আমার মত সাধারণ মানুষের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা তৈরি হয় মূলত ইতিহাসের স্কুল পাঠ্য বইগুলি থেকে। সেইসব বইয়ে থাকে কিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আর বিজয়ী ( কিছু ক্ষেত্রে বিজিত) অধিনায়কের বীরগাথা। ইতিহাসের হয়ে ওঠার পিছনে যে সামাজিক বাস্তবতা চালিকাশক্তি হিসেবে থাকে তার বিশ্লেষণ জানার সুযোগ যেমন আম জনতার থাকে না তেমনি যে অনামী মানুষের সমষ্টি ইতিহাসের বাঁক তৈরি করে দেয় তাদের আখ্যানও সামনে আসে না। চলে যাওয়া থেকে চলমান সময়ে ইতিহাস তাই হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তির বীরত্বের অথবা ব্যর্থতার আখ্যান, যা অনেকাংশেই পরিণত হয় মিথে। ব্রেখটের কবিতা অবলম্বনে তৈরি কবীর সুমনের ‘তাজমহল’ গানে বিষয়টা ধরা হয়েছিল ঃ
“এদেশের ইতিহাসে দেখি শুধু নেতাদের নাম
তারাই বিশেষ্য বিশেষণ
ক্রিয়া সর্বনাম”
বর্তমান ভারতবর্ষে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা ২০১৯ এর শীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দানা বাঁধা নাগরিকত্ব রক্ষার আন্দোলন যা শাহীনবাগ আন্দোলন নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সাধারণ মানুষ যেভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে জোটবদ্ধ হচ্ছিলেন, যেভাবে নিজেরাই নায়ক হয়ে উঠছিলেন তা বিগত ৫০ বছরে অভূতপূর্ব। অতিমারীর আগমন না হলে ইতিহাসের মোড় কোনদিকে ঘুরত বলা অসম্ভব। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে শাহীনবাগ ইতিহাস গড়ে দিচ্ছিল।
জনতার এই উৎসবের ইতিহাসকে একটি শিশুর ছোট্ট চাওয়া পাওয়ার গণ্ডীতে এনে ফেলে তার চোখ দিয়ে সমকালকে দেখার একটি অনবদ্য প্রয়াস ফুটে উঠেছে সামিনা মিশ্রর সাম্প্রতিকতম বই “ Nida finds a way” তে। প্রিয়া কুরিয়েনের অলংকরণ আর সামিনা মিশ্রের ঝরঝরে গদ্যের মেলবন্ধনে বইটি গল্পচ্ছলে শিশুদের ইতিহাসের পাঠ দেওয়ার সূচনাফলক; সেই ইতিহাস যা পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে না কিন্তু শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য জরুরী। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ৭ বছরের ছোট্ট মেয়ে নিদা। সকলের আদরের নিদা বড় হয় স্নেহশীল, অতি সাধারণ, সদা আশংকিত বাবার চোখের মণি হয়ে। নিদার বাবা আমাদের বড় পরিচিত। চরিত্রটি আসলে আমার, আপনার সামনে আয়না ধরতেই ফুটে উঠবে। এহেন নিদা তার জগতটাকে বড় করতে চায় কিন্তু নিরন্তর শঙ্কিত বাবার ‘না না না না ‘এর সামনে পেরে ওঠে না। তাই সে রাস্তা খোঁজে। এই রাস্তা খোঁজার গল্প নিয়েই এই বই। বাবার সতর্ক নজর এড়িয়ে সাইকেল শেখার রাস্তা খোঁজা থেকে সমকাল নিদাকে পরিচয় করিয়ে দেয় এক বৃহত্তর আঙ্গিনার সাথে যেখানে তার দেশের মানুষ নতুন নাগরিকত্ব আইনের রক্তচক্ষুর সামনে খুঁজছে তাদের পরিচয়। সদর্পে তারা ঘোষণা করছে যে এক টুকরো কাগজ তাদের পরিচয় নয়, তাদের পরিচয় এই মাটিতেই, তার রং রস স্বাদ গন্ধে। জাতীয় পতাকা, আজাদি স্লোগান, কনকনে ঠাণ্ডা অগ্রাহ্য করে অনামা মানুষদের একসাথে বেঁধে থাকার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে তারা রাস্তা খুঁজছে গোটা পৃথিবীর সামনে তাদের পরিচয়কে তুলে ধরার। বাড়ির উঠোনে ভারসাম্য রেখে সাইকেল চালানোর বাধা অতিক্রম করার শিক্ষা নিয়ে নিদা পৌঁছে যায় প্রশস্ত রাজপথে যেখানে সে পাঠ পাবে সংবিধানপ্রদত্ত সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার। আর নিদার হাত ধরেই উত্তরণ ঘটে তার ভীতু বাবার, তাঁর ‘না’ গুলো ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, মেয়ের সাথে তিনিও ভিড়ে যান অধিকার রক্ষার উৎসবে।
এই গল্প তাই কেবল নিদার রাস্তা খোঁজার নয়, আসলে আমাদের সবার রাস্তা খোঁজার। বহু লড়াইয়ে অর্জিত সামাজিক ভারসাম্যকে নষ্ট করার যে নিরন্তর প্রয়াস চলছে তার আঁচ থেকে আমার আপনার মত জন্মগত সুবিধাভোগী মানুষও কিন্তু ছাড় পাবে না। তাই সময় থাকতে আমরা সামিল হই নিদার জগতে, নিদাদের জগতে যাতে আগামীতে নিদাদের আর আত্মপরিচয়ের রাস্তা খুঁজতে না হয়। মানুষের ইতিহাস লেখার যে সুযোগ সমকাল আমাদের দিয়েছে সে সুযোগে মিলিয়ে নিই আমাদের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
পুস্তক পরিচিতি
“Nida finds a way”
লেখিকা ঃ সামিনা মিশ্র
প্রকাশকাল ঃ জুন ২০২১
প্রকাশকঃ পেঙ্গুইন