এই পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াটা পছন্দ আইরিনের। কতবার বিভাগীয় সম্পাদকের বকুনি শুনতে হয়েছে তাকে, তুমি তো বিষয়টাকেই অ্যাড্রেস করলে না! এটা কোনও আর্টিকেল হয়েছে! তারপর সে-যখন বিষয়ে ঢুকে, সমস্যা সরাসরি চিহ্নিত করে লেখাটা দাঁড় করালো, লেখাটা আর ছাপানো গেল না। সম্পাদক বেজার মুখে বলত, লেখাটা খুব ভালো হয়েছে আইরিন, কিন্তু পলিসির বিরুদ্ধে। ছাপা হবে না। আইরিন জানত সে এই কারণেই বিষয়কে পাশ কাটিয়েছিল, কিন্তু এই অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীলোকগুলো তা জানত না।
এই পাশ কাটানোটা একটা সাহিত্যিক রণকৌশলও বটে। আর্ট অব ডাইভারশন – আচমকা দুম করে প্রসঙ্গ পালটে ফেলা – অর্থাৎ প্রসঙ্গান্তরের শিল্প। সেনসরশিপকে বুড়ো আঙুল দেখাবার জন্যেই সেটা চাই।
অফিস থেকে বেরিয়েই টের পেল স্বস্তি, যা পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিলপিল করে উঠে আসছে। লিফটে না-চড়ে ধরল সিঁড়ি। বহুদিন পর এমন আনন্দ এলো আইরিনের জীবনে। মুক্তির আনন্দে শেষ দুটো সিঁড়িতে পা না-ঠেকিয়ে লাফিয়ে নামল চাতালে। অফিসবাড়ি থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের তলায় এসে একবার পিছন ফিরে দেখল মস্ত বাড়িটাকে। এই বাড়িটাকে চিরদিনের জন্য পিছনে ফেলে সে চলে যেতে পারছে, শেষমেশ। এখন থেকে সে এক স্বাধীন সাংবাদিক। কোনও হাউজের পলিসি বা রাজনৈতিক চাপ এখন থেকে আর অন্তরায় হবে না। সে নিজের মতো করে স্টোরি বানাবে, যারা কিনতে চায় তাদের বেচবে অথবা নিজেই একটা পোর্টাল বানিয়ে প্রকাশ করবে।
সেদিনের কথা ভাবলে, হাসি পায় আজ। কত সরল ছিল সে! ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রেস বলে যে কিছু হয় না, কিছুদিন একা-একা কাজ করেই বুঝে গেল। আবার হয় না বললেও ভুল বলা হয়, হয়, একটু কায়দা করে প্রকাশ করলেই যা-বলার ইচ্ছে, বলা যায়। আর্ট অব ডাইভারশন।
পূর্ব ইয়োরোপের শিল্প-সাহিত্য যেমন। আইরিন জানে, পূর্ব ইয়োরোপে একসময় শিল্পী-সাহিত্যিকরা কীভাবে তাঁদের কথা বলতেন।
কেউ কেউ হয়তো বলতে প্রলুব্ধ হবেন যে স্লাভদের একটা শাণিত হাতিয়ারই ছিল শ্লেষ – নিরস্ত্রের সবচেয়ে বড় শস্ত্র। পোল সাহিত্যেও তা-ই, সার্বিয়ার সাহিত্যেও তা-ই, ক্রোয়াটরাও বাদ যায়নি – আর ১৯১৮-র পর বোহেমিয়া আর স্লোভাকিয়াকে জুড়ে দিয়ে যে-দেশ তৈরি হল, চেখোস্লোভাকিয়া, তার তো বটেই। আর ইহুদিদের তো অনেককাল ধরে সুদে খাটাতে হয়েছিল কৌতুককেই। বেঁচে থাকবার জন্যে।
কীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কীসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা?
