পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মুড়ির টিন

  • 13 August, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1003 view(s)
  • লিখেছেন : রোহন রায়
[এক] “কথাটা তাহলে সত্যি?” হারাধন মাইতি কাঁচুমাচু মুখে বলল, "আমাদেরই পাড়ার লোক স্যার। বুড়ি মানুষ। চোখে দ্যাখে না ভালো, তাই হয়তো বুঝতে পারেনি। আপনি একবারটি চলুন, আমি সব ম্যানেজ করে দিচ্ছি।” বিডিও উত্তেজিত গলায় বললেন, "কিন্তু বাক্সটা উনি পেলেন কোত্থেকে?"

 

প্রশ্নটা এতই সরল যে, উত্তর দেবার দরকার পড়ে না। সত্যি বলতে কী, আদৌ প্রশ্নই বলা যায় না একে। কথার পিঠে বেরিয়ে আসা কথা মাত্র। বিডিও-ও বিলক্ষণ জানেন সেটা। তবু ভদ্রতার খাতিরেই চোখ নামিয়ে নিল হারাধন।  

বিডিও একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। ব্লকের চৌষট্টিটা বুথের আটটায় এমন ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে যে রিপোল করাতে হয়েছে। একটা বুথে আবার মোট ভোটার এগারোশো একাত্তর, কিন্তু বিজয়ী জেলা পরিষদ প্রার্থী পেয়েছেন বারোশো একুশ ভোট। কম পাঁক ঘাঁটতে হয়নি। জবাবদিহিও কম করতে হয়নি। সে-পর্ব এখনও চলছে। বিডিও-র নতুন চাকরি। এটাই প্রথম পোস্টিং। জয়েন করেই ছ-মাসের মাথায় পঞ্চায়েত ইলেকশন। ‘চোখে সর্ষেফুল’ প্রবাদটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন এই কদিনে। তা সেসবই নাহয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু এ-কেমন বেয়াড়া সমস্যা? ইলেকশন কমিশনের কাছে ফাইনাল রিপোর্ট পাঠানো এখনও বাকি। ‘পারফেকশনিস্ট’ বিডিও সাহেবের কপালে বিনবিনে ঘাম জমল। রিমোট টিপে ঘরের এসিটা ষোলোয় করে দিলেন তিনি। হারাধনকে জিগ্যেস করলেন, “কোন বুথ ছিল তোমাদের?”

“হাতিবেড়িয়া বিবেকানন্দ স্কুল স্যার। একশো ছত্রিশ নম্বর বুথ।”  

টেবিলের উল্টোদিকে বসা বিডিএমও-র দিকে তাকালেন বিডিও, “অনিন্দ্যবাবু, রিপোর্টটা একবার চেক করুন প্লিজ।"

বিডিএমও প্রৌঢ়, ধীরস্থির মানুষ। অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন। এমন একটা অবিশ্বাস্য কথা শুনেও তাঁর বিশেষ ভাবান্তর ঘটেনি। টেবিলের ফাইলের স্তূপ থেকে বেছেবুছে একটা নীল ক্লিয়ার ফাইল টেনে নিলেন তিনি। তার ভিতর থেকে একটা কাগজ বের করে খানিকক্ষণ মন দিয়ে দেখলেন। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, "একশো ছত্রিশে রিপোল হয়েছে স্যার। প্রথমবারের দুটো বাক্স পুকুরে পাওয়া গেছে। পঞ্চায়েত সমিতিরটা মিসিং ছিল। তার মানে এটাই সেই বাক্স।" 

“হ্যাঁ স্যার,”সায় দিল হারাধন, “পঞ্চায়েত সমিতির বাক্স। রং ছাড়া যেটা।”

“মুড়ির টিনই তো বলে ওকে।” মুখ টিপে হাসলেন বিডিএমও।   

বিডিও বিরক্ত মুখে হারাধনকে বললেন, “তোমরা আগে জানতে না?”

