাদের পেশাগত জগতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছি।

এখানে দেরিদাকে দিয়ে সহজ করে বুঝলে দেখা যাবে যে একটি শব্দের মধ্যেকার বিভিন্ন অর্থের মধ্যে ক্রমাগত টানাপড়েন চলে – দেরিদা একে differance বলেছেন। ক্ষমতাসম্পর্কের সাথে শব্দার্থের কোন অংশটিকে যুক্ত করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে তার ওপরে নির্ভর করে কোন অর্থটি জনসমাজে গ্রাহ্যতা পাবে। বাকী অর্থগুলো থেকে যায়, সম্পূর্ণ মুছে যায়না – trace হিসেবে থেকে যায়। ক্ষমতাসম্পর্ক আবার নির্ধারিত/নির্মিত হয় রাজনৈতিক প্রয়োজন, রাষ্ট্রিক তাগিদ, অর্থনৈতিক শক্তি ইত্যাদি বহুবিধের সমন্বয়ে। আমরা ক্ষমতাসপম্পর্কের সাথে কোন কিছুর being (অস্তিত্বশালী) হয়ে ওঠা বারেবারেই দেখব। যেমন একটু আগে দেখলাম দ্বিজ শব্দটির অর্থ কিভাবে প্রসারিত করা হয়েছে।

মনিয়ের-উইলিয়ামসের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান থেকে দেখা যাচ্ছে “শপথ” শব্দের প্রথম অর্থটিই রয়েছে (ঋগবেদ অনুসরণ করে) অভিশাপ দেওয়া বা বিষোদ্গার করা। দ্বিতীয় অর্থ ওথের অনুগামী।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে শপথ শব্দটির চারটি অর্থ – (১) আক্রোশ, শাপ (যেমন ইংরেজিতেও দেখেছি), (২) মিথ্যানিরসন, (৩) দিব্যি এবং (৪) নির্ভৎর্সন, উপালম্ভন, এবং অমরকোষ অনুযায়ী শপথ। আমরা শেষ অর্থটি প্রধানত গ্রহণ করেছি।

আজ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি আগে (১৯৭০ সালে) আই এ মেনন এবং এইচ এফ হেবারমানের প্রবন্ধ (“The medical students’ oath of ancient India”) প্রকাশিত হয় মেডিক্যাল হিস্টরি জার্নালে। প্রবন্ধকাররা জানান কেন হিপোক্রেটিসের তুলনায় চরকের ওথ বেশি গ্রহণযোগ্য – “It is conceivable that the Hippocratic Oath was influenced by Ancient Indian teachings and practices via the Pythagorean school. On the other hand, we have seen that the oath found in the Charaka Samhita is the embodiment of concepts and practices of the Ancient Indian community in general and not as in the Hippocratic Oath that of a small sect possibly of foreign origin.” অর্থাৎ, ভারত যে “বিশ্বগুরু” হয়ে ওঠার উপযুক্ত এ ধারণা সেসময় থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে ভিন্ন ঢংয়ে, ভিন্ন রূপে প্রচার পেতে শুরু করেছিল। জারিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।

এখানে একাধিক প্রসঙ্গ উঠে আসে। আমাদের মনযোগও আকর্ষণ করবে আশা করি।

প্রথম, একটি বিশেষ সময় এবং প্রেক্ষিতে রচিত মেডিক্যাল এথিক্স তথা ওথ আদৌ অন্য একটি সময়ে (একবিংশ শতাব্দীতে) transferrable কিনা।