মস্ত প্রতিবেশি রুশরা তো ছিলই। ছিল অস্ট্রোহাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য, তারও পরে নাৎসি বর্বরতা, ছিল সোভিয়েতের নজরদারি খবরদারি।
এগুলো তো আইরিনের কথা নয়, আইরিন পড়ে জেনেছে, শুনে জেনেছে। পূর্ব ইয়োরোপের আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সময় কলকাতার এক অন্ধ কবি ও অনুবাদক তাকে বলেছিলেন। থোড়িই সে পূর্ব ইয়োরোপের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিল, সে প্রতিক্রিয়া নিতে গিয়েছিল সেই অন্ধ কবি ও অনুবাদকের, কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন আর্ট অব ডাইভারশনের কথা। কীসের প্রতিক্রিয়া? ভারত, যাকে এখন নিউ ইন্ডিয়া বলা হয়, সেই নতুন ভারতে, পঁচাত্তরতম স্বাধীনতার সময়, বাকস্বাধীনতার অবস্থা কেমন, কী মনে করেন জ্ঞানীগুণীরা, জানতে গিয়েছিল আইরিন। তখন সেই অন্ধ কবি ও অনুবাদক পূর্ব ইয়োরোপের এই লিটারারি টুলের কথা বলেছিলেন।
সরাসরি যখন বলা যাবে না, একটু পালটে দাও, ডাইভার্ট করে দাও, ইয়ার্কি করো এমনকী অশ্লীলতাও! একজন সমালোচক একবার বলেছিলেন, “পূর্ব ও মধ্য-ইওরোপে সবকিছুই রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো।” ভেংচি কাটা, বিকট মুখভঙ্গি, ভাঁড়ামি – এমনকী স্ট্রিপটিজও। এক-এক করে জামাকাপড় খুলে ফেলে যৌন শুড়শুড়ি দেয়াও প্রতিবাদ হয়ে ওঠে একসময় – যখন পেছনে বাজানো হয় বেটোফেনের তৃতীয় সিম্ফনি, এরোইকা, যার বিষয় ছিল স্বাধীনতা, নাপোলিয়ঁ বোনাপার্ৎকে যেটা ভর্ৎসনা করেছিল।
তার পর থেকে আইরিন তার লেখার স্টাইল বদলে ফেলল, যা সরাসরি বললে বাধা আসবে, ছাপা হবে না, তা সে সরাসরি বলবেই না। ইনিয়েবিনিয়ে বলবে, তা-ও নয়, বলবেই না। অন্য কথা বলবে, যেমন এনার্সি নিয়ে বলতে গিয়ে সে এনার্সি ভালো-না-খারাপ বলবেই না, সে মন্টোর টোবা টেক সিং গল্পের কথা লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলবে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের বর্বরতা নিয়ে লিখতে গিয়ে সে ‘ইফ…’ ছবির কথা লিখবে, ১৯৬৮ সনের লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ব্রিটিশ ছবি ‘ইফ…’। কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি’অর পাওয়া ছবি ‘ইফ…’। ছাত্রীটি কীভাবে হেডমাস্টারের দুই ভুরুর মাঝখানে গুলি করে, সেই দৃশ্যের কথা বলবে, কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর দিল্লি পুলিশের অত্যাচারের বর্বরতা নিয়ে একটি কথাও লিখবে না। উন্মত্ত লাঠিচার্জ থেকে সহপাঠীকে বাঁচাতে ছাত্রীরা কীভাবে নিজেদের শরীর দিয়ে আড়াল করে বাঁচাল, এই নিয়ে একটি বাক্যও লিখবে না আইরিন। এইভাবে লিখতে লিখতে, এক-একসময় আইরিনের মনে হয়, আদৌ সে কোনওদিন সরাসরি কিছু লিখতে পারবে! ডাইভারশনটাই নিয়ম হয়ে যাবে নাতো!
