পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মায়া-মৃগাঙ্ক

  • 03 November, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 348 view(s)
  • লিখেছেন : আবু সঈদ আহমেদ
ভাবনা আসে, বদিরুলের মনে ভাবনা আসে। সারাদিনের দাপট দেখানোর ব্যস্ততা ফেলে রেখে, ফাঁক পেলে সুবলদাকে তোষামোদ করার মুহুর্তগুলো পেরিয়ে, বাড়ির নিত্য ঘ্যানঘ্যানানি সরিয়ে, লাস্যময়ীর সুকোমল মুখটিকে বুকে রেখে ভাবনা আসে।
কয়েকদিন আগের কথা
 
পুকুরধারে বসে আছে শিবে। নজর মৃগাঙ্ক রায়ের পুরনো বাড়ির দোতলায়। দিন বদলেছে, নইলে তার মতো ছিঁচকে চোর এই বাড়ির ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে পারতো না। আজকের মৃগাঙ্ক রায় দোরেদোরে হাতজোড় করে ভিক্ষা চায় ভোট। আর মৃগাঙ্কর পূর্বপুরুষ এলাকা দাপিয়ে আদায় করতেন খাজনা। মৃগাঙ্কর ঠাকুর্দা, বাবাও রাজনীতি করতেন। মৃগাঙ্কও তাঁদের মতো জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিয়ে রাজনীতি করে। তবে তাঁদের দল বদলে এখন শাসকের ঘরে এসেছে।
 
"ওসব মালের কি আর দাম হবে? তাও এত পুরানো।" শিবে প্রথম শুনে বলেছিল।
"ধ্যার গাধা! ওকি আর তোর গ্রামের হাটে বেচা হবে নাকি? এসব নিয়ে চলে যাবো কলকাতায়। ওখানে ফরেনার সাহেবের কাছে দাঁও মারবো। বুঝলি? ওরা সোনা দিয়ে এসব জিনিষ কিনে নিবে। যত পুরনো মাল তত বেশি মুনাফা।"
শিবে এসব শুনে আর কথা বাড়ায়নি। এই লোকটাকে তার সুবিধার মনে হয়না। তবুও তার হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়েছে। এখন কাজ আদায় না করে ছাড়বে না। এখন শিবের উঠতি বয়স। তার চোখে মাঝেমাঝেই ভেসে ওঠে একটা মায়াকাড়া মুখ। সত্যিই নামটা সার্থক হয়েছে ডাগর চোখের মেয়েটার। 
 
পুকুরধারে মশা কাটছে। শব্দ হবে, নড়াচড়া করলে চোখে পড়ে যাবে বলে মশাগুলোকে মারতেও পারছেনা। এদিক ওদিক ঝোপের কাঁটাও ফুটেছে। তবুও কি এসবকে পাত্তা দিলে চলে? কাজ না করেই যা পেয়েছে! কাজ করে দিয়ে যা পাবে, তাতে এসব ছোটখাটো জ্বালাকে একটু সয়ে না নিলে উপায় নেই। দোতলায় পুকুরের ধারের ঘরটায় কে এলো মনে হলো? সেখান থেকে এই জায়গাটা কিরকম দেখা যায় কে জানে? তবুও নজর রেখে যেতে হবে। ওদিকে ধরা পড়লেও চলবে না। জানলাটাও কি খুলে গেল? শিবের সব স্নায়ু টানটান হয়ে এলো। চুপিসাড়ে দেখে নিতে হবে কোথায় থাকতে পারে জিনিসটা। কিন্তু এ কি দেখলো সে?
 
