আমাদের দেশের আইন প্রণেতারা যা কিছু ঘোষণা করেন সবই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। আগামী দেড় বছরে দেশে আবার নির্বাচন আসতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘ আট বছর ধরে যতই হিন্দু–মুসলমান, জাতির বিভাজনের রাজনীতি করুন না কেন তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন দেশের আসল সমস্যা কি? যতই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রচার করুন না কেন, দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটছে, যতই বলুন না কেন তিরিশ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দিকে দেশ এগিয়ে চলেছে, দেশে কর্মহীন যুবকের সংখ্যা যে রোজ বাড়ছে তা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। তাঁরা নিশ্চিত জানেন যে, এই যুবকদের বেশীদিন আর বোকা বানিয়ে রাখা যাবে না। সেইজন্যেই আগামী সাধারণ নির্বাচনকে মাথায় রেখে, তাঁরা দুটি ঘোষণা করলেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে দশ লক্ষ চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। এর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ঘোষিত হলো সেনাবাহিনীতে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া— ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প।
এই ঘোষণার পরেই সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর ঊর্দ্ধতন কতৃপক্ষ হয়তো ভেবেছিলেন যে, বছরে ছেচল্লিশ হাজার চাকরির খবর শুনে দেশের কর্মক্ষম যুবকরা দুহাত তুলে মোদীর প্রশংসা করবেন। কিন্তু দেখা গেল ফল হয়েছে উল্টো। তাঁরা রাস্তায় নেমে পড়লেন এই প্রকল্পের বিরোধিতায়, পুড়িয়ে দিলেন ট্রেন, বাস সহ নানান সরকারী সম্পত্তি। বিক্ষোভকারীদের একজন মারাও গেলেন। সরকার এবং প্রশাসন হতচকিৎ, তাঁরা ভাবতেই পারেননি এমনটা হতে পারে। যাঁরা এই ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প প্রস্তাব করেছেন এই ভেবে যে তাঁরা সেনাবাহিনীর গড় বয়স কমিয়ে আনবেন। তাঁরা হয়তো ভারত এবং ইন্ডিয়ার তফাৎ বোঝেন না। তাঁদের কাছে ২১ বছর বয়সী একজন তরুণ মানেই একজন ঝকঝকে তরুণ, যিনি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যিনি শাইনিং ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি, অথচ তিনি জানেনই না, যে ভারতের অধিকাংশ তরুণ কর্মহীন, এবং তাঁরা এই রকম শর্তে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে চান না। তাঁরা তাঁদের ভারতকে ভালবেসে শহীদ হতেও রাজি কিন্তু এই চুক্তির ভিত্তিতে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে রাজি নন। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী তরুণদের প্রায় ৫০% কর্মহীন। ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরোধিতা মূলত যে রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশী হচ্ছে, বিহারে— কর্মহীন যুবকের অনুপাত দেশের সর্বোচ্চ, প্রায় ৭৬%। সমীক্ষা অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের কর্মহীনতার হার প্রায় ৩৯%। এই অবস্থায় যদি কোনও চাকরী প্রার্থী লক্ষ্য করেন যে, সরকারের একটি সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বা নিশ্চয়তা কমতে পারে, তবে কি তাঁর ক্ষোভ খুব অনায্য?
অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে বিক্ষোভ যখন একটু স্তিমিত, তখন আবার দেখা গেল ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও সরকার একই পদ্ধতি নিতে চলেছেন, ব্যাঙ্কের চাকরির নিশ্চয়তাও কমবে। পেনশন বা গ্র্যাচুইটি নেই, চুক্তি শেষ হলে চুক্তি নবীকরণ হবে কি না তা নির্ভর করছে ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষের ওপর। অর্থাৎ একজন চাকরীপ্রার্থীর চাকরির আর কোনও নিশ্চয়তা রইল না। যদি খেয়াল করা যায় কোভিডের সময়ে আশা কর্মীরা বা অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা যাঁরা দিনরাত এক করে মানুষের সেবা করেছেন, তাঁদের চাকরিরও কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। রোজ সকালে যাঁরা বাড়ির বর্জ্য তুলে নিয়ে যান, যাঁদের জন্য ‘স্বচ্ছ ভারত’ বিজ্ঞাপিত হয়, তাঁদের চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই। এই সমস্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা যদি একদিন কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কি ঘটতে পারে তা কি আমরা আন্দাজও করতে পারি? তাঁরা যদি একদিন কাজ বন্ধ করে মুখের ওপর বলে দেন, আমাদের কাজের নিরাপত্তা না থাকলে আমরা সাত দিন কাজ করবো না, তাহলে কি হবে? এই মানুষদের সুবিধা অসুবিধের সঙ্গে কি সেনাবাহিনীতে চাকরি করা মানুষদের সুবিধা অসুবিধের কোনও পার্থক্য আছে?
