'আমি অনুমান করি বর্তমান দেশের লোকের যে চরিত্র...তাহাতে এই লোকদের ভিতর হইতে যাঁহাদিগকে ছাঁকিয়া আনিয়া নির্বাচিত করা হইবে, তাঁহারা ক্ষমতা হাতে পাইবামাত্র প্রথমেই গোহত্যা সমস্যা বিষয়ে প্রশ্ন তুলিবে।'- ভারতবাসীদের সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণীটি প্রায় ১৩৮ বছর আগে করেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (২২ জুলাই ১৮৪৭- ৩ নভেম্বর ১৯১৯)। তখন তিনি কলকাতা জাদুঘরের অ্যাসিসট্যান্ট কিউরেটর। লণ্ডনে অনুষ্ঠিত একটি ঔপনিবেশিক শিল্প প্রদর্শনীর প্রতিনিধি হিসেবে সেকালের সরকার বাহাদুর তাঁকে বিলেতে পাঠান। ১৮৮৬ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নয় মাস তাঁর ইওরোপ ভ্রমণের বিবরণ দেশে ফিরে 'ইণ্ডিয়ান নেশন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ইংরেজি ভাষায় লিখতে হয়েছিল তাঁকে। দেড় বছর ধরে 'এ ভিজিট টু ইউরোপ' নামে এটি প্রকাশিত হয়, পরে কিছুটা সম্পাদনা করে বই আকারেও প্রকাশিত হয়। নব্বই বছর পরে এর অনুবাদ করতে গিয়ে পরিমল গোস্বামী লেখেন: 'এর পাতায় পাতায় তাঁর দেশপ্রেম এমন আশ্চর্য রূপ গ্রহণ করেছে, যা সে যুগের অন্য কোনো বাঙালীর মধ্যে আমি খুঁজে পাইনা।' গো-সম্পর্কিত অংশটুকুর মূল ইংরেজি বয়ান পরিমলবাবু নীরোদ সি চৌধুরীকে পাঠিয়েছিলেন। চৌধুরী মশাই তখন 'হিন্দুস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড' কাগজে লিখতেন। সেখানে ত্রৈলোক্যনাথের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তাঁর মন্তব্য ছিল: 'If this is not prophetic, i don't know what is.' ত্রৈলোক্যনাথের যুক্তির নিগড়ে বাঁধা গো-চিন্তা সেকালের মতো আজও সমান প্রাসঙ্গিক। গো-হত্যা নিবারণ বিষয়ে তৎকালীন অতিউদ্যোগ নিয়ে তিনি কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। গো-নিধন বন্ধ হলে হিন্দু ব্রাহ্মণ হিসেবে তিনি খুশি হবেন জানিয়ে বক্রোক্তি করছেন এইভাবে: 'যে জাতির মধ্যে এত চারণভূমি আছে যে গোরুর সংখ্যা সীমাহীন বৃদ্ধি পাইলেও কোনও অসুবিধা হইবে না, তাহাদের মধ্যে গোরক্ষা আন্দোলন সফল হইতে পারে। ...ভারতবর্ষ হইতে সমস্ত মানুষকে বিদায় করিয়া সমস্ত মহাদেশটিকে শুধু গোরুতে পূর্ণ করিয়া তুলিলেও যত গোরু, তত খাদ্য মিলিবে কল্পনা করা অসম্ভব।'
২.
রামায়ণের মহানায়ক শ্রীরামচন্দ্রের আর এক নাম 'রাম হায়দার' যদি বলি তবে কি সেটা সোনার পাথরবাটির মত শুনতে লাগবে? অবিশ্বাস্য মনে হবে? ইয়েমেন দেশে প্রচলিত রামায়ণ কাহিনির শরণাপন্ন হলে এই ধোঁয়াশা কেটে যেতে বাধ্য। তার জন্য অবশ্যপাঠ্য ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে আরব ভূখণ্ডে লেখা একটি বই- 'তারিখ আল মুস্তাবসির', লেখক ঐতিহাসিক ইবন আল মুজাহির। ইতিহাস চর্চার খাতিরে তিনি মক্কা থেকে লোহিত সাগরের তীর ধরে ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন, সংগ্রহ করেছেন তথ্যাদির পাশাপাশি লোককথাও। ইয়েমেনের সেকালের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মহম্মদ বিন মাসুদের পিতা মুবারক ইল শারোনি মৌলা এই পর্যটক-ঐতিহাসিককে 'রাম হায়দারে'র কাহিনিটি শুনিয়েছিলেন: প্রাচীন কালে ইয়েমেনের এডেন নামক জায়গাটি ছিল যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের নির্বাসন স্থল। দানবরাজ দশশির তাঁর বন্দীদের এখানে নির্বাসন দিতেন। এডেনে আছে অসংখ্য পাহাড়। কোনও একটির মুখে আছে কূপ- তার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগাযোগের একটি উপযুক্ত সুড়ঙ্গপথ আছে। দশশির দানব অযোধ্যা প্রদেশ থেকে রাম হায়দারের স্ত্রীকে খাট সমেত চুরি করে আকাশপথে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। জোবেলসিরা পাহাড়ের মাথায় বিশ্রাম নেবার সময় দানবরাজ দশশির রাম হায়দারের স্ত্রীকে বলেন: 'আমি তোমার মানুষের শরীরটাকে একটা জ্বীনে বদল করব, তাই তোমাকে চুরি করেছি।' এর ফলে দুজনের মধ্যে বেধে গেল তীব্র বচসা!
