পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০: তোমরা (নির্ধনেরা) খাবে নিমের পাচন, আমরা (ধনীরা) খাব মিছরি

  • 22 August, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1475 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
ভারতে শিক্ষা যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ক্রমাগত কেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় সরকার সমস্ত রাজ্যকেই কেন্দ্র আরোপিত শিক্ষানীতি গ্রহণে বাধ্য করেছে। ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতিও শিক্ষায় আঞ্চলিক ও স্থানীয় আকাঙ্খা ও বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখার জন্য রাজ্যের প্রয়োজনীয় ভূমিকাকে খর্বিত করেছিল। এই নীতিটি কেন্দ্রের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও যেটুকু যুক্তরাষ্ট্রিয় অবশেষ বজায় রয়েছে তাকে ধ্বংস করার দিকে আরেকটি জোরালো পদক্ষেপ।

দেশ জুড়ে যখন মহামারিতে ত্রাহি ত্রাহি রব তখন ‘সার্বজনীন’ শিক্ষার জন্য মোদি সরকারের প্রাণ আকুল হযে উঠল। অতিমারিজনিত লকডাউনের ৫ম মাসে সদম্ভে ঘোষিত হল জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০। চারিদিকে মানুষের হাতে যখন কেনাকাটার জন্য কোনো টাকা নেই, মাসে ৫০ লক্ষ চাকুরি যখন নট হয়ে যাচ্ছে, সরকারি ও খয়রাতি বদান্যতায় গ্রামের বহু মানুষ কেবল দুমুঠো ভাত অনিয়মিতভাবে পাচ্ছে, সেই জুলাই মাসে, যে মাসে নুতন করে ১১ লক্ষের বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে ও প্রায় ২০ হাজার কোভিড রুগির মৃত্যু হয়েছে, সেই সঙ্কট সময়কে আত্মনির্ভরের হরিনাম সংকীর্তনে মাতোয়ারা সরকার বাহাদুর নয়া শিক্ষানীতি প্রবর্তনের মাহেন্দ্রক্ষণ মনে করলেন। অবশ্য প্রধান সেবক তো বলেছেনই সঙ্কটকে সুযোগে পরিবর্তিত করতে হবে। যেমন, কারুর বাড়িতে দুর্ঘনা ঘটলে বাড়ির অধিবাসীরা যখন শোকার্ত তখন সেখানকার জিনিসপত্তর হস্তগত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। শোকের সময় বলে সিঁদ কাটাতো আর বসে থাকতে পারে না। তাই তো যে যে বিষয়ে মানুষ প্রতিবাদ করত, যেমন রেল বেচা, বিমান কোম্পানি বেচা, প্রতিবাদি নাগরিকদের গ্রেফতার, কৃষিপণ্যের বানিজ্য উন্মুক্তি এমন সব আমোদি সিদ্ধান্তগুলিকে এই অতিমারির মধ্যেই গ্রহণ করা হল। একইভাবে চটজলদি নয়া শিক্ষানীতিকেও চাপানো হল।

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যানকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের উপযুক্ত কর্তা মনে করার কারণ বোধহয় ভারতীয় শিক্ষাকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা। মাটির সঙ্গে যোগাযোগহীন শিক্ষাক্রম এদেশে চলতেই থাকে, দেশকে আমরা যত কম জানি ততই আমরা জ্ঞানী হই। দেশের শিক্ষাক্রম যে সমগ্র দেশের মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে খেয়াল না রেখে হওয়া উচিত নয়, তেমন ভাবনা এদেশে বিরল ছিল, তা ক্রমাগত বিলীন হতে বসেছে তা এই নীতির পাতায় পাতায় স্পষ্ট। শিক্ষানীতিটি কখনো ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যাকে খুঁজতে চায় নি। কখনো বলেনি যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে অবস্থায় পৌঁছেছে তার জন্য এদেশের অর্থনীতি ও সমাজ দায়ী। ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজে যা ঘটছে তার থেকে ভারতীয় শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। দেখলে তা অন্যায়। সমাজ নিদারুণ বর্ণবিভক্ত, ধর্মবিভক্ত থাকবে, ও অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বণ্টনে চরম বৈষম্য থাকবে. আর সকলের জন্য সমমানের সঠিক গুণমানসমৃদ্ধ শিক্ষার বন্দোবস্ত হবে এমনটা সোনার পাথারবাটি।

