আমার মনে পড়ে ২০০৪ সালের কথা। বয়স তখন চৌদ্দো। তৎকালীন রাজনীতির কোনও ধারণা আমার ছিল না। আমার বাবা ছিলেন একনিষ্ঠ কংগ্রেস কর্মী। তিনি দলকে অন্ধভাবে ভালোবাসতেন এবং কখনও তার সমালোচনা করেননি। তিনি সমস্ত নির্বাচনী সমাবেশ বা সভা-সমাবেশে যেতেন। আমিও আমার বাবার পথ অনুসরণ করেছি, যদিও রাজনীতি বোঝার বয়স আমার ছিলনা। নির্বাচনী সমাবেশ বা সভা আমার কাছে বিনোদনের উৎস ছিল। আমি স্থানীয় এলাকায় রাজনৈতিক সমাবেশ বা মিটিঙে বাবার সাথে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতাম। ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রণব মুখার্জি ছিলেন আমাদের এলাকার প্রার্থী। তাঁর অতীত রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। আমি কেবল জানতাম তিনি মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ছিলেন না। তিনি বীরভূম জেলার মীরাতি থেকে এসেছেন। প্রণববাবু খুবই শালীনও মার্জিত বক্তা ছিলেন এবং মানুষকে সুন্দরভাবে বরণ করেছিলেন, যা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের আগে পর্যন্ত তিনি জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের জনগণের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ ছিলেন। আমরা জানতাম বহরমপুরের বিখ্যাত সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী তাঁকে এনেছিলেন। তাঁর কারণেই জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ প্রণববাবুকে গ্রহণ করেছিলেন। এলাকার মানুষ তাঁর অভিপ্রায় সম্পর্কে সন্দেহ না করেই ভূমিপুত্র হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন। মানুষ তাঁকে কেবল সম্মানই দেননি, তাঁর প্রতি সুগভীর বিশ্বাসও ছিল। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে অনুন্নত ও দরিদ্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত মুর্শিদাবাদের জনগণ তাঁকে আশা ও প্রগতির এক নতুন অবতার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি তিনি ‘নদী ভাঙন প্রতিরোধ’-এর জন্যও প্রচারও করেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি যদি নির্বাচনে জয়ী হন তবে তিনি গঙ্গার ক্ষয়রোধের জন্য কাজ করবেন।
তীব্র দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা,অনগ্রসরতা এবং আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ এবং বিশেষত জঙ্গিপুর অঞ্চলের মানুষ গঙ্গার ভাঙ্গনে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করেন। ফারাক্কা ব্যারেজের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত উত্তর মুর্শিদাবাদের অঞ্চলগুলি প্রতিবছর বর্ষাকালে ভয়াবহ পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়। বর্ষার সময়, এলাকাগুলিতে মানুষজন তাদের বাড়িঘর ধ্বংসএবং জীবিকা নির্বাহের তীব্র আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করেন। প্রতি বছর গঙ্গায় তাঁদের ঘরবাড়ি ভেসে যায়। এটি একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার কোনও পরিবর্তন নেই।
২০০৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময়, প্রণববাবু জঙ্গিপুরের জনগণের কাছে নতুন আশা নিয়ে এসেছিলেন। অঞ্চলটি কেবলমাত্র রাজ্যে নয়, দেশেও সর্বাধিক জনবহুল ও অনগ্রসর একটি অঞ্চল যেখানে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষ একসাথে বাস করে। জেলার নব্বই শতাংশ মানুষ বিড়ি শ্রমিকের করুণ জীবন যাপন করছেন। তাঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজ, বিড়ি তৈরি এবং অন্যান্য নৈমিত্তিক কাজের ওপর নির্ভর করেন। প্রণববাবু তাঁর গোটা নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শন করেন এবং নদী ভাঙনের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে ঘরে প্রচার করেন। এমনকি তিনি ওই মারাত্মক সমস্যার বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার জন্য বাম-শাসিত রাজ্য সরকারেরও সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাকে ভোট দিন, আমি নদী ভাঙন প্রতিরোধ করব।’ মানুষ চিন্তা না করেই তাঁকে সমর্থন করেছিলেন।