দ্বিতীয়, আয়ুর্বেদের “চরক শপথ” বলে যা পরিচিত সে তো প্রাচীন ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদের কালে রচিত। বর্তমান সময়ে আয়ুর্বেদের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া বলে পরিচিত মিউলেনবেল্ড (G Jan Meulenbeld, ২০১৭ সালে প্রয়াত হয়েছেন) এবং অন্যান্য আয়ুর্বেদের বিশেষজ্ঞরা সংশয়াতীতভাবে দেখিয়েছেন ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশক পর্যন্ত আধুনিক মেডিসিন তথা মেডিক্যাল কলেজের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে আয়ুর্বেদের আভ্যন্তরীন চরিত্রে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। একে এঁরা বলেছেন নব্য-আয়ুর্বেদ। মিউলেনবেল্ডের magnum opus হল ভারতীয় মেডিসিনের ইতিহাসের ওপরে ৫ খণ্ডে সম্পূর্ণ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পুস্তক History of Indian Medical Literature। মিউলেনবেল্ড বলছেন – “ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আয়ুর্বেদের নবজন্ম ভারতীয় মেডিসিনের একটি একীভূত মডেলের জন্ম দিল। এই মডেল আয়ুর্বেদের মধ্যেকার সেসব অসংলগ্নতা এবং প্রমানের অসাধ্য ধারণগুলো ছিল সেগুলোকে আধুনিক মেডিসিনের অনুকরণে ছেঁটে ফেলা হল। ফিজিওলজি, প্যাথলজি এবং রোগের বর্গীকরণ সংক্রান্ত পুরনো ঐতিহ্যবাহী শব্দসমূহকে ধৈর্য্য ধরে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হল যাতে পশ্চিমী মেডিসিন থেকে আহরিত মেডিক্যাল টার্মের সাথে এদের সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা যায়”। তাঁর পরবর্তী সংযোজন – “The renaissance of āyurveda since about the middle of the nineteenth century – historically a fascinating phenomenon – made its protagonists and epigones feel called upon to sketch a profile of this science that would be serviceable in the competitive struggle with Western medicine ... These procedures resulted in the appearance of a type of ayurveda that can best be designated as navyayurveda or neo-ayurveda.” (১ম খণ্ড, ১৯৯৯, পৃঃ ২)। এ প্রসঙ্গে আরেকটি লেখা দ্রষ্টব্য – কেনেথ জিস্ক, “New Age Ayurveda or What Happens to Indian Medicine When It Comes to America”।)

মিউলেনবেল্ড আরও বলছেন – “Indian medicine is thoroughly embedded in the culture of the subcontinent and cannot adequately be studied and understood without acquaintance with its history and ways of thought. Conversely, knowledge of medical concepts will certainly illuminate problems that would otherwise remain obscure. Medical treatises abound in material relevant to cultural history, and many nonmedical texts contain data pertaining to medicine, which demonstrates that medical science constitutes an integral part of the Indian civilization.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২) অর্থাৎ, ভারতীয় মেডিসিনের গবাক্ষ দিয়ে ভারতের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে ভালো করে বোঝা সম্ভব। উলটো দিক থেকে দেখলে, ভারতের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রোথিত আয়ুর্বেদ ভারতকে পূর্ণত বোঝার জন্য নিতান্ত জরুরী।

এই নতুন ধরনের আয়ুর্বেদ রাষ্ট্রের সহযোগিতায় কলেজ ও পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে। মেডিক্যাল কলেজের অনুসারী সিলেবাস তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে হাসপাতাল। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের History of Indian Medicine: Containing Notices, Biographical and Bibliographical, of the Ayurvedic Physicians and their Works on Medicine-এর (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪) ২য় খণ্ড দ্রষ্টব্য। তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম হল এরকম – First-year – physics, chemistry, biology and anatomy, dissection and practical training in scientific subjects. Second-year – anatomy, physiology, materia medica, pathology dissection, practical classes, and hospital duty. Third-year – medicine, surgery, midwifery, hygiene, clinical medicine and surgery, labour cases, hospital duty – medical and surgical, and operative surgery. Fourth-year – same as in the third year, medical jurisprudence and history of medicine। (২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬)

ড্যাগমার বেনার তাঁর “The Medical Ethics of Professionalized Ayurveda” (Asian Medicine, January 2005 1(1):185-203) প্রবন্ধে বলছেন – “it must be stressed that the passage in Caraka's text is by no means the only or the most important passage on ethical standards for medical practice in ayurvedic texts. On the other hand, Caraka's Oath, as it will hereafter be referred to, does summarise many ethical injunctions also found elsewhere in ayurvedic texts and therefore is to a certain extent representative of ayurvedic ethics, though not a comprehensive summary of them.”

