রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ পর্যায়ের একটা খুব অপরিচিত গানের কথাভাগ দিয়ে কথালাপ শুরু করি—
যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না,
তবে তুই ফিরে যা না।
যদি তোর ভয় থাকে তো করি মানা,
তবে তুই ফিরে যা না।
যদি তোর ঘুম জড়িয়ে থাকে গায়ে,
ভুলবি যে পথ পায়ে পায়ে।
যদি তোর হাত কাঁপে তো নিবিয়ে আলো,
সবারে করবি কানা।।
যদি তোর ছাড়তে কিছু না চাহে মন,
করিস ভারী বোঝা আপন—
তবে তুই বইতে কভু পারবি নে রে
এ বিষম পথের টানা।।
যদি তোর আপনা হতে অকারণে,
সুখ সদা না জাগে মনে,
তবে তুই তর্ক করে সকল কথা
করিবি নানাখানা।।[স্বদেশ]
প্রায় একশ বিশ বছর আগে রচিত এই গানটির বয়ান এমন যে সেদিনের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গণ্ডী ছাড়িয়ে আজকের দিনেও যাঁরা শ্রমিক কৃষকদের নিয়ে সংগ্রাম করেন এবং তার জন্য গান বাঁধতে চান, তাঁদেরও কাজে লাগবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে আমরা যারা মধ্যবিত্ত সমাজভাগ থেকে যুক্ত হতে আসি, তাদের মনের গহনে যা কিছু দোলাচল দেখা দেয় এবং তার থেকে উদ্ভূত যা কিছু গোলমেলে ব্যাপার যৌথ কাজের মাঝে মাঝে যূথকে অসুবিধার মধ্যে ফেলে দিতে থাকে, সেই সব কথাই এখানে অপূর্ব রাবীন্দ্রিক বয়ানে বয়ন করে রাখা আছে। ব্রহ্মবিলাসী ব্রাহ্ম কবি, পরমেশ্বরে বিশ্বাসী পিতা দেবেন্দ্রনাথের এই গভীরভাবে প্রভাবিত কনিষ্ঠ পুত্রের কণ্ঠে বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত কোনো আধ্যাত্মিক চিত্রকল্প। মাটির কাছে, জমির উপরে দাঁড়িয়ে যে মানুষ লড়াইটা করবে, তাদেরই কথা অত্যন্ত সরাসরি কথনে! আমাদের এমনই সুবিস্তৃত রবীন্দ্রযাপন যে এরকম একটি অমূল্য সংগ্রামী গীতি আমরা কত অনায়াসেই না ভুলে থাকতে পেরেছি।
ইতিহাসে কার্জনের বাংলা বিভাজনের আদেশ এবং তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস নানা ভাবে বাংলা সাহিত্যে কাব্যে প্রবন্ধে সুচর্চিত। সেই বিভাজনের প্রকৃত উদ্দেশ্য, তার বিরোধিতার পেছনে হিন্দু উচ্চবিত্তের স্বার্থ, তার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খুল্লমখুল্লা আত্মপ্রকাশ—সেই সব নিয়ে একালে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক নানা দিক থেকেই তারও আলোচনা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। হয়ত শেষ রায় দেবার সময় এখনও আসেনি।
কিন্তু সেই ১৯০৫ সাল থেকেই যে প্রথমে বাংলায় এবং অচিরে সারা দেশে জাতীয়তাবাদের ধূমাগ্নি জেগে ওঠে, তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় আজ আর নেই। আর এটাও সত্য যে সেদিনকার সেই নবীন জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে এবং জ্বালিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কবিগুরু এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। একেবারে রাস্তায় নেমে।
রাস্তায় নেমে এবং রাস্তারই গান গেয়ে। স্মরণে এসে গেল—
আমরা পথে পথে যাব সারে সারে
তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে।
বলব “জননীকে কে দিবি দান,
কে দিবি ধন তোরা, কে দিবি প্রাণ—
তোদের মা ডেকেছে”—কব বারে বারে।
তোমার নামে প্রাণের সকল সুর
আপনি উঠবে বেজে সুধামধুর,
মোদের হৃদয় যন্ত্রেরই তারে তারে।।
বেলা গেলে শেষে তোমারই পায়ে
এনে দেব সবার পূজা কুড়ায়ে
তোমার সন্তানেরই দান ভারে ভারে।।[স্বদেশ]
সংগ্রামের ময়দানে অন্তত দুটো জ্বলন্ত সমস্যার কথা আমাদের অভিজ্ঞতায় বিধৃত আছে। একটা হল, যারা লড়াই করতে এল, তাদের মধ্যে অনেক রকমের আপস এবং সমঝোতার মনোভাব কাজ করতে থাকে, বিশেষ করে সংগ্রামের জটিল মুহূর্তগুলোতে। আর তাকে আড়াল করতে প্রয়োজন হয় যে হাতিয়ারের তার ভুবনজয়ী নাম হল ভণ্ডামি। নানা মিথ্যা ছলনার মাধ্যমে সেই ভণ্ডামির প্রকাশ ঘটে। নিশ্চয়ই সেকালেও ঘটেছিল। নইলে সদ্য যৌবনোত্তীর্ণ কবি সেদিন কেন গাইবেন---
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?
এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি--
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ—
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা? [স্বদেশ]
আবার যারা হয়ত সচেতন মনে সংগ্রামের মঞ্চ ছেড়ে সরে যেতে চায় না, শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো রকম আপস করতে চায় না, ভণ্ডামিকে আশ্রয় করে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে চায় না, তাদেরও কারও কারও মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় দ্বিধা দ্বন্দ্ব পিছুটান লজ্জাবোধ ইত্যাদি কাজ করতে থাকে। তারাও সেই লজ্জা বা পিছুটানের বশবর্তী হয়ে অনেক রকম উল্টোপাল্টা বকে, বাজে কথা বলে। তাদের উদ্দেশে সেদিন রবীন্দ্রনাথের যে পরামর্শ ছিল, বোধ করি আজও তা কার্যকর---
ওরে, তোরা না-ই বা কথা বললি,
দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে না-ই জাগালি পল্লী॥
মরিস মিথ্যে ব'কে ঝ'কে, দেখে কেবল হাসে লোকে,
নাহয় নিয়ে আপন মনের আগুন মনে মনেই জ্বললি॥
অন্তরে তোর আছে কী যে না-ই রটালি নিজে নিজে,
নাহয় বাদ্যগুলো বন্ধ রেখে চুপেচাপেই চললি॥
কাজ থাকে তো কর্ গে না কাজ, লাজ থাকে তো ঘুচা গে লাজ,
ওরে, কে যে তোরে কী বলেছে না-ই বা তাতে টললি॥ [স্বদেশ]
[মূল গানের কথায় কবি প্রদত্ত “নেই” এবং “নেই বা” এখানে “নাই” এবং “নাই বা” করে লেখা হয়েছে। — অ. মু.]
ভীরু কাপুরুষ দ্বিধাগ্রস্তদের উদ্দেশে তিনি যা বলে গেছেন, সে আজকেও আমাদের বলতে হবে---
ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভূবনের ভার।
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার॥
তুফান যদি এসে থাকে তোমার কিসের দায়--
চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা, কাজ কি ভাবনায়?
আসুক-নাকো গহন রাতি, হোক-না অন্ধকার--
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার॥
পশ্চিমে তুই তাকিয়ে দেখিস মেঘে আকাশ ডোবা,
আনন্দে তুই পুবের দিকে দেখ্-না তারার শোভা।
সাথি যারা আছে তারা তোমার আপন ব'লে
ভাবো কি তাই রক্ষা পাবে তোমারি ওই কোলে?
উঠবে রে ঝড়, দুলবে রে বুক, জাগবে হাহাকার--
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার॥ [পূজা]
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ঔপনিষদিক আধ্যাত্মিকতা ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে থাকলেও এমনকি পূজা পর্যায়ের মধ্যেও তাঁকে রচনা করতে দেখি এমন গান যেখানে তিনি মানুষকে তার দুর্বলতা জয় করার পথের সন্ধান দিতে পারেন এক অনায়াস ও সুগম চিত্রকল্পে---
আগুনে হল আগুনময়।
জয় আগুনের জয়।
মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে এইবেলা সব যাক না পুড়ে,
মরণ-মাঝে তো জীবনের হ'ক রে পরিচয়॥
আগুন এবার চলল রে সন্ধানে
কলঙ্ক তোর লুকিয়ে কোথায় প্রাণে।
আড়াল তোমার যাক না ঘুচে, লজ্জা তোমার যাক রে মুছে,
চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়॥ [পূজা]
এরই প্রেক্ষিতে যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব লজ্জা সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে গণ আন্দোলনের জোয়ারে সাহস করে ঋজু মেরুদণ্ড আর উচ্চশির নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান ছিল তাঁর কিছু গানের সংবেদনে---
বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই!
শুধু তুই ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষ্ণী ঠেলিস নে ভাই॥
একটা কিছু করে নে ঠিক, ভেসে ফেরা মরার অধিক—
বারেক এ দিক বারেক ও দিক, এ খেলা আর খেলিস নে ভাই॥
মেলে কিনা মেলে রতন করতে তবু হবে যতন—
না যদি হয় মনের মতন চোখের জলটা ফেলিস নে ভাই!
ভাসাতে হয় ভাসা ভেলা, করিস নে আর হেলাফেলা—
পেরিয়ে যখন যাবে বেলা তখন আঁখি মেলিস নে ভাই॥ [স্বদেশ]
দেশাত্মবোধক রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে এও আমরা লক্ষ করি, কবি জানেন, যে কোনো গণ সংগ্রামের সামনে যোগ্য নেতৃত্ব চাই। আর চাই সেই নেতৃত্বকে সুশৃঙ্খলভাবে অনুসরণ করা। অশৃঙ্খল জনতাকে দিয়ে ভিড় জমানো হয়ত যায়, কিন্তু রণজয় সম্ভব হয় না। আকাঙ্ক্ষিত সেই নেতারই আবাহন কিছু কিছু গানে---
আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার।
তোমারে করি নমস্কার।
এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর—
তোমারে করি নমস্কার॥
আমরা দিয়ে তোমার জয়ধ্বনি বিপদ বাধা নাহি গণি
ওগো কর্ণধার।
এখন মাভৈঃ বলি ভাসাই তরী, দাও গো করি পার—
তোমারে করি নমস্কার॥
এখন রইল যাত্রা আপন ঘরে চাব না পথ তাদের তরে
ওগো কর্ণধার।
যখন তোমার সময় এল কাছে তখন কে বা কার—
তোমারে করি নমস্কার।
মোদের কেবা আপন, কে বা অপর, কোথায় বাহির, কোথা বা ঘর
ওগো কর্ণধার।
চেয়ে তোমার মুখে মনের সুখে নেব সকল ভার—
তোমারে করি নমস্কার॥
আমরা নিয়েছি দাঁড়, তুলেছি পাল, তুমি এখন ধরো গো হাল
ওগো কর্ণধার।
মোদের মরণ বাঁচন ঢেউয়ের নাচন, ভাবনা কী বা তার—
তোমারে করি নমস্কার।
আমরা সহায় খুঁজে পরের দ্বারে ফিরব না আর বারে বারে
ওগো কর্ণধার।
কেবল তুমিই আছ আমরা আছি এই জেনেছি সার—
তোমারে করি নমস্কার॥ [স্বদেশ]
এবং আধ্যাত্মিক পটপ্রেক্ষায় লেখা হলেও এর মধ্যেও পাই একই বার্তা---
ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়, তোমারি হউক জয়॥
হে বিজয়ী বীর, নব জীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়্গ তোমার হাতে—
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে, বন্ধন হোক ক্ষয়॥
এসো দুঃসহ, এসো এসো নির্দয়, তোমারি হউক জয়।
এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয়, তোমারি হউক জয়।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,
দুঃখের পথে তোমারি তূর্য বাজে—
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মৃত্যুর হোক লয়॥ [পূজা]
সেই প্রবল দেশপ্রেমের আবেগ থেকেই কবি সেদিন এমন দুএকটা টপ্পাঙ্গের গান গেয়েছিলেন, যা আজও আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে আলোড়ন তুলতে পারে। এই আলোড়নের জোরেই এক দিন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছিল। আর পাশাপাশি আর একবার অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল এই অসাধারণ গানটি---
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে॥
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রাণীর মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে॥
কোন্ বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন্ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে॥ [স্বদেশ]
যে কোনো আন্দোলনে আশাবাদ জাগিয়ে রাখতে হয়। সংগ্রাম চলতে চলতে শুরুর দিকে অনেক ব্যর্থতা আসে, পরাজয় আসে। তার থেকে আসে হতাশা, নিরুদ্যম। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নানা পর্বেও এই আশাবাদের সঞ্চারের লক্ষ্যে তিনি যে স্বদেশি গীতগুলি রচনা করেছিলেন, আমাদের বর্তমান শ্রমিক কৃষকের আন্দোলনের আঁকেবাঁকে যখন নৈরাশ্য দেখা দেয় তখনও সেই সব গান গাওয়া যেতে পারে---
ওরে, নূতন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে ॥
কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী হবে না
ওরে হিসাবি,
এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবি?
যেমন করে ঝর্না নামে দুর্গম পর্বতে
নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজানিতের পথে।
জাগবে ততই শক্তি যতই হানবে তোরে মানা,
অজানাকে বশ ক'রে তুই করবি আপন জানা।
চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী—
পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়, করিস নে আর দেরি॥ [স্বদেশ]
আরও একটা---
নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।
ওরে মন, হবেই হবে॥
পাষাণসমান আছে পড়ে, প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,
আছে যারা বোবার মতন তারাও কথা কবেই কবে॥
সময় হল, সময় হল— যে যার আপন বোঝা তোলো রে—
দুঃখ যদি মাথায় ধরিস সে দুঃখ তোর সবেই সবে।
ঘণ্টা যখন উঠবে বেজে দেখবি সবাই আসবে সেজে—
এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে॥ [স্বদেশ]
লড়াই মানেই আনন্দ। অনেকে মিলে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ---
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।
দাঁড় ধ'রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥
বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,
ঢেউয়ের 'পরে ধরব পাড়ি— যায় যদি যাক প্রাণ॥
কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা,
ভয়ের কথা কে বলে আজ— ভয় আছে সব জানা।
কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে।
পালের রশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান॥ [বিচিত্র]
সেই সঙ্গে আমরা অনেকেই এই গানটা শুনেছি এবং হয়ত করেছিও, যার মধ্যে শুধু আশাবাদের সুর নয়, আগামী বিজয় সম্পর্কে এক ধরনের দৃঢ় বিশ্বাসের ঘোষণাও যেন প্রত্যয়িত হয়---
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো॥
দুন্দুভিতে হল রে কার আঘাত শুরু,
বুকের মধ্যে উঠল বেজে গুরুগুরু—
পালায় ছুটে সুপ্তিরাতের স্বপ্নে-দেখা মন্দ ভালো॥
নিরুদ্দেশের পথিক আমায় ডাক দিলে কি—
দেখতে তোমায় না যদি পাই নাই-বা দেখি।
ভিতর থেকে ঘুচিয়ে দিলে চাওয়া পাওয়া,
ভাব্নাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া
বজ্রশিখায় এক পলকে মিলিয়ে দিলে সাদা কালো॥ [স্বদেশ]
একই ভাবে কবি যখন সংগ্রামের প্রান্তরে আহ্বান জানান, তখন এই ভাষাতেই আগামী দিনের আবেদনকে তুলে ধরেন এক অনবদ্য দৃপ্ততায়---
নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার—
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার॥
ক্ষণে ক্ষণে তুই হারায়ে আপনা সুপ্তিনিশীথ করিস যাপনা—
বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার॥
স্থলে জলে তোর আছে আহ্বান, আহ্বান লোকালয়ে—
চিরদিন তুই গাহিবি যে গান সুখে দুখে লাজে ভয়ে।
ফুলপল্লব নদীনির্ঝর সুরে সুরে তোর মিলাইবে স্বর—
ছন্দে যে তোর স্পন্দিত হবে আলোক অন্ধকার॥ [স্বদেশ]
অশান্ত সমুদ্রে নৌকা নিয়ে দুঃসাহসিক পাড়ি দেবার রূপক এঁকে গণসংগ্রামের আবেদন সৃষ্টির সেই যে সূত্রপাত হয়েছিল কবিগুরুর গানে, তা আমাদের কালে এসেও অব্যাহত থেকেছে---
খরবায়ু বয় বেগে, চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।
তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল—
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥
শৃঙ্খলে বারবার ঝন্ঝন্ ঝঙ্কার, নয় এ তো তরণীর ক্রন্দন শঙ্কার—
বন্ধন দুর্বার সহ্য না হয় আর, টলমল করে আজ তাই ও।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥
গণি গণি দিন খন চঞ্চল করি মন
বোলো না, 'যাই কি নাহি যাই রে'।
সংশয়পারাবার অন্তরে হবে পার,
উদ্বেগে তাকায়ো না বাইরে।
যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,
হোয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিয়ো তাল— জয়-জয় জয়গান গাইয়ো।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥ [বিচিত্র]
এই মানব মুক্তি সংগ্রামের কঠিন পথে এগিয়ে চলার মূল মন্ত্রটি উঠে এসেছিল কবির এক চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির অন্তঃস্থল থেকে। তিনি এমন একটি সঙ্গীত আমাদের উপহার দিয়েছিলেন যার ভেতরে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার এই সূত্রটি আছে ধরা। অথচ, দুঃখের কথা হল, আমরা এই গীতটিরও বড় একটা সন্ধান রাখিনি---
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে।
লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন, ওগো, তায় জাগাইনু রে॥
পোষ মেনেছে হাতের তলে যা বলাই সে তেমনি বলে--
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে॥
অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে--
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে॥ [বিচিত্র]
আর কবি এক দূরদ্রষ্টা ঋষির মতোই আমাদের শোনান কিছু দার্শনিক তত্ত্বকথা। ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী হয়েও সেই তত্ত্বে তিনি কোথাও আত্মা-পরমাত্মার কথা উত্থাপন করেন না। ফলে সেই জ্ঞানের আলোকে সংগ্রামী মানুষ জীবন মৃত্যুর দুঃখ শোকে শুধু সান্ত্বনা নয়, মনের জোরও খুঁজে পাবে। আমরাও যদি এই প্রজ্ঞাদীপ্ত কথাগুলির সহজ সরল অর্থ নিজেদের কাছে তুলে ধরি, হয়ত আমাদেরও এই কালে তা পথ দেখাবে---
দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে,
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে। [পূজা]
শুধু তাই নয়, দুঃখের সময়ে এমনও দুর্যোগময় পরিস্থিতি হতে পারে, যাদের জন্য আমি লড়াই করছি, শাসকের সান্ত্রীর আনাগোনার ভয়ে তারাই হয়ত আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সাহায্য বা অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা, আতঙ্কে বা দ্বিধায় দূরে সরে থাকছে। সেই কঠিন অবস্থার কথা চিন্তা করেই কবির সৃজন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে”, আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চের রণধ্বনি হয়ে উঠেছে। কিন্তু একই জাতের আরও এক খানি গীত আমাদের অন্যভাবেও অনুপ্রাণিত করতে পারে---
তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা ব'লে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না॥
আসবে পথে আঁধার নেমে, তাই ব'লেই কি রইবি থেমে--
ও তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি,
হয়তো বাতি জ্বলবে না॥
শুনে তোমার মুখের বাণী আসবে ঘিরে বনের প্রাণী--
হয়তো তোমার আপন ঘরে
পাষাণ হিয়া গলবে না।
বদ্ধ দুয়ার দেখলি ব'লে অমনি কি তুই আসবি চলে--
তোরে বারে বারে ঠেলতে হবে,
হয়তো দুয়ার টলবে না।
তা ব'লে ভাবনা করা চলবে না।। [স্বদেশ]
সেই সব ক্ষণে কখনও কখনও সংগ্রামী চরিত্রকে একাকী লড়তে হয়, একাই পথ খুঁজে নিতে হয়---
যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথি।
আকাশ-কোণে সর্বনেশে
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে করছে মাতামাতি।
যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে,
আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে।
বুঝি বা এই বজ্ররবে
নূতন পথের বার্তা কবে,
কোন্ পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি।। [পূজা]
এই নিবন্ধে আমি কয়েকটি গানের কথাই উল্লেখ করলাম। এরকম গীত কবি আরও অনেক রচনা করেছেন। সেগুলিও একই ভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। আজ আমরা এক ঘোর তমসার মধ্য দিয়ে চলেছি। এক সংকীর্ণ রাজনৈতিক শক্তির হিংস্র মৌলবাদী চতুর্মুখ আগ্রাসনে দেশের বুকে গণতন্ত্র, মানবতা, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, শুভবুদ্ধি, সত্যানুশীলন—সমস্ত কিছুই আজ বিপন্ন। এক নতুন এবং কঠোর সংগ্রামের দিন সামনে। এই সময়, বিশেষ করে কবিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অন্য অনেক নির্দেশের মতো উপরের গানগুলিও হোক আমাদের চলার প্রেরণা এবং পথের দিশারী। ¨