অন্ধ কবি ও অনুবাদক তাকে আরও অনেক কথা বলেছিলেন। ‘কেবল ভারত নয়, ভারতবর্ষ মানে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশ এখন এক ক্ষুরধার পথে এসে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র আজ কেবল বিপন্ন নয়, অসুস্থ। এর জন্য দায়ী অন্যায় আইন। আমাদের সব প্রতিষ্ঠান, পূজার বেদী, মন্দির, যজ্ঞস্থল আজ অপবিত্র হয়ে গেছে। নাগরিকের সৎকারহীন মৃতদেহের ছিন্ন মাংস দেবালয়ে এনে ফেলেছে শিয়াল আর শকুন। আমাদের পবিত্র অগ্নি, আমাদের যজ্ঞ, আমাদের স্তবস্তুতি, সব, স-ব কিছু আজ দেবতার কাছে ঘৃণ্য! তাই পাখিদের কলকাকলিতে আর সুর নেই, নররক্তে ভেজা তাদের ঠোঁট! সুমধুর কলকাকলি আজ পৈশাচিক কোলাহলে পূর্ণ। এগুলো আমার কথা নয়, আড়াই হাজার বছর আগে লেখা এক নাটকে এক অন্ধ মানুষের কথা। তার নাম তাইরেসিয়াস। তোমার পেছনে বইয়ের তাকের সেকেন্ড রো-এর একদম ডানদিকে একটা বই আছে, দ্যাখো, নিয়ে এসো।’ আইরিন বইটি নিয়ে এসে আবার জায়গায় বসে। আন্তিগোনে। ‘আমারই অনুবাদ। বার করো ক্রেয়ন আর তাইরেসিয়াসের কথোপকথন।’ উদ্দিষ্ট পাতায় পৌঁছায় আইরিন। ‘পড়ো!’ অন্ধ কবি ও অনুবাদক এমনভাবে বললেন যেন আদেশ।
ক্রেয়ন
রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের কাজ করতে দিন পণ্ডিত মশাই! যাগযজ্ঞ আপনারই কোনও ভুলে, অশুদ্ধাচারে পণ্ড হয়েছে, নিজের কৃতকর্মের দায় রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপাবেন না।
তাইরেসিয়াস
কথায় কথায় যারা খুব রাষ্ট্র-রাষ্ট্র করে, তাদের আমি সন্দেহ করি। রাষ্ট্র হল তোমার আইন, তোমার সেনাবাহিনী, তোমার চাটুকার অনুচরবর্গ! রাষ্ট্র মানে থেবাই নয়, রাষ্ট্র মানে দেশ নয়। সমুদ্র থেকে পাহাড়, এই বিশাল ভূভাগের অধিবাসী অসংখ্য সাধারণ নাগরিক, অযুত জীবজন্তু-পাখপাখালি, নদী-খাল-অরণ্য আর এই সৌভার্তৃত্বময় সহাবস্থানই হল দেশ। দেশকে তোমার রাষ্ট্রের খোপে ফেলে ছোটো কোরো না। আমি তোমার মঙ্গল চাই, থেবাইয়ের মঙ্গল চাই, তাই অযাচিত এই উপদেশ দিতেই আমার আগমন।
ক্রেয়ন
ওহ, আপনিও ওদের দলে ভিড়ে গেছেন! তীর ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছেন আমার দিকে! শুনে রাখো সবাই, তোমরা যা-খুশি তাই কর, দেবরাজ জিউসের সিংহাসনে ঈগলের দল তুলে নিয়ে যাক এই মড়া, আমি তাঁকেও ভয় পাব না! কেউ পলিনাইকেসের শেষকৃত্য করে ওকে সম্মান প্রদর্শন করবে না, আমার আদেশ! আপনি থেবাইয়ের প্রবীণ মানুষ, অত্যন্ত চতুর, আপনার এই যাগযজ্ঞ আর ভবিষ্যদ্বাণীর আড়ালে যড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছেন, মনে রাখবেন এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
তাইরেসিয়াস
কোনও ব্যক্তি শাসকের প্রতি সামান্য মোহও আমার নেই। আমার দায় সত্যকথনের, আমি সত্য উচ্চারণ করব, সেই সত্য তোমার বিপক্ষে গেলে তুমি নিজেকে সংশোধন কর, তাই বলে আমি সত্যগোপন করব না।
ক্রেয়ন
আপনার চাতুর্য আমি জানি। একটা পাক্কা ঘাগু সন্ন্যাসী! প্রতারক! এইসব সত্যকথক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্ট্রার আড়ালে আপনি আসলে একজন অর্থলোভী!
তাইরেসিয়াস
স্বৈরাচারীর ক্ষমতার জন্য লোভ, সে আরও ভয়ঙ্কর! শোনো ক্রেয়ন, বলতে চাইনি কিন্তু প্রিয় থেবাইয়ের জন্য আমায় সত্য বলতে হবেই। আমি অন্ধ তাইরেসিয়াস অয়দিপাউসকেও সত্য বলেছিলাম। ডরাইনি। পিছিয়ে যাইনি। রাজপাটের পরিবর্তনের পরও, তুমি রাজা হওয়ার পরও সত্য বলতে পিছিয়ে যাবে না তাইরেসিয়াস! রাজাকে খুশি করে পারিতোষিক লাভের জন্য সত্যের ওপর মিথ্যের প্রলেপ দেবে না! যা সত্য তাই বলবে।
ক্রেয়ন
বলে যাও তাইরেসিয়াস, তাতে খুব কিছু সুবিধে হবে না! ক্রেয়ন অত সহজে ভীত হয় না! তুমি একটা অর্থলোভী বুড়ো! এক স্বর্ণমুদ্রার লেনদেনও হবে না এইজন্য। বলো, বলো! বলো, চুপ করে আছ কেন, বলো বৃদ্ধ শয়তান!
