“পুতুল নেবে গো পুতুল / আমার এ ছোট্ট ঝুড়ি এতে রাম রাবণ আছে /”- ভানু পেলো লটারি ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এই গান গাইতে গাইতে রথের মেলায় পুতুল ফেরি করছেন। ঝুড়িতে করে পুতুল বিক্রির এই দৃশ্য শুধু সিনেমায় নয়, বাস্তবেও ছিল। পাড়ায় কিংবা মেলায় নিজের জমানো পয়সায় পছন্দের পুতুল কিনতে পারলে বাচ্চাদের আনন্দের শেষ থাকত না। সেই পুতুলের বিয়ে ঘিরে কত ঘটা। কিন্তু এ সব-ই আজ অতীত। এখন বাচ্ছাদের জগৎ মোবাইলকে ঘিরেই। এ যুগের শৈশব পুতুল খেলতে শেখেনি। আধুনিক প্রজন্মের কাছে পুতুলের ঐতিহ্য আজ ম্লান ।
বহুকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পুতুল তৈরি হচ্ছে। মূলত মায়েরা মেয়েদের খেলার জন্য কাপড় বা মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিতেন। পরবর্তীতে শিল্পীর হাতে পুতুল তৈরির শুরু। যা জীবন জীবিকার অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং বিক্রির জন্য বাজারে আসে। দক্ষ কারিগরের পেশাদারী হাতে পুতুল তৈরি একদিন রীতিমতো শিল্পকর্ম হয়ে উঠল। বাংলার পুতুলের কদর বিশ্বজোড়া। এখানে যত রকমের পুতুল মেলে, তা আর কোথাও মেলে না। কালের নিয়মে বদলেছে পুতুল গড়ার উপাদান । তবে পুতুল তৈরির উপকরণ যাই হোক না কেনো, অঞ্চল ভেদে পুতুলের গড়নের বিশেষত্ব চোখে পড়ার মত। যদিও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাতে বিবর্তন এসেছে। বাংলার পুতুল আজ আর ছোটদের মন ভোলানো খেলনা নয় এমনকি ঘর সাজানোর উপকরণও নয়। তবে, তা লোকসংস্কৃতির ধারাকে বহন করে চলেছে ।
বাংলার পুতুলের চেহারাতে যত বৈচিত্র্য নামেও ঠিক ততটাই। প্রত্যেকেই নিজ বৈশিষ্ট্যে ঐতিহ্যশালী। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ইতিহাস আছে। এ রকমই একটি পুতুল ‘রানি পুতুল’ - যার বিচরণ ছিল রানির মতন। এই পুতুল ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বহুদিন আগে হাওড়া জেলার মৃৎ শিল্পীরা দুখোল ছাঁচের এক ধরনের পোড়ামাটির মেয়ে পুতুল বানানো শুরু করেন। এর গড়ন খানিকটা ষষ্ঠী পুতুলের মত হলেও এটি ষষ্ঠী পুতুল নয়। পুতুলের রং গোলাপি। শিল্পীরা আদর করে এই পুতুলের নাম দিয়েছিলেন ‘রানি পুতুল’। বাংলার পুতুলের সাম্রাজ্যে রাজা-রানিদের অভাব নেই। কিন্তু বাকি রানিদের সঙ্গে হাওড়ার ‘রানি পুতুলের’ - রানির কোনো মিল নেই। জনশ্রুতি এমন টাই যে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ারই ছিলেন রানি পুতুলের অনুপ্রেরণা। তাঁর পোশাক আশাক নকল করেই পুতুলের সাজ। রানির গাউনের মত পুতুলের পরনে ঘাগরা। পুতুলের মুখে শিল্পীরা এনেছিলেন ভিক্টোরিয়ার মুখের আদল। তখন থেকেই গ্রামীণ লোকশিল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন ‘কুইন ভিক্টোরিয়া’। আর মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল সকলের আদরের ‘রানি পুতুল’। এক সময় রানি পুতুলের রমরমা থাকলেও, হতাশার কথা এই যে, সময়ের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী- ‘রানি পুতুল’। কিন্তু বাংলার লোকশিল্পে রানি পুতুল বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। আজও পুতুল নিয়ে লোকশিল্পের যে গবেষণা, সেখানে আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে রানি পুতুলের।
এক সময় হাওড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মৃৎ শিল্পীরা ঘরে ঘরে রানি পুতুল বানাতেন। এখন তা হয় হাতে গোনা কয়েকটা অঞ্চলে। বর্তমানে ছয় ইঞ্চি উচ্চতার পুতুল তৈরি হয় খুবই কম। চার ইঞ্চি মাপের রানি পুতুলই বেশি হয়। অনেকের ছাঁচ ভোঁতা হয়ে যাওয়ায় পুতুলের গায়ের কাজের সূক্ষ্মতা তেমন ফোটে না। যে কটি পুতুল তৈরি হয়, তা মূলত স্থানীয় মেলাতে বিক্রির জন্য। অনেক সমস্যার মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী আছেন যারা রানি পুতুলের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছেন।