নব্য-আয়ুর্বেদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, জিমারম্যান যেমন বলেছেন, কেবলমাত্র সাম্প্রতিক সময়ে “no doubt influenced by European medicine have the Ayurvedics been concerned with indicating physiological phenomena cartographically ... the appearance of the treatises of anatomical diagrams to be found in English handbooks, replacing the English captions with Sanskrit names --- through a kind of retrospective rationalization.” (The Jungle and the Aroma of Meats, পৃঃ ১৬৬)

এখন স্বাভাবিক নিয়মে প্রশ্ন উঠবে – কোনটি আমরা গ্রহণ করব? নব্য-আয়ুর্বেদে নতুন রূপে এবং চরিত্রে প্রকাশিত প্রফেশনাল আয়ুর্বেদের বর্তমান রূপটিকে কিংবা ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদে বর্ণিত শিক্ষক-ছাত্র-রোগী সম্পর্কের ধরনটিকে? পুরনো ধরনটি দিয়ে নতুন ধরনকে আদৌ প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব বা উচিত কিংবা নৈতিক? শুধু তাই নয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল মেডিক্যাল জ্ঞানের জগতকে যেখানে জ্ঞানের নতুন নতুন উপচার, রোগীর অধিকার, লিঙ্গসাম্য ও প্রতিবন্ধীদের অধিকারের জোরালো দাবী, রাজনীতি-বাণিজ্য-কর্পোরেট পুঁজি-মেডিসিনের আন্তঃসম্পর্ক, স্বাস্থ্যব্যবস্থার আভ্যন্তরীন নিত্যনতুন জটিলতা এবং অন্যান্য বিষয় ক্রমাগত প্রভাবিত করে চলেছে সেখানে প্রায় ২৫০০ বছরের পুরনো একটি শিক্ষাকে আবার তুলে আনা কি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নতুন বিগ্রহ (icon) তৈরি করার চেষ্টা যখন প্রাচীনকে দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানের অতিরাষ্ট্রিক বিজ্ঞাপন হবে? যেমনটা প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যাল্য শিক্ষাতে নতুন করে সংযোজন করা হচ্ছে।

তৃতীয়, চরকের শপথ বলে যা বলা হচ্ছে তা আসলে প্রকৃত অর্থে শপথ নয়। চরক সংহিতা-র বিমানস্থানের ৮ম অধ্যায় “রোগভিষগজিতীয়ং”য়ে বর্ণিত (৮.৩ থেকে ১৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত) আয়ুর্বেদ কিভাবে পাঠ করা হবে, শিক্ষকের নির্বাচন এবং একজন ছাত্রের নতুন জ্ঞানে দীক্ষা নেওয়ার মতো বিষয়গুলো এসেছে। “Chapter eight, called rogabhivishagjitiya, deals with the study of ayurveda, the selection of a teacher, the method of studying, the method of teaching, and the initiation of a student (8.3-14)” (মিউলেনবেল্ড, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৪)।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করার যে দৃঢ়বলের দ্বারা চরক সংহিতার যে সংস্কার এবং সংস্কার হবার পরের যে চেহারাকে আমরা মূল চরক সংহিতা বলে জানি সেখানে সংস্কারের পরে মোট ১২০টির মধ্যে ৪১টি অধ্যায় নেই। মিউলেনবেল্ড বলছেন – “Agnivesa's treatise, as redacted by Caraka, found to be incomplete by one-third, was fully restored by Dridhabala (12.36cd--40ab).” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯১-৯২) চরক সংহিতা-র সিদ্ধিস্থান-এর শেষাংশে বলা হচ্ছে – “এই তন্ত্রের চিকিৎসাস্থানের শেষ সপ্তদশ (১৭) অধ্যায় এবং সিদ্ধি ও কল্পস্থান পাওয়া যায় নাই। দৃঢ়বল নামক এক ব্যক্তি ... বহু পরিশ্রমে বহুতন্ত্র হইতে সংগ্রহ করিয়া ইহাতে চিকিৎস্থানের সপ্তদশ অধ্যায় এবং কল্প ও সিদ্ধিস্থান যোজনা করেন।” (চরক সংহিতা, অনুঃ সতীশচন্দ্র শর্মা, ১৯০৪, পৃঃ ৮৮৪)

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “We are not told about the actual cause of extinction. Could it be that the contempt for medicine expressed by the Indian law-givers – their insistence that its practice must remain restricted to the culturally under-privileged ones – had anything to do with the neglect and loss of a very substantial portion of it? We do not have the answer to this from Dridhabala.” (Science and Society in Ancient India, 1977, পৃঃ ৩০) দেবীপ্রসাদের গ্রন্থ থেকে আমরা এ তথ্যও জানতে পারি যে হঠাৎ করেই চরক সংহিতায় দ্রাবিড় এবং আন্ধ্রকদের ব্যাপারে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩১)