সীতা-হরণের সংবাদ পেলেন হনবীত। তিনি বানররূপী এক ইফরীত। এক রাত্রির কঠিন পরিশ্রমে উজ্জইন-বিক্রম নামের নগর থেকে সমুদ্রের নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে জোবেলসিরার কেন্দ্রে এসে পৌঁছালেন তিনি। কূপের মুখ দিয়ে প্রস্থান করে হনবীত দেখতে পেলেন পাহাড়ের মাথায় একটা কাঁটা গাছের নিচে রাম হায়দারের স্ত্রী ঘুমিয়ে আছেন। "সে তৎক্ষণাৎ তাহাকে পিঠে তুলিয়া সেই সুরঙ্গ-পথে ভোরবেলা উজ্জইন বিক্রমেতে আসিয়া পৌঁছিল এবং তাহাকে তাহার স্বামী রাম হায়দারের হাতে সমর্পণ করিল। রাম হায়দারের দুইটি সন্তান হইল লথ (Luth) ও কুশ।"- লিখেছেন ত্রৈলোক্যনাথ, তাঁর উপরে উল্লিখিত গ্রন্থে। ১৮৮৬ সালের এই ভ্রমণ বৃত্তান্তে দেখা যায় তিনি এডেন বন্দরে পৌঁছে এই চমৎকার রামায়ণ-কাহিনি শুনে বেশ বিস্মিত, সেই সঙ্গে তা লিখে নিতেও ভুল করেননি। কাহিনিতে বর্ণিত সুড়ঙ্গের প্রসঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথ বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি: 'প্রাচীন হিন্দুদের বিস্ময়কর সব ক্রিয়াকলাপ বা কীর্তি আবিষ্কারের জন্য আমার দেশের যাঁহারা কল্পনার বিস্তারে আনন্দলাভ করিয়া থাকেন, তাঁহারা ইহা শুনিয়া খুশি হইবেন নিশ্চিত।' দেড়শ বছর প্রায় কেটে গেল, ত্রৈলোক্য-কথিত কল্পনার বিস্তার এখন প্ল্যাস্টিক সার্জারিতে উন্নীত হয়েছে, গণেশের উদাহরণে আনন্দ আহরণ করছেন রাষ্ট্রের প্রধান!
আলোচ্য আরবি লোক-রামায়ণে খেয়াল করতে হবে 'দশশির' নামটিকে- সেখানে স্পষ্ট দশ মাথাওয়ালা কোনও ব্যক্তিই এই দানবরাজ। 'হনবীত' যে হনুমান, 'লথ ও কুশ' যে সীতার জমজ দুই সন্তান লব-কুশ এগুলো বলে দিতে হবে না। শুধু সেই কাহিনির সময়-বাক্সে একই সঙ্গে বন্দী হয়ে পড়েছে অযোধ্যা আর উজ্জয়িনী। এটা প্রমাণ করে আরব অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ব্যবসায়িক যোগ ছিল যা পরিণত হয়েছিল সাংস্কৃতিক যোগের আন্তর্জাতিক আন্তরিকতায়। ব্যবসার লেনা দেনার ছোট বৃত্ত ছাপিয়ে এক দেশের মহাকাব্যের কাহিনিকে আত্মস্থ করে নেয় অন্য দেশের মানুষ, তথাকথিত 'ধর্ম' সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না।
রামায়ণ কাহিনির এই আরব দেশীয় সংস্করণের কথা এদেশের পণ্ডিতবৃন্দ জানেন না, তা নয়। কিন্তু অধুনা শ্রীরামের মানসম্মান রক্ষার দায়িত্ব যে বীরপুঙ্গবেরা নিয়েছে, সংখ্যালঘু মানুষের মুখে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি শোনার জন্য যারা অপমান, লাঞ্ছনা, শারীরিক নিগ্রহ করতে পটু হয়ে উঠেছে, তাদের কর্ণকুহরে এই তথ্যগুলি প্রবেশ করানোর দায় বিদ্যাজীবী সমাজকে নিতে হবে; যেমনটা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় নিয়েছিলেন।