তাইরেসিয়াস
তুমি চোখে যা দেখছ তোমার চারপাশে, সত্য তার বাইরে থাকে। প্রতিটি অন্ধ মানুষের কাছে সত্য আছে।
স্বয়ং দেবরাজ জিউস যাকে দিয়েছেন দীর্ঘ পরমায়ু আর ভবিষ্যৎ বলার শক্তি, সেই অন্ধ দৈবজ্ঞ তাইরেসিয়াস, আজ থেবাইয়ের রাজদরবারে, রাজা ক্রেয়ন ও তাঁর অমাত্যদের সামনে উচ্চারণ করছে সত্য!
‘তারপরই তাইরেসিয়াস উচ্চারণ করে তার ভবিষ্যদ্বাণী! ভয়ঙ্কর সে-সত্য! অপমানিত হয়ে চলে যেতে যেতে, ক্রেয়নের দিকে ফিরে বলে, মনে রেখ ক্রেয়ন, মৃতদেহ কথা বলে। যে মৃতদেহ নিয়ে এই অন্যায়ের সূত্রপাত, সেখানেই থেমে থাকবে না এই অন্যায় প্রতিহিংসা! মৃতদেহ বাড়বে এবং তারা প্রত্যেকে সরব হবে তোমার বিরুদ্ধে। মৃতের প্রতিটি উচ্চারণ দগ্ধ করবে জীবিতের হৃদয়।’ তারপর মুখমণ্ডলে সামান্য হাসি ফুটিয়ে অন্ধ কবি ও অনুবাদক বলেন, ‘ওগো মেয়ে, তাই তো লেখা আছে?’ আইরিন মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ-বাচক। পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পারে, বলে, ‘একদম তাই স্যার!’ উনি আরও একটু হেসে বলেন, ‘ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে দ্যাখো, একদম তাই মনে হবে।’ আইরিন অবাক চেয়ে থাকে। ওঁকেই তাইরেসিয়াস বলে মনে হয়। অন্ধ। দৈবজ্ঞ। প্রতিটি অন্ধ মানুষের কাছে সত্য আছে।
আইরিন এখন ডকু বানায়। ঠিক ডকুমেন্টরি বলতে যা-বোঝায় তা নয়, ছোট ছোট ভিডিও, রিলস নয়, বানিয়ে ছড়িয়ে দেয় নেটদুনিয়ায়।
‘ডান!’
কেটে-জুড়ে কাজটা শেষ করেই মস্ত এক শ্বাস ফেলে আইরিন। অন্ধ কবি ও অনুবাদকের কথা মনে পড়ে। পুরনো অফিসের কথা মনে পড়ে। একটা সিগারেট ধরায়। মৌজ করে টানে। ভিডিও’র সময়কাল দেখে, নয় মিনিট আট সেকেন্ড, ঠিকই আছে। যা-করার নয় মিনিটেই করতে হবে। গোড়া থেকে ফের চালায়। গলায় হারের মতো জড়িয়ে-থাকা হেডফোন তোলে মাথায়। পর্দায় টাইটেল ফুটে ওঠে – কাগজ।
Scene 1 |
Visuals |
Sound |
INT. Night.