এতগুলো স্তর মাথায় রেখে আমরা “চরক শপথ”-এর বিষয়টি বুঝবো। আগেই বলেছি, চরক সংহিতার বিমানস্থানের ৮ম অধ্যায় “রোগভিষগজিতীয়ং”য়ে বর্ণিত (৮.৩ থেকে ১৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত) অংশে প্রথমে বলা হয়েছে কারা চিকিৎসক হতে পারবেন সে বিষয় – “কারণ চিকিৎসকগণের মধ্যে বহুবিধ শাস্ত্র সমাজে প্রচলিত আছে।” (চরক সংহিতা, সম্পাদকঃ ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩২) এ থেকে বোঝা যায় শুধু চরক সংহিতা নয়, আরও অনেক মেডিক্যাল টেক্সট সেসময়ের সমাজে প্রচলিত ছিল। ধীরে ধীরে চরক সংহিতা একমাত্র কর্তৃত্বকারী টেক্সট হয়ে উঠেছে। অধীত টেক্সটের কি কি গুণ থাকবে? “অল্পবুদ্ধি মধ্যবুদ্ধি ও বিপুলবুদ্ধি এই ত্রিবিধ শিষ্যের যাহা বুদ্ধিগম্য, যাহাতে পুনরুক্তি দোষ নাই, যাহা ঋষিপ্রণীত ... যাহাতে কোন শব্দ প্রক্ষিপ্ত হয় নাই অর্থাৎ যাহাতে কোন আধুনিক লেখকের বিষয় সংযোজিত হয় নাই ... এইরূপ শাস্ত্রই নির্মল সূর্যের ন্যায় তমোরাশি বিনষ্ট করিয়া সমুদয় প্রকাশ করিয়া থাকে।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩২) এটুকু থেকে স্পষ্ট হয় যে টেক্সটের আধুনিক হওয়া চলবেনা। ঐতিহ্যাশ্রয়ী, দৈবনির্ভর এবং ব্রাহ্মণ্য সমাজ অনুমোদিত একটি টেক্সটই অধ্যন করতে হবে।

“শাস্ত্রপরীক্ষার পরে আচার্য পরীক্ষা করিবে।” কি সেই পরীক্ষা? “শাস্ত্রে সন্দেহশূণ্য, দৃষ্টকর্মা, কার্যদক্ষ, অনুকূলস্বভাব, শুদ্ধাচারী, সিদ্ধহস্ত” ইত্যাদি গুণ থাকতে হবে। “শাস্ত্রে সন্দেহশূণ্য” শব্দবন্ধ নজরে রাখতে হবে। অর্থাৎ কোন প্রশ্ন করা চলবেনা। প্রশ্নাতীত আনুগত্য নিয়ে শিক্ষালাভ করতে হবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যারা প্রশ্ন করে তাদেরকে বাতিল করতে হবে। সম্ভবত চার্বাকপন্থীদের লক্ষ্য করে এ কথাগুলো বলা হয়েছিল।

এরপরের অংশ শিষ্যপরীক্ষার পালা। শিক্ষার্থীদের কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে? “যে প্রশান্তস্বভাব, আর্যবংশীয়, অক্ষুদ্রকর্মা; যাহার চক্ষু মুখ ও নাসাবংশ সরল, জিহ্বা পাতলা রক্তবর্ণ ও নির্মল, দন্ত ও ওষ্ঠ অবিকৃত, যে মিন্মিনভাষী নহে, যে ধৈর্যবান, অনহংকৃত, মেধাবী, তর্কশক্তি ও স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, উদারচেতা, আয়ুর্বেদবিদবংশজ অথবা আয়ুর্বেদোপজীবী ... আচার্যের সমূহ আজ্ঞাবহ ও অনুরক্ত, এইরূপ গুণসম্পন্ন সেই শিষ্যই অধ্যাপনার উপযুক্ত।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩৪) অস্যার্থ, আর্যবংশীয় এবং বিশেষ শারীরিক গুণসম্পন্ন ছাত্র শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত। পরিত্যক্ত হল আর্য নয় যারা এবং যাদের শারীরিক অক্ষমতা রয়েছে। নারীর তো কোন প্রশ্নই ওঠেনা। আয়ুর্বেদে রয়েছে “unwaveringly male gaze”।

