পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

খাল তো কাটাই, টিরেনোসরাস আনবেন কি?

  • 25 November, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1690 view(s)
  • লিখেছেন : স্যমন্তক ঘোষ
বাংলা ভাষায় 'দায়' বলে একটি শব্দ এখনও অভিধানে পাওয়া যায়। বাস্তবে তার ব্যবহার কতটা হয়, সে প্রশ্ন বিতর্কিত। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তে বামপন্থীদের সেই দায়ের কথাটা বোধ হয় আরও একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝালাই করে নেওয়া উচিত।
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের মধ্যে শোরগোল পরে গিয়েছে। বিহার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় সিপিআিইএমএল (লিবারেশন)এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কী বলেছেন, তা নিয়ে উত্তাল বঙ্গীয় বামপন্থীরা। তিনি না কি বলেছেন, বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করুক বামপন্থীরা। যদিও সম্প্রতি কলকাতা প্রেস ক্লাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে দীপঙ্কর বলেছেন, যা প্রচার হচ্ছে, তা তিনি বলতে চাননি। তিনি কী বলেছেন, তার একটি ব্যাখ্যাও দীপঙ্কর দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা রাজনীতির খোলা ময়দানে কতটা বাস্তব, কতটা নয়, তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হতে পারে। এই লেখা সেই বিতর্ক উসকে দেওয়ার জন্য নয়। বরং সামগ্রিক ভাবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পর্যালোচনা করার।
পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও প্রান্তে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যে কোনও নাগরিককে যদি প্রশ্ন করা যায়, রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি কে? এক কথায় উত্তর মিলবে। বিজেপি। এটা বাস্তব। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। এবং তাদের লড়াই বিজেপির সঙ্গে। বামপন্থী হিসেবে ভাবতে যতই কুণ্ঠাবোধ হোক, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নিজেদের সেই জমি তৈরি করতে পেরেছে। কী ভাবে করেছে, সে আলোচনায় আসব। তবে তার আগে একটি অন্য কথা বলে নেওয়া দরকার।
এই মুহূর্তে গোটা দেশের যে পরিস্থিতি, যে ভাবে দিকে দিকে সঙ্ঘ পরিবারের আধিপত্য এবং আগ্রাসন বাড়ছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে আলাদা করে দেখার পরিস্থিতি আছে বলে একজন বামপন্থী হিসেবে মনে করি না। বরং গোটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ নির্ধারণ করবে, দেশে বিজেপি আরও একটি রাজ্য পাবে, না কি পাবে না। সার্বিক পরিস্থিতির নিরিখে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দেশের চরিত্র বদলে দিচ্ছে বিজেপি। সংবিধানের এক একটি শব্দ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ইদানীং একটি গালাগালি। সরকারের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করলে অ্যান্টি ন্যাশনাল হয়ে যেতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দিকে দিকে সমাজকর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের জেলে পুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়। বৃহত্তর ফ্যাসিবাদ যখন সমাজকে গ্রাস করে, তখন ক্ষুদ্র বিষয়গুলি গায়ে মাখলে চলে না।
২০১১ সাল থেকে এক দিনের জন্যও মনে হয়নি তৃণমূল বাংলার উন্নতি করতে পারে। 'এক-নেতা' নির্ভর দল পশ্চিমবঙ্গের বুকে কার্যত এক নৈরাজ্য তৈরি করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাণ্ডকারখানার শক্ত হাতে বিরোধিতা হওয়া দরকার। তাঁর প্রতিটি একনায়ক পদক্ষেপের নিন্দা হওয়া দরকার। এবং তার একটি বিকল্প গড়ে তোলা দরকার। প্রশ্ন হল, সেই দায়িত্ব কাদের?
৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষ পর্বের সাক্ষী আমাদের প্রজন্ম। নব্বইয়ের শেষের দিক, একুশ শতকের গোড়ার দিকে বার বার একটি কথা শুনেছি। এ রাজ্যে বামেদের কোনও বিকল্প নেই। এবং সে কারণেই তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। ২০০৬ সালের নির্বাচনেও বোঝা যায়নি, কয়েক মাসের মধ্যে বিকল্প তৈরি হয়ে যাবে। ৩৪ বছরের জমিদারীতে ধস নামবে। গণতন্ত্রে এ ইতিহাস নতুন কিছু নয়। বার বার এমনটা ঘটেছে। ২০১১ সালে বামেরা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে তারা ফের মাথা তুলতে পারবে না, এটা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু দশ বছরেও নয়? এত দিন কেটে গেল, পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতি কোনও নতুন স্লোগান তৈরি করতে পারল না? কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারল না? কেন গ্রামে গ্রামে, কল-কারখানায়, কৃষি জমিতে, নগরে বন্দরে বাম মূল্যবোধের জাগরণ ঘটানো গেল না? কমরেড, ইতিহাসের পাল্টা উল্টে দেখুন। গণ আন্দোলন কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের চরিত্র বদলে দিতে পেরেছিল, পঞ্চশ, ষাট, সত্তরের দেওয়ালে তা আরও একবার ঝালিয়ে নিন। গত দশ বছরে সে কাজটি এতটুকু করে উঠতে পারেনি এ রাজ্যের বামেরা। লকডাউনের সময় কিছু জনহিতৈষী কাজ অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু সেটুকু যথেষ্ট নয়। আরও গভীরে গিয়ে কাজ করা দরকার ছিল। আরও গভীরে গিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জনের প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্য, বামেরা সে কাজটি করে উঠতে পারেনি। তারা এতটাই বিফল যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির মতো শক্তি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। যেখানে ২০১৬ সালের নির্বাচনেও তাদের ভোট ১১ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে বাংলায় লড়াই করতে পারেনি বামেরা।