|
|
ক্যামেরা বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। অন্ধ মানুষ যেভাবে স্টিক এদিক-ওদিক ঠেকিয়ে ঠাহর করতে করতে সামনে এগোয়, ক্যামেরাও সেইভাবে এগোয়। অন্ধকার। দূরে কারা যেন মশাল জ্বালিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে আগুন। উন্মত্ত চিৎকার চলছে, যদিও চিৎকারের আওয়াজ ফিকে, সাউন্ড ট্র্যাকে জলের তোড়ের কুলকুল ধ্বনি। হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরা অন্ধ মানুষের মতো এগোয়। কুকুরটার লেজ ঢুকেছে দুই ঠ্যাঙের মাঝে। কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে সে। কুঁইকুঁই করে কেবল। কুঁইকুঁই ছাপিয়ে জলের তোড়ের ধ্বনি। ক্যামেরা আবার অন্ধ মানুষ। আধো-অন্ধকারে এগোয়। কেবলি জন্ম হয় দৃশ্যের। ক্যামেরার সামনে হঠাৎ এসে খ্যাক-খ্যাক করে হাসেন শিব-সাজা এক বহুরূপী। সাউন্ড ট্র্যাকে জলের তোড়ের শব্দ বাড়তে থাকে। ক্লোজ আপে মহিলার মুখ। ভয়ে শাদা। পরের দৃশ্যে আবার সন্ত্রস্ত মহিলা। তিনি সুটকেস খুলে, ট্রাঙ্ক খুলে কিছু খুঁজছেন। উদ্বিগ্ন অনুসন্ধান। হাতড়ে বের করে কিছু কাগজ ভরে নিলেন নিজ-শরীরে। তারপর বাচ্চাটাকে কাঁখে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।
পর্দায় বাংলা খবরের কাগজের কাটিং।
‘জিনিসপত্র হারালে ফিরে পাওয়া যায়, কাগজ হারালে নাগরিকত্ব খোয়াবো।’
বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ
প্রান্তজ্যোতি প্রতিবেদক, শিলচর, ৪ জুলাই।
কটিগড়া বিধানসভা সমষ্টির নিশ্চিন্তপুর গ্রামের উপর বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা বলেশ্বর নদী। তছনছ হয়ে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি, তবু নদীর স্রোত কমেনি। সর্বহারা হয়ে যেসব লোকেরা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের কাছে জিনিসপত্র বাঁচানোর কোনও সুযোগ ছিল না, তাঁরা বাঁচিয়েছেন এনার্সির কাগজ। তাঁরা বলছেন, জিনিসপত্র হারালে হয়ত আবার বানানো যাবে, প্রয়োজনে একটু গরিব জীবন যাপন করলেও অসুবিধা নেই, তবে নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন তা কোনওমতেই হারাতে চান না তাঁরা। জলের তোড়ে বছর ৩৫-এর আসমা বেগম যখন ঘর ছাড়ছেন তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। ‘হু-হু করে প্রবল বেগে জল ঢুকছে ঘরে, আমার স্বামী চিৎকার করে বলেন, আগে কাগজ বাঁচাও, ওগুলা হারালে সব শেষ!’ বিদ্যুৎ নাই। হাতের কাছে ছিল না মোবাইল বা টর্চ। মোমের আলোয় যতটুকু দেখতে পেয়েছেন তাঁর হাত প্রথমেই গেছে এনার্সির কাগজের বাক্সে। আর সঙ্গে নিয়েছেন বাচ্চাদের বিদ্যালয়ের নথিপত্রগুলো। প্রাণের চেয়েও বেশি আঁকড়ে সেই কাগজগুলো নিয়ে সেই রাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন নিকটবর্তী ক্যাম্পে। কাগজ হাতে নিয়ে আসমা বেগম রাস্তায় ওঠে আগে আগে, পেছনে বাচ্চাদের নিয়ে আসমার স্বামী।
‘আমাদের নাগরিকত্ব নথি নষ্ট হয়নি।’ আসমার মতোই বললেন ৪২ বছরের হারুন উদ্দিন। তিনি আরও বলেন, ‘এনআরসির কাগজ পেতে অনেক কষ্ট পেয়েছি আমরা। সব সহ্য করেছি সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সেই রাতে যখন বুঝতে পারলাম ঘর ছাড়তেই হবে, আমরা জানতাম ফিরে এসে হয়ত কিছুই পাব না। তখন মনে হয় সবকিছুই হারানো যেতে পারে তবে নাগরিকত্বের যন্ত্রণা সহ্য করা যাবে না, তাই আমরা এনআরসির কাগজ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠি। ক্যাম্পে যাওয়ার পরও সেই কাগজ কোনোভাবেই হাতছাড়া হতে দিইনি। দু’দিন হল বাড়ি ফিরেছি, আমরা এখন নিঃস্ব, সামান্য খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে মনে একটা স্বস্তি রয়েছে, এনআরসির কাগজ হারাইনি!’