চরক সংহিতা-র পরে সংকলিত সুশ্রুত সংহিতা-য় ভিন্ন সুর শোনা যায় – “কেহ কেহ বলেন যে, কুললক্ষণসম্পন্ন শুদ্রকেও মন্ত্রভাগ পরিত্যাগপূর্বক (এরা মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারবেনা) দীক্ষিত করা যায়।” (সুশ্রুত সংহিতা, ২য় অধ্যায়, শিষ্যোপনীয়, শ্লোক ৩) এর সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করা এ প্রবন্ধের পরিধির বাইরে। একটি কারণ হতে পারে অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে কায়িক শ্রম এবং দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কুশলতা এদের জন্য এরকম একটি শিক্ষার সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছিল। আর শল্য চিকিৎসা প্রধানত হস্ত নির্ভর কর্ম। এটাও একটা কারণ হতে পারে। কারণ আমরা পরবর্তীতে দেখেছি যারা চরক-নির্ভর ব্রাহ্মণ্যবাদী স্কল্যাস্টিক মেডিসিনের চর্চা করেছে তারা রোগীদের দেহ স্পর্শ পর্যন্ত করত না। আর শল্য চিকিৎসা একটি গোষ্ঠী বা পারিবারিক craft হিসেবে নির্বাসিত হয়েছিল সবচেয়ে নীচুশ্রেণীর মধ্যে।

সুশ্রুত সংহিতা-য় এর পরে বলা হয়েছে – “দ্বিজ, গুরু, দরিদ্র, মিত্র, প্রব্রজিত, শরণাগত, সাধু, অনাথ ও আগন্তুকদিগকে আপনার জ্ঞাতি-কুটুম্বের ন্যায় মনে করিয়া আপনার ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করিবে, তাহাতে মঙ্গল হইয়া থাকে।” কাদের চিকিৎসা করবেনা? “ব্যাধ, শাকুনিক (যারা পাখীদের হত্যা করে), পতিত ও পাপকারীদের চিকিৎসা করিবেনা। এইরূপে আচরণ করিলে বিদ্যা প্রকাশিত হয় এবং মিত্র, যশ, ধর্ম, অর্থ ও কাম লব্ধ হয়।”

এবার আবার চরকে ফিরি। বিমানস্থানের পূর্বোক্ত অধ্যায়ে দীক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি হিসেবে “পূর্বদিকে নত বা উত্তরদিকে নত ... চতুর্দিকে এক এক হস্ত পরিমিত (সমতল পবিত্রস্থানে) স্থণ্ডিল (যজ্ঞভূমি) করিয়া ... আশীর্যুক্ত মন্ত্রদ্বারা ব্রাহ্মণ” ইত্যাদিকে অভিমন্ত্রিত করে দীক্ষাগ্রহণ করতে হবে।

শিষ্যরা কেমন হবে? “ব্রহ্মচারী, শ্মশ্রুধারী, সত্যবাদী, অমাংসভোজী, পবিত্রভোজী” হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কঠোর অনুশাসন এখানে স্বতঃই প্রতিভাত হচ্ছে। আচার্যের ক্ষেত্রে “রাজবিদ্বেষজনক, প্রাণহানিকর, অত্যন্ত অধর্মজনক এবং অনর্থক বাক্য ভিন্ন, আমার সকল বাক্যই প্রতিপালন করিবে। তুমি সমস্তই আমাকে অর্পণ করিবে, আমাকে প্রধান বলিয়া জানিবে ... উঠিতে বসিতে সর্বদার জন্য সর্বাগ্রে গো-ব্রাহ্মণের তৎপরে সমুদয় প্রাণীর সুখ কামনা করিবে।” (চরক সংহিতা, সংঃ ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৬) আমরা “অমাংসভোজী” শব্দটি খেয়াল রাখবো। বোঝা যায়, এক বিশেষ খাদ্যবিধির ও সংস্কৃতির মানুষ আয়ুর্বেদ পাঠের উপযুক্ত।