অনেকে কর্মহীনতার জন্য কোভিডকে দায়ী করবেন, কিন্তু সত্যিটা কি তাই, কোভিডের আগে থেকেই কি ভারতবর্ষের অর্থনীতির হাল খারাপ হচ্ছিল না? প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বলছেন, দেশের কোনায় কোনায় বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, কিন্তু সত্যিটা এই যে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর নিজের গ্রামেই এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো বুক বাজিয়ে বলতে পারেন, এখন আর ভারতে কেউ খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করেন না, তিনি প্রচুর শৌচাগার বানিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে, সব জায়গায় এখনো জল পৌঁছয়নি। তাঁর সরকারের তরফ থেকে যতই ‘উজালা’ যোজনার প্রচার করা হোক না কেন, সারা দেশ জুড়ে, ভারতের বহু পরিবার গ্যাসের দাম দিতে না পেরে আবারও কাঠ পুড়িয়ে রান্না করছেন। বাস্তবটা বুঝতে পেরে গ্যাসের দামে দুশো টাকা ভর্তুকি দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ইন্ডিয়ার সমস্ত মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে বলে বিদেশে গিয়ে প্রচার তিনি করতেই পারেন, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেলে লম্ফ জ্বালানোর কেরোসিনের দাম আশি টাকা লিটার। তা কেনার ক্ষমতা দেশের বহু মানুষেরই নেই। তিনি ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে গ্যাসের সংযোগ— সব কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগ করালেন আর বললেন, ইন্ডিয়া ডিজিটাল হয়ে গেছে, দুর্নীতি কমে গেছে, অথচ তার ফলে যে ভারতের বহু মানুষ অসুবিধায় পড়েছেন তার খবর কি সরকারের কাছে আছে? অনেকে হয়তো তর্কের খাতিরে বলতেই পারেন, এইটা দেশের একটা ক্ষুদ্র অংশের সমস্যা। কিন্তু তিনি কি জানেন মাসে পঁচিশ হাজার টাকা বেতন পাওয়া মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম? ‘ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবস্থা’ নামে এই রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষুধা সূচকেও ভারতের স্থান কিন্তু তলানিতে।
ধরে নিলাম, এই দশ শতাংশ মানুষ ‘ইন্ডিয়া’র বাসিন্দা এবং তাঁদের জন্যেই শাইনিং ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপণ, বাকি ৯০% ভারতবাসীর খবর কি আমরা রাখি? যে আমলা এবং রাজনীতিবিদেরা ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প বা অন্যান্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন, তাঁরা কি এই ৯০% ভারতবাসীর অবস্থা নিয়ে একবারও ভাবেন? আইপিএল ভারতের সঙ্গে বিপিএল ভারতের যে পার্থক্য আছে, তা কি আইন প্রণেতারা ভাবেন? ভাবেন না বলেই গড় বয়স কমানোর নামে বছরে ছেচল্লিশ হাজার কর্মক্ষম যুবককে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারেন। ভাবেন না, তাই বুঝতেও পারেন না, কেন বারো বছরের একজন শিশু শ্রমিক (জামলো মাকদম) লকডাউনের সময়ে তেলেঙ্গানা থেকে পায়ে হেঁটে ছত্তিসগড় পৌঁছতে দিয়ে রাস্তায় পড়ে মারা যায়। ভাবেন না বলেই, কেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক লকডাউনে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে বাড়ি পৌঁছতে চান, তা বুঝতে পারেন না।
ক্ষুধার্ত শিশুকে স্বান্তনা দিতে তার মা খাবারের বদলে যদি টফি ধরিয়ে দেন তাহলে যা হবে, দীর্ঘদিন চাকরির প্রতিক্ষায় থাকা একজন যুবকের জন্য যদি অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, বা ব্যাঙ্কের কর্মী বা অফিসার নিয়োগে অনিশ্চয়তা নিয়ে আসা হয় তাহলে যা হবার তাই হচ্ছে। বেশীরভাগ রাজনৈতিক দলই অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন। বিরোধী দলের অনেকেই কিন্তু এই প্রশ্নে যতটা সরব, অন্যান্য চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিয়ে ততটা সরব নন। যদি সমস্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের লড়াইগুলোকে একত্রিত করতে পারা যেত তাহলে সে লড়াই একটা সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারতো। তাঁদের যদি বোঝানো যেত, আসল লড়াই সেদিনও ছিল ভাতের, জাতের নয় ধর্মেরও নয়। তাহলে আগামী দিনে তাঁরাই হয়তো অন্যভাবে ভাবতেন, তখন কিন্তু সেনাবাহিনীতে চাকরিপ্রার্থীর লড়াই বা একজন সাধারণ সাফাই কর্মীর লড়াইয়ে কোনও ফারাক থাকতো না।