“না স্যার, মাক্কালী জানতাম না,” হারাধন কণ্ঠার হাড়ে হাত ছোঁয়াল, "আপনার ফোন পেয়েই তো দাদা আমায় ফোন করল। আমি তক্ষুনি ছুট্টে গিয়ে দেখে এলাম। তারপরেই সোজা আপনার কাছে আসছি। দাদা আপনাকে খুব রেসপেক্ট করে, জানেনই তো। বলল সরকারি ব্যাপার, বিডিও স্যারকে না-জানিয়ে খবরদার কিছু করবি না। আপনার কানে খবরটা উঠেছে মানে অপোনেন্ট একটা বাওয়াল খাড়া করার চেষ্টা করছে স্যার, বুঝতেই পারছেন। ঠাকমা স্যার আমাদেরই ভোটার। সবাই জানে।"   

মুখ চুলকে ওঠে বিডিও-র। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এলে বোঝা যায়, সংবরণই জীবন। পঞ্চায়েত-প্রধানের একটা সেজোমাপের সাইডকিককে অবধি গলা তুলে ধমক দেবার জো নেই। বিডিও তাঁর অগতির গতি বিডিএমও-র দিকে তাকালেন, "অনিন্দ্যবাবু, আপনিও চলুন তবে।"

মিনিট পাঁচেক পর সরকারি গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে জাঁকিয়ে বসে হারাধন বলল, "একটা কথা আগেভাগে বলে রাখি স্যার। বুড়ি একা মানুষ। বিধবা। ছিলেপিলেও নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে, বড় দুর্মুখ।" 

 

[দুই]

হারাধনের নির্দেশমতো অলিগলি ঘুরে সাদা এসইউভি এসে দাঁড়াল একটা মাটির একটেরে বাড়ির সামনে। খড়ের ছাউনি, টিনের দরজা। সামনে ছোট্ট এইটুকু উঠোনমতো। সেখানে দড়িতে ঝুলছে একটা ভেজা গামছা আর খানতিনেক ন্যাতা। উঠোনে একটা হাড়জিরজিরে কুকুর শুয়ে ঝিমোচ্ছিল। গাড়ি দেখে ভয়ে ভয়ে সরে পড়ল। 

দাওয়ায় একটা তালপাতার চাটাই পাতা। তার ওপর গিয়ে বসল হারাধন। ডাক ছাড়ল, "ঠাকমা, আছো নাকি?"

খুনখুনে গলায় জবাব এল, "কে রে?"

"আমি গো। হারা। কথা আছে। এসো"

একটু পরে দরজা খুলে বুড়ি বাইরে এল। শনের মতো কয়েকগাছা সাদা চুল। চামড়া কুঁচকে গেছে। খড়ি ফুটেছে জায়গায়-জায়গায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে পিঠ। গায়ের সাদা থানটা ময়লা, শতচ্ছিন্ন। বয়েস অন্তত পঁচাশি তো হবেই। হারাধনের দিকে চেয়ে বলল, "তুই আবার? কী হইছে?"

"এই সাহেবরা এসেছেন তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।"

চোখ কুঁচকে ঠাহর করার চেষ্টা করল বুড়ি, "কে এঁয়ারা?"

"সরকারি আফিসার গো ঠাকমা," বিডিও-র দিকে নির্দেশ করে হারাধন বলল, "ইনি হচ্ছেন আমাদের বিডিও সাহেব।"

বুড়ি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, "বসো বাছারা। ঘরের যা হাল, এখানেই বসো। জলটল খাবে?"

বিডিও বিরক্ত মুখে হারাধনের দিকে তাকালেন। হারাধন বলল, "ঠাকমা, এঁনারা একটা দরকারে তোমার কাছে এসেছেন। বসাটসার সময় নেই। তোমার নতুন মুড়ির টিনটা সাহেবদের দেখাও তো। একটু আগে আমায় যেটা দেখালে।"

"কেন? মুড়ির টিন দেখাব কেন?" বুড়ির গলায় সন্দেহ।

“আহা আনোই না। তারপর বলছি।”

বুড়ি বিডিও আর বিডিএমও-কে খর চোখে মেপে নিল একটু। তারপর হারাধনকে বলল, “সবাই মিলে আমার মুড়ির টিনের দিকে নজর দিছিস কেন রে? পত্থমে নিজে দেখে গেল, এখন আবার সরকারি আপসার ধরে এনেচে। মতলবটা কী তোর?”