অথচ আশচর্যজনকভাবে চরক সংহিতা-র সূত্রস্থান-এ ২৭ অধ্যায়ে (“অনুপানবিধিমধ্যায়”) ৬১ থেকে ৮৭ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য রোগীর উপযোগী পথ্যের মাংসের তালিকায় রয়েছে (“অথ মাংসবর্গ” শিরোনামে) বিভিন্ন প্রাণীর মাংস যা বিভিন্ন ধরনের রোগীর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রয়োজন পড়ে। এবং এগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখনকার সময়েও তালিকা দেখলে আয়ুর্বেদাচার্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদের গণ্ডীর বাইরে অবস্থান এবং “সেক্যুলার” দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় – যদিও অনেক মৌলিক চিন্তাতেই আপোষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এঁরা। যাহোক, কোন কোন প্রাণীর মাংস রোগীর পথ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিবেচিত হবে তার তালিকাটি এরকম – শৃমর, চমর, খড়গ, মহিষ, গবর, হস্তী, নঙ্কু এবং শূকর প্রভৃতিকে আনূপ পশু বলে। রুরু প্রভৃতি মৃগরাও আনূপ শব্দের বাচ্য। এই তালিকায় রয়েছে গো, গর্দভ, অশ্বতর, উষ্ট্র, ঘোটক, চিতাবাঘ, সিংহ, ভল্লুক, পেঁচা, ধুমীক অর্থাৎ ফিঙ্গা পাখী, কচ্ছপ, কর্কটক, মৎস্য, শিশুমার, তিমিঙ্গিস, শুক্তি ইত্যাদি। জঙ্গল পশুদের নাম – পৃষৎ, শরভ, রাম, শ্বদংষ্টা, মৃগমাতৃকা, শশ, উরণ, কুরঙ্গ, গোকর্ণ, কোট্টকারক, চারুষ্ক, হরিণ, এণ, শম্বর, কালপুচ্ছক, ঋষ্য এবং ভরপোত। এর সাথে যুক্ত হবে ছাগ ও মেষ মাংস, ময়ূরের মাংস, কুক্কুট মাংস, গোসাপের মাংস (বলবর্ধনকারী), শজারুর মাংস, শশক মাংস, গোমাংস (“দেহের মাংসক্ষরে বিশেষ হিতকর” বলা হয়েছে), বরাহ ও শূকরের মাংস (স্নিগ্ধকারক বলা হয়েছে), মহিষের মাংস। সবশেষে বলা হচ্ছে – “শরীরপোষকের মধ্যে মাংসাপেক্ষা অন্য কোন খাদ্য শ্রেষ্ঠ নহে।”

বর্তমান ভারতবর্ষে এরকম “বিপজ্জনক” খাদ্যবিধিকে অনুমোদন দেওয়া প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে – যেখানে একইসাথে গরু, মহিষ, শূকর, ময়ূর, শজারু, ভল্লুকের মাংস ভক্ষণের বিধান দেওয়া আছে রোগীর এবং রোগের প্রয়োজন অনুযায়ী। একে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে, নির্বিষ, নিরামিশ এবং নিরীহ করে কেবলমাত্র ফার্মাকোলজির অংশটুকুকে গ্রহণ করে AYUSH-এর মধ্যে নিয়ে এসে একটি একমাত্রিক আয়ুর্বেদ তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যেকার বহুস্তরীয়, বহুত্ববাদী, বহু-অর্থবাহী চরিত্র বিলীন হয়ে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির চিকিৎসা জগতের বাহক আয়ুর্বেদ (মিউলেনবেল্ড, জিমারম্যান এবং অন্যান্য স্কলাররা এমনটাই মনে করেন) পর্যবসিত হয়ে যাবে রাষ্ট্র অনুমোদিত নির্জীব, নিষ্প্রাণ একমাত্রিক একটি চিকিৎসাবিধিতে।

ব্রাহ্মণ-রাজা-রাজত্ব-গোসম্পদকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক সংস্কৃতি চিকিৎসাশাস্ত্র তার সাথে ক্রমাগত আপস করে চলেছে। দেবীপ্রসাদ বলেছেন, এরকম আপোস না করলে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃত্বকারী সমাজে আয়ুর্বেদের মতো একটি সেক্যুলার চিকিৎসাব্যবস্থা টিকে থাকতে পারত না। কিন্তু এ ধরনের মেডিসিন চর্চার মধ্যে যে নৈতিকতার বনিয়াদ রচনা হয়, সহজেই অনুধাবন করা যায়, সেটা একান্তই বিশেষ সমাজ-সংস্কৃতি নির্ভর, সার্বজনীন নয়। একবিংশ শতকে একে transfer/translocate করা যায়না।