একদিকে কোটি কোটি অপুষ্টিতে আক্রান্ত দারিদ্রক্লিষ্ট জনতা, অপরদিকে বিশ্বের চতুর্থ ধনী;এমন এক ভারতবর্ষে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যই হোক বা শিক্ষাই হোক, তীব্র অসাম্য ও বৈষম্য থাকবে এটাই ভবিতব্য। অতিমারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অনাছিষ্টিকে প্রকট করেছে, যেখানে বিনা চিকিৎসায় গুজরাটের রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, সামাজিক বৈষম্যকে সারা দুনিযার কাছে তুলে ধরেছে কোটি পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তায় অনাহারে অর্ধাহারে হাঁটতে হাঁটতে ট্রেন লাইনে কাটা পড়ে মারা গিয়ে। শিক্ষা ক্ষেত্রের চরম অসাম্য যে বিভাজন তৈরি করেছে তা ধনী বিদ্যালয়ের অনলাইনে শিক্ষা আর গ্রামে শহরে কোটি কোটি গরিব শিশুর পড়াশোনা বন্ধ থাকার মাধ্যমে সামনে চলে এসেছে। গ্রাম থেকে শহরে কোটি কোটি শ্রমিকের পরিযায়, ছত্তিশগড়ের ১২ বছরের শিশু পরিযায়ী শ্রমিক জামাল মাকড়মের বাড়ি ফেরার জন্য ২৫০ কিলোমিটার হেঁটে এসে বাসস্থানের কয়েক কিলোমিটার দূরে ডিহাইড্রেসনে মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যথাযথ খাদ্য ও সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত ব্যতিরেকে শিক্ষার সার্বজনীনিকরণ মরীচিকা মাত্র।

গোল গোল কথা শিক্ষানীতিটির বৈশিষ্ট্য। কেবল পরীক্ষায ভালো ফলের জন্য মুখস্ত বিদ্যেকে শিক্ষানীতি নাকচ করেছে, বিষযকে আয়ত্ব করার উপর জোর দিতে চেয়েছে। কিন্তু কখনো একথা বলেনি যে শিক্ষার পণ্যায়ন ও তার থেকে উদ্ভুত বাণিজ্যায়ন জন্যই ওই মুখস্ত বিদ্যা, কোচিং সেন্টার এগুলোর রমরমা হয়েছে। বাবা-মা ছেলে-মেয়েকে ভবিষ্যতে ক্রম-সঙ্কুচিত চাকুরির বাজারের উপযুক্ত করে তোলার জন্যই পরীক্ষা কেন্দ্রিক ও মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করে ও উদ্বুদ্ধও করে। কোচিং সেন্টার নির্ভর মুখস্ত বিদ্যার উপরে নির্ভরশীল তথাকথিত প্রতিযোগিতামূলক সাফল্যের হাত থেকে কীভাবে নিস্তার পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে শিক্ষানীতি নিশ্চুপ।

একদিকে সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার গল্প, অপরদিকে ৩-৫ বছরের শিশুদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে প্রাক-বিদ্যালয় শিক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত গোড়া থেকেই ধনী-দরিদ্রের শিক্ষার মধ্যে তফাৎ করে দিতে চাইছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের এর জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যা তাঁরা তাদের বর্তমান কাজের পাশাপাশি গ্রহণ করবেন। শিশু শিক্ষা যে কতটাই ব্রাত্য তা এই ধরণের চিন্তার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। এমনিতেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সরকারি চাকুরে হিশেবে গণ্য না করে অতি স্বল্প ভাতায় তাঁদের কাজ করানো হয়, তার উপরে এই ধরণের চাপ। তাছাড়া, মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলি তো অঙ্গনওয়াড়িতে তাঁদের শিশুদের পাঠাবে না এটা জানা কথা। সরকার কি বেসরকারি প্রাক-বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দেবে? তাতো দেবেই না। তাই গোড়া থেকেই সমাজে পার্থক্য সৃষ্টি করা হবে, আর নীতি দলিলে লেখা হবে ‘শিক্ষা একটি মহান সমতা প্রদানের অস্ত্র’ (Education is a great leveller)- শুনে রসিকতা মনে হয় ।