“তোমার ওই মুড়ির টিনে একটু গোলমাল আছে ঠাকমা। সেইজন্যই তো এঁরা দেখছে এসচেন।”

“কী গোলমাল আছে? দিব্যি পরিষ্কার ফটফট করচে। সুন্দর কবাট। ইঞ্জিনের টিনের থেকে অনেক ভালো। একটু টোল খেয়েচে। তাতে মুড়ি রাখতে তো অসুবিধা হচ্চে না।”

“আরে না-দেখে বলবে কী করে গোলমালটা কোথায়? তুমি নিয়ে তো এসো।”

"কোন আপসার বাড়ি বয়ে এসে মুড়ির টিন দেখতে চায়?" গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে গেল বুড়ি। একটু পরেই তোম্বা মুখে বেরিয়ে এল দুহাতে একটা টিনের বাক্স ধরে।

হারাধন বলল, “এখানে রাখো দিকি। সাহেবদের সামনে রাখো।”

বুড়ি বাক্সটা নামিয়ে রাখল। বিডিও আর বিডিএমও একযোগে ঝুঁকে পড়লেন সেটার ওপর।

কোনও সন্দেহ নেই। ইম্প্রোভাইজড ব্যালট বক্স।  চকচক করছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের ভোটগ্রহণের জন্য এই ধরনের টিনের বাক্স ব্যবহার করা হয়। এবারের পঞ্চায়েত ইলেকশনে ব্যালট বাক্সের গায়ে কিউ আর কোড বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই কোডও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। সামনের দিকে কয়েক ফোঁটা লাল গালা শুকিয়ে আছে। ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই বাক্সে তালা মেরে গালা সিল করে দিতে হয়। তারই চিহ্ন। বাঁ পাশে একটা জায়গায় খানিকটা অংশ তোবড়ানো। ব্যালট-লুটেরার দল নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছে। ভোটকর্মীদের লব্জে এই বাক্সের নাম সত্যিই ‘মুড়ির টিন’। কথাটা যে এভাবে আক্ষরিক অর্থে সত্যি হয়ে যাবে, কে জানত। বিডিও হাসি চেপে বুড়িকে জিগ্যেস করলেন, "এই বাক্স আপনি কোথায় পেলেন?"

"মাকালতলায় নদীর পাড়ে। কে ফেলে রেখে গেছল। ভালোই হল।"

"কখন পেলেন?"

"তা ভোরের বেলা হবে।"

"আপনি জানেন এটা কীসের বাক্স?"

"মুড়ির টিন। আবার কী!"

"না, মুড়ির টিন নয়। এটা ব্যালট বাক্স।"

"ব্যালট বাস্কো আবার কী?"

"ব্যালট জানেন না? ব্যালট মানে ভোটের কাগজ। এটা ভোট দেবার বাক্স।"

“কী বলে রে!” বুড়ি চোখ কপালে তুলে বলল, “পাগল আছু নাকি তুমি? ভোটের বাস্কো কি নদীর ধারে গড়াগড়ি খায়?”  