“রাজদ্বিষ্ট (যে রাজার কুপিত নজরে) বা রাজদ্বেষী এবং মহাজনদ্বিষ্ট বা মহাজনদ্বেষী ব্যক্তিগণকে ঔষধ প্রয়োগ করিবে না। যাহারা অত্যন্ত বিকৃতাচারী, দুষ্টস্বভাব, দুঃশীলাচারী, অপচারী, যাহারা অপবাদের প্রতিকার করে না, যাহারা মুমূর্ষু এবং যে সকল স্ত্রীলোকের স্বামী বা অধ্যক্ষ (মালিক) উপস্থিত নাই, এইরূপ লোকসকলকেও ঔষধ প্রয়োগ করিবে না।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩৭)

কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রসঙ্গ পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় – “আতুরকুলসম্বন্ধীয় বিষয় সকল বাহিরে প্রকাশ করিবেনা। আতুরের আয়ুঃ হ্রাস হইয়াছে ইহা জানিতে পারিলেও, যেখানে বলিলে রোগী বা রোগীর অন্য কোন ব্যক্তির প্রাণহানিকর হইবে, সেখানে তাহা প্রকাশ করিবেনা।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩৮)

এখানে হিপোক্রেটিক ওথের সাথে চরকের ধারণার পার্থক্য ঘটে যায়। ওথ-এ বলা হয়েছে – রোগী চাইলেও তাকে কোন ধরনের বিষ দেওয়া যাবেনা। চরকে বলা হচ্ছে – “আতুরকুলসম্বন্ধীয় বিষয় সকল বাহিরে প্রকাশ করিবেনা। আতুরের আয়ুঃ হ্রাস হইয়াছে ইহা জানিতে পারিলেও, যেখানে বলিলে রোগী বা রোগীর অন্য কোন ব্যক্তির প্রাণহানিকর হইবে, সেখানে তাহা প্রকাশ করিবেনা।” দুটো বিষয়বস্তুর মধ্যে মূলগত ফারাক রয়েছে।

হিপোক্রেটিক ওথ এবং তার বিবর্তন

এই ওথ-এর একটি অংশে আছে – “1 will apply dietetic measures for the benefit of the sick according to my ability and judgment; 1 will keep them from harm and injustice.

1 will neither give a deadly drug to anybody if asked for it, nor will 1 make a suggestion to this effect. Similarly 1 will not give to a woman an abortive remedy. ln purity and holiness 1 will guard my life and my art.”

এ অংশটি নিয়ে বিপুল বিতর্ক চলেছে, প্রাণবন্ত আলোচনা চলেছে, অসংখ্য মতামত উঠে এসেছে। আবার নতুন করে সংশোধিত হয়েছে। যেমনটা হবার কথা গতিশীল চলমান বৌদ্ধিক জগতে (চরকের শপথের মতো যদি অপরিবর্তনীয় বা অভ্রান্ত না হয়)। এরপরে বিভিন্ন সংশোধনী হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ১৯৪৮ সালে ডিক্লেয়ারেশন অফ জেনেভা এবং ১৯৪৯ সালে ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ইন্টারন্যাশনাল কোড অফ মেডিক্যাল এথিক্স। মনে রাখতে হবে এর অব্যবহিত আগে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন “হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট” নিয়ে চিকিৎসকদের ভূমিকা শক্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সমগ্র বিশ্বের মানুষ এবং চিকিৎসকেরা চিকিৎসাপেশার নৈতিকতা নিয়ে প্রবলভাবে আলোড়িত। এর অভিঘাতে এই নতুন কোড অফ এথিক্সগুলো জন্ম নেয়। ভারতে এর বিশেষ কোন অভিঘাত সৃষ্টি হয়নি। ফলে তেমনভাবে প্রভাবও পড়েনি।

ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (২২-২৯ ডিসেম্বর, ২০০১) প্রকাশিত হয়েছিল “Medical oaths and declarations” শীর্ষক প্রবন্ধ। এখানে বলা হল – “The increasing complexity of healthcare arrangements and interagency collaboration, and the need to look at rationing resources, has forced the medical profession to re­examine its core values.” ২০০৪ সালে প্রকাশিত স্টিভেন এইচ মাইলস-এর লেখা The Hippocratic Oath and the Ethics of Medicine-এ জোর দেওয়া হয়েছিল “The status and rights of persons with mental illness or contagious disease is not known.” (পৃঃ vii) সঙ্গে এটাও বলা হয়েছিল – “It comes from an ancient culture that, though ancestral to ours, was very different.” (p. v) Different হবার স্বীকৃতি চরক শপথে নেই। আমরা একে সরিয়ে রেখেছি। রাষ্ট্র সমস্তকিছুকে সমসত্ত্ব করতে চায়।

২০০৬ সালের জেনেভা ডিক্ল্যায়েরেশনকে গ্রহণ করেছে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। এর সর্বশেষ রূপ এরকম –

Declaration of Geneva (WMA, 2006)

At the time of being admitted as a member of the medical profession:

I solemnly pledge to consecrate my life to the service of humanity;

I will give to my teachers the respect and gratitude that is their due;

I will practise my profession with conscience and dignity;

The health of my patient will be my first consideration;

I will respect the secrets that are confided in me, even after the patient has died;

I will maintain, by all the means in my power, the honour and the noble traditions of the medical profession;

My colleagues will be my sisters and brothers;

I will not permit considerations of age, disease or disability, creed, ethnic origin, gender, nationality, political affiliation, race, sexual orientation, social standing or any other factor to intervene between my duty and my patient;

I will maintain the utmost respect for human life;

I will not use my medical knowledge to violate human rights and civil liberties, even under threat;

I make these promises solemnly, freely and upon my honour.

শেষ কথা

ক্রমপরিবর্তনশীল চরিত্রই মেডিসিন, জ্ঞান, সমাজ এবং এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ মেডিক্যাল এথিক্সের জীয়নকাঠি। এভাবেই সমাজ ও জীবন এগোয়। পুরাতনের আরাধনার জন্য তাকে নতুন মোড়কে নির্মাণের পেছনে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য কাজ করে। আমরা এই সময়ের সাক্ষী।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, প্রাচীন মেডিসিনের মান্য গবেষক পূর্বোদ্ধৃত এডেলস্টাইনের Ancient Medicine গ্রন্থে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে – হিপোক্রেটিসের ওথ পিথাগোরীয় দর্শনের উপজাত – আধুনিক গবেষকদের একটি শক্তিশালী অংশ ভুল প্রমাণ করেছেন বা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। স্টিভেন এইচ মাইলস-এর পূর্বোক্ত পুস্তকে মাইলস বলছেন – “most scholars of ancient Greece are at least skeptical of the claim that the Oath written by Pythagorean philosophers.” (পৃঃ ৩০) আমি একজনমাত্র গুরুত্বপূর্ণ গবেষকের গবেষণাপত্রের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি – “Ludwig Edelstein's influential but disputed hypothesis that the Oath belongs to a Pythagorean context fails to account satisfactorily for this feature of the Oath: the Oath's concluding prayer and imprecation do not correspond to the aspirations shaped by a Pythagorean belief in the transmigration and reincarnation of the soul after death.” (H. Von Staden, “"In a pure and holy way:" Personal and professional conduct in the Hippocratic Oath”, Journal of the History of Medicine and Allied Sciences, 1996, 51(4): 404-437) আধুনিক চিকিৎসক এবং গবেষকেরা একে নাকচ বা অগ্রাহ্য করেননি।

আমরা কি চরকের ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে সক্ষম? না কি একটি কল্পিত, ছেদহীন, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতবর্ষকে প্রতিষ্ঠা করার অতিরাষ্ট্রিক উদ্যোগকে প্রশ্নহীন আনুগত্যসহ মেনে নেব?

(এ প্রবন্ধটির একটি সংক্ষিপ্ত এবং ভিন্নতর ভার্সন কয়েকদিন আগে ডক্টরস ডায়ালগ ওয়েবজিনে প্রকাশিত হয়েছে। তারপরে আরেকটি বৃহত্তর এবং পূর্ণতর ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে গুরুচণ্ডালী ওয়েবজিনে।))

0 Comments

Post Comment