মানছি, পশ্চিমবঙ্গের এই চরিত্র বদলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল অবদান আছে। মেরুকরণের কুৎসিত রাজনীতি তিনি হাত ধরে টেনে এনেছেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তাঁকে আনতে দেওয়া হল কেন? বামেদের দায় ছিল না, সেই অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার? কেন মানুষের কাছে পৌঁছতে পারলেন না তাঁরা? কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট করতে পারলেন না?
সব ভোট নেগেটিভ হয় না। এই মুহূর্তে কেন্দ্রে এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে ভোট হচ্ছে, তা বিজেপির পক্ষে হচ্ছে। মানুষ বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন। কারণ, সঙ্ঘ পরিবার দীর্ঘ দিন ধরে দেশের গলিতে গলিতে সাম্প্রদায়িকতার সেই বীজ খুব সফল ভাবে রোপণ করতে পেরেছে। আজ সেই বীজ জল হাওয়া পেয়ে ফসল দিচ্ছে। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির কাঠামোগত তফাত নেই। রেজিমেন্টেড ভাবে মানুষের মধ্যে মতাদর্শ পৌঁছে দেয় দু'তরফই। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এক সময় বামেরা সেটা পেরেছিল বলেই ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। গোটা দেশ জুড়ে বিজেপিও এখন সেটা পারছে। এই সত্য অস্বীকার করা এবং উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে রাখা একই বিষয়।
যে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সত্তরের দশক থেকে সেই পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ পরিবার তাদের বীজ বপন করতে শুরু করেছিল। আরএসএস দিকে দিকে স্কুল, শাখা, সংগঠন তৈরি করে নিভৃতে কাজ করে গিয়েছে। হিন্দু জাগরণ সমিতি রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে প্রচার করেছে। গ্রামীণ পরিবারের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েছে। কোন আমলে? বাম আমলে। সে সময়ের বাম রাজনীতি বুঝতেই পারেনি, একদিন সেই ঘটনাই বুমেরাং হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে সঙ্ঘের সেই প্রচার জল হাওয়া পেয়ে বিকশিত হয়েছে। তারই রূপ দেখতে পাচ্ছি আমরা এখন।
দোষ বুঝে নিতে পারলে, আগামী দিনে তা শুধরে নেওয়ার একটি সুযোগ থাকে। মেনে নেওয়া যাক, গত দশ বছরে বামেরা প্রয়োজনীয় একটি কাজও পশ্চিমবঙ্গে করে উঠতে পারেননি। করলে কী হয়, তার একটি স্পষ্ট ফলাফল চোখের সামনে আছে। বিহার নির্বাচন। বিজেপির এই রমরমা বাজারেও বামেরা বেশ কিছু আসন বার করে আনতে পেরেছে। যাঁরা বামেদের ভোট দিলেন, তাঁরা বিজেপিকে ভোট দিলেন না কেন, প্রতিবেশীদের মতো? দিলেন না, কারণ, ওই সমস্ত অঞ্চলে দিনের পর দিন ধরে মার খেয়ে, জান দিয়ে বামেরা মাটি আঁকরে পড়ে ছিলেন। আরও কিছু আসনে প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ পেলে বামেদের ভোট আরও বাড়তে পারতো বলেও মনে করছেন অনেকে। অর্থাৎ, শত্রু যখন বুকের উপর বেয়োনেট চালায়, তখনও প্রতিস্পর্ধা দেখানো যায়। বিহার তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গও তা করতে পারতো। পঞ্চায়েত ভোটে যখন লুঠ চলছিল চারিদিকে, তখন লড়াই করার সুযোগ ছিল বামেদের। করেননি কমরেড। বিজেপি সেই জমি দখল করে নিয়েছে। বামপন্থী কর্মীদেরও কোনও কোনও জায়গায় বিজেপি প্রোটেকশন দিয়েছে। সাংবাদিকতার সূত্রে সে ছবিও নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা জমি হারিয়েছেন। ভাবতে ইচ্ছে করে, ২০২১ সালে বামেরা বিপুল আসন নিয়ে সরকার গঠনের মতো জায়গায় পৌঁছাক। কিন্তু বাস্তবে যে তার দূরবর্তী কোনও সম্ভাবনা নেই, বামেদের থেকে ভালো সে কথা আর কেউ জানে না। মেনে নিতেই হবে, পশ্চিমবঙ্গে ভোট হচ্ছে তৃণমূল বনাম বিজেপির। এই পরিস্থিতিতে চাইব না, সংখ্যাতত্ত্বে বিজেপি ভারতের আরও একটি বিরোধী রাজ্য জিতে নিক। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে বিজেপি সব চেয়ে বড় শত্রু। কারণ তারা ফ্যাসিবাদী। চরম শিবসেনা বিরোধী হয়েও পশ্চিমবঙ্গে বসে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল দেখতে যেমন ভালো লাগে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসে অবিজেপি আরেকটি রাজ্য দেখতেও ঠিক ততটাই ভালো লাগবে। ভালো লাগবে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে বামেরা যদি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যেখানে তৃণমূল বা বিজেপি-- কোনও পক্ষই একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে না। অচলাবস্থা তৈরি হবে।
ছাত্রবেলায় শিখেছিলাম, বামেরা ভোটের রাজনীতি করে না। সমাজ গঠনের রাজনীতি করে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা যদি সেই পরিশ্রম নতুন করে, নতুন উদ্যমে শুরু করেন, তা হলে ফল নিশ্চয় মিলবে। নতুন বামপন্থী আন্দোলনের সূচনামুখ তৈরি হবে। ভুলে যাবেন না কমরেড, ২০০৬ সালের নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু সরকার পতনের পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে।
0 Comments

Post Comment