এরপর আর কি বলবে। অগত্যা বাসন্তী ঘোড়াটা তুলে নেয়।
ঘরে ছেলেটা কত কি চায়। গরীব মানুষের কি অত চাইতে আছে? বাবুদের ঘরে কাজ করে যা পাওয়া যায় মাইনের বাইরে তাই ঘরে নিয়ে তোলে সে। তেমনই একটা ঘোড়া সে আজ পেয়ে খুব খুশি। ছেলেকে দেবে। নিজে আর কিইবা কিনে দিতে পারে সে। বাসন্তী ঘোড়াটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। বেশ বড়সড়। পিঠের ওপর কেমন বেল্ট লাগানো। বসার জায়গা বেশ গদি দেওয়া। তবে তা ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়।
বউদিমণির বাড়িতে জিনিসের অভাব নেই। টুকটাক এটা ওটা প্রায়ই দেয় বউদিমণি। আর দেবে নাই বা কেন বলো? কাজ তো কম করে না সে, নিজের মত ভেবেই তো করে। অন্য কাজের মানুষ তো সে নয় যে একটা বাড়তি কাজ বললেই মুখ বেজার হবে।
বউদিমণি মানুষটা ভালো। ঘরের কলাটা মুলোটা বাড়তি জিনিসপত্র ফেলার মত হলে বাসন্তীর ভাগ্যে তা জুটে যায়। তাই বউদিমণি যখন বলল ঘোড়াটা নিয়ে যেতে তখন আর না করেনি সে। আর নেবে নাই বা কেন বলো কমদিন তো হলো না এ বাড়িতে। কোনকালে কাজে ঢুকেছে সে। তখনও মিনসের সঙ্গে বে থা হয়নি। বিয়েতেও বউদিমণি কাপড়চোপড় দিয়েছে মিথ্যে বলব না। মিনসে প্যান্ডেলের কাজ করে বড় বড় বাঁশ টাঙিয়ে তার উপর চড়ে ত্রিপল ফেলে প্যান্ডেল বাঁধে। বেশ কাজ কম্মো করছিল।
তকন নেশাভাঙ করত নি। ঐ অনামুকো মিনসে বুদন ওকে নেশা ধরালে। সে নি কত অশান্তি গো। কিন্তু মিনসে শুধরোল নি গো। নিত্যদিন ঘরে অশান্তি। এরমধ্যে করোনা শুরু হল। তখন ও বাইরে কাজে হঠাৎ নকডাউন শুরু হলো। বাচ্চা নিয়ে কি অবস্তা আমার। এসব ঘরসংসারের নানা বলার একটাই মানুষ তার। সে হলো বউদিমণি। বাসন্তীর নানা কথা শুনতে শুনতে আড়ালে বাড়ির কর্তা সোমনাথ বলে, ওর যত কথা কি এ বাড়িতে তোমার কাছে? আরও তো কবাড়িতে কাজ করে সেখানে কি করে? তুমিও পারো বাপু এসব শুনতে? স্বপ্না বলে ওঠে, কি করবে বলো আমার কাছে দুটো কথা বলে ও শান্তি পায়। তাই না বলা যায় না?
সোমনাথ জানে এব্যাপারে কথা বলা অর্থহীন। তাই চু্প করে যায়।
ছেলেকে নিয়েই বউদির বাড়িতে কাজকম্মো করতে যায় এখনও।
আজ ওর স্বামী ঘরে আছে তাই ওকে রেখে এসেছে। সে একদিন গেছে লকডাউনের সময় রোজ ছেলে কোলে নিয়ে কাজ বেরুতে হত। কি করবে বলো ঘরে দ্বিতীয় মানুষ নেই যে ছেলেকে রাখব। ঘর ত পাকা নয় ঝুপড়ির ঘর। পাশেই রাস্তা। শনশন করে গাড়ি যাচ্ছে শব্দ তুলে। আজ দিন ভাল বউদিমণি ঘোড়া দিল। তাই নিয়ে মনের আনন্দে বাসন্তী ঘর মুখো হয়। ছেলের তো ঐ ঘোড়া পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। কোথায় রাখবে ঠিক করতে পারে না। পাশের ঝুপড়ির থেকে সবাই উঁকিঝঁকি মারে। আর মার বে নাই বা কেন বল অত বড় ঘোড়া দেখে? মালতীর মা আর চেপে থাকতে পারে না বলে উঠে, কোন বাড়ির বউদি দিলে গো ? উকিলবাবুর বাড়ি বুঝি?