বিডিও খর চোখে হারাধনের দিকে তাকিয়ে নিলেন একবার। এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা করতে পারেন তিনি। হারাধন লোকটাকে অবশ্য মোটের ওপর বিনয়ীই বলতে হবে। লজ্জা আর অপরাধবোধ মেশানো একটা বোকাটে হাসি হাসল সে।

উপায়ান্তর না দেখে বিডিও এবার বুড়িকে বোঝাতে বসলেন, “শুনুন, আপনি চোখে কম দেখেন বলে বুঝতে পারেননি। আপনি তো ভোট দিয়েছেন। দুবার করে ভোট হয়েছে তো আপনাদের। প্রথমবার ভোট লুট হয়ে গেল বলে আবার হল। দুবারই তিনটে বাক্সে আলাদা আলাদা করে কাগজ ফেলতে হয়েছে, মনে আছে? এটা হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতের বাক্স। বাকিদুটো সবুজ রঙের। এটায় রং নেই।”

বুড়ি খুব মন দিয়ে সবটা শুনল। তারপর খুব সেয়ানা মুখ করে বলল, “কিন্তু তোমাদের কথা বিশ্বাস কী করে করি বাছা? তুমি সরকারি আপসার কিনা সেটাই বা বুঝব কেমন করে?”

“আরে আমি এই ব্লকের বিডিও। গাড়িতে দেখুন সরকারি ছাপ মারা।”

“আমি সরকারি ছাপ চিনি নাকি?”

“কী মুশকিল!” বিডিও হতাশ গলায় বললেন, “এই হারাধন, বোঝাও না একে!” 

হারাধন বলল, “আরে ঠাকমা, উনি কত বড় আপিসার, এমুনভাবে কথা বলছ? যা বলছেন, শুনে নাও। তোমার ভালোর জন্যই তো বলছেন।”

বুড়ি ঘাড় দুলিয়ে ক্যাটক্যাটে সুরে বলল, “তোকেও বিশ্বাস করব কিনা বুঝে উঠতে পারি না হারা। দুবার করে ভোট দিতে যেছি, দুবারই বলল ভোট পড়ে গেছে আর যাবার দরকার নেই। আরে বাপু, ভোট তো আমি হ্যাজাকেই দিতাম নাকি। তোরাই তো দেখিস আমায়। আমার আর আছেটা কে।”

হারাধন থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।

বিডিও-ও গুম মেরে গেছেন। আষাঢ়ের মেঘ তাঁর মুখে।

অগত্যা বিডিএমও হাল ধরলেন, "এ-জিনিস ঘরে রাখতে পারবেন না ঠাকুমা। আইন নেই। এটা ফাঁকা করে দিন। আমরা নিয়ে যাব।"

"নিয়ে যাব! বললেই হল নিয়ে যাব!" মুখ ভ্যাংচাল বুড়ি, "সরকারি আপসার না ডাকাত তোমরা? এত এত মাইনে পাও, আরেকটা বাস্কো কিনে নিতে পারছু না?"

"কিন্তু এটা সরকারি জিনিস। বাড়িতে এভাবে ব্যবহার করার নিয়ম নেই।"

"সরকারের জিনিস মানে তো আমাদেরই জিনিস। সরকারটা কাদের? আমাদের লয়?"

"কিন্তু সবকিছুরই তো একটা নিয়ম থাকে ঠাকুমা। ভোটের বাক্স ভোট ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না।"

কথাটা মাছি-তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল বুড়ি, "এমন ভালো টিকাও বাস্কো তো এদিকে হুট বলতেই মেলে না। বাস্কো নিয়ে যেতে পারবে না বাপু। পাঁচটা টাকা চাও তো দিতে পারি।" 

বিডিও অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ কথাটায় চটে গিয়ে একটু গলা চড়িয়ে বললেন, "আপনি কথা শুনতে না চাইলে বাধ্য হব পুলিশ ডাকতে।"

এতক্ষণে যেন বুড়ি একটু চমকাল। সতর্ক গলায় বলল, "কেন? পুলিশে ধরবে কেন? হ্যাজাকের ভোটার না আমি?”

“তা আপনি কথা না শুনলে আর কী করতে পারি বলুন? আপনাকে বলা হচ্ছে এটা ভোটের জিনিস, এটা ঘরে রাখা যাবে না, আপনি তো শুনছেনই না।”

বুড়ি খানিকক্ষণ কুটিল চোখে তাকিয়ে রইল। মুখের বলিরেখাগুলো কিলবিল করে উঠল। তারপরেই সপ্তমে গলা তুলে চেঁচিয়ে উঠল, “ও হারা, কী বলছে দ্যাখ বাবু! আমাকে পুলিশ ধরবে? কেন? কী দোষ করিচি আমি?"   

