কাতার বিশ্বকাপে স্বপ্নের দৌড়ে এগিয়ে চলেছে মরক্কো। গতদিনই এশিয়ার মাটিতে এশিয়ার সব দেশের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়েছে কিন্তু আফ্রিকার জয়যাত্রার ধ্বজা আরও এগিয়ে নিয়ে চলল মরক্কো। মরক্কো এর আগে কখনওই বিশ্বকাপের মূলপর্বে গ্রুপের বাধা পেরোতে পারেনি কিন্তু এবার একমাত্র আফ্রিকান দেশ হিসাবে এই বিশ্বকাপের শেষ আটে পৌছে গেল তারা। এর আগে মাত্র তিনবার আফ্রিকার কোনও দেশ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে পৌছেছে। ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকী দেশ হিসাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করে রজার মিল্লার ক্যামেরুন, ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া/জাপান বিশ্বকাপে সেই লক্ষ্যে পৌছায় পাপা বউবা দিওপের সেনেগাল আর ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আফ্রিকার মাটিতে এই কৃতিত্ব অর্জন করে আসামো গিয়ানের ঘানা। সেই অর্থে কাতার ২০২২-এর মূলপর্বে খেলতে আসা এই মরক্কো দলে তারকা বলতে কেউ নেই। কিন্তু দলগত সংহতির দারুণ নিদর্শন রেখে দল ভিত্তিক ফুটবল খেলে নিজেদের স্বপ্নের দৌড় জারি রাখল মরক্কো। ইউরোপীয় ফুটবলের মহাশক্তিধর দেশ স্পেনকে এবারের মত বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পথ দেখিয়ে দিল মরক্কো। প্রথম ম্যাচে এই বিশ্বকাপে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে যে সংহারক মূর্তি দেখিয়েছিল লুইস এনরিকে-এ স্পেন, বিশ্বকাপ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন তাদের সেই ছন্দ হারিয়ে ফেলল এবং জাপানের কাছে হেরেও শেষ ষোলোয় নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করলেও মরক্কোর বিরুদ্ধে এদিন যথার্থ অর্থেই একেবারে সাধারণ সাদামাঠা ফুটবল খেলল স্পেন। সবচেয়ে আশ্চর্য স্পেনীয় অভিজ্ঞ ফুটবলাররা যেভাবে শিশুসুলভ ঢঙে টাইব্রেকারে পেনাল্টি শট নিলেন। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের খেলা গোলশূন্য থাকার পর টাইব্রেকারে নায়ক নয় রীতিমতো মহানায়ক হয়ে উঠলেন মরক্কোর গোলরক্ষক বোনো। একবারের জন্যও স্পেনের কোনও পেনাল্টি শটকেই মরক্কোর জালে জড়াতে দিলেন না। সেইসঙ্গে এটাও বলতে হবে জঘন্য পেনাল্টি শট নেওয়ার ব্যাপারে আগের দিনের জাপানি খেলোয়াড়দেরও টেক্কা দিলেন স্পেনের ফুটবলাররা।
অন্যদিকে অন্য ম্যাচে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই স্পেনের প্রতিবেশী পর্তুগাল কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য ধরণের ফুটবল উপহার দিল। পর্তুগালও শেষ ষোলোয় ওঠার পথে গ্রুপের শেষ খেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু নক আউট পর্বে যেন নতুনভাবে শুরু করল সি-আর সেভেনের দেশ। যদিও নিজেদের স্ট্র্যাটেজি বদল করে এদিন পর্তুগাল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে প্রথম একাদশের বাইরে রেখেই শুরু করেছিল বর্ষীয়ান পেপে-কে অধিনায়ক করে। এক অনবদ্য ছন্দময় পর্তুগালকে দেখা গেল সুইটজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। উল্টোদিকে বিগত ইউরো কাপে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নট আউট পর্যায়ে যে লড়াকু সুইটজারল্যান্ডকে দেখা গিয়েছিল জাকা-শাকিরিরা বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় পর্তুগালের বিরুদ্ধে তার ধারেকাছেও পৌছতে পারলেন না। যেন পর্তুগিজ হার্মাদ আক্রমণের সামনে আত্মসমর্পন করে লুন্ঠিত হয়ে গেল পর্তুগাল। সবুজ-মেরুন জার্সিতে পর্তুগালের হয়ে তিন গোল করে হ্যাটট্রিক করলেন গনসালো র্যামোস। ডান পায়ে-বাঁ পায়ে উভয় পায়েই গোল করলেন তিনি। র্যামোস আজ এক কথায় ছিলেন সত্যিই অপ্রতিরোধ্য। গোল পেলেন বর্ষীয়ান পেপেও। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুই গোল করে সুইটজারল্যান্ডকে গোলের মালা পরিয়ে দেয় পর্তুগাল। র্যামোস আর পেপের পাশাপাশি গোল স্কোরারের তালিকায় নাম তোলেন রাফায়েল গুরেরিও। দ্বিতীয়ার্ধের ৫৮ মিনিটে সুইসদের হয়ে ব্যবধান কিছুটা কমান ম্যানুয়েল আকাঞ্জি। তবে আবারও ম্যাচের ৬৭ মিনিটে নিজের তৃতীয় গোল করে হ্যাটট্রিক সম্পাদন করেন র্যামোস। খেলার একেবারে শেষের দিকে পরিবর্তিত খেলোয়াড় হিসাবে মাঠে নেমে আরও একটি গোল করে সুইসদের হাফ-ডজন গোলের মালা পরিয়ে দেন রাফায়েল লিয়াও। রোনাল্ডোও পরিবর্তিত খেলোয়াড় হিসাবে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমেছিলেন কিন্তু এত গোলের মধ্যেও বিশ্বকাপ নক-আউটে তার গোল খরা এদিনও ঘুঁচল না। তবে স্বপ্নের দৌড়ে থাকা মরক্কোর যে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পৌছে আফ্রিকার দেশ হিসাবে ইতিহাস তৈরি করা যে খুব কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে সেটা এদিন ভালোভাবেই জানান দিয়ে দিল পর্তুগাল। কারণ সেমি-ফাইনালে পৌছানোর আগে মরক্কোকে কোয়ার্টার-ফাইনালে পর্তুগিজ প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, তাই সুইটজারল্যান্ডকে ধ্বংকারী বিধ্বংসী পর্তুগালকে দেখার পর এটা উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে না যে কাতার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের বিরুদ্ধে ম্যাচই হতে চলেছে মরক্কোর চরম অগ্নিপরীক্ষা।