না। মালতী বলে ওঠে।
মাষ্টারের বাড়ি বুঝি?
না, যে বাড়িতে এতককাল কাজ করছি সেই দিদিমণির বাড়ি গো।
অ। ও বাড়ির দাদাবাবু শুনেছি মস্তবড় চাকরি করে। দেবে নাই বা কেন বলো?
থাকলিই বা দেয় কে শুনি? দিদিমণি মস্ত ঘরের মেয়ে তায় মনটা বড়। বাসন্তী বলে ওঠে।
এত কথা যাকে নিয়ে সে তখন ঘোড়া নিয়ে মশগুল। তার এদিকে মন নেই। সে যেন রাজপুত্র। সারাদিন রাত কাছ ছাড়া করে না ঘোড়াটাকে। রাতে ছেলেকে দুটো ভাত খাইয়ে নিজেদের খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। কারণ কেরোসিনের যা দাম তাতে কুপি বেশি রাত অবধি জ্বালাতে পারে না। আর সত্যি কথা বলতে কি ভোর থাকতে উঠতে হয় কাজের বাড়ি যাব বলে। সারাদিনের পরিশ্রমে ঘুম আসে গভীর। তারমধ্যে গাড়ির সাঁইসাঁই শব্দ তুলে ছুটে যায়। গাড়ির শব্দে মাঝে মধ্যে ঘুম ভেঙে যায়। তখন ছেলের গায়ের কাঁথাটা ভাল করে টেনে দেয়। বাসন্তী। সেদিনও ভাল করে ছেলের গায়ে কাপড় টেনে দিয়ে শোয়।
ঘুমের মধ্যে এক আশ্চর্য জগতে চলে যায় ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে রাজপুত্র। চারদিক অবাক করা সব ফুলের মেলা। ক্রমশঃ গভীর জঙ্গলের পথে ঢুকে পড়ে সে। আশ্চর্য জীবজন্তু ফুল ফল ঝুলছে। কোমরে গোঁজা তরোয়ালটা বের করে যেই না এক কোপ তখনই বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সবার। চারদিক হৈ চৈ। ঝুপড়ির মানুষজন কিছু বুঝতে পারে না। কি হলো?
বাসন্তীর গলাফাটা কান্নায় সবাই ছোটে ওদিকে। একটা বড় মোটর গাড়ির নীচে তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাসন্তীর ছেলের দেহটা থেঁতলে গেছে গাড়ির তলায়।
তারপর যা হয়, অনেক পরে পুলিশ আসে। তদের ঘিরে লাশ আটকে বিক্ষোভ দেখায় বস্তির মানুষজন। রাস্তা অবরোধ করে দেহ নিয়ে। অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে না গড়ায় এলাকার কাউন্সিলর নেমে পড়ে আসরে দূকল রক্ষা করে লাস তুলে দেয় পুলিশের হাতে।
বিরোধীরা গাড়িটা কার? কে চালাচ্ছিল? কি ভাবে ফুটপাতে উঠে এ কান্ড ঘটালো? এসব প্রশ্ন তুলে সোরগোল ফেলে দেয়। মিডিয়াও টি আর পি বাড়াতে শিশু মৃত্যু, গাড়ির মালিক কে এসব বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সুর বদলায়। বিরোধীরা অভিযোগ করে বিজ্ঞাপন হারাবার ভয়ে নাকি মিডিয়া অন্য সুর গাইছে।
এরমধ্যেই একটা ছোট্ট ঘটনা নিয়ে এত হল্লার কি আছে? বিরোধীরা এমন ভাব করছে যেন এরকম ঘটনা প্রথম ঘটল দেশে। পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানিয়ে দেয়। পুলিশ সিসি টিভি দেখে অপরাধীকে সনাক্ত করে । যেহেতু পুলিশ বসে থাকে না তাই প্রকৃত অপরাধী গ্রেপ্তার হয়। তারপর যা হয় আর কি থানায় ঘনঘন ফোন আসতে থাকে। জানা যায় মন্ত্রী পুত্র মদ্যপ অবস্থায় ডান্সবার থেকে ফিরছিল। বেসামাল হয়ে গাড়ি উঠে পড়ে ফুটপাতে। আইন আইনের পথেই চলে তাই যথাসময়ে অপরাধী আদালতে পেশ হয়। যেহেতু তদন্তের স্বার্থে পুলিশ হেফাজতে চায় না তাই খুব স্বাভাবিক নিয়মেই জামিন পেয়ে যায়।