সুপুকে মুখোশ দেখতে বললাম। অন্ধকার অন্ধকার ঘরে মুখোশ তৈরি হচ্ছিল। নানান মুখ টুকরো টুকরো করে সারা ঘরময় ছড়ানো। সুপু বলল,“ আরিব্বাস।”
—— তুই তো আগেও মুখোশ দেখেছিস।
—— হ্যাঁ।
—— তবে আশ্চর্য হচ্ছিস কেন?
—— আশ্চর্য , কই না তো।
—— তা হলে?
—— আমি মুখোশ তৈরি করা দেখে বললাম — আরিব্বাস।
একটু আগে আমরা দোসা খেয়েছি। বেশ নরম। উল্টো দিকে দেখলাম নতুন পার্টি অফিস খোলা হয়েছে। কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকটা মটোর বাইক। মটোর বাইকের ওপর একজন বসে ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ আপনি কোন পার্টি করেন।” লোকটা কোন উত্তর দিল না।
আসপাশের লোকজনও পাত্তা দিচ্ছে না দেখে আমি রাস্তার উল্টো দিকে রেষ্টুরেন্টে আবার চলে এলাম। সেখানে আমরা ভালো দোসা খেয়েছি আর চা- সেটাও ভালো ছিল। এর কিছু পরেই চড়িদা সেখানে মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে। পিলু বলল,“ বাঘমুণ্ডিতেই কি শুধু মুখোশ তৈরি করা হয়?অন্য কোথাও হয় না?”আমি বলেছি,“ নানা তা হবে কেন? মুখোশ তো নানা জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে তবে এতো ছৌয়ের মুখোশ, বাঘমুণ্ডিতেই বেশি হয়— চড়িদায় বেশি হয়।” খাবার খেয়ে আমরা চড়িদার দিকে রওনা দিলাম। আমরা গাড়ি করে এসেছি। গাড়ির রঙটা মেটে স্বর্ণাভ, এ এক এমন রঙ যা দিনের নানা সময় দেখতে আলাদা আলাদা লাগে। এখন সকাল , চারদিক ঝকঝক করছে তাই গাড়িও ঝকঝক করতে লাগল সেই দেখে নতুন পার্টি অফিসের সামনে থাকা লোকজন সবাই আমাদের দিকে তাকাল। তারা কি ঝকঝকে রঙ দেখছিল - গাড়ির?
চড়িদার প্রথম দোকানে সুপু আর পিলুকে রেখে আমি অন্য দোকানগুলো দেখলাম। প্রায় কোন দোকানেই সাইন বোর্ড নেই। ফলে বোঝা যায় না এ গুলো ঘর না দোকান। সে জন্য আমি জিজ্ঞেস করেছি,“ আপনাদের এ গুলো ঘর না দোকান?” একজন মুখোশ তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল, সে কিছু বলল না আর একজন মুখোশগুলো পরপর সাজিয়ে সোজা করে বা উল্টো করে পরপর রাখছিল রোদে কারণ রঙ শুখোতে হবে - সে বলল,“ সে একরকম বলতে পারেন আরকি।”
—— হ্যাঁ কিন্তু বলবটা কী?
—— সে ঘরও বলতে পারেন আবার দোকানও একরকম বলতে পারেন।
—— দোকান যদি হবে তবে দোকানের মতো নয় কেন?
—— দোকানও বলতে পারেন।
—— দোকানের মতো না হলে দোকান বলে বুঝব কী করে?
—— তা বলতে পারব না।
একটার পর একটা দোকান ঘুরে বেড়ালাম একাই। প্রায় প্রতিটা দোকানই দোকান বলে মনে না হওয়ায় ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। ছেলেপিলেরাও মুখোশের কাজ করছে - ছৌয়ের মুখোশ। চড়িদার বুক চিরে পিচের রাস্তা চলেছে। পিচের রাস্তার আসপাশে কি গ্রাম আছে? কিন্তু সে গ্রামে ঢোকার রাস্তা খুঁজে পেলাম না। শুধুই রাস্তার ধারে বাড়ি আর বাড়ির ভেতরটা বাইরে এসে দোকানের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেখানে সবাই মুখোশ তৈরি করে। একটা ছেলে ডান হাত দিয়ে লম্বা শিক ধরে আছে। সে ধরার জায়গাটা কাপড় দিয়ে মুড়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে শিকটা গরম। সে গরম দিয়ে দিয়ে চোখ তৈরি করছিল- অদ্ভূত মুখোশের। সেই ছৌয়ের মুখোশটা বীভৎস একটা মুখ। বীভৎস আর অদ্ভূত। মুখোশেটায় চোখের জায়গাটা আঁকার পর একটা গর্ত করতে হয় আর ছ্যাঁতততত ছ্যাঁতততত আওয়াজ করে চোখ তৈরি করা চলতে থাকে। চোখের ওপারে সব দেখা যায় কারণ গরম শিক ঢুকিয়েছে। সেখানে বীভৎস চোখ দেখা গেল কারণ তাতে গর্ত করা হল এই এক্ষুণি। পাশ দিয়ে বাইকের আওয়াজ আসছিল অনেকক্ষণ। রাস্তার ওপারে বাইক চলাচল করে, গাড়ি চলাচল করতে থাকে। চড়িদার মুখোশ তৈরির গ্রামের তাতে কিছু এসে যায় না। সে মুখোশ বানাতে থাকে। কখনও কখনও তাতে ছ্যাঁদা করে চোখ বানাতে গরম শিক ঢুকিয়ে দিতে হয়। তখন ওপাশে সব দেখা যায় আর দেখা যাবে রাস্তার পাশে নানা অলিতে গলিতে সবকটা বাড়িতেই মুখোশ তৈরি হচ্ছে। যে ছেলেটা মুখোশের চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করে ঘোরাচ্ছে সে বেশ লম্বা, বয়স বেশি নয় ফলত আরো লম্বা হবে এটা ধরেই নেওয়া যায়। এ ডান হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে দেখে বলি,“ তুমি বাঁ হাত দিয়েও শিক ঘোরাতে পার।”
—— পারি।
—— দু হাতেই?
—— শিক গরম হয়। এমনিই ফুটো হয়ে যায়। শুধু ছেঁদা হওয়া কাগজের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয়। তাহলেই পরিষ্কার।
এই বলে ছেলেটা মুখোশের আর একটা চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে দিল ছ্যাঁতততত ছ্যাঁতততত। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ তোমরা কি ঠাকুরের চোখেও শিক ঢুকিয়ে দাও?” ছেলেটা আর উত্তর করে নি।
সেই থেকে আমি খুঁজতে লাগলাম কোন কোন মুখোশে চোখের জায়গাটা গর্ত করা আর কোনটায় নেই। দেখেছি কার্তিক, দুর্গা, গণেশ , লক্ষী , সরস্বতী সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিন্তু কারও চোখে গর্ত নেই ফলে সবাই কেবল তাকাতে পারছে কিন্তু দেখতে পারছে কি? চোখ ফুটো করা মুখোশ পরে যখন নাচ হবে কেবল বীভৎস মুখেরা আমাদের দেখবে? এ সময় দেখলাম বড় বড় কথাকলির মুখোশও বানানো হয়েছে। সেগুলো দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে সেলোফেন কাগজ দিয়ে মুড়ে। চড়িদা গ্রামটিতে কথাকলির মুখোশ পাওয়ার কথা নয় তবু তা দেখে সুপুকে আর পুলুকে ডাকতে চললাম গিয়ে দেখি ওরা অনেকগুলো মুখোশ কিনেছে। সবই ছোট ছোট মুখোশ । সে গুলোর চোখে গর্ত নেই দেখে সুপুকে বললাম,“ গর্ত নেই কেন?”
—— কোথায় ?
—— মুখোশে।
—— গর্ত থাকবে কেন?
—— না থাকলে নাচ হবে কী করে?
—— মানে?
—— মুখোশ আমরা দেখব কিন্তু মুখোশ আমাদের দেখবে কি?
পুলুকে বললাম,“ চল কথাকলির মুখোশ দেখাই চল।” সুপু বলল,“ এখানে কথাকলি!” আমি বললাম,“ সব আছে।” কথাকলির মুখোশ দেখে সুপু বলেছে,“ আরিব্বাস।”
—— আশ্চর্য হচ্ছিস কেন?
—— আশ্চর্য হয়নি তো। এখানে কথাকলির মুখোশ দেখে, চড়িদায় কথাকলির মুখোশ দেখে বললাম আরিব্বাস।”
সুপুকে বললাম,“ কিন্তু চোখের জায়গায় গর্ত আছে কি মুখোশের?”
—— কোনটার?
—— কথাকলির।
সুপু মন দিয়ে কথাকলির মুখোশ দেখতে লাগল। কী জানি কিনেও ফেলতে পারে। অনেকগুলো মুখোশ কিনেছে। কথাকলির মুখোশগুলো খুব বড় বড় গাড়িতে ধরবে কি?এই সব ভাবছি , দেখি পুলু সিগারেট ধরিয়েছে সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে রাস্তায় অনেকগুলো বাইককে আসতে দেখা যাচ্ছে। বাইকের সামনে সামনে পতাকার রঙ পতপত করে উড়ছে। তবে আমার পতাকার রঙ চোখে পড়ল না। বাইক আরোহীদের মুখ দেখতে লাগলাম , সেখানে মুখোশ দেখতে লাগলাম, মুখোশে চোখের গর্ত দেখতে লাগলাম- খুঁজতে লাগলাম। শুনি পুলু এসে দাঁড়িয়েছে পাশে,সুপুও। না, কথাকলির মুখোশটা কেনেনি।
প্রজাতন্ত্র দিবসের দীর্ঘ বাইক মিছিল দেখে আমরা সবাই থমকে ছিলাম অনেকক্ষণ আর সুপু বলেছিল,“ আরিব্বাস।”
—— আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? কথাকলির মুখোশটা দেখলি?
—— কথাকলি নয়, কথাকলি নয় এত বড় বাইক মিছিলটা দেখে বললাম — আরিব্বাস।