পুতুল রানির খোঁজে পৌঁছে গিয়েছিলাম শ্যামপুরের বড় ঘুঘুবেশিয়ায়। সারা গ্রাম ঘুরে একজনই মাত্র মহিলার দেখা মিলল যিনি এখানে রানি পুতুল বানান। ইনি যোগমায়া পাল। এখন থেকে পুতুল বানাচ্ছেন, বিক্রি করবেন পৌষ সংক্রান্তির মেলায়। গ্রামের তিন দিনের মেলায় তিনশ বড় আর সাতশ ছোটো সব মিলিয়ে মোট এক হাজার পুতুল বিক্রি তাঁর লক্ষ্য। শুধু পুতুল তৈরি করে সংসার চলে না। তাই অন্যত্র টব তৈরির কাজ করেন। অবসর সময়ে অল্প অল্প করে পুতুল বানিয়ে রাখছেন। বাড়তি রোজগারের আশায়। এই গ্রামেরই দেবু পাল কয়েক বছর আগেও চুটিয়ে রানি পুতুল বানাতেন। অসুস্থতার কারণে ব্যবসার হাল ছেলেদের হাতে। তাঁদের কথায় জানা গেলো এই পুতুলের বাজার নেই। ফলে এখন আর তাঁরা পুতুল তৈরি করেন না। এদের কাছেই খোঁজ পাওয়া গেলো চেঙ্গাইলের চককাশী পাড়ার মৃৎ শিল্পীদের, যারা এখনও রানি পুতুল গড়ছেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দু’টি মাত্র বাড়িতে রানি পুতুলের খোঁজ মিলল। এখানকার একজন মৃৎ শিল্পী শহরে গাড়ি চালান। পুতুল বানান ছুটির অবসরে। তবে অন্য শিল্পী প্রতিমা পাল, খানিকটা আসার কথা শোনালেন। “এই পুতুলের বাজার এখনও আছে। অনেকেই বাইরে থেকে এসে কিনে নিয়ে যান বিক্রির জন্য । কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারি না । পুতুল গড়তে পরিশ্রম অনেকটাই। প্রথমে মাটির ছাঁচে পুতুল তৈরি করে তাকে শুকোনো হয়। তারপর পুড়িয়ে শেষে গোলাপী রং করা হয়। বাজারে টিকে থাকতে কোনও কোনো শিল্পী রং এর সঙ্গে অভ্র মেশাচ্ছেন। আমরা অভ্র দিই না। আমি বড় দু’ হাজার, ছোটো তিন’ হাজার। বছরে মোট হাজার পাঁচেক পুতুল বানাই। বড়ো রানি পুতুল আটশ টাকা ‘শ’। ছোটো গুলো তিনশ থেকে চারশ টাকা ‘শ’। ছোটো পুতুল লোকে জোড়ায় কেনে মাটির পালকিতে বসানোর জন্য”। তিনি আরও জানালেন পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি এই পুতুল গড়ছেন। ছেলেদের ছোটবেলার বায়না মেটাতেই পুতুল তৈরির শুরু। আজ সেটাই ব্যবসার চেহারা নিয়েছে। বেশিরভাগটাই পাইকারি বিক্রি করেন। সামান্য কিছু পুতুল বেচেন গ্রামীণ মেলায়। সব টুকু বিক্রি করতে পারলে বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু পুতুল বানাতে যে পরিশ্রম এবং সময় লাগে তাতে মাটির টব, অন্যান্য খেলনা বা ঠাকুর গড়লে আয় কয়েক গুন বেশি। ফলে রানি পুতুল বানানোতে উৎসাহ হারিয়েছেন শিল্পীরা। এই পুতুল বানানো প্রতিমা দেবীর একটা নেশা, তাই একেবারে ছেড়ে দিতে পারেননি। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে রানি পুতুল আদৌ তার ঘরে আর তৈরি হবে কিনা তিনি জানেন না। একই সুর উলুবেড়িয়ার তাঁতিপাড়ার দিপালী পালের গলাতেও। “আমাদের গ্রামে বেশ কয়েক ঘর পালেদের বাস। সবাই এখন লাভের আশায় মাটির হাঁড়ি, টব, খেলনা, পালকি, মাটির ঘোড়া ইত্যাদি তৈরি করছি। প্রশান্ত পাল, শংকরী পাল আর আমি - আমরা এই তিন ঘর এখনও রানি পুতুল বানাই। বর্তমানে আমার ছাঁচ ভেঙে যাওয়ায় আমি রানী পুতুল বানাতে পারছি না। অন্য ধরণের মেয়ে পুতুল বানাচ্ছি। তবে ছাঁচে এখন অনেক বদল এসেছে। পুরোনো দিনের রানি পুতুল পাওয়া মুশকিল”।
হারিয়ে যাচ্ছে লোকশিল্পের ঐতিহ্য হাওড়া জেলার রানি পুতুল। একে বাঁচাতে, বেসরকারি উদ্যোগে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে মহিলা মৃৎ শিল্পীদের রানি পুতুলের নতুন ছাঁচ উপহার দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার শিল্পীরা এতে কতটা আগ্রহ দেখান। তবে বাংলার লোকসংস্কৃতির এই ধারাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি বদান্যতা প্রয়োজন। সারা দেশের বড় বড় হস্তশিল্প মেলাগুলিতে রানি পুতুল বিক্রির ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রেগুলিতে বিক্রির জন্য লাভদায়ক দামে রানি পুতুলের সরকারি ক্রয় জরুরী। রানি পুতুল গড়ায় উৎসাহ দিতে প্রদর্শনী ও কর্মশালার আয়োজন করা দরকার। ভবিষ্যৎ জানা নেই! কিন্তু লোকশিল্পের গবেষকরা আশাবাদী। হাওড়া জেলার নিজস্ব লোকশিল্প এই রানি পুতুল বেঁচে থাকবে, একদিন আবার ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব।