পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সংসদে হলুদ ধোঁয়া ও চাকরি না পাওয়ার বাস্তবতা

  • 18 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1067 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য ( দি ওয়ার,অক্টোবর ২৫) যৌবনের কাজ না পাওয়ার ক্ষোভকে সঠিক বলে মনে করছে।সার্ক ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ভারতে কাজ না পাওয়ার সংখ্যা (২৩.২২%) সবচেয়ে বেশি।এর পরে আছে পাকিস্তান (১১.৩%),বাংলাদেশ (১২.৯%) এবং ভুটান(৯.৩%)। সেই যুবকদের মধ্যে থেকে যদি চাকরির দাবীতে আওয়াজ ওঠে, তাহলে তাঁদের কি সন্ত্রাসবাদী, হামলাকারী বলে দাগিয়ে দেওয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব?

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে অহরহ বিজ্ঞাপিত ভারতীয় গণতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারাটা এক লহমায় সামনে এনে ফেলল সংসদে চার- পাঁচ যৌবনের  আগ্নেয় ' অনুপ্রবেশ '। প্রতিবাদের এই পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু যে কথাগুলো এই সহ নাগরিকরা বলতে চেয়েছিলেন তা শোনা গণতন্ত্রের স্বার্থেই ভীষণ জরুরি। কিন্তু আমরা যতই ভারত গণতন্ত্রের জননী বলে নাচন কোঁদন করি না কেন,ভিন্ন মত শোনার ধৈর্য ও সাহস, কোনটাই আজ আর অবশিষ্ট নেই। আমরা তাই দেখলাম দিল্লি পুলিশ প্রাথমিক ভাবে এই অনুপ্রবেশের ঘটনায় সন্ত্রাসবাদের কোন যোগ নেই বললেও,অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের করা হল।অনুপ্রবেশ বিতর্ক নিয়ে কর্পোরেট মিডিয়া খুব পরিকল্পিত ভাবে আলোচনার অভিমুখ শুধুই নিরাপত্তা জনিত ভুল- ভ্রান্তির মধ্যে সীমায়িত রাখতে চাইছে যাতে সংসদের মধ্যে যে বার্তা অভিযুক্তরা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাকে ভুলিয়ে দেওয়া যায়।এই বিষয়টা খুব জরুরি কারণ না হলে চাকরি,মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সম্পর্কিত দাবিগুলো সামনে চলে আসবে। ঐ দিন যে শ্লোগানগুলো সংসদ কক্ষে ধ্বনিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হল চাকরি পাওয়ার দাবি যাকে আমরা এক ন্যায্য দাবি বলেই জানি।বর্তমান নিবন্ধে এই অমৃতকালে চাকরির হাল হকিকতটা ঠিক কিরকম তা তথ্য সহকারে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

চাকরির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারে পারফরম্যান্স কারো অজানা নয়।বছরে এক কোটি চাকরি বহু দিন আগে গঙ্গায় ভেসে গেছে।২০১৭-১৮ পর্বে মোদি সরকারের সেই অসাধারণ কীর্তি সর্বজনবিদিত যেখানে আমরা জেনেছিলাম বিগত পঞ্চাশ বছরে বেকারির পরিমাণ সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছিল। তারপর এসেছে করোনা অতিমারী। অতিমারীর সময় কর্মহীনতা ছিল অভূতপূর্ব, সরকার অযোগ্যতা,পরিকল্পনার অভাব ও কর্পোরেট মুনাফার প্রতি দায়বদ্ধতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছিল।কিন্তু সেসব সরকারের ভাষায় এখন অতীত।বিশ্বগুরুর অধিনায়কত্বে আমরা এখন তিরিশ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হতে চলেছি,পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই সময় কাজের বাজারের অবস্থা কেমন! সোজা কথায় চাকরির বাজার খুব খারাপ।সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির শেষ প্রতিবেদন অনুসারে অক্টোবর মাসে কর্মহীনতার হার ১০.০৫% যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৭.০৯%। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদ এসেছে গ্রামীণ  অর্থনীতিতে যারা আজও ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষকে কাজ জোগায়।গ্রামীণ বেকারির হার অক্টোবর মাসে হয়েছে ১০.৮% যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৬.২%। বৃষ্টি নির্ভর ভারতীয় কৃষি যেহেতু চরিত্রগত ভাবে ভঙ্গুর তাই বৃষ্টির স্বল্পতা সংকটকে আরো ব্যাপ্ত করে তুলেছে। লোকনীতি-সিএসডিএস আগস্ট(২০২৩) মাসে এক সমীক্ষা করে দেশের ১৫-৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে। সেখানে ৩৬% যুবক মনে করেছে তাদের কাছে চাকরি জোগাড় করাই সবচেয়ে বড় সমস্যা, ১৬% দারিদ্র্য ও ১৩% মুদ্রাস্ফীতিকে সমস্যা মনে করে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে চাকরি জোগাড় করাকে প্রধান সমস্যা মনে করেছিল ১৮% যুবক-যুবতী।

এই সাধারণ তথ্য দিয়ে কিন্তু সংকটের ছবিটা পুরোপুরি ধরা যাবে না। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার ( যদিও লোকগণনা ২০২১ সালে না হওয়ার কারণে প্রকৃত সংখ্যাটা বলা সম্ভব নয়) অর্ধেক ২৫ বছরের নিচে,বিজ্ঞাপনের ভাষায় পৃথিবীর সবচেয়ে তরুণ প্রজাতন্ত্র। শিক্ষার পরিধি আগের চেয়ে বাড়ার কারণে এদের একটা বড়ো অংশ শিক্ষিত। মোদির ভারতের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল এখন যত বেশি শিক্ষিত,তত কম চাকরি পাওয়ার সুযোগ। দি মিন্ট(২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির "স্টেট অফ ওয়ার্কিং রিপোর্ট -২০২৩ " অনুসারে ২৫ বছরের নিচে স্নাতকদের মধ্যে বেকারির পরিমাণ ৪২%।উচ্চ মাধ্যমিকে পাশে বেকারির হার ২১.৪%,মাধ্যমিক ১৮.১% এবং অষ্টম শ্রেণি পাশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১৫%। এই ছবিটা কিন্তু নতুন নয়।২০১৯ সালের ১০ জুন কোয়ার্টজ এক সমীক্ষাপত্র প্রকাশ করে।সমীক্ষাটি করে কোটাক ইন্সটিটিউশনাল ইকুইটিজ। এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ডিপ্লোমা হোল্ডারদের মধ্যে বেকারির হার ৩৭%,স্নাতকদের মধ্যে ৩৬% এবং স্নাতকোত্তরদের মধ্যে বেকারির পরিমাণ ৩৬%। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল প্রতি মাসে ভারতের কাজের বাজারে ১ কোটি নতুন কর্মপ্রার্থী প্রবেশ করে।

শিক্ষিতদের মধ্যে এই চাকরি না পাওয়ার গল্পটা সর্বব্যাপ্ত।ইকনমিক টাইমস (ডিসেম্বর ১০,২০২৩) এর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গৌরবশালী প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত দেশের আইআইটি গুলিতে যে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে তাতে নতুন নিয়োগের পরিমাণ ১৫%-৩০% কমে গেছে।ইন্টারভিউ শুরু হবার এক সপ্তাহ পরেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরও একটাও জব অফার আসে নি।কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন আগে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে ৮-১০ জন নতুন লোক নিত তারা ১-২ জনের বেশি লোক নিচ্ছে না।সবচেয়ে আলোচিত তথ্য - প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও ছবিটা আলাদা কিছু নয়।এমনকি কুলীন আইআইটি বলে পরিচিত বোম্বে,কানপুর, মাদ্রাজ, খড়্গপুর, রুরকিতেও সংকট নজরে পড়ছে। নতুন নিয়োগের পরিমাণ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়িত আর্থিক মন্দার কারণে তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে কাজ হারানোর ঘটনাও ঘটছে প্রচুর। মানিকন্ট্রোল (নভেম্বর ১০,২০২৩) প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে ১০০০ টি টেক কোম্পানি প্রায় ১,৫০,০০০ চাকরি ছাঁটাই করেছে।

চাকরির ছবিটা উজ্জ্বল বলে প্রমাণ করার লক্ষ্যে মোদি সরকার ২০১৮ পরবর্তী সময়ে এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে।মোদির উপদেষ্টারা বলতে থাকেন যে প্রভিডেন্ট ফান্ডে নতুন সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার নতুন কর্মসংস্থানের সূচক।যদিও অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের ভবিষ্যনিধি প্রকল্পে যোগদান নতুন কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি হতে পারে না।তবে এই সূচকেও বিচার করলে মোদি সরকারের ঝুলি এখন শূন্য। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ( নভেম্বর ২০,২০২৩) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডে নতুন অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ছিল ৯,৫৩,০৯২ যা সেপ্টেম্বর মাসে হয়েছে ৮,৯১,৫৮৩।সরাসরি ৬.৪৫% হ্রাস। এই নতুন সদস্যদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ২,২৬,৩৯২ যা আগস্ট মাসে ছিল ২,৪৮,৯৮০।

সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য ( দি ওয়ার,অক্টোবর ২৫) যৌবনের কাজ না পাওয়ার ক্ষোভকে সঠিক বলে মনে করছে।সার্ক ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ভারতে কাজ না পাওয়ার সংখ্যা (২৩.২২%) সবচেয়ে বেশি।এর পরে আছে পাকিস্তান (১১.৩%),বাংলাদেশ (১২.৯%) এবং ভুটান(৯.৩%)। দ্বিতীয় বৃহত্তম  অর্থনীতি হয়ে ওঠার দাবিদারদের জ্ঞাতার্থে একথা জানিয়ে দেওয়া দরকার যে সার্কের বাইরের দেশগুলোর ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হল ভিয়েতনাম(৭.৪%),সিঙ্গাপুর (৬.১%),দক্ষিণ কোরিয়া (৬.৯%),সিরিয়া (২২.১%) এবং চিন (১৩.২%)।

নীলম,ললিত,মনোরঞ্জনের মত প্রজাতন্ত্রের সন্তানরা যে প্রশ্নগুলো তুলেছে তা এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল রাষ্ট্রের কাছে। আমরা ভেবে দেখতে পারতাম যে নয়া-উদারবাদ নির্দেশিত এই গ্রোথ মডেল কেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ। জিডিপি ও ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির গল্পে বুঁদ না হয়ে থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম উৎপাদন ক্ষমতা ও জনগনের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে হাজার যোজন দূরত্বের আসল রহস্য। আর ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে না ফলত ম্যানুফাকচারিং সেক্টরের মত কর্ম নিবিড় ক্ষেত্রগুলির বৃদ্ধিও হবে না। আমরা জিজ্ঞেস করতে পারতাম  একদিকে যখন আদানি-আম্বানিদের মুনাফা ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে তখন কেন দেশের কোটি কোটি মানুষের দু বেলা খাবার জুটছে না।কিন্তু এক অমিতধর,একনায়ক শাসিত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে মশগুল সরকারের কাছে রুটিরুজি, শিক্ষা,স্বাস্থ্যের মত মূল বিষয়গুলোর কোন মূল্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। তাই সংসদে অনুপ্রবেশকারীদের দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করেই সরকার তার দায়িত্ব শেষ করছে।

0 Comments

Post Comment