এই যে, শুনুন মশাই, বানান টা ঈদ না ইদ, তাই নিয়ে এঁড়ে তক্কো বাঁধালে লাচ্চা সিমাই এর লিস্ট থেকে আপনার নামটা প্রথমেই কেটে বাদ দেবো এইটে আগাম হুমকি দিয়ে রাখলুম। কি কইছেন? সিমাইতে আপনার ইন্টারেস্ট নেই? আপনি সেরেফ বিরিয়ানি খান। তা আপনার পাপী হৃদয়কে পরম করুণাময় ঈশ্বর যদি সিমাই এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রাখেন তার দায় তো আর আমার হতে পারেনা।
আপনি সুনীতি আচার্যি নন, আমিও নীরেন চক্কোত্তি নই, সুতরাং, এসব বানান নিয়ে বখেড়া বাড়িয়ে কি হরিমটর লাভ হবে বলুন? তার চেয়ে কত্তা, আজ ঈদ-উল-ফিতর, আসুন একটু মিষ্টিমুখ করে যান। করোনার সময়, তাই কোলাকুলিটা করতে পারবো না। তবে দূরত্ব যাইই থাক, ভালোবাসা থাকবে অফুরান।
আর কি বলছেন?নাম? নাম জানতে চাইছেন তো? আজ্ঞে, আমার নাম মেহফুজ আলম। ডাক নাম রাণা। মাহফুজ বা মাফুজ নয় দাদা, মেহফুজ। উচ্চারণ করতে জিভে আটকাচ্ছে? গিরীন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়? ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ? উইলহেল্ম ম্যাক্সিমিলিয়ান উ্যন্ডট? তাও দিব্যি গড়গড়িয়ে শেয়ালদা সাবওয়ের মত আউড়ে ফ্যালেন। তাই তো?
তাহলে আমার নাম মেহফুজ আলম, এইটে উচ্চারণ করাটা আমার নামের নয়, আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা।
আবার কি হল? বিরিয়ানির নেমতন্ন করছি না ক্যানো জিগাচ্ছেন? কোন বাঙালি বাড়িতে রোজ রোজ বিরিয়ানি হয় বলুন তো? দুবেলা বিরিয়ানি খেলে আপনার পেটে লাইন দিয়ে অ্যান্টাসিড আর ভিটাজাইমের শিশি ঢুকবে না?
ওহ…বুঝেছি কত্তা। আপনার ভিতরে সেই চিরপুরাতন দ্বন্দ লেগেছে। মুসলমান নাকি বাঙালি? আরে মশাই, কোন শাস্ত্রে লেখা আছে বলুন তো যে বাঙালি একটি ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক পরিচিতি?
আপনার নামের শেষে পৈত্রিক ঘোষ, দাস, বসু, মিত্র লেগে থাকলেই যেমন আপনি বাঙালি হয়ে ওঠেন না, তেমনি খান, রহমান, ইসলাম, আলম রাও শুধুমাত্র আরবি নাম থাকলেই অবাঙালি হয়ে যান না। বাঙালি একটি ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত পরিচয়। তার সাথে ধর্মের বিন্দুমাত্র যোগ নেই। ঠিক যে কারণে ভি বালসারা, আমার আপনার থেকে হাজারগুণে বেশি বাঙালি।এই সহজ সত্যটা যদি আপনার মাথায় না ঢোকে তাহলে রাঁচী থেকে কুড়ি কিলোমিটার দক্ষিণে কাঁকেতে ঘুরে আসতে পারেন।
আচ্ছা, চলুন এসব কথা একপাশে সরিয়ে রেখে একবার আমার বাড়ি যাবেন। চেনেন না? তাই তো? চিনিয়ে দিচ্ছি মশাই।ঈদের দিন সকাল সকাল বহরমপুর মোহনা বাস স্ট্যান্ড থেকে ডোমকল-ইসলামপুর লাইনের বাস ধরুন। দৌলতাবাদ পেরিয়ে ছয়ঘরি বাস স্ট্যান্ডে নামবেন। মাত্র আঠেরো কিলোমিটার দূরত্ব। বাস স্ট্যান্ড থেকে টোটো পাবেন। বলবেন বদর মাস্টারের বাড়ি যাবো। পঞ্চায়েত আপিসটা পেরিয়ে মসজিদটাকে বাম হাতে রেখে টোটো ঘুরবে আমাদের বাড়ির দিকে। আগে কাঁচা রাস্তা ছিল। বছর কয়েক হল পাকা হয়েছে।