হারাধন একটু দূরে গিয়ে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিল। বুড়ির চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি ফোন রেখে এগিয়ে এল। শেষ কথাটুকু তার কানে গেছে। বলল, "না না, পুলিশ ধরবে কেন? ও তো কথার কথা। কিন্তু এই বাক্স তো ঘরে রাখা যাবে না। সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে তো, নাকি?"

“গরীব মানুষ একটা মুড়ির টিন এনেচি তাই নিয়ে এত বড় কতা? আমায় পুলিশে দেবে?” চিৎকারের চোটে বুড়ির মুখ দিয়ে থুতুর ফোয়ারা ছুটছে। কুতকুতে চোখদুটো বিস্ফারিত।  

হারাধন বিডিও আর বিডিএমও-কে হাত ধরে একদিকে টেনে এনে বলল, “দাদা ফোন করেছিল স্যার। ভোটারদের হ্যারাসমেন্ট হলে… বুঝতেই পারছেন, মানুষ নিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। একটু সেটল করুন স্যার। প্লিজ।”

ভিতরের বিস্ফোরণ চেপে রেখে গম্ভীর গলায় বিডিও বললেন, “কী করতে বলছেন অনাদিবাবু?”

"বলছি স্যার, কিউ আর কোডটা ঘষে তুলে দিলে হয় না? তাহলেই তো আর হ্যাপা থাকে না।"

"কী যা-তা বলছ!” আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না বিডিও, “ইয়ার্কি নাকি? ভোটের বাক্সে মুড়ি রাখছে, সেটা জেনেও কিছু করব না? না জানলে তবু একটা কথা ছিল।"

হারাধন গলায় যথাসম্ভব বিনয় ঢালল, “আপনি রেগে যাচ্ছেন স্যার। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। ভোট কমপ্লিট, রিপোলও কমপ্লিট। রেজাল্টও বেরিয়ে গেল। আর অত ভেবে কী হবে? একটা বাক্সের হিসেব না পেলে আপনি যা করতেন, সেটাই করবেন। রিপোর্টে সেরকমই লিখে দেবেন। আর তাছাড়া এটা তো রিপোলের বাক্স না। প্রথমবারের বাক্স।”

বিডিও বিপন্ন মুখে বিডিএমও-র দিকে তাকালেন। বিডিএমও-র কপালে ভাঁজ। নিজের সতের বছরের চাকরিজীবন স্ক্যান করে এই অভূতপূর্ব সমস্যার সমাধান খুঁজছেন তিনি।

ওদিকে বুড়ি হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজের বন্যা, "মুখে রক্ত উঠে মরবি রে আবাগির পুত। মাথায় বাজ পড়ে মরবি। ভেদবমি হবে তোদের।"

বিডিও হাঁ করে চেয়ে রইলেন সেদিকে, "একটা মুড়ির টিনের জন্য কেউ এরকম সিন ক্রিয়েট করতে পারে? রিডিকুলাস!"

হারাধন বলল, “গরীব লোক স্যার। বিধবা ভাতার টাকায় চলে। আমার কথাটা শুনুন আপনি। কিউ আর কোড ঘষে দিয়ে একটু লাল রং মেরে দিই। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। জানতেও পারবে না। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেই থাকবে।"

বিডিএমও বিডিও-র হাতে মৃদু চাপ দিলেন, “মন্দ বলেনি স্যার।”

বিডিও হাঁড়ির মতো মুখ করে কয়েক মুহূর্ত গুম মেরে রইলেন। তারপর হাল-ছাড়ার ভঙ্গিতে হারাধনকে বললেন, “কিন্তু আমায় যে ফোন করেছিল সে তো জানে।”

“সেসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না,” কাঁধ ঝাঁকাল হারাধন, “নামটা বলুন। আমরা দেখে নিচ্ছি।”

বিডিও শঙ্কিত গলায় বললেন, “নাম বলেনি। শুধু খবরটাই দিয়েছে।”

একগাল হেসে হারাধন বলল, “আপনি ফোন নম্বরটা দিন তাহলেই হবে। দাদা আপনাকে খুব রেসপেক্ট করে, বলছি না? আপনার পবলেম মানে দাদার পবলেম। কিচ্ছু ভাববেন না। মিলেমিশেই তো কাজ করতে হবে আমাদের, নাকি? আমরা যদি একে-অন্যকে না দেখি, কী করে চলবে বলুন স্যার?”

“আমার ব্লকে আমি কিন্তু কোনও ঝামেলা চাই না হারাধন। কোনও হিংসাত্মক ঘটনা চাই না।”

“সেরকম কিছু হবে না স্যার। আমাদের অনেকরকম কায়দা আছে।” 

বিডিএমও বললেন, “তাহলে বুড়িকে শান্ত করো। আর বাক্সটার যা যা ব্যবস্থা করবে বললে, আমাদের চোখের সামনেই সব করবে। স্যার দেখবেন, তবে যাবেন।”  

“যে-আজ্ঞে,” বলে হারাধন গিয়ে হাত ধরে বুড়িকে দাঁড় করাল। বুড়ি কাঁইমাঁই করছিল, ধমকধামক দিয়ে তাকে থামাল। তারপর খানিকক্ষণ নিচু গলায় গুজুর গুজুর করে দুজনে যখন এদিকে এল, বুড়ির ফোকলা মুখে হাসি ঝলমল করছে। 

হারাধনের ঠোঁটেও একটা কলার-তোলা হাসি। বলল, “আমি রংটা নিয়ে আসি স্যার। আপনারা দুটো মিনিট বসুন। এই যাব আর আসব।” বলে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগাল পশ্চিমদিকের বিরাট বটগাছটার দিকে।

বিডিএমও চাটাইয়ে বসে পড়লেন। বিডিও-কে বললেন, “বসুন স্যার, কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন?”

বুড়ির পুরো ভোলবদল। খোশামুদে গলায় বলল, “হ্যাঁ বাছা, বোসো। কিছু মনে কোরো না। অনেক কুকথা বলেচি। মন থেকে বলিনি গো। আসলে পুন্যিমেয় মাজার ব্যথাটা বেড়েছে বলে মেজাজটা ঠিক থাকচে না। তার উপর কানের ভিতর পুঁজ…।”  

“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” বিডিএমও বললেন, “আমরা কিছু মনে করিনি। তবে আপনি ওই বাক্সটা কাউকে দেখাবেন না যেন। কোথা থেকে কীভাবে পেয়েছেন, বলবেন না কাউকে। কেমন?”

“পাগল! কেউ বলে! কিন্তু তোমরা বাছা পত্থমবার এলে। কিছু মুখে না দিয়ে গেলে গেরস্তের অকল্যাণ হয়। তার ওপর সরকারি আপসার। একটু কিছু খাও।”

“না না, কিছু খাব না। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।”

“আহা, কষ্ট কীসের? একগাল মুড়িই খাও নাহয়।” তোবড়ানো গালে শিশুর মতো হাসল বুড়ি, “মোটা লাল চালের, ঘরে-ভাজা মুড়ি। খেয়ে দ্যাখো। দুটো বাতাসা দিচ্ছি সাথে।"   

 

….…………………..

 

* সূত্র : “কোচবিহারে অবাক কাণ্ড! ব্যালট বাক্স কুড়িয়ে পেয়ে বানানো হল মুড়ির টিন।” - সংবাদ প্রতিদিন, ১৬ মে ২০১৮

** লেখকের কৈফিয়ত : সংবাদমাধ্যম-উক্ত ঘটনাটি বাদে বাকি সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। 

 

0 Comments

Post Comment