এই অবস্থা শুধু হারুন উদ্দিন বা তার পরিবারের নয়, অসমের লক্ষ লক্ষ বন্যাক্রান্ত মানুষ এই কাজই করেছেন, জলের তোড় থেকে নাগরিকত্বের নথি বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়েছেন! তিন বছর আগে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হলেও এখনও তা সরকার স্বীকৃত নথি হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। প্রতিদিন ফরেনার ট্রাইব্যুনাল থেকে নিত্য নতুন নোটিশ পাঠানো হচ্ছে আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দিতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এই বছরের বন্যায় তাই মানুষ এনআরসি বা নাগরিকত্বের কাগজ বাঁচাতেই জান কবুল করছেন।
Scene 6 |
Visuals |
Sound |
EXT. Day.
|
|
ক্যামেরা আবার কটিগড়া ত্রাণ শিবিরে। খেলছে বাচ্চারা। বড় কড়াইতে রান্না হচ্ছে। গাদাগাদি করে পড়ে আছে বন্যাক্রান্ত বাস্তুহারা আশ্রিত মানুষ। নেপথ্যে কেউ ঈষৎ জড়ানো গলায় বলে, ‘এটা দাঙ্গা নয়, দিল্লিতে যা-হয়েছে তাকে বলে পোগ্রোম, স্টেট স্পনসর্ড পোগ্রোম।’ ত্রাণ শিবির থেকে সরে ক্যামেরা ধরেছে পুরনো দিনের অভিনেতা কেষ্ট মুখার্জিকে। তিনি মিডিয়াকে বাইট দিচ্ছেন। পেছনে ময়দান। আসলে কেষ্ট নয়, কেষ্ট’র মিমিক্রি করা একজন, বহু বুমের সামনে কেষ্ট’র ভঙ্গিতে বলছেন, ‘এটা সঙ্ঘবদ্ধ লুঠ। খুন। তিন মাস ধরে চলা সিএএ বিরোধী আন্দোলনে কই কিচ্ছুটি হয়নি, কোনও শান্তি বিঘ্ন হয়নি! উঁক! এখন যা-হল, বোঝাই যাচ্ছে এরা শান্তি চায় না! উঁক! পুরোটাই প্ল্যানড! আই অ্যাকিউজ!’ পর্দায়, নীচের দিকে, খটাখট শব্দে নাম ভেসে ওঠে। কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। কবি। কলকাতা। পেছন থেকে শিব-সাজা বহুরূপী কবির বাঁদিক ও ডানদিক থেকে মুখ বাড়িয়ে ক্যামেরামুখী হতে চান। ‘ডোনাল্ডের সঙ্গে ঘুরে এরাও ট্রাম্প হয়ে গেল!’ বলেই চোখ ট্যারা করে ক্যামেরার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলেন তারপর পেছন ফিরে ‘তবে রে!’ বলে তাড়া করলেন বহুরূপীকে। বহুরূপী পালালেন। ক্যামেরা পিছু নেয় তাঁর। সবুজ ময়দানের ওপর দিয়ে দৌড়ান বহুরূপী। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে সরাসরি তাকান ক্যামেরার দিকে। মাথার জটাটা খুলে বাঁ বগলে চেপে, একটা বিড়ি বার করে কানের কাছে পাকান। তারপর আগুন ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, ‘কী কাগজ বাঁচাচ্ছো গো বাছাধনেরা, কী কাগজ? কোন কাগজ প্রাণের চেয়েও দামি!’ বলেই হ্যা-হ্যা করে হাসেন। খকখক করে কাশেন। কাশতে কাশতেই হাসেন। হাসি ও কশি ছাপিয়ে সাউন্ড ট্র্যাকে মিশে যায় জলের তোড়ের ধ্বনি আর উন্মত্ত জনতার চিৎকার। বহুরূপী ক্যামেরার সামনে মুখ এনে বলেন, ‘কোন কাগজ? কোন কাগজ?’
দিল্লির মহিলা পোশাকের ভিতর থেকে বার করেন কাগজ। শিলচরের আসমা খাতুন আর হারুন উদ্দিনও। তারপর পরপর তিনজনই ক্যামেরার সামনে দেখান তাঁদের কাগজ।
কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে লেখা আছে – দ্য কনস্টিটিউশন অফ ইন্ডিয়া।
রচনাকাল:২০২২. প্রথম প্রকাশ: উদ্ভাস উৎসব সংখ্যা ২০২২।