২০০৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের পরে প্রণববাবু সাংসদ নির্বাচিত হন এবং তারপরে ইউপিএ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। তিনি নবনির্বাচিত সরকারে প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দফতরের মতো বিভিন্ন মন্ত্রকে পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ২০০৯ সালে, তিনি আবার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করেন।মানুষ আবার তাঁকে বিশ্বাস করেন এবং বিপুল ভোটে তাঁর জয় সুনিশ্চিত করেন। তাঁর বিজয়ের পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে শীর্ষ নীতি নির্ধারক হয়ে ওঠেন। তিনি মুর্শিদাবাদে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটি শাখা স্থাপনে সহায়তা করেন, বিড়ি শ্রমিকদের জন্য একটি পিএফ অফিস এবং একটি হাসপাতাল চালু করেন এবং এই অঞ্চলে একটি সেনা রেজিমেন্ট কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তিনি নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে তাঁর প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন। জঙ্গিপুরের লোকেরা প্রণববাবুর ‘নদী ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্প’-এর প্রতিশ্রুতি ভুলে তাঁর সাফল্য উদযাপন করেছেন।
প্রতি বছরের মতো এবারও জঙ্গিপুর আসনের সামসেরগঞ্জের ধানঘোড়ার জনগণ তার অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতির কথা মনে করছেন। এ বছর করোনা অতিমারী জেলার মানুষের জীবন সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলেছে। মানুষ একদিকে মরিয়া হয়ে কাজের সন্ধান করছে, আর অন্যদিকে সামসেরগঞ্জ ব্লকের ধানঘোড়া, চাচন্দা, শিবপুর ও ঔরঙ্গাবাদ গ্রামগুলি গঙ্গায় ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাঁরা বাড়িঘর এবং সম্পত্তি হারিয়েছেন। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ বিড়ি শ্রমিক এবং তাঁদের অনেকেই গ্রামে নতুন এসেছেন। অধিকাংশ পরিবারই সম্প্রতি তাদের দুটি বা তিনটি ঘরের একতলা বাড়ি তৈরি করেছে। কোনরকম জল সরবরাহ ও ন্যুনতম স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই।অঞ্চলটি অপরিছন্ন এবং ঘন জনবসতিপূর্ণ। জায়গাটি দেখে আমি শুধুই কষ্ট পাই ও অসহায় বোধ করি।
অগাস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে অনবরত বৃষ্টিপাতের কারণে গঙ্গা বিপজ্জনকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে। ভারী বৃষ্টিপাত এবং জল জমে থাকায় ধানঘোড়া গ্রামে বিপুল ভুমিক্ষয় হয়। কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ এখন এক দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় ৭০ টি বাড়ি গঙ্গার দুরন্ত জলে তলিয়ে গেছে। আরও ১০০ টি বাড়ি ধসের পথে। বাসিন্দারা তাদের সমস্ত হারাতে চলেছেন। তাঁরা সর্বস্ব হারিয়ে এখন নিঃস্ব।
বাকী বাসিন্দারা তাঁদের জিনিসপত্র বাঁচানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তাঁরা অন্যত্র ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের আশায় জানালা, দরজা এবং ইট খুলে নিয়ে তাঁদের বর্তমান বাড়ি ভেঙে ফেলছেন। তাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। তবে যাঁদের বাড়ি ইতিমধ্যে নদীতে তলিয়ে গেছে, তাঁরা সম্পূর্ণ নিঃস্ব। তাঁদের বেশিরভাগেরই ঘর তৈরির অন্য কোনও জমি নেই। এখন তাঁরা এক টুকরো জমি ও একটি বাড়ির সন্ধানে। পরিবারের সদস্য ও শিশুরা আতঙ্কে জেরবার। সমস্ত বয়সের মহিলারা এবং বিশেষত অল্পবয়সী মহিলারা ঘর ও কোনোরকম গোপনীয়তা ছাড়াই দুরবস্থায় বেঁচে আছেন। তাঁদের চোখে শুধুই যন্ত্রণা এবং হতাশার ছবি।তাঁদের একমাত্র জীবিকা বিড়ি বাঁধা যা বেঁচে থাকার জন্য ন্যুনতম অর্থটুকু সরবরাহ করে মাত্র।
এই বিপর্যয় শুধুই রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা সামনে এনেছে। ভুমিক্ষয় শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু করে অতিমারী চলাকালীন সরকার এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি। আসন্ন বিপদের কথা জেনেও গত কয়েক দশকে রাজ্য খুবই কম কাজ করেছে। প্রাক্তন সাংসদ আবুল হাসনাত খান ও সামসেরগঞ্জের শিক্ষাবিদ মি: জুলফিকার বলেছেন যে, সরকারী জল বিভাগ ফারাক্কা ব্যারেজের দক্ষিণ-পূর্বে ৮০ কিলোমিটার অবধি জলঙ্গীর দিকে এবং ফারাক্কা ব্যারেজের উত্তর-পূর্বে ৪০ কিলোমিটার অবধি নদীর তীর রক্ষার পরিকল্পনা করেছিল।দুর্ভাগ্যক্রমে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন না হয়ে তা শুধুই অফিসের নথিপত্রে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। স্থানীয় জনগণ এই প্রস্তাব এবং তার পরিকল্পনা সম্পর্কে অজ্ঞাত।
রাজনীতিবিদ ও পুলিশের সহায়তায় ভূমি মাফিয়া চালিত অবৈধ ইটভাটার কারণে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হয়েছে। বাসিন্দারা শুধুই এখন নদীর অতলে তলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। ধনী আরও ধনী হয়ে ওঠে এবং দরিদ্র ক্রমশই তাদের বাসস্থান, জীবিকা ও তাদের সন্তানের ভবিষ্যত হারাতে বসেছে। বিশ্ব এভাবেই দরিদ্র, নিপীড়িত ও নিঃস্বের দুঃখের কাহিনী রচনা করে। অনুবাদ:প্রবালভৌমিক