ওঁ দংশপালঃ মহাবীরঃ সুচিত্রঃ কর্মকারকঃ।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃকতঞ্চ বাসনামানো দণ্ডধৃক।।
ওঁ বিশ্বকর্মণে নমঃ।
ঋগ্বেদে আছে, বিশ্বকর্মা হলেন ঋত বা কসমিক অর্ডারের প্রতিরূপ এবং তিনিই সৃষ্টির দেবতা। তিনি অতিবর্তী সময়ে আদর্শ এবং সাধারণ সময়ে বাস্তব। সময়ের শুরুর অবস্থা থেকেই তিনি অস্তিত্ববান, স্থপতি এবং ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য স্রষ্টা। রামায়ণ হল এ দেশের প্রথম মহাকাব্য কিন্তু গৌণ, তুলনায় মহাভারত মুখ্য। রামায়ণে দেখা যায়, বিশ্বকর্মা দুটি ধনুকের নির্মাতা। একটি ত্রিপুরাসুর বধের জন্য শিবকে বা প্রযতিকে দেন আর অন্যটি প্রদান করেন বিষ্ণু, দ্য ক্যাপিটালিস্টকে। বিষ্ণু ধনুকটি দেন চিরজীবী পরশুরামকে। রাম শিবের ধনুকটি ভঙ্গ করেন। শিবের ধনুক গেল। রয়ে গেল বিষ্ণুর ধনুক। রাম স্বয়ং বিষ্ণু। বিশ্বকর্মার পুত্র বিশ্বরূপকে ইন্দ্র বধ করেছিলেন। এই বিষ্ণুকে দু ভাবে দেখা যায়। সে প্রসঙ্গে অন্য সময় যাওয়া যায়। মোদ্দা কথা হল, বিশ্বকর্মা হলেন কারিগর। পুঁজির বাজার সেই বিশ্বকর্মাকে আদি থেকেই ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর।
কৃষকরা কারিগরের তালিকায় আছেন। কারণ কৃষি মূলত তন্ত্রভিত্তিক। সেখানে স্বধা ও প্রযতি মূল কারিগর। এই কৃষকরা এখন জমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়, চাকর বা ভৃত্যের পেশা তাঁদের কাছে অধিকতর লোভনীয়। নতুন আইন এনে কৃষকদের বার বার চ্যুত করার চেষ্টা হয়। সেখানে বৈশ্যরা আসে গ্রাস কাড়তে, সঙ্গে সঙ্গত দেয় ক্ষত্রিয় তথা রাজপুরুষেরা। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে এবং আজও যে পরস্পরের নির্ভরশীল, সমাজ পরিচয়মূলক ব্যবস্থা চলে আসছে, সেটা মিথ্যে হয়ে যায় না । এই ব্যবস্থা ভাঙতে রাষ্ট্র এবং কর্পোরেটকে সম্পদ বুদ্ধি ব্যয় করতে হচ্ছে,, নোট বাতিল আর জিএসটি এবং করোনাকাল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আজও বিস্তৃত এই বাজারখানি কর্পোরেটদের হাতে নেই।, চাষে গত সাত দশক ধরে কর্পোরেটরা প্রবেশ করা সত্ত্বেও। এখানেই বোঝা যায়, বিশ্বকর্মারা চিরজীবী। তাই আজও চাষীরা বিশ্বকর্মা পূজার দিন লাঙল বা ট্রাকটর কিংবা কাস্তে অথবা আধুনিক কালের ফসল কাটার যন্ত্র, ঝাড়াই করার যন্ত্রকে বিশ্বকর্মার হাতিয়ার বলে পূজা দেয়। বেদে তিনি মুখ্যতঃ বিশ্বস্রষ্টা , তাঁকে দেখা হয় দেবশিল্পী হিসাবে। কোনো পুরাণ মতে তাঁর জন্ম অষ্টবসুর অন্যতম প্রভাসের ঔরসে দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনীর গর্ভে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান মতে প্রজাপতি ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার উৎপত্তি বলে লেখা আছে। তিনি "কর্তা শিল্প সহস্রাণাম" অর্থাৎ তিনি সহস্র শিল্পের অধিকর্তা। তিনি "দেবানাং কার্য্যসাধকঃ" অর্থাৎ দেবতাদের শিল্পের কার্য্য সাধক। বিশ্বকর্মার জন্ম বিষয়ে পুরানে নানা আখ্যানের অবতারনা করা হয়। বিশ্বকর্মার হস্তে দাঁড়িপাল্লা থাকে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক।
মহাভারত অনুসারে, কারিগর বিশ্বকর্মা হলের শিল্পকলার দেবতা। তিনি কর্মী, তাই তাঁর চার বাহু, মাথায় রাজার মুকুট কারণ সেইই হলেন আসল নরপতি।, হাতে জলের কলস,, বই,, দড়ির ফাঁস আর অন্য হস্তে যন্ত্র। তিনি একাধারে মহাবীর ও দয়াদি অষ্টগুণ যুক্ত । তিনি সৃষ্টির নির্মাতা ও ধাতা। তিনি মান ও দণ্ডধারী মহাশিল্পী। আবার তিনিই মহাযোদ্ধা।
এই দণ্ড কী? দণ্ড হল যা ধারণ করে, দণ্ড সকল ক্ষমতার উৎস। এখান থেকেই আসে দণ্ডনীতি বা রাজনীতি। শাস্ত্রে সাধারণত চার বিদ্যার কথা শাস্ত্রে পাওয়া যায় – আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি। আন্বীক্ষিকী হলো যুক্তিবিজ্ঞান। ত্রয়ী হল তিন বেদ, বার্তা হলো অর্থনীতি, এবং দণ্ডনীতি হলো রাজনীতি। আচার্য মনু যুক্তিবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্রভাবে মানেননি। তিনি তিন বিদ্যার সমর্থক – ত্রয়ী, বার্তা, ও দণ্ডনীতি। যুক্তিবিজ্ঞানের বিষয়টি তাঁর মতে এই ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কিনা বেদের যুক্তি তাঁর কাছে শিরোধার্য।
কিন্তু বেদ তো শব্দ-প্রমাণ। তাঁকে বহু ক্ষেত্রে নির্বিচারে মেনে নিতে হয়। যুক্তিবিজ্ঞান নির্বিচারবাদের ঘোর বিরোধী। দেবতাদের গুরু আচার্য বৃহস্পতি আন্বীক্ষিকী ও ত্রয়ী, দুটিকেই মানেননি। দেবগুরু বার্তা ও দণ্ডনীতি, এই দুই বিদ্যা মেনেছেন। তাঁর অভিমত, অর্থনীতি ও রাজধর্ম জানলে যুক্তিবিজ্ঞান বা তিন বেদকে পৃথক বিদ্যা মানা নিষ্প্রয়োজন। এই দুই বিদ্যা – অর্থনীতি ও রাজনীতি সব কিছুর নিয়ামক।
দণ্ডনীতি বা রাজনীতি নিয়ে নীতিশাস্ত্রের কথা চলতে থাকুক। কেননা বিশ্বকর্মা নৈতিক নিয়মের পুরোধা, তিনিই ঋত বা কসমিক অর্ডার। তিনিই কালের ঘুড়ি।