এই ধনী দরিদ্রের তফাৎ নিয়ে আরেক প্রস্থ রসিকতা করা হয়েছে যখন শিক্ষার মাধ্যমের কথা বলা হয়েছে। আমরা সকলেই জানি অভিজাত শাসক শ্রেণী ও তাদের সহযোগীদের কাঙ্খিত শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, এবং সেই কারণেই বিদ্যালয় শিক্ষার বেসরকারি করণের পথ ক্রমাগত প্রশস্ত হয়েছে। একটু স্বচ্ছল, এমনকি নিম্নবিত্ত অভিভাবকেরাও তাঁদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর ফলে সকল শহরেই মাতৃভাষার মাধ্যমের সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। শিক্ষানীতি অনুযায়ী” যেখানে সম্ভব সেখানেই মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হবে, অন্তত ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এবং ৮ম শ্রেণি বা তার উর্ধতন স্তরেও”। বাক্যের চলনেই বোঝা যাচ্ছে শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে কতটা দায়সাড়া উচ্চারণ। সরকার কি বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠন বন্ধ করবে? অবশ্যই না। যদি তা করা হয়, তাহলে সারা দেশের শহরগুলিতে আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় গঠনের হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে।

নয়া নীতিতে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনকি কর্মশিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যেও ভাগ বাটোয়ারা হবে না। ১২ ক্লাস পর্যন্ত তেমন বিভাজন বর্তমানেও নেই, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। যদিও শুনতে ভাল, কিন্তু তেমনটা চালু করতে বিপুল পরিকাঠামোগত ব্যয় হবে। সেটা কেউ করবে বলে মনে হয় না, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড় ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতো নয়ই। এতে শিক্ষার কী উন্নতি হবে বা শিক্ষার সার্বজনীনিকরণে কী সুবিধে হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। দেশের বেশির ভাগ সাধারণ দরিদ্র মানুষের পক্ষে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণে অপারগতা এই অতিমারিতে প্রকট হওয়া সত্বেও অনলাইন শিক্ষার উপরে প্রভূত জোর দেওয়া হয়েছে, যা আগেই বলা বিভাজনকে তীব্রতর করবে। শাসকরা ধরেই নিয়েছে যে শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়া কিশোর –যুবকদের চলে যাওয়ার রাস্তাকে মসৃণ করেই শিক্ষা ব্যবস্তা উন্নত হবে। তাই স্নাতক স্তরটিকে ৪ বছরের করে দীর্ঘায়ত করা হবে ও যারা স্নাতক স্তরে পড়তে আসবে তাঁদের জন্য বৎসরান্তিক শংসাপত্র নিয়ে চলে যাওয়ায় সরকারি শিলমোহর লাগানো হবে। এছাড়াও, দূরশিক্ষাকে বিস্তৃত করে প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়মুক্ত করা হবে।

ত্রিভাষা শিক্ষার কথা বলে প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে তোলার ষড়যন্ত্র নীতি দলিলটির ভিতরে প্রোথিত রয়েছে। কোনো বিদ্যালয়েই সব রকমের ভাষা শেখানোর মত পরিকাঠামো থাকবে না। ফলে তৃতীয় ভাষা হিসেবে এসে উপস্থিত হবে হিন্দি, তাকে ঐচ্ছিকের ছদ্মবেশে বাধ্যতামূলক করে তোলা হবে। শিশুরা দ্রুত ভাষা আয়ত্ব করতে পারে বলে কেন তাকে ৩টি ভাষা শিখতে হবে তার অন্য কোন যুক্তি নেই, কোন দেশেই শিশুর উপরে এরকম ৩টি ভাষা শেখানোর চাপ তৈরি করা হয় না। একদিকে বোঝা কমানোর চর্চা অন্যদিকে ৩টি ভাষা শেখানো অবশ্যই পরস্পরবিরোধী। শিশুবয়স থেকেই কোডিং শেখানোর চিন্তা আরেক যান্ত্রিকতার দিকে এগোনো। কোডিং বলতে কী বোঝানো হয়েছে কে জানে?

উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে একদি বানিজ্যিকীকরণ অপরদিকে কেন্দ্রিকরণের ঝোঁক সুস্পষ্ট। ইউজিসিকে তুলে দিয়ে একটি ভারতের উচ্চ শিক্ষা সংসদ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষায় ছড়ি ঘোরানো হবে। সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সমস্ত বিষয় পড়াতে হবে। যে সমস্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেমনটি করতে সক্ষম হবে না, বা যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যা কম সেগুলিকে একত্র করার জন্য গুচ্ছ তৈরি করা হবে। এই গুচ্ছ তৈরি করার ভাবনা বিদ্যালয় স্তরেও রয়েছে। এর অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ছাত্রদের দূরত্ব বাড়বে। ফলে বিদ্যালয় স্তরে স্কুলছুট হওয়ার সম্ভাবনা আরো বাড়বে। অন্যদিকে সেই সব গুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের স্থানগুলিতে বিনিয়োগ করতে হবে। যার জন্য পিপিপি মডেলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ডাক দেওয়া হবে। যদিও মানবকল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলিকেই শিক্ষায় কাজ করার সুযোগের কথা বলা হয়েছে, যারা মুনাফার বদলে বদান্যতা দেখাতে শিক্ষায় বিনিয়োগ করবে, তবুও সেই মুনাফাহীন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে আমরা যারপরনাই ওযাকিবহাল। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আস্তে আস্তে স্বায়ত্বশাসিত করে তোলা হবে। প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বশাসন দেওয়া হলেও শিক্ষাক্রম গঠনের স্বশাসনের কথা বলা হয নি। আর্থিক স্বশাসনের অর্থই হল সরকারের দায় কমানো। ফলে ছাত্রদের পড়ার খরচ বাড়বে। ওই সমস্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্টানের প্রশাসনের ক্ষেত্রে যে প্রশাসক মন্ডলি গঠনের কথা বলা হয়েছে তাতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের কোন ভুমিকার কথা উচ্চারিত হয় নি। বোঝাই যাচ্ছে যেটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর আছে তাকেও খর্বিত করার সার্বিক প্রচেষ্টা চলবে। এতদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষা ও গবেষণা দুটিই চলত। নতুন নীতি অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা হবে। এমন বন্দোবস্ত উচ্চ শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুরুত্ব হ্রাস করবে। গবেষণার তহবিলের ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত কেন্দ্রিকতার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে তহবিল প্রদানের ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয নির্বাচনেও জাতিয় গবেষণা তহবলের ভূমিকা থাকবে। ফলে উচ্চ শিক্ষায় চরম কেন্দ্রিকতার আকাঙ্খা প্রকাশ পেয়েছে।

গেরুয়া বা্হিনী কর্তৃক প্রাচীন ভারতের গরিমার বিজ্ঞাপন ও উচ্চকিত উচ্চারণ নীতি দলিলের বিভিন্ন পাতায় প্রকাশ পেয়েছে। তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা, বল্লবী প্রভৃতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের উজ্বল ভূমিকা অবশ্যই প্রণিধেয়। কিন্তু তার পাশাপাশি একটি তুমুল বর্ণ বিভাজনের যে কুৎসিত পরম্পরা চালু ছিল ও এখনো আছে, যার ফলে দলিত ও অস্পৃশ্যরা শিক্ষার আঙিনাতেই ঢুকতে পারত না, তাকে বিষ্মৃতিতে পাঠাতে চেয়েছে এই নীতি দলিল। সংস্কৃত মূলত: উচ্চ বর্ণের ভাষা। এই দলিল সেই ভাষার উপরে জোর দিয়ে বর্তমান শাসকদের ব্রাহ্মণ্যবাদি মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।

শিক্ষায় জিডিপির ৬% বিনিয়োগের চেষ্টা করা হবে বলে ঘোষণা হয়েছে। সমস্ত শিক্ষানীতিতে রাজ্য সরকারগুলির কথা উচ্চারিত হয় নি, কিন্তু অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি যৌথভাবে করবে বলে বলা হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্র শিক্ষা ক্ষত্রে খরচ করে জিডিপির ০.৫ শতাংশেরও কম। রাজ্যগুলি সমেত সারা ভারতে শিক্ষা ক্ষেত্রে মোট ব্যয় জিডিপর ৪ শতাংশের মত। কীভাবে তাকে ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে তার কোন রূপরেখা নেই। হয়তো দেখা যাবে বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে শিক্ষা ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দিয়ে তাদের বিনিয়োগ করতে দেওয়া হল ও তার মাধ্যমেই ওই ৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হল, এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের বিনিয়োগের উপরে উচ্চ হারে প্রতিদান পাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। তার ফলে ধনীর জন্য উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হবে, গরিবের জন্য রুদ্ধ।

শেষে বলি, ভারতে শিক্ষা যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ক্রমাগত কেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় সরকার সমস্ত রাজ্যকেই কেন্দ্র আরোপিত শিক্ষানীতি গ্রহণে বাধ্য করেছে। ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতিও শিক্ষায় আঞ্চলিক ও স্থানীয় আকাঙ্খা ও বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখার জন্য রাজ্যের প্রয়োজনীয় ভূমিকাকে খর্বিত করেছিল। এই নীতিটি কেন্দ্রের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও যেটুকু যুক্তরাষ্ট্রিয় অবশেষ বজায় রয়েছে তাকে ধ্বংস করার দিকে আরেকটি জোরালো পদক্ষেপ।

0 Comments

Post Comment