এখনকার কথা
 
এরপর দিনগুলো সব এক এক করে চলে গেছে। মাঠে সভা করে বক্তব্য রাখছেন ভোটপ্রার্থী সুবল বিশ্বাস, "বলেন দাদাদিদিরা? এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? একেই তো ওই পার্টির লোকেরা মৃগাঙ্কদার মতো এরকম জনদরদী নেতাকে খুন করলো। তার ওপর কি ভেবেছে? এরকম অপবাদ দিলেই কি পার পেয়ে যাবে? একবার তাঁর দেবতূল্য চরিত্রে কালিমা লাগাচ্ছে, আবার তারপরেই বলছে চুরি করতে গেছিল। বলুন আপনারা, এসব কি মানুষ মেনে নিবে? মেনে নিতে পারবেন কি আপনারা? সামনের রবিবার ভোট দিতে যাওয়ার সময় কি একটুও ভাববেন না?"
পাশেই মায়ার পুরনো বাড়ির টালির চালার তলায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরিয়ে শুনে যাচ্ছে বদিরুল। এই বাড়ি এখন পার্টি অফিস। শিবে যখন মৃগাঙ্ক রায়ের গলায় সিঁদকাঠিই বসিয়ে দিচ্ছিল তখন অসংলগ্ন বস্ত্রে মায়ার আর্তচিৎকার আসেপাশের ঘরগুলোতেও পৌঁছে গেছিল। একের পর এক কোপ দিতে থাকা রাগে অন্ধ শিবের চোখে পড়েনি বদিরুল কিভাবে খিড়কি দরজা দিয়ে মায়াকে নিয়ে গিয়ে বদিরুল সেখানেই লুকিয়ে রেখেছিল যেখানে কিছুক্ষণ আগে শিবে নিজেই লুকিয়ে ছিল। ক্রোধের ভূত যখন তার মাথা থেকে নামতে শুরু করেছে তখন রক্তমাখা মৃগাঙ্কের দেহের পাশে মায়াকে দেখতে না পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। এরপর লোকজনের আগমনপর্ব, গণধোলাই, গ্রেফতারি পেরিয়ে এসব নিয়ে অনেক ভাবার চেষ্টা করেছে শিবে। পারেনি।
 
মায়ার মাকে লতাপিসি বলেই ডাকতো বদিরুল। বাবার মতোই মায়ার দাদাও অন্য শহরে কাজ করতো। ঘটনা জানাজানি হতে শুরু করলে কি ঘটবে এই আশঙ্কায় ওদেরকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিতেও পেরেছিল। তারপর অনেক বলেকয়ে কলকাতার সুবলদার হোটেলে ওদের সবারই কাজের ব্যবস্থাও করতে পেরেছিল। অন্যদিকে মায়াদের বাড়িটাও সুবলদার দখলে এসে পার্টি অফিস হয়ে গেছে। পার্টিও খুব খুশি। মায়াদের জন্য এত কিছু করতে হওয়ায় প্রথমে রাগ করলেও সুবলদাও শেষে বুঝেছে, খুনের মোকদ্দমায় অনেক কথা উঠে আসার যে হ্যাপা তার বদলে এটাই ভালো হয়েছে। মায়ার পরিবারও এরপর থেকে কেনা গোলামই হয় গেছে প্রায়। সহজ ও সস্তা শ্রম তো প্রত্যেক পুঁজিপতিরই কাম্য।
 
বদিরুলই তো সুবলদার কথায় শিবেকে বলেছিল মৃগাঙ্ক রায়ের পৈতৃক বাড়িতে একটা দুর্মূল্য দেওয়াল ঘড়ি আছে, চোরাবাজারে যার অনেক দাম। আর তা দেওয়ালে ঝোলানো আছে পুকুরের ধারের দোতলার ঘরে। তাই শিবে পুকুরধারের ঝোপগুলোতে লুকিয়ে খোঁজ নিতে গেছিল এই বাড়িতে কখন কে আসে যায়, কোথায় কি করে।
 
আর মায়ার সাথে সুবলদার বিরোধী গোষ্ঠীর মৃগাঙ্কর কি চলছে সেটাও তো বদিরুলেরই আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের কথা প্রথমেই সুবলদাকেই জানিয়েছিল বদিরুল। ভেবেছিল সুবলদার মতো ঘোড়েল লোক এই কেচ্ছার সুযোগ ছাড়বে না। আর আজকালকার সোসাল মিডিয়ার জামানায় যে কেচ্ছা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেবেনা। আর গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে এসব এসব গুজব একবার উঠলে তো কথাই নেই। কিন্তু সাত ঘাটের জল খাওয়া সুবলদা আর তো তার মতো সীমিতবুদ্ধির মানুষ নয়। সে অন্য ছক আঁটে। মায়ায় আসক্ত শিবেকে মৃগাঙ্কর বাড়িতে ছিঁচকে চুরির মতলব দেয় বদিরুলের মাধ্যমে। তারপর মায়াকে মৃগাঙ্কের সাথে দেখে শিবে যে কি করবে তাও সহজেই কল্পনা করে নিয়েছিল সুবলদা।
 
কিন্তু সুবলদা তো অত সহজ মানুষ নয়। প্রয়োজন পড়লে সে সামান্য প্রমাণও রাখবে না।
তাই ভাবনা আসে, বদিরুলের মনে ভাবনা আসে। তার জীবনটাও শেষ যাবে কিনা, যেভাবে শিবে-শিবের বিধবা মা, লতাপিসিদের জীবন শেষ হয়ে গেছে। যেভাবে শেষ হয়ে গেছে মায়া-মৃগাঙ্কর জীবন।
 
 
 
 
   
0 Comments

Post Comment