খানিক এগিয়ে রাস্তার ধারে বাঁধানো কবরটা দেখছেন? ওখানে শুয়ে আছেন সুরসাধক উস্তাদ আবু দাউদ। তার পৈত্রিক বাড়ি এইখানেই।
এই যে। প্রায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু ঈদের নামাজের সময় হয়ে গেছে। এবার করোনার সময় জামাত হবেনা। যে যার বাড়িতেই পড়ে নেবে। আমরা দুই ভাই সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে জায়নামাজে দাঁড়িয়েছি। পরিষ্কার জামাকাপড় এবং শুদ্ধ মন থাকলে আপনিও আমাদের সাথে দাঁড়াতে পারেন। আমরা পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো বিশ্বের সমস্ত মানুষের জন্য। আমাদের সব আত্মীয়-অনাত্মীয়দের দের কল্যাণের জন্য।
নামাজ শেষ। এইবার চলুন গোরস্তানের দিকে যাই। মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথ। ডানহাতে জুম্মা মসজিদ পেরিয়ে বামহাতে বড় গোরস্তান। এইখানেই আমাদের আব্বা কে আমরা শুইয়ে দিয়ে এসেছি হপ্তাকয়েক হল। এইবারের ঈদ তিনি দেখে যেতে পারেন নি।জানেন, প্রত্যেকটা ঈদ আমরা আব্বার সাথে ঈদগাহে আসতাম।এইবারই প্রথম আব্বা আমাদের সাথে এলেন না। আর কোনোদিনই আসবেন না।কিন্তু, অপেক্ষায় থাকবেন যে কবে তার সন্তানেরা তার জন্য প্রার্থনা করতে আসবে। আমরা কিন্তু এখানে শুধু আমাদের আব্বার জন্য প্রার্থনা করবো না। এখানে শুয়ে থাকা সমস্ত মানুষের বেহেস্তবাসের উদ্দেশ্যে আমরা পরম করুণাময় আল্লাহের কাছে হাত তুলে দোয়া চাইবো। সম্ভব হলে আপনিও আমাদের সাথে প্রার্থনা করুন সমস্ত ‘তারা’ হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য। তারা যেন জান্নাতবাসী হোন। তার জন্য কোনো আরবি ভাষায় দোয়া পড়াটা জরুরী নয়। বাংলায় প্রার্থনা করুন। হৃদয় থেকে করুন। তাহলেই হবে।
আমাদের বাড়িতে আমার চাচাতো ভাই দাড়ি রাখেন। ফেজ টুপি পরেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমাদের বাড়িতে কোনো লুকোনো অস্ত্র নেই।আপনার প্রতি কোনো সযত্ন চর্চিত বিদ্বেষও নেই। আমরাও ডাল-ভাত খাই। বিরিয়ানি খেলে তার আগে অ্যান্টাসিড খেতে হয়। আমরা বাঙালি। ঠাকুরবাড়িতে দূর্গাপূজা হলে আমরাও ভিড় করে দেখতে যাই। আমাদের বাগানের পাশে আগে রামনবমীর মেলা হত। কোনোদিনই সেটা অন্যের উৎসব মনে হয় নি।
এবার আমাদের বাড়ি চলুন। মা আর ভাবি মিলে সিমাই, বোঁদে আর পায়েস বানিয়েছেন। একটু মিষ্টিমুখ করুন। ঈদের শুভেচ্ছা নিন। আমরা আপনার মঙ্গল চাইবো।
আজ পবিত্র ঈদ। আসমানী চাঁদের অপার্থিব আলোয় আপনার জীবন উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
দাওয়াত রইলো ভাই। আপনি আসছেন তো?