পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গণপ্রহার কোন সামাজিক ব্যাধি নয়

  • 30 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1744 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত গণপ্রহারের প্রবণতাকে লক্ষ্মণরেখায় আবদ্ধ করে রাখা অসম্ভব। গণপ্রহারের প্রবণতা আসলে সামাজিক বিচারধারার এক বিকৃতি। তাতে সমাজের যে অংশটা জড়িত, তারা সামাজিক প্রবণতার বাইরে নয়। ফলে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরেও তারা এরকম সংগঠিত অপকর্ম চালাবে। তাদের প্রতি শাসকশক্তির পক্ষপাতিত্ব থাকবে, এটা যখন নিশ্চিত, তখন তারা বেপরোয়াই হবে।


মহারাষ্ট্রে পালঘর জেলায় গণপ্রহারে দুই সন্ন্যাসী সহ তিনজনের মৃত্যু দেশে মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনায় মানুষের মধ্যে বেদনা বহুগুণ ভারী হয়েছে, নিন্দার প্রকাশ তীক্ষ্ণ হয়েছে। কারণ করোনাজনিত মহাবিপদের সময়ে এই ঘটনা মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। গণপ্রহারে দেশে আগেও মানুষ মারা গেছে। সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতকে সামনে রেখে ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বেশিরভাগ আক্রমণ ঘটেছে দলিত, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর। পালঘরের ঘটনায়ও ভিন্নভাবে মুসলিমদের ওপর দায় চাপাতে মতলব আঁটা হয়েছিল। সেই জাল ছিঁড়ে সত্যটা সামনে আসে। ঘটনা যেখানে ঘটেছিল সেই অঞ্চলে ছেলেধরা নিয়ে কিছুদিন ধরে গুজব চলছিল। গ্রামের মানুষ ছেলেধরা সন্দেহে ঐ তিনজনকে আক্রমণ করে। এই ঘটনা-প্রবণতায় উঠে আসছে এক গণমনোবিকারের খণ্ডচিত্র।
আমাদের দেশে মানুষের সমাজে রয়েছে এক সামাজিক বিচারধারা। সমাজের বিবেকের ভূমিকায় থাকে সমষ্টিগত নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ। সমষ্টির নিরিখে মানুষের মধ্যে সামাজিক পরিসরে সামাজিক সমস্যার নিষ্পত্তির জন্য একটা আপাত আগ্রহ থাকে। এই বাস্তবতার উর্ধ্বে কোনও কর্তৃত্ব, যেমন আইনি প্রক্রিয়া, পুলিশ প্রশাসন বা পঞ্চায়েতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি, সাধারণভাবে সমাজের এই দিকটিকে বশীভূত করে রাখে। সমাজে ভালমন্দের চর্চা কিন্তু থেমে থাকে না। অবশ্য আদালতেও সমাজের এই দিকটির প্রাথমিক স্বীকৃতি আছে। খুঁটিনাটি সমস্যায় সামাজিক স্তরে আপস-মীমাংসা আদালতে মান্যতা পায়। একথা বলতেই হবে, সামাজিক নৈতিকতা-বোধে গণপ্রহারের মতো চরম সিদ্ধান্তের জায়গা নেই। কিন্তু কায়েমী স্বার্থ বা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির পাকচক্রে পড়ে তার কিছু ব্যত্যয় ঘটে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইণ্ডিয়া-র তথ্যে দেখা যায়, ভারতে সেপ্টেম্বর,২০১৫ থেকে জুন, ২০১৯ পর্যন্ত ধর্ম-জাতপাত পরিচয়ভিত্তিক ঘৃণাজনিত গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে ৯০২টি। ২০১৯-এ জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছ’মাসেই ১৮১টি ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলি বেশিরভাগ ঘটেছে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থান ও হরিয়ানায়। হেট ক্রাইম ওয়াচ-এর তথ্য অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালে এধরনের ঘটনা কখনও এক অঙ্কের সংখ্যা ছাড়ায়নি। সমগ্রভাবে এটা স্পষ্ট, মোদি জমানায় ঘৃণাজনিত গণপ্রহারের ঘটনা বেড়েছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। গণপ্রহারের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, বিজেপি বা সংঘবাদীরা স্রেফ আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বলে ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অপরাধীরা ধরা পড়লে তাদের বাঁচাবার জন্য পুলিশ প্রশাসন থেকে ফন্দিবাজি করা হয়েছে। অপরাধীদের পক্ষে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে, গণপ্রহার-বিরোধী কেন্দ্রীয় আইনের জন্য জোরালো দাবি ওঠা সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার তা নাকচ করেছে। অর্থাৎ গণপ্রহারের ঘটনায় হিন্দুত্বের রাজনীতির বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এভাবে এক বাস্তবিক সামাজিক বিচারধারাকে ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে যথাসম্ভব দিকভ্রষ্ট করা হয়েছে।
শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-প্রশাসন দিয়ে শাসনে হিন্দুত্বের চলে না। তার সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজন। ভারতের মতো বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জনসংখ্যার দেশে সমাজ-অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি একেবারে নিষ্ফলা। সেখানে এদেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও সহিষ্ণুতার ভাবধারাপুষ্ট সমাজ-বাস্তবতার বিকৃতিসাধন রূঢ় বাস্তব।
বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত গণপ্রহারের প্রবণতাকে লক্ষ্মণরেখায় আবদ্ধ করে রাখা অসম্ভব। গণপ্রহারের প্রবণতা আসলে সামাজিক বিচারধারার এক বিকৃতি। তাতে সমাজের যে অংশটা জড়িত, তারা সামাজিক প্রবণতার বাইরে নয়। ফলে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরেও তারা এরকম সংগঠিত অপকর্ম চালাবে। তাদের প্রতি শাসকশক্তির পক্ষপাতিত্ব থাকবে, এটা যখন নিশ্চিত, তখন তারা বেপরোয়াই হবে। পালঘরের ঘটনা তারই এক খণ্ডচিত্র। পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের দশকে শ্বেতসন্ত্রাসের আবহে বেশকিছু গণপ্রহারের ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছিল, যেগুলির সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক ছিল না; কিন্তু ঘটনার খলনায়কদের শাসক রাজনীতিতে সম্পর্ক ছিল। রাজনীতির প্রভাবের বাইরে গণপ্রহারের ঘটনা ঘটে না, এমন নয়। কিন্তু তা তাৎক্ষণিক উত্তেজনার ফল ও নগণ্য। আসলে আইনের রক্ষকদের দায়িত্বহীনতার জন্য তাদের প্রতি অনাস্থার ফলে এধরনের ঘটনা ঘটে। পিছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা মদত থাকে না।
গণপ্রহার এদেশে সামাজিক বিচারধারার বিকৃতিসাধন বটে; কিন্তু সামাজিক ব্যাধি নয়। রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা সাধারণভাবে সামাজিক বিচারধারাকে সংকুচিত করে রেখেছে।। ফলে সমাজের বিচারধারা রয়েছে অসংহত অবস্থায়। এই অসংগতির ফাঁকতালে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ঢুকে পড়ছে। কিন্তু সমগ্র সমাজ তার সঙ্গে নেই। তাই নিন্দা-বিরোধের জায়গাটা অপ্রশস্ত নয়। আজ সমষ্টিগত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে গণপ্রহার বিরোধী সোচ্চার মননের সংযোগ করাটা জরুরি।

